শতাব্দীর পর শতাব্দী নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক সভ্যতার বর্তমান অবস্থানে আমরা এসেছি। আর একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং যে বিষয়টির মুখোমুখি আমরা, তা হলো নারী ও পুরুষ হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে সকল বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
সভ্যতার প্রথম থেকেই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে নারীকে উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে ঘরের মাঝে শৃঙ্খলিত করেছে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও তার অনুসারীরা। নারীর চলাচলের পরিধিকে সংক্ষিপ্ত করার পাশাপাশি একদিকে তৈরি হয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, অন্যদিকে চলেছে নারীকে অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়নের দীর্ঘ ইতিহাস। আর সে শোষণের ইতিহাসের মূল চরিত্রে ছিল নারী। সময় পরম্পরায় সে অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়নের থেকে মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে সামনে আসে ‘নারীবাদ’ প্রত্যয়টি, যা পুনরায় শিকার হয় ভুল ব্যাখ্যার। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কিংবা সকল ক্ষেত্র থেকে পুরুষকে উচ্ছেদের যে বিবরণ নারীবাদ সম্পর্কে পাওয়া যায়, তা পূর্বোক্ত বাক্যকেই সমর্থন করে।
নারীবাদ হলো সমাজ দ্বারা নির্ধারিত সকল প্রকার বৈষম্যের অবসানের মাধ্যমে নারী হিসেবে নয়, বরং একজন মানুষ হিসেবে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা তথা জেন্ডার সমতা তৈরি করার মতবাদ। নারীবাদকে ধারণ করা মানুষই নারীবাদী। নারীবাদী হওয়ার জন্য নারী হওয়া প্রয়োজন না, বরং প্রয়োজন জেন্ডার সচেতন একজন মানুষ হওয়া।
নারীবাদের বিভিন্ন ধারার একটি সাইবার নারীবাদ। ১৯৯০ সালে এই ধারণাটির শুরু হয়। প্রযুক্তির বিকাশের এ সময়টিতে ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইনকে নারী অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহারের আশা করেন নারীবাদীরা। যার ফলে উত্থান ঘটে সাইবার নারীবাদের। মূলত অনলাইনে নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটি আন্দোলন তৈরি করার মাধ্যমে নারীবাদকে আরো বিস্তৃত করাই এর প্রধান লক্ষ্য ছিল। ওয়েব ২.০ এর মাধ্যমে একইসাথে একাধিক মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ মাধ্যমটি বার্তা আদান-প্রদানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি আনুভূমিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি সফল আন্দোলনের পটভূমি তৈরির জন্যে যোগ্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠার সম্ভাব্যতা থেকেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নারীবাদীরা। অবশ্য অনেকের মতে, নারীবাদের অপব্যাখ্যার ফলে প্রত্যয়টি নিয়ে যে নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে, তা ঢাকতেই নতুন রূপে সামনে এসেছে সাইবার নারীবাদ।
সাইবার নারীবাদকে কার্যকরী করার জন্য প্রযুক্তি মাধ্যমে দক্ষ হয়ে ওঠা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অথচ সমাজ দ্বারা আরোপিত সত্য অনুযায়ী দীর্ঘ সময় ধরেই গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মতো মাথা খাটানো কাজগুলোকে তথাকথিত ভাষায় ‘পুরুষের কাজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ধরে নেয়া হয়েছিল জন্মগতভাবে যুক্তিবোধ এবং কঠিন কাজ করতে পারার মানসিক দৃঢ়তার অভাব নারীকে এ ক্ষেত্রগুলোতে করেছে অযোগ্য। কিন্তু মাথা খাটানো কাজগুলোতে বরাবরই নারীর অক্ষমতা ও অযোগ্যতা ফলাও করেছে কে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে কতটা সক্রিয় থেকে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ দেয়া হয়েছে?
বাস্তবতা হলো পুরুষদের অধিক সক্ষম ভেবে আসার প্রধান কারণ ছিল ক্ষেত্রগুলোতে পুরুষের একচেটিয়া অবস্থান। শিক্ষাগত যোগ্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নিয়ন্ত্রিত গতির মতো যে বিষয়গুলো নারীকে পিছিয়ে রেখেছিল, তাতে প্রত্যক্ষ অবদান যে সমাজেরই ছিল, তা নির্দ্বিধায় ভুলে গিয়েছিল খোদ সমাজই। কিন্তু থেমে থাকেনি নারীরা। সময়ের সাথে সাথে তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়। নারীবাদী আন্দোলনগুলো জাতীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক একটি অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হলে ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে পা রেখে নিজেদের যোগ্যতা, উপস্থিতি এবং সামর্থ্য জানান দেয় তারা। সকল বাধা অতিক্রম করে নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সমাজের উন্নয়নে পরোক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ অবস্থানে এসে দাঁড়ায় নারীরা।
পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার অ্যাডা লাভলেস একজন নারী। ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞান ও ১৯১১ সালে রসায়নে পর পর দুবার নোবেলজয়ী নারী মেরি ক্যুরি। তথাকথিত সমাজের ভাবনায় নারীর জন্যে মানানসই সাহিত্য বা শান্তিতে নয়, বরং মানব সভ্যতার উন্নয়নে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের মতো জটিল দুটি ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পুরষ্কার জয় করেছেন তিনি। মেরি ক্যুরি ও অ্যাডা লাভলেস নারী জাতির মাঝে ভিন্ন উদাহরণ বলে নয়, বরং যথাযথ সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন বলেই অর্জনের শীর্ষে অবস্থান করতে পেরেছেন। অন্যান্য নারীদের যোগ্যতা যে আলোর মুখ দেখেনি তার প্রধান কারণ ছিল বৈষম্যের ফলে প্রকৃত সুযোগের অভাব। আর সাইবার নারীবাদ নারীকে সেই সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই আন্দোলন গড়ে তুলছে।
নারীবাদ বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে ভাঙতে চায়, যার জন্য মূলে আঘাত করা অত্যন্ত জরুরি। আর সভ্যতার বর্তমান অবস্থানে দাঁড়িয়ে প্রাযুক্তিক মাধ্যমকে হাতিয়ার না করলে যে আদতে নারীর মুক্তি সম্ভব না, সে উপলব্ধি থেকেই যাত্রা শুরু নারীবাদের নয়া ধারা সাইবার নারীবাদের। সাইবার নারীবাদ কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদ না। সাইবার নারীবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে ডোনা জে. হারাওয়ে, মিয়া কনসালভো এবং সুসান লুকম্যান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তন্মধ্য ডোনা জে. হারাওয়ের লিখা সাইবর্গ মেনিফেস্টো সাইবার নারীবাদকে ব্যাখ্যা ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সাইবার নারীবাদীদের দৃষ্টিতে পিতৃতান্ত্রিক পরবর্তী সমাজের আদর্শ নাগরিক হিসেবে আবির্ভূত হয় সাইবর্গ। ডোনা জে. হারাওয়ের মতে নারীদের আরো বেশি প্রাযুক্তিক দিক থেকে দক্ষ হয়ে এই সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ছিল- প্রযুক্তি ব্যবহারকারী নারীদের ব্যবহারই যথেষ্ট না, বরং আন্দোলনকে কার্যকর করতে একইসাথে বুদ্ধিমান ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়া জরুরি।
পিতৃতান্ত্রিক কোডকে হ্যাক করার একটি মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তিকে ব্যবহারের ফলে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে আশা করেন সাইবার নারীবাদীরা। তাছাড়া সমাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জেন্ডার রোল অনলাইনে হ্রাস হবার সম্ভবানাও দেখা যায়। অনেকের মতে, শুধু নতুন প্রযুক্তির বৃহত্তর ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অর্জনের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে প্রচলিত ধারণায় বৈষম্য নিরসনের এ প্রক্রিয়াকে অত্যধিক সরল বা লঘু করে দেখা হয়। সুসান লুকম্যানের মতে, এই ধারণা জটিল প্রযুক্তিগত সিস্টেমকে নিছক সরঞ্জাম হিসেবে এর গুরুত্বকে হ্রাস করে এবং তাদের উৎপাদন ও ব্যবহারের প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিকতাকে উপেক্ষা করে।
তবে প্রাযুক্তিক ক্ষেত্রটিকে লিঙ্গ পরিচয়হীন সর্বপ্রথম মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে জেন্ডার রোল বিনষ্ট করার মাধ্যম ধরা হলেও আদতে তা শতভাগ ফলপ্রসূ হয়নি। এখানেও যখন কর্মসংস্থানের জায়গা সৃষ্টি হয়েছে, তার সাথে সাথেই এসেছে বৈষম্য। প্রথমত একে পুরুষের কাজ বলে প্রাথমিকভাবেই নারীদের প্রবেশে বাধা তৈরি করা হয়েছে। তারপরও যারা প্রতিকূলতা কাটিয়ে এগিয়েছে, তারাও পুরুষের সমান যোগ্যতা সত্ত্বেও পেয়েছে তুলনামূলক কম মজুরি। তাছাড়া প্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইসে সবার অভিগম্যতা না থাকায় কেবল একটি শ্রেণীর নারীরাই এ আন্দোলনে যোগ দেবার সুযোগ পাবে, যা পুনরায় শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি করবে।
যন্ত্রের সাথে মানবদেহের সংযোগ করে সামাজিক ও দৈহিক লিঙ্গের ভিত্তিতে সামাজিক মর্যাদা প্রাপ্তির সমাপ্তি হবে বলে সাইবার ফেমিনিজমে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই ধারণা ফলপ্রসূ হয়নি। সামাজিক মাধ্যমে নিজ পরিচয় গোপন করে মতামত প্রকাশের একটি স্থান তৈরি হলে নারীদের ক্ষমতায়ন হবে বলে ভাবা হলেও পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, সে স্থানটিও নারীদের হয়রানির শিকার হওয়ার একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও সামাজিক মাধ্যমে নারীরা নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে সক্রিয়তা প্রদর্শনের সুযোগকে কাজে লাগাবেন বলে যে ধারণা করা হয়েছিল তা-ও ‘অতি সক্রিয়’ পুরুষদের তুলনায় এবং তাদের হয়রানির বদৌলতে কার্যকর হতে দেখা যায়নি। এছাড়া প্রযুক্তি মানুষের ক্ষমতায়নকে বিনষ্টও করেছে অনেক ক্ষেত্রে।
প্রযুক্তিকেন্দ্রিক পৃথিবী সভ্যতার ভবিষ্যৎ। আর নারীদের এই ভবিষ্যতের অংশীদার হওয়া অত্যন্ত জরুরি। পূর্ব থেকেই উৎপাদন, বণ্টন, বিপণনসহ যে সকল ক্ষেত্রে পুরুষদের একচেটিয়া রাজত্ব ছিল, তা ভেঙে নারীদের নিজ অবস্থান পোক্ত করা জরুরি। সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থান পরিবর্তনের নতুন পথ হিসেবে সাইবার নারীবাদকে সক্রিয় করলেই নতুন যুগের নতুন বৈষম্য নিরসন সম্ভব।
বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, সমাজ যদি দ্বিচক্রযান হয়, তবে নারী ও পুরুষ তার দুটি চাকা। সমাজকে সুষ্ঠুভাবে এগোনোর জন্য তাই চাকাদ্বয়ের সমান হওয়া অপরিহার্য। সেই সুরের সাথে সুর মিলিয়ে বলতেই হয়, সমাজ-সভ্যতাকে পরিচালনার জন্যে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন নারী পুরুষ উভয়ই একসাথে সভ্যতার হাল ধরবে। আর সেজন্য যেকোনো প্রকারে নারীবাদের উত্থান অপরিহার্য। যেহেতু বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ, সেহেতু সাইবার নারীবাদই হতে পারে সেই আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার।