প্রথমেই একটা ছোট প্রশ্ন দিয়ে লেখাটা শুরু করি।
মানুষ বলতে আপনি আসলে কী বোঝেন?
প্রশ্নটা অনেকের কাছে হাস্যকর কিংবা নিরর্থক মনে হতে পারে। অনেকে হয়তো রেগে বলে বসবেন, “এটা আবার কেমন প্রশ্ন? মানুষ তো মানুষই। এই যে আমরা একটা সমাজে বাস করি। আশেপাশে কতো মানুষ!” আসলেই কি তা-ই?
আচ্ছা, তাহলে মানুষের সংজ্ঞা কী? কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে কাউকে মানুষ বলা যায়? এখানে ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে কিছুটা দ্বন্দ্ব লেগে যায়। আবার একেকজনের একেক বিশ্বাস। তাই সংজ্ঞাতেও লাগে গড়মিল। একজন হয়তো বলবে কারো ডিএনএ হোমো স্যাপিয়েন্সের সাথে মিলে যাওয়া মানেই সে মানুষ। আবার আরেকজন হয়তো বলবে মানুষের মতো দেখলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানবিক গুণাবলি অর্জন করা না পর্যন্ত কাউকে মানুষ বলা যাবে না। অন্য এক ব্যক্তি এসে হয়তো বলবে উন্নতমানের মস্তিষ্কের অধিকারীই হলো মানুষ। আবার কেউ বলবে, রক্ত-মাংসের তৈরি সবচাইতে সেরা জীবই হলো মানুষ।
আচ্ছা, সবার মস্তিষ্ক তো একইভাবে কাজ করে না। তাহলে কাদের মানুষ বলতে হবে সেটা কীভাবে বুঝবো? কারো শরীরে রক্ত-মাংসের অঙ্গের বদলে যদি কৃত্রিম অঙ্গ থাকে, তাহলে কি তাকে মানুষ বলা যাবে? মস্তিষ্ককে উন্নত করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার করলে মানুষের লক্ষণ থাকবে না? যে হারে কম্পিউটার প্রযুক্তি ও বায়োমেডিসিনের উন্নতি হচ্ছে, তাতে একসময় এসব প্রশ্ন সামনে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমন কি হতে পারে যে, এসব উন্নতির কবলে পড়ে মানুষ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং দীর্ঘস্থায়ী একটি জীবনের মালিক হওয়া সত্ত্বেও দিন দিন একাকী এবং নিরাশ জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়বে?
এসব প্রশ্ন কেন আসলো এবং এগুলো বিজ্ঞানের কোন অংশের আলোচ্য বিষয় সেটা বোঝানোই হলো এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। বিজ্ঞানের জগতে অদূর ভবিষ্যতের এমন সব অবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ‘ট্রান্সহিউম্যানিজম’-এ।
ট্রান্সহিউম্যানিজম হলো সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক মুভমেন্ট, যা বিশ্বাস করে- মানুষে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থা উন্নত করতে পারবে। আরেকটু ভেঙে বললে, এই ট্রান্সহিউম্যানিজম হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ন্যানোটেক, ক্লোনিং এবং এই ধরনের প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের শারীরিক এবং মানসিক সামর্থ্য উন্নত করা। আর এই বিকাশ একজন মানুষের স্বাভাবিক সামর্থ্যের তুলনায় অনেক বেশি এবং উন্নত। তাই এই ধরনের উন্নত মানুষদের আলাদা করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রান্সহিউম্যান’। আর যারা এই মতবাদে বা মুভমেন্টে বিশ্বাসী বা এর লক্ষ্যে কাজ করছে তাদের বলা হয় ‘ট্রান্সহিউম্যানিস্ট’। মানুষ বা হিউম্যানকে ট্রান্সহিউম্যান করার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুরু হয়ে গেছে। যেমন: ইউএস মিলিটারি ক্যাম্পে স্পাইনারদের ট্রেনিং দেওয়ার সময় তাদের ট্রান্সক্র্যানিয়াল ডাইরেক্ট কারেন্ট স্টিম্যুলেশন (টিডিসিএস) দেওয়া হয়, যা তাদের মস্তিষ্কে দুর্বল ইলেকট্রিক কারেন্টের মাধ্যমে শেখার গতি এবং প্রতিক্রিয়ার সময় দ্রুত করে। এটা ট্রান্সহিউম্যানিজমের ‘সুপার ইন্টেলিজেন্স’ নীতির অন্তর্ভুক্ত।
ট্রান্সহিউম্যানিজমের তিনটি মূল নীতি রয়েছে- সুপার লংজিভিটি, সুপার ওয়েল-বিঙ এবং সুপার ইন্টেলিজেন্স।
সুপার লংজিভিটি
স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে আয়ু বাড়ার সাথে একজন ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি কাজ করে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। আর তাছাড়া ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে যেকোনো সুস্থ ব্যক্তিও হঠাৎ করে মারা যেতে পারে। আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা বাদ দিলে মানুষের মৃত্যুর পেছনে দুটি মূল কারণ রয়েছে। কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব, আর না হয় বয়স বাড়ার কুফল। এই দুটি বিষয় নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই মানুষের আয়ু দীর্ঘ করা সম্ভব। ১৯০০ সালে থেকে প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রের উন্নতির ফলে মানুষের আয়ু বছরে তিন মাস করে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৬ ঘণ্টা করে আয়ু বাড়ছে।
ট্রান্সহিউম্যানিস্টদের মতে, সুপার লংজিভিটি বা অতিরিক্ত দীর্ঘায়ু সম্ভব, যদি শরীরের আগে থেকেই ঠিক করা আত্মহনন প্রক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব হয়। সাধারণত একজন ব্যক্তি ২০ বছর বয়সে পা রাখতেই তার দেহের আত্মহননের চক্র ঘোরা শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ বয়স্ক হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, যা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য হলো এই আত্মহননের চক্র বন্ধ করে দিনে ২৪ ঘণ্টার বেশি আয়ুকাল বাড়ানো। বর্তমানে পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ১২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকা সম্ভব। ট্রান্সহিউম্যানিজমের মাধ্যমে ১,০০০ বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব বলে তাদের ধারণা।
সুপার ওয়েলবিঙ
সুপার ওয়েলবিঙ বা অতিরিক্ত সুস্থ থাকা ট্রান্সহিউম্যানিজমের দ্বিতীয় নীতি। উল্লেখ্য, ‘সুস্থতা’ বলতে মূলত ‘শারীরিক সুস্থতা’র উপরই আলোকপাত করা হয়েছে। একটু আগেই বলা হলো যে, দুর্ঘটনা বা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা বাদে সাধারণত মানুষ দুটি কারণে মানুষ মারা যায়। বৃদ্ধ হওয়ার কারণে, আর অসুস্থতার কারণে। বৃদ্ধ হওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যে সুপার লংজিভিটিতে বলা হয়েছে। এখন মানুষের আয়ু বাড়াতে হলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোও অতি প্রয়োজন। আমরা আসলে এই ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা সবসময়ই করি। যেমন- একসময় অল্প ঠাণ্ডা পড়লেই মানুষ তা সহ্য করতে পারতো না। অনেকে মারাও যেত। কিন্তু এখন মোটা জামা-কাপড়, সোয়েটার, কম্বলের আগমনের পর শীত সহ্য করার ক্ষমতা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। ফলে ঠাণ্ডায় মারা যাওয়ার হারও কমেছে। দিনে দিনে পাতলা কিন্তু বেশি গরম কাপড় তৈরির চেষ্টা চলছে। এই সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য একটাই। মানুষকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করা।
ঠিক একইভাবে চিকিৎসাক্ষেত্রেও একের পর এক নতুন ঔষধ আবিষ্কার এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দেহে কৃত্রিম কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানুষের দৈহিক সুস্থতা বৃদ্ধি করা যায়। পঙ্গুত্বের হাত থেকে বাঁচাতে কৃত্রিম পা, অন্ধত্বের হাত বাঁচাতে কৃত্রিম রেটিনার ব্যবহার নতুন নয়। তাছাড়া এসব কৃত্রিম অঙ্গ যেন প্রাকৃতিক অঙ্গের চেয়েও ভালো সার্ভিস দেয় সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। ফার্মাসিউটিক্যাল এবং বায়োটেকনোলজির উন্নতির ফলে এমন শিশুদের পৃথিবীতে আনা সম্ভব, যারা মা-বাবার শুধুমাত্র ভালো জেনেটিক বৈশিষ্ট্যগুলোই ধারণ করবে। এতে করে জন্মের পরপরই কোনো রোগ, স্থূলতা এবং হতাশার ফ্যাক্টরগুলো শিশুরা পাবে না। ট্রান্সহিউম্যানিস্টদের মতে, একসময় নেতিবাচক অনুভূতিও সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধি পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
সুপার ইন্টেলিজেন্স
ট্রান্সহিউম্যানিজমের তৃতীয় নীতি হলো সুপার ইন্টেলিজেন্স। ট্রান্সহিউম্যানিস্টরা বিশ্বাস করেন, মানুষের মস্তিষ্ক উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের মতে, প্রযুক্তির মাধ্যমে মস্তিষ্কের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। তাই মস্তিষ্কের স্বাভাবিক সক্ষমতায় সন্তুষ্ট না থেকে একে উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পুরো মস্তিষ্ককে শক্তিশালী কম্পিউটারে পরিণত করার মতো ব্যাপার আর কী।
সুপার ইন্টেলিজেন্স বলতে এমন সব জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বোঝানো হয় যা মানুষের জানাশোনা বা চিন্তার বাইরে। এর মাধ্যমে ‘টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি’ সৃষ্টি হতে পারে। প্রযুক্তিগত বৃদ্ধি অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিবর্তনীয় হয়ে পড়লে মানবসভ্যতায় বিপুল ও অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসা সম্ভব। ভবিষ্যতের সেই অবস্থাই হলো টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি। এটি বিজ্ঞানকে দ্রুত এমন এক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যা সম্পর্কে কখনো ভাবাই সম্ভব ছিল না। এত আবিষ্কার, এত জ্ঞান, এত উন্নতি; সবকিছুতেই কাজ করে মানুষের বুদ্ধি। আর এসব বুদ্ধির উৎস তথা মস্তিষ্ককে উন্নত করা গেলে যে এসব আবিষ্কার ও উন্নতির সংখ্যাও বাড়বে তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আর এর সহায়তায় মানুষেরা নিজেরাই ‘সুপার লংজিভিটি’ এবং ‘সুপার ওয়েলবিঙ’-এর নীতি পূরণ করতে পারবে। মানুষের মন বা অনুভূতিকে মস্তিষ্ক থেকে নিয়ে কম্পিউটারে ডাউনলোড করা সম্ভব হবে। উন্নত মাইক্রোপ্রসেসর বা এ ধরনের প্রযুক্তি এই কাজে সহায়তা করতে পারবে। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের চেষ্টায় আছেন। অবশ্য এর ফল কতটা লাভজনক হবে সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
ট্রান্সহিউম্যানিজমের কুফল
এর নেতিবাচক দিকগুলো বেশিরভাগই খুব স্পষ্ট। যেমন- সব মানুষ অতিরিক্ত দীর্ঘজীবী হলে এই পৃথিবী অস্বাভাবিকভাবে জনবহুল হয়ে যাবে। কিন্তু পৃথিবীতে ভূমির পরিমাণ তো নির্দিষ্টই থাকবে। ফলশ্রুতিতে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ভোগান্তিও বাড়বে। আরেকটি বিষয় হলো ট্রান্সহিউম্যানিস্টদের বিশ্বাস, মানুষের আয়ু একসময় হয়তো এতটাই বেড়ে যাবে যে তারা অমরও হতে পারবে। কবে নাগাদ তা হবে তা বলতে না পারলেও এই বিশ্বাস তারা পোষণ করে। অমরত্বের বিষয়টি ধর্মীয় ও নৈতিক বিশ্বাসের পরিপন্থী।
আচ্ছা, এসব বিতর্কের দিকে না গিয়ে এমনিই বিষয়টি একবার চিন্তা করেন। এমন একটি জীবন কাটাচ্ছেন যার কোনো শেষ নেই। আরাম-আয়েশ করা শেষ, কাজের ধকল সামলানো শেষ। জীবনের সব ধাপ পার করাও শেষ। তারপর কী? নিরাশ ও একাকী জীবনের দিকে অগ্রসর হতে হবে সেই দীর্ঘজীবী মানুষটিকে। আর এই জীবনটা পার করার জন্য দৈনন্দিন খরচের ভারও বাড়তে থাকবে দিন দিন। আর সুপার ওয়েলবিঙয়ের নীতি পূরণ হলে তো শুধু মানুষের দৈহিক সুস্থতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে মানুষটির মানসিক সমস্যা ও অস্বস্তিকর অবস্থা তো থেকেই যাবে। সুপার ইন্টেলিজেন্সের নীতি পূরণ হতে হতে পৃথিবীটা হয়তো মানুষ কম, রোবটের নিয়ন্ত্রণেই বেশি চলে যাবে। মস্তিষ্ক ও মন সব চলে যাবে প্রযুক্তির মুঠোয়। আরেকটি কঠিন সত্য হলো, এতসব উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করার সামর্থ্য একসাথে সবার কোনো কালেই থাকা সম্ভব না। এর মানে এগুলো শুধু ‘ধনী’ মানুষের জন্যই। ব্যাপারটা তো তাহলে বেশ চিন্তা করার মতো!
লেখার শুরুতে মানুষের সংজ্ঞা নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম। তখন হয়তো উত্তরগুলো একটু সহজ ছিল। কারণ তখন আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদানে প্রাপ্ত সাধারণ ‘লংজিভিটি’, ‘ওয়েলবিঙ’ এবং ‘ইন্টেলিজেন্স’-এর কথা চিন্তা করছিলাম। তবে অতিরিক্ত প্রযুক্তির ফলে যখন ‘সুপার’ শব্দটি এগুলোর প্রথমে বসে যায় তখন পরিস্থিতিটা ভালো না হয়ে খারাপের দিকেই বেশি যায় বলে মনে হচ্ছে। এখন আপনিই ভেবে বলুন, অতিরিক্ত দীর্ঘায়ু (১,০০০ বছর বা এর বেশি); রোগবালাই ও অনুভূতিহীন এবং অস্বাভাবিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ‘ট্রান্সহিউম্যান’কে কি আসলেই ‘মানুষ’ বা হিউম্যান’ বলা চলে?