এক রঞ্জি হিরো। কিন্তু তার নামের পাশেও যুক্ত হওয়ার কথা ছিল কিংবদন্তি কিংবা রথী-মহারথী এসব শব্দমালা। ভাগ্যের পরিহাস আর ভুল যুগের সারথি ছিলেন বলে তার নামের পাশে শুধুই দীর্ঘশ্বাস আর আক্ষেপ ঝরে। কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার আর প্রতিভার নিদারুণ অপচয় করা বিনোদ কাম্বলির সাথে একই স্কুলের ক্লাসমেট ছিলেন তিনি। ক্রিকেটগুরু হিসেবেও পেয়েছিলেন শচীন-কাম্বলির গুরু রমাকান্ত আচরেকারকে।
১৯৮৮ সালে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) হ্যারিস শিল্ড ইন্টার স্কুল টুর্নামেন্ট চলছিল। ১৩ বছরের দুটো ছেলে, শচীন টেন্ডুলকার এবং বিনোদ কাম্বলি সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরের হয়ে তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৬৬৪ রানের পার্টনারশিপ গড়ে চারদিকে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তখনকার সময়ের দুই অখ্যাত ছেলের স্কুল ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটির পর হঠাৎ করেই দুজনের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
ঠিক ওই জুটির সময়েই স্ট্যান্ড থেকে খানিক দূরে ১৩ বছরের আরেকটা ছেলে ওয়ার্মিং করছিলেন, নেট প্র্যাকটিস করছিলেন। ব্যাট-প্যাড পড়ে রেডি হয়ে দুই দিন অপেক্ষা করছিলেন পরবর্তী ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাট করতে নামার জন্য। কিন্তু তার সেই ‘অপেক্ষার’ পালা শেষ হয়নি আর, ব্যাটিংয়েও নামা হয়নি সেই ম্যাচে। দল যখন ইনিংস ঘোষণা করছে, তখনও যে শচীন-কাম্বলি অপরাজিত!
ক্যারিয়ার জুড়েই অপেক্ষার সাথে বন্ধুতা করা সেই ছেলেটি আর কেউ নন, আজকের গল্পের নায়ক অমল অনিল মজুমদার। যে ‘অপেক্ষা’ শব্দটি অমল মজুমদারের সারা জীবনের আক্ষেপ হয়ে থেকেছে।
যখন শচীন-কাম্বলী ভারতের হয়ে খেলছেন, অমল মজুমদারের ক্যারিয়ার তখনও ওই হ্যারিস শিল্ড ইনিংসের মতোই ব্যাট-প্যাড পড়ে রেড়ি হয়ে সাইডলাইনে বসে থাকার, আছেন শুধু একটি সুযোগের অপেক্ষায়। কিন্তু সেই সুযোগ একবারও ধরা দেয়নি। কারো কারো ভাগ্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো অপশনই হয়তো থাকে না! সারা জীবন তাই অপেক্ষা করেই কাটাতে হয়েছে অমল মজুমদারকে।
পাঁচ বছর পর ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে রঞ্জি ট্রফিতে ফরিদাবাদে হারিয়ানার বিপক্ষে বোম্বের হয়ে (বর্তমান মুম্বাই) অভিষেকে ২৬০ রানের এক জ্বলজ্বলে ইনিংস খেললেন অমল, যে ইনিংসে ফুটে উঠেছিল অমলের বড় ইনিংস খেলার ক্ষমতা, ব্যাটিংয়ের সময় শতভাগ মনোযোগী অমলের বৈশিষ্ট্য। এই ইনিংস প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যেকোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রানের স্কোর হয়ে টিকেছিল পঁচিশ বছর। অবশ্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অজয় রোহেরা সেই রেকর্ডটি ভেঙে দেন।
১৯৯৪ সালে ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে সহকারী অধিনায়কের দায়িত্ব পান অমল। তখন থেকেই তাকে মনে করা হতো ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ভবিষ্যত তারকা’ হিসেবে। গায়ের সাথে সেঁটে গিয়েছিল ‘নতুন টেন্ডুলকার’ তকমাও। সে সফরে সেঞ্চুরি করা অমলকে নিয়ে বলতে গিয়ে তখনকার ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ সাবেক ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটার সন্দীপ প্যাটেল বলেন,
এখন চারদিকে মানুষজন তাকে নিয়ে প্রচুর কথা বলবে। এটা অমলের মধ্যে একটা ভুল আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করতে পারে।
ক্যারিয়ার জুড়ে অমল সেটা ভুল প্রমাণ করেছেন। ম্যানেজার বিক্রম দাসগুপ্ত বলেন,
হি ইজ অ্যা টেস্ট প্রসপেক্ট।
সকল প্রকার ব্যাটিং মেধা এবং টেকনিক থাকা সত্ত্বেও অমল মজুমদার আটকা পড়ে গিয়েছিলেন সময়ের মারপ্যাঁচে। এমন সময়ে এসে ক্যারিয়ার পড়েছিল, যখন ভারতীয় ক্রিকেট তথা ভারতের মিডল-অর্ডার রাজত্ব করতে অপেক্ষা করছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, সৌরভ গাঙ্গুলিরা। একই স্কুল দলে শচীন-কাম্বলির পর এবার অমলের কপাল পুড়লো রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ আর সৌরভ গাঙ্গুলিতে। ১৯৯৫ সালে এই তিন বর্তমান মহারথীর সাথে মিডল-অর্ডারের চিন্তায় ভারত ‘এ’ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে সুযোগ পান অমল মজুমদার।
ভারতীয় মিডল অর্ডারের দুই আস্থা রবি শাস্ত্রী এবং নভজ্যোত সিং সিধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরগ্রহণ করার পর মিডল অর্ডারে জায়গা ফাঁকা হয়। সেজন্য ১৯৯৫-৯৬ দুলীপ ট্রফিকে ভাবা হচ্ছিল জায়গাগুলো পূরণ করার অডিশন হিসেবে। সেখানে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভিভিএস লক্ষ্মণ ৩৯৫ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। দ্বিতীয় রাহুল দ্রাবিড় করেন ৩৫৩ রান, একটি দ্বিশতকসহ তৃতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক অমল মজুমদার করেন ৩৩৩ রান। পঞ্চম স্থানে থাকা সৌরভ গাঙ্গুলি করেন ৩০৮ রান। কিন্তু একে একে সবাই সুযোগ পেলেও অমল থেকে গেলেন ‘অপেক্ষায়’।
টেকনিক, লম্বা সময় ব্যাটিং করার প্রজ্ঞা, ধৈর্য- সব মিলিয়ে ব্যাটিংয়ের একটা দারুণ প্যাকেজ ছিলেন অমল মজুমদার। কখনো কখনো তার-ছেঁড়া ডিফেন্স, আবার কখনো কখনো জ্বলজ্বলে স্ট্রোকপ্লে। তবে একটা জায়গায় তিনি অনন্য। ব্যাটিংয়ে ডিফেন্সের সাথে ধৈর্য্যের অনন্য নিদর্শন ছিলেন অমল মজুমদার। জনৈক ইংলিশ রিপোর্টার মজুমদারের ডিফেন্স সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন,
এমসিসি অ্যাপ্রুভড ডিফেন্স।
মুম্বাই ক্রিকেট অমল মজুমদারের রক্তের সাথেই জড়িয়ে ছিল। এক সাক্ষাৎকারে মুম্বাই ক্রিকেট নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন,
মুম্বাই ক্রিকেট ইজ অ্যান অ্যাডিকশন ফর লাইফ।
মুম্বাইয়ে হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে ১৫ মৌসুম খেলেন তিনি। সেখানে ২২ সেঞ্চুরির সাথে ৫০ হাফ সেঞ্চুরিসহ করেছেন ৮,৭৬৯ রান। এ সময়ে মুম্বাইয়ের হয়ে সাতটি রঞ্জি ট্রফি জেতেন অমল মজুমদার। সব মিলিয়ে ১৭১ ফাস্ট ক্লাস ম্যাচে ৪৮.১৩ গড়ে ১১,১৬৭ রান করেছেন তিনি। ৩০ সেঞ্চুরির পিঠে ৬০টি হাফসেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ স্কোর ২৬০ রান। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ১১৩ ম্যাচে ৩৮.২০ গড়ে করেছেন ৩,২৮৬ রান। ২৬ হাফসেঞ্চুরির পিঠে ৩টি সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ স্কোর ১০৯ রান। ১৪ টি-টোয়েন্টিতে ১৯.৩৩ গড়ে করেছেন ১৭৪ রান, হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে ১টি।
এক সাক্ষাৎকারে নিজের পুরোনো দিনের আলোচনায় অমল মজুমদার বলেন,
আমার একমাত্র লক্ষ্য, রান করা। নব্বইয়ের দশকে যা ঘটেছিল, যে আমাকে বাছাই করেনি, যে আমাকে অগ্রাহ্য করেছে… এসব কোনো কিছুই আমার মাথায় থাকে না, যখন আমি মাঠে পারফর্ম করতে নামি।
প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাতে পরিশ্রমের প্রতিচ্ছবি আনতে না পারার অবহেলায় কত প্রতিভাবান অকালে হারিয়ে গিয়েছে! তারা নিজেরা ব্যর্থ হয়েছে, প্রতিভাকেও অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে। অমলকে আপনি সেই দলে ফেলতে পারবেন না। অমল প্রতিভা আর নিজের চেষ্টায় গোটা ক্যারিয়ারেই অপেক্ষা করে গেছেন। স্রেফ সময়ের মারপ্যাঁচে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন বলেই নীল রঙের জার্সিটা গায়ে জড়াতে পারেননি অমল। সফল তো তারাই, যারা চেষ্টার দ্বার খোলা রেখে প্রতিনিয়ত স্বপ্নকে তাড়া করে। অমল মজুমদার তাদেরই একজন ছিলেন।