Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যালিগ্রাফি: শব্দ আঁকার শিল্প

প্রস্তর যুগে গুহার দেয়ালে আঁকাআাঁকির নজির কম নেই। লেখাগুলোর অর্থ আমাদের কাছে দুর্বোধ্য হলেও অনেক পণ্ডিত মনে করেন, এগুলো কোনো অতীন্দ্রিয় গোপন তাৎপর্য বহন করে। মিশরীয়রা হায়ারোগ্লিফিক ব্যবহার করত ছয় হাজার বছর আগে। অক্ষরগুলো ছবির মতো। যেন লেখার অর্থের চেয়ে সুন্দর করার দিকে মনোযোগ ছিল বেশি। খুব সংক্ষেপে ক্যালিগ্রাফির মূল সুর এখানেই। 

কী নাম দেয়া যায়? বর্ণ নাকি ছবি? © theartist.me

পাশের বাসায় বিয়ে। দাওয়াত কার্ড ছাপা হল। বর্ণগুলোকে পেঁচিয়ে অন্যরকম সৌন্দর্য দেয়া হয়েছে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া হয় সনদ। অক্ষরকে সাজিয়ে লেখার জন্য তোড়জোড় সেখানেও কম না। মসজিদের মতো ধর্মীয় স্থাপনা এবং সমাধি ফলকে লিখে রাখা বাণীতেও কাছাকাছি অবস্থা। ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ধর্মগ্রন্থের প্রিয় কথা, ভ্রমণ থেকে আনা শিলালিপি, সরকারি জন্ম ও মৃত্যু সনদ কিংবা আধুনিক যুগের গ্রাফিক ডিজাইন- কোথায় নেই ক্যালিগ্রাফি? একটা কিছু লিখবে, কে না চায় লেখাটা সুন্দর হোক?   

ক্যালিগ্রাফি 

Calligraphy শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ kallos এবং graphein সহযোগে গঠিত। এদের অর্থ যথাক্রমে সুন্দর এবং লেখা। ক্যালিগ্রাফি বলতে প্রথমত বোঝায় হাতের লেখা সুন্দর করার শিল্প। বর্ণের এমন নিয়মানুগ ব্যবহার এবং আনুপাতিক বিন্যাস, যা দেখার পর সমঝদার ব্যক্তি মাত্রই আখ্যা দেবে রুচিশীল শিল্প বলে। কখনো কখনো হয়তো দেখে ঠিক ঠাহর করা যাবে না বর্ণের আকৃতি ও অবস্থান। কখনো বা পড়তে কষ্ট হবে বেশ। কিন্তু তার একটা সহজাত দৃষ্টিনান্দনিকতা থাকবে।

পড়ে বুঝতে কষ্ট হলে ক্ষতি পুষিয়ে দেবে সৌন্দর্য্য ©  storyblocks.com

এসেরীয় কিংবা ব্যাবিলনীয় কিউনিফর্ম এবং পরবর্তীতে ফিনিশীয়দের বর্ণমালা সভ্যতার স্রোতে নয়া গতি দেয়। গ্রিক-রোমানরা মূলত তাদের থেকেই গ্রহণ করে। সেখানে চার্চের অধীনে একটি শ্রেণীই ছিল, যাদের কাজ বাইবেল সংরক্ষণের নিমিত্তে অনুলিপি করা। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ক্যালিগ্রাফি এভাবেই শিল্পের রূপ লাভ করে। একই কথা প্রযোজ্য ইহুদিদের হিব্রুগ্রন্থ, ভারতে সংস্কৃত সাহিত্য কিংবা অন্যান্য সংস্কৃতিতে ক্যালিগ্রাফির উত্থানের পেছনে। যদিও আধুনিক সময় অব্দি কেবল মুসলিম দেশগুলো, চীন ও জাপান ক্যালিগ্রাফির চর্চাকারী বলে দাবি করতে পারে। কিন্তু এর পেছনে আছে বিস্তীর্ণ ইতিহাস। জড়িয়ে আছে ধর্ম, রাজনীতি এবং সামাজিক অবস্থা।

প্রাচীন সেমেটিক তোড়জোড়

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ অব্দের দিকে ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরের মানুষ প্রথম বর্ণমালার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। বিক্ষিপ্ত চিহ্নের মাধ্যমে অর্থবোধ্য লিখনপদ্ধতি। ইতিহাস তাদের ফিনিশীয় নামে সমধিক চেনে।

ভাষা যাত্রা শুরু করলো লিখিতভাবে © shutterstock.com

বর্ণমালা লেখার অগ্রগতিতে তাদের মতো হিব্রু ও আরমায়ীদের অবদানও কম না। ল্যুভর মিউজিয়ামে রক্ষিত মোয়াবাইট পাথর নামে পরিচিত ৮৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি প্রাচীন সেমেটিক শিলালিপি এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে।

ইহুদিদের মধ্যে লেখার তাড়না আসে মূলত ৫৮৬ থেকে ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত ব্যাবিলনে নির্বাসিত সময়কালে। ব্যাবিলনের সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার জেরুজালেম আক্রমণ থেকে পারসিক সম্রাট সাইরাসের অভিযান পর্যন্ত। সেসময় হিব্রু আধিপত্যকারী ভাষা হলেও নির্বাসন পরবর্তীতে আরামাইক প্রধান হয়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে আরামাইক ভাষার লিখিত নথি পাওয়া যায়। 

হিব্রু ক্যালিগ্রাফি ছিল অন্যমাত্রার © vectorstock.com

হিব্রুর ঐতিহ্যগত প্রকরণ মেরুব্বার অগ্রগতি ঘটেছিল যিশু খ্রিস্টের জন্মের কয়েক শতক আগে। ১৯৪৭ সালে আবিস্কৃত ডেড সি স্ক্রলে এর নজির দেখা যায়। ডেড সির উত্তর পশ্চিম উপকূলে সংগঠিত কতিপয় ইহুদি দ্বারা স্ক্রলটির জন্ম। সেটাও অবশ্য ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। লেখার জন্য সেখানে কলম ব্যবহার করা হতো। লেখার ধরণ ছিল নান্দনিক। খ্রিস্টের জন্মের প্রথম ৫০০ বছর উল্লেখযোগ্য হিব্রু পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। যা অগ্রগতি ঘটেছে, তার বেশিরভাগ ১০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। হাতের লেখার ধরনে প্রাচীন সেফারদিক লিপির আগমন ৬০০ থেকে ১২০০ সালের মাঝামাঝি। ধ্রুপদী সেফারদিক এসেছে আরো পরে। হিব্রু লেখায় আশকেনাযিক লিপিতে ফরাসি ও জার্মান প্রভাব দেখা যায়, যেগুলো মধ্যযুগে বিকাশ লাভ করেছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অনেক ভাষার জন্মই আরামায়িক থেকে। কানানাইট-ফিনিশীয় প্রভাব গিয়েছে পশ্চিমে। আর আরামায়িক ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীর থেকে প্রভাব ফেলেছে পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তরে। কোনো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়েও এই ভাষা আন্তর্জাতিকতায় ওঠার প্রধান কারণ সেই সময়ের ব্যবসায়ী ও পর্যটকেরা।

আরামায়িক অনেকটা আন্তর্জাতিকতা পেয়েছিল © deviantart.com

আরামাইক ভাষা থেকে উৎসারিত সিরীয় ভাষা উত্তর ও পশ্চিম ফিলিস্তিনের বিশাল অঞ্চলে ব্যবহৃত হলেও লেখালেখি পাকা আসন পায় এডেসাকে কেন্দ্র করে। চতুর্থ থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত। ৪৩১ সালের পর সিরীয় ভাষার পাণ্ডুলিপিগুলো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শাখায় বিভাজিত হয়ে পড়ে ধর্মীয় দল-উপদলের প্রভাবে। সেরতা নামে পরিচিত পাশ্চাত্য অংশ জেকোবাইট ও মেলকাইট নামে দুটি ভাগে এগিয়ে যায়। সেরতা লেখা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিবর্তিত হয়ে বর্তমানে সিরীয় রূপে টিকে আছে। পাণ্ডুলিপির প্রাচ্য অংশ নেস্টোরিয়াসের পর নেস্টোরিয়ান নাম নিয়ে বিকাশ লাভ করেছে পারস্যে।  

আরব ক্যালিগ্রাফি

নিঃসন্দেহে আরবরা ক্যালিগ্রাফিকে সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে গেছে। মুসলিমরা ৭ম ও ৮ম শতকে আটলান্টিক উপকূল হতে সিন্ধু নদ পর্যন্ত অধিকার করে। আস্তে আস্তে আরবি ভাষা ব্যাপকতা লাভ করে। যেভাবে ইউরোপে ল্যাটিন আধিপত্য পেয়েছিল। বিভিন্ন ভাষার সাথে মিশে এবং ডান থেকে বামে লেখার মতো কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য আরবি ভাষা নান্দনিকতা পেয়েছে। প্রাত্যহিক প্রয়োজনে পরিচিত টানা পদ্ধতির (Cursive) পাণ্ডুলিপি। অন্যদিকে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার হত কুফি লিপি। ইরাকের কুফায় স্থাপিত শহর কুফার নাম থেকে এই নামের উদ্ভব। এই লিপিতে সংকলনের পুরাতন কোরআন এখনো বিদ্যমান। লেখা প্রায়শ বড়। কখনো কখনো পৃষ্ঠায় মাত্র তিনটি লাইন লেখা যেতে পারে। 

ক্যালিগ্রাফি চরমে পৌঁছেছে আরবদের হাতে © saatchiart.com

দশম শতকের দিকে নাসখী লিপি নামে নতুন এক পদ্ধতি সামনে আসে। আরব বিশ্বে সবথেকে জনপ্রিয় এই লিপির অগ্রগতির সাথে দুজন ইরাকীর নাম জড়িত। ইবনে মুকলাহ এবং ইবনে আল বাওয়াব। ডাবলিনে চেস্টার বেটি লাইব্রেরিতে রক্ষিত কোরআনের পাণ্ডুলিপি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। স্পেনে উদ্ভব ঘটে মাগরিবি লিপির। উত্তর আফ্রিকায় কোরানের পাণ্ডুলিপিতে এ লিপির ব্যবহার ছিল একচেটিয়া। মূলত কুফি লিপি থেকেই কিছুটা বিবর্তিত হয়ে এর আবির্ভাব। 

আয়াতুল কুরসিও হয়ে উঠেছে শিল্প © barraques.cat

পারস্য এবং তুর্কিও ক্যালিগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। উভয়ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাব লক্ষ্যণীয়। ত্রয়োদশ শতকের দিকে ইরানে তা‘লিক লিপির আবির্ভাব ঘটে। এই রীতিতে প্রত্যেকটি শব্দ তার পূর্ববর্তী শব্দ থেকে নিচে সরে আসে। বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার মীর আলি তাবরিজী নাসখী এবং তালিক লিপির মিশেল ঘটিয়ে নতুন এক লিপির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। নাস্তালিক নামের এই লিপি ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছে ফারসি সাহিত্যে। দিওয়ানী নামে এক ধরনের লিপি অটোম্যান দফতরে দেখা যেত। বর্ণমালা ছিল বিশেষভাবে সজ্জিত, মাঝে মাঝে পড়তে বেগ পেতে হত। সিংহাসনে আসীন সুলতানের নাম আকর্ষণীয় ও মুগ্ধকর সংকেতের মতো করে লেখার একটা রীতির সাথেও পরিচিত ছিল অটোম্যানরা। একে বলা হতো তুঘরা।

 ‍সুলতান সুলােইমানের তুঘরা © islamic-art.org

প্রত্যেক সুলতানের জন্য পৃথক তুঘরা, এবং তা অঙ্কনের জন্য থাকতো অভিজ্ঞ নিশানি (ক্যালিগ্রাফার)। সোজা কথায় বললে, মুসলিম বিশ্বে ক্যালিগ্রাফি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে এসেছে। আরবি ভাষার লেখাকে দান করেছে বৈচিত্র্য।

চীন এবং জাপানের হাল-হকিকত 

চার হাজার বছর আগে ছাঙ চিয়েহ নামের জনৈক ঋষি। অবসরে বালিতে পাখির পায়ের ছাপ দেখতেন আর তাদের মধ্যকার প্যাটার্ন খুঁজে বের করতেন। এই সাঙ চিয়েহকে মনে করা হয় চীনা লেখার উদ্ভাবক। বর্ণমালা না, চিত্র হিসাবে জন্ম লাভ করেছে এই ভাষা। প্রথমদিকে তাই বাক্য না, খণ্ড খণ্ড ভাব প্রকাশ পেত। শাঙ আমলে (১৭৬৬-১১২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) এবং তৎপরবর্তী চৌ আমলে (১১২২-২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) লেখারীতির অগ্রগতি ঘটে। ২২১ খ্রিস্টপূর্বে চিন সাম্রাজ্যের উত্থানের সাথে সাথে ভাষা লেখাকে সহজীকরণ করা হয়। চীনের বাক্যাংশগুলো প্রথম দিকেই অভিযোজিত করে নেয়া হয় জাপানে। জাপানের প্রথমদিককার কবিতাগুলো চীনা ভাষার সাথে একীভূত। পরে জাপানীরা তাদের ভাষাকে সংক্ষিপ্ত, সহজ, উচ্চারণযোগ্য এক সিলেবল বিশিষ্ট্য ভাষায় রূপান্তরিত করে। আর চীনারা এগিয়ে যায় বহু সিলেবল বিশিষ্ট্য কথ্য ভাষার দিকে। ক্যালিগ্রাফির উদ্ভবও অনেকটা এভাবেই বৈচিত্র্য পেয়েছে। 

চীনা ক্যালিগ্রাফিতে তুলে আনা হয়েছে প্রকৃতিকেও © noconmisimpuestos.info

চীনে তাং আমলে (৬১৮-৯০৭) সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের জন্য হাতের লেখা সুন্দর করাকে প্রাধান্য দেয়া হত। সরকারি অধ্যাদেশ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে নাগরিককে। চীনা ভাষার প্রখ্যাত দুজন ক্যালিগ্রাফার ওয়াঙ শি চি এবং তার পুত্র ওয়াঙ শিয়াঙ চি। চতুর্থ শতকের এই দুই পণ্ডিতের লিপি অনুকরণ করেছে পরবর্তী ক্যালিগ্রাফাররা। চীনা অক্ষর জাপানে কানজি নামে পরিচিত। জাপানে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ তাদের লেখার উপর অবদান রাখে। জেন বৌদ্ধরা লেখার জন্য যে রীতি অনুসরণ করত, তা পরিচিত বকুসেকি নামে। হিরাগানা নামে নিজস্ব লিপিরও বিস্তার ঘটতে থাকে দ্রুত। বর্তমান সময়েও জাপানে ক্যালিগ্রাফির কদর ঢের ভালো। 

জাপানে ক্যালিগ্রাফির কদর তুলনামূলকভাবে ভাল © theartofcalligraphy.com

ভারতীয় ক্যালিগ্রাফি

ভারতীয় পাণ্ডুলিপি বিশেষত সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি ক্যালিগ্রাফির গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে সামনে আসতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে অশোকের রাজত্বকালে (২৬৫- ২৩৮ খ্রি.পূ,) প্রথম লেখা পাওয়া যায়। অশোক সামরিক নেতা থেকে শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছেন। তাকে অনুসরণ করেই সামনে এসেছে দুটি বিখ্যাত লিপি- খরোষ্ঠি লিপি ও ব্রাহ্মী লিপি। খরোষ্ঠী লিপি ব্যবহৃত হত উত্তর পশ্চিম ভারত এবং পরবর্তী দিকে মধ্য এশিয়ায়। অন্যদিকে ভারতে বর্তমানে প্রচলিত বহু ভাষার জন্ম ঘটেছে আদি ব্রাহ্মলিপি থেকে। লেখার জন্য ভেজা মাটি কিংবা তালের পাতা ব্যবহৃত হত। সংস্কৃত ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত লিপি দেবনাগরী। বাঁ থেকে ডানে এগিয়ে যাওয়া এই লিপি সংস্কৃত, হিন্দী, বিহারি, কাশ্মিরী ও উত্তর ভারতীয় ভাষাতে ব্যবহৃত হয়। 

ভারতীয় উড়িষ্যা ক্যালিগ্রাফি © wikipedia

ইউরোপীয় ক্যালিগ্রাফি

গ্রিক লেখালেখির সর্বপ্রাচীন উদাহরণ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ সময়ের, যা মাইসিনে পাওয়া গেছে। হোমারের মহাকাব্যও লেখ্যরূপ পেয়েছে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের দিকে। প্রথমদিকের লেখাগুলো থাকতো মাটি বা ধাতব পাত্রের গায়ে। পরে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয় প্যাপিরাস, যা আসত মিসর থেকে। মাঝে মাঝে লেখা পাতাই মুছে আবার লেখার জন্য প্রস্তুত করা হত। চতুর্থ শতকের দিকে মার্জিন ও সাদা পটে আকর্ষণীয় করার ধারণা যুক্ত হয় বাইবেলের সাথে। টলেমীয় মিশর, পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাতের লেখাকে এগিয়ে নিতে থাকে। 

প্রাচীন গ্রিসের হাতের লেখা নজির © foundinantiquity.com

৮ম শতক থেকে থেকে ১৫শ শতক প্রভূত অগ্রগতি হয় ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণায়। আরবদের দখলে আসে সিরিয়া, মিশর ও ফিলিস্তিনের মত অঞ্চল, যা একসময় বাইজান্টানীয় অধিকারে গণ্য ছিল। অন্যান্য দিকের মতো লিখন রীতিতেও বিবর্তন আসে। চার্চের সরাসরি হস্তক্ষেপে লিখিত হতে থাকে বাইবেল।

চতুর্দশ শতকে ইতালিয় পণ্ডিতেরা গ্রিক ভাষা শিখছিল। অন্যদিকে বাইজান্টাইনের গ্রিক পণ্ডিতেরা চলে যাচ্ছিল ইতালির দিকে। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটলে ইতালিতে জ্ঞানচর্চার নতুন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। পাণ্ডুলিপিকাররা সেখানে দুই ধরনের রীতির প্রচলন ঘটান। জোহান রোসাসের (মৃ.-১৫০০) মতো ব্যক্তিদের হাতে Liturgical এবং জন ল্যাসারিসের মতো ব্যক্তিদের হাতে প্রথাগত নিজস্ব ধাঁচ। ইতোমধ্যে রোমান ক্যালিগ্রাফিতেও লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। পম্পেইয়ের গ্রাফিতিতে ব্রাশ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।  

ব্রিটেনের মতো ইউরোপের কিছু অঞ্চলে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে সামনে আসে ক্যালিগ্রাফি। আইবেরিয়ান উপদ্বীপে ৮ম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ভিসিগথিক ধারা ব্যবহার করা হত। মেরোভিনিয়ান ও ভিসিগথিক দুটি প্রভাবশালী লিপি। প্রথমটি ফ্রান্স এবং দ্বিতীয়টি স্পেনে বিকাশ লাভ করে। দক্ষিণ ইতালিতে বেনেভেনটান নামে লিপি বেশ আধিপত্য রেখেছিল বলে জানা যায়। ক্যারোলিন যুগে বিশেষ করে শার্লেমানের সময়ে শিক্ষা ও লেখালেখিতে উৎসাহ প্রধান অন্য মাত্রা লাভ করে।

মানবতাবাদের হাওয়া লাগে বর্ণমালাতেও © callifonts.com

রেনেসাঁর যুগে মানবতাবাদের ধাক্কা লাগে সবকিছুতেই। পুরাতন বহু পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে একঝাঁক মানুষ ফ্লোরেন্সে মিলিত হলো। তাদের পেছনে প্রভাবক ছিল চতুর্দশ শতকের কবি পেত্রার্কের মতো কবিরা। লেখালেখিতে এলো নয়া উদ্যম। লিপিতেও এলো পরিবর্তন। এদের মধ্যে ফেলিসিয়ানো অন্যতম। তিনি লিপিতে জ্যামিতির ব্যবহার করলেন। ষোড়শ শতকের দিকে ভেনিসে বর্ণ সৃষ্টির উপর প্রথম বই প্রকাশিত হলো লোকা প্যাচিওলির Divina proportione বা স্বর্গীয় অনুপাত। যদিও তা প্রায়োগিকতার চেয়ে তত্ত্বের উপর প্রাধান্য দিয়েছে। 

ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকে লেখার উপর দুই ধরনের বই আধিপত্য করে। প্রথমে কীভাবে লিখতে হয় আর দ্বিতীয়ত কাগজ, কালি প্রভৃতি সরঞ্জামাদি নিয়ে। রোমে ১৫৪০ সালে জিওভানি বাত্তিস্তা প্রকাশ করেন তার গ্রন্থ ‘Libro nouvo d`imparare a scrivere’ অর্থাৎ বই লেখার উপর নতুন বই। সেই সাথে ছিল অ্যারিঘি এবং তাগলিয়েন্তের লেখা। পরবর্তী লেখালেখিতে কেবল তাদেরকে অনুকরণ করা হয়েছে। 

পরবর্তী বহু বই একে অনুকরণ করেছে © christies.com

আধুনিক দুনিয়ায় ক্যালিগ্রাফি

উনিশ এবং বিশ শতকে ক্যালিগ্রাফি নবপ্রাণে উজ্জীবিত হয়। উইলিয়াম মরিসের মতো ইংরেজ শিল্পীগণ মনোযোগ দেন এদিকে। মরিস ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কেমস্কট প্রেস। পরবর্তীতে এডওয়ার্ড জন্সটনের মতো আরো অনেকে এগিয়ে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ইংলিশ ও জার্মান ক্যালিগ্রাফির প্রভাব পড়ে আমেরিকায়। শিকাগোতে আর্ট ইনস্টিটিউট এবং নিউ ইয়র্কে কুপার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বযুদ্ধের পর এই শিল্প আরো বিস্তার লাভ করে। জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে সাধারণের মাঝেও। জাপানে ক্যালিগ্রাফারকে উচ্চ বেতনে চাকুরি দেয়া হয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ধারণার অনুপ্রেরণা নয়। শিল্পের জন্য শিল্প হিসেবেও ক্যালিগ্রাফি স্থান পেয়ছে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তির দৌরাত্মে কোণঠাসাও হয়ে থাকছে কখনো কখনো। ইদানিং মুসলিম দেশগুলোও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে।

ইস্তাম্বুলের হায়া সুফিয়াতে ক্যালিগ্রাফির সজ্জায় ‍সুরা নুর © wannaseeuhappy.blogspot.com

This Bengali article is about Calligraphy, the art of writing and its history in different cultures. 

References:

1) Encyclopedia of Religion, Mircea Eliade, Vol: 3, Page: 24-30

2) The Oxford Encyclopedia of the Modern Islamic World, John Esposito, Vol:1

3) Calligraphy - britannica.com

4) Calligraphy - iranicaonline.org

5) The History of Islamic Calligraphy - education.asianart.org

6) Chinese Calligraphy - asiasociety.org

7) Japanese calligraphy - japancalligraphy.eu

Featured Image: tugra-style.com

Related Articles