পেলে এবং ম্যারাডোনা- খেলোয়াড় হিসেবে নিঃসন্দেহে দুজনেই নিজ নিজ যুগের সেরা, সর্বকালের সেরার প্রশ্নেই বিতর্কটা এসে পড়ে। ফুটবলের সবচাইতে মর্যাদাসম্পন্ন টুর্নামেন্ট বিশ্বকাপটা পেলে জিতেছেন তিনবার, অন্যদিকে ম্যারাডোনা একবার জেতার পাশাপাশি রানার্স আপ হয়েছেন আরো একবার। ট্রফি সংখ্যায় পেছনে থাকলেও ম্যারাডোনা মূলত প্রতিযোগীতায় চলে আসেন দুর্বল একটি দল নিয়ে লড়াই করার কারণে।
তবে এরপরেও সর্বকালের সেরার প্রশ্নে সাধারণ দর্শক তো বটেই, ফুটবল বিশেষজ্ঞরাও দ্বিধায় পড়ে যান যেকোনো একজনকে এগিয়ে রাখার প্রশ্নে। দুজনের পক্ষেই যুক্তি অনেক। খেলোয়াড়ি দিক থেকে পেলে ম্যারাডোনার মাঝে অনেক অমিল। দুজন দুই পজিশনে খেলতেন। তবে একটা দিকে এসে যেন দুজনেই মিলে গিয়েছেন। নিজ মহাদেশের সর্বোচ্চ শিরোপা ‘কোপা আমেরিকা’টা যে কারোরই জেতা হয়নি!
একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক কোপা টুর্নামেন্টে এই দুই মহারথীর পারফর্মেন্সে।
কোপায় ম্যারাডোনা
আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে ম্যারাডোনার অভিষেক ১৯৭৭ সালে, খেলেছেন ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এই ১৭ বছরে আর্জেন্টিনা খেলেছে ৬টি কোপা, তবে ম্যারাডোনা খেলতে পেরেছিলেন ৩টি টুর্নামেন্টে।
১৯৭৯ সালের টুর্নামেন্টটি ছিল ম্যারাডোনার প্রথম কোপা। এই টুর্নামেন্টে কোনো স্বাগতিক দেশ ছিল না। হোম এবং অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে খেলাটা হয়েছিল। তিনটি গ্রুপে তিনটি করে দল খেলেছিল। প্রতি গ্রুপ থেকে একটি করে দল সেমিতে খেলেছিল। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পেরু সরাসরি সেমি খেলেছে।
গ্রুপ বি-তে ছিল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর বলিভিয়া। এই টুর্নামেন্টে তরুণ ম্যারাডোনা মাত্র দুটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। বলিভিয়ার বিপক্ষে হোমে ৩-০ গোলে জেতা ম্যাচে একটি গোলও করেন। কিন্তু আর্জেন্টিনা ৪ ম্যাচে মাত্র ১ জয় নিয়ে গ্রুপে ৩য় হয়।
১৯৮৭ সালের কোপাতে ম্যারাডোনা ফর্মে ছিলেন। এর আগে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপেও ম্যারাডোনা জিতিয়েছিলেন মোটামুটি একক কৃতিত্বে। আর্জেন্টিনার ১৪টি গোলের মাঝে ১০টিতেই সম্পৃক্ততা ছিল এই ম্যাজিশিয়ানের। ৫টি গোল করার পাশাপাশি ৫টি গোলে অ্যাসিস্ট করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটাও জিতে নিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮৭ কোপাতে আর্জেন্টিনা স্বাগতিক ছিল। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ম্যারাডোনার গোলেই আর্জেন্টিনা ১-১ গোলে ড্র করে পেরুর সাথে। পরের খেলাতেও ইকুয়েডরকে ৩-০ গোলে পরাজিত করা ম্যাচে দুই গোল করেন ম্যারাডোনা।
তবে সেমিতে উরুগুয়ের সাথে ১-০ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। পরবর্তীতে ৩য় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে কলম্বিয়ার কাছে ২-১ গোলে পরাজিত হয় আর্জেন্টিনা।
১৯৮৯ সালের কোপাতে ম্যারাডোনা কিছুটা বাজে ফর্মে ছিলেন। সেটার প্রভাব পড়ে আর্জেন্টিনার পারফর্মেন্সেও। কোপা ১৯৮৯ এর ফরম্যাটটা ছিল একটু ভিন্ন রকম। দুটি গ্রুপে ৫টি করে দল ছিল। প্রতি গ্রুপ থেকে ২টি করে দল পরের পর্বে উঠে মোট ৪টি দল নিয়ে ফাইনাল রাউন্ড করা হয়। সেখানে লিগ ভিত্তিতে সেরা দলকে চ্যাম্পিয়ন করা হয়।
গ্রুপে আর্জেন্টিনার সঙ্গী ছিল উরুগুয়ে, চিলি, ইকুয়েডর আর বলিভিয়া। ম্যারাডোনা গোলহীন থাকার পরও ৪ ম্যাচে ২ জয় আর ২ ড্র নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের পর্বে যায় আর্জেন্টিনা। ফাইনাল রাউন্ডে ছিল ব্রাজিল, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে। এখানেও প্রতিটি দল লিগ পদ্ধতিতে সবার সাথে ম্যাচ খেলে। পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকা দলটি শিরোপা জিতবে। এবার আর ম্যারাডোনার অফ ফর্মকে সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। আর্জেন্টিনা ৩ ম্যাচে ১ ড্র আর ২ পরাজয় নিয়ে ৩য় হয়। ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়। টুর্নামেন্টে ম্যারাডোনা কোনো গোল পাননি।
এই তিনটি টুর্নামেন্ট বাদেও ম্যারাডোনার সময়ে ১৯৮৩, ১৯৯১ আর ১৯৯৩ সালে আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকায় অংশ নিয়েছিল। কোপা ১৯৮৩-তে খেলোয়াড়ি কারণে বাদ পড়লেও ১৯৯১ আর ১৯৯৩ সালের কোপার আসর দুটো ছিল ম্যারাডোনার জন্য আক্ষেপের। ডোপ কেলেঙ্কারির জন্য এই দুই আসরে ম্যারাডোনা সুযোগ পাননি। অথচ এই দুই আসরে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়।
এরপর ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার দুর্দান্ত পারফর্মেন্স আক্ষেপটাকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
কোপায় পেলে
ব্রাজিলের হয়ে পেলের অভিষেক ১৯৫৭ সালে। পরের বছর ব্রাজিলকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতাতে পেলের ভূমিকা অপরিসীম। গ্রুপ পর্যায়ে একটি অ্যাসিস্ট দিয়ে শুরু করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে পেলের একমাত্র গোলে ওয়েলসকে হারিয়ে সেমিতে পৌঁছে ব্রাজিল। সেমিতে ফ্রান্সের সাথে হ্যাটট্রিক করে পরিণত হন বিশ্বকাপের সবচেয়ে কমবয়সী হ্যাটট্রিকদাতা হিসেবে (১৭ বছর ২৪৪ দিন)। ফাইনালেও দুই গোল করেন, জিতে নেন সেই বিশ্বকাপের সিলভার বুট এবং সিলভার বল। এছাড়া সেই বিশ্বকাপের উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতে পেলে তখন সুপারস্টার। ১৯৫৯ সালের কোপা আমেরিকাতে পেলে তাই যান তারকা হিসেবেই।
আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত কোপা ১৯৫৯ এর ফরম্যাট ছিল লিগ ভিত্তিক। ৭টি দলের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিপক্ষে খেলবে, পয়েন্ট তালিকায় এগিয়ে থাকা দল চ্যাম্পিয়ন হবে। পেরুর বিপক্ষে নিজেদের প্রথম খেলায় দিদি আর পেলের গোলে ৪৮ মিনিটেই ২ গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। কিন্তু হুয়ান সিমিনারিওর দুই গোলে ম্যাচ ড্র হয়। চিলির বিপক্ষে পরের ম্যাচে পেলের ২ গোলে ৩-০ গোলের জয় পায় ব্রাজিল। বলিভিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচে ৪-২ গোলে জয় পায় ব্রাজিল। এই ম্যাচে বলিভিয়া প্রথমে গোল করে এগিয়ে গেলেও পেলের গোলেই সমতা ফেরায় ব্রাজিল। উরুগুয়ের বিপক্ষে পরের ম্যাচে ৩-১ গোলে জয় পেলেও টুর্নামেন্টের এই একটি ম্যাচেই পেলে কোনো গোল করতে পারেননি। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে পরের ম্যাচে পেলের হ্যাটট্রিকে ৪-১ গোলের জয় পায় ব্রাজিল।
টুর্নামেন্টের শেষ রাউন্ডে এসে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, চ্যাম্পিয়ন হতে হলে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে ব্রাজিলকে জয় পেতেই হবে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন হবে।
ম্যাচের ৪০ তম মিনিটে প্রথম গোল আর্জেন্টিনাই করে। সম্ভাবনা আর্জেন্টিনার দিকে থাকলেও ৫৮ তম মিনিটে পেলে গোল করে ম্যাচ জমিয়ে তোলেন। তবে শেষ পর্যন্ত রক্ষণাত্মক খেলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছে যায় আর্জেন্টিনা।
৮ গোল করে পেলে জিতে নেন সেই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার। এছাড়া সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটাও জিতে নেন পেলে।
তবে এরপর হয়তো বা কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টটা ব্রাজিলের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছিল। পরের দুটি টুর্নামেন্টে ফর্মে থাকা পেলেকে দলে না রাখা সেই ইঙ্গিতই দেয়। এরপর ১৯৬৭ সালের কোপা থেকে ব্রাজিল নিজেদের সরিয়ে নেয়। পরের কোপা আমেরিকা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। জাতীয় দল থেকে ১৯৭১ সালে অবসর নিয়ে ফেলা পেলের সেই কারণেই আর খেলা হয়নি কোপা আমেরিকায়। শিরোপাটাও আর ছুঁয়ে দেখা সম্ভব হয়নি ফুটবল সম্রাটের। তবে পেলেবিহীন ব্রাজিলের অবস্থাও সেই সময় কোপা আমেরিকাতে বাজেই ছিল। পেলের সময়ে রানার্স আপ হবার পর পরের ফাইনাল খেলতে ব্রাজিলের সময় লেগেছিল আরো ২৪ বছর, চ্যাম্পিয়ন হয় আরো ৬ বছর পর। ১৯৫৯ সালের পেলের সেই আসরের পর মাঝে চলে গিয়েছিল ৭টি আসর। কে জানে, সেই সময় ব্রাজিল দলে পেলে থাকলে হয়তো ব্রাজিল এবং পেলে সবার আক্ষেপই ঘুচতো।