সমাজের নিয়ত বৈষম্য, শোষণ, অত্যাচার আর অনাচার দেখে সমাজকে পরিবর্তনের কথা ভাবেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর যে দেশে দাবি তোলা মাত্র রক্তঝরা আন্দোলন শুরু হয়, সেখানে সময়-সুযোগ হলে দুই-চারবার আন্দোলনে গিয়ে গলা হাঁকায়নি তেমন মানুষ পাওয়াটাও কঠিন। কিন্তু আদতেই কি এ মানুষগুলো পরিবর্তন চায়? নাকি নেশার ঝোঁকে মাতাল যেমন খিস্তি আওড়ায়, ঠিক তেমনি যৌবনের নেশায় টগবগে রক্তকে তাঁতিয়ে নিতে গলায় রক্ত চড়িয়ে স্লোগান দিয়ে যায় মানুষগুলো? তাদের ভাবনার কতটা গভীর আর কতটা লোক দেখানো মাজেজা? চারপাশের আবর্তে একজন সচেতন সাধারণ মানুষমাত্রই যে প্রশ্নগুলো নিয়ত সঙ্গী হয়ে মাথায় ঘুরবে, সেই প্রশ্নগুলোই সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে নিজ কর্মের মাঝে রেখে গেছেন যে ব্যক্তি, তিনি আহমদ ছফা। তার প্রতিটি কাজে তিনি আঙুল তুলে দেখিয়েছেন মানুষের মধ্যকার চাওয়া আর কর্মের দূরত্বকে। তেমনি একটি কাজ ‘নিহত নক্ষত্র’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, সন্ত্রাস এবং পরিচালিত ব্যবস্থার সামগ্রিকতার একাংশের চিত্র নিহত নক্ষত্রে তুলে ধরেছেন আহমদ ছফা। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সৌম্য এবং সুদর্শন যুবক মুনতাসীর। সকলের থেকে ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মুনতাসীরকে সহপাঠী এবং রুমমেট হিসেবে পেলেও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি কথক জাফরের। অথচ মুনতাসীরের উদ্দীপ্ত চোখ বরাবরই আকর্ষণ করে জাফরকে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে গিয়ে মুনতাসীরের ঘনিষ্ঠতায় অন্যান্য বন্ধুত্বে আঘাত হানার সম্ভাবনা টের পেয়ে দূরত্বই বজায় রাখে জাফর।
অন্যদিকে ক্যাম্পাসের উঠতি লেখক বন্ধু খালেদের লেখা ঋতুরঙ্গে প্রকাশের পর সকলের ব্যাপক প্রশংসার মাঝে মুনতাসীরের মন্তব্য নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না জাফর। অথচ বাঘা বাঘা সমালোচকের প্রশংসা পাওয়া লেখাটিকে শক্ত যুক্তির ধারে দিব্যি নাকচ করে দেয় মুনতাসীর। তার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা ছাড়া আনাড়ি লেখকদের শুধু লেখার জন্যে লিখে যাওয়াকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেন আহমদ ছফা।
হঠাৎ একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অরাজকতা সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসীদের আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত শিক্ষার্থীরা লুকিয়ে পড়লে সেই খালেদকে রক্ষায় এগিয়ে আসে মুনতাসীর। খেলার সরঞ্জামাদি যখন অস্ত্র হয়ে উঠে আসে কতিপয় সন্ত্রাসীর হাতে, আর তারই দাপটে গোটা ক্যাম্পাস তারা দাঁপিয়ে বেড়ায়, তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়ে অবলীলায় লেখক বলে যান-
বিশজন হকিস্টিকধারী ছ’হাজার ছাত্রকে ন্যায্য অধিকার থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
কঠিন বাক্যের ঝনঝনানি ছাড়াই ছোট ছোট অথচ শান্ত শব্দের মাধ্যমে তীব্রভাবে চোখে আঙুল দিয়ে লেখক দেখিয়ে দেন বড় বড় বুলির অকার্যকারিতা। নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে কোনো প্রকার ভণিতা ছাড়া ভাবলেশহীনভাবেই বলে যায় গল্পের মুনতাসীর। তার মতে,
আমাদের রক্তে মাংসে সত্যের আগুন জ্বলে না। রোমান্টিকতার বাইরে এক কদম দেবার সামর্থ্যও আমাদের নেই।
খালেদ যখন মুনতাসীরের তপ্তবাক্যে অভিভূত হয়ে পড়ে, যখন দীর্ঘদিনের ধুলো জমে থাকা প্রশ্নগুলো পুনরায় মনের আকাশে উদিত হয়, তখন আনমনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সেই মুনতাসীরকে- “কী নেই আমাদের?” প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন ছুড়েই ক্ষান্ত হয় না মুনতাসীর। ভণ্ডামির পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের মহড়া চালানো এ সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে কঠিন কথাগুলোকেই সহজ ও স্পষ্টভাবে বলে যায় সে,
কী নেই আমাদের? মোল্লা আছে, মৌলানা আছে, রদের কথা লেখার সাহিত্যিক আছে, যাত্রাদলের রাজনীতি আছে, ড্রয়িং রুমের সংস্কৃতি আছে, গুলিস্তান পর্যন্ত লং মার্চ আছে। মেঘনার তরল পানির মতো স্তরে স্তরে কুসংস্কার আছে, অত্যাচার আছে, নির্যাতন আছে। দোকানদার আছে, শিল্পপতি আছে, মাদ্রাসা, মসজিদ, অধ্যাপক, সাংবাদিক সব আছে। কী চাই বলুন না।
এ গল্পে অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র কথক জাফর। নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত বিষয়কে বর্ণনার সময় তার দ্বিধাবিভক্ত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। একটি মানুষ ও তার ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয় হলেও শুধু বন্ধু এবং পরিচিতদের মাঝে নিজ অবস্থান খোয়াতে চাওয়ার ভয়ে ভালোলাগার চেয়ে বন্ধুদের প্রাধান্য দেয়া কিংবা সময়ের সাথে সাথে অবস্থান পরিবর্তন এবং নিজ স্বার্থসিদ্ধির পর বাকিদের ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত মানুষের নৈতিক সংকীর্ণতাকেই তুলে ধরেছেন লেখক। একসময় যে মুনতাসীর এতটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল, তাকেই সময়ের আবর্তে ভুলে যাওয়া কিংবা পত্রিকায় গ্যেটেকে নিয়ে দীর্ঘ লেখা ছাপানোর পরও নাম উল্লেখের পর তাকে চিনতে না পারাকে ‘চাকরি পেয়ে কর্তব্যের খাতিরে লিখে যাওয়া বলা’ এ সবই এমন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা কি না ঐ আবর্তের বাইরে বেরোতে পারে না। সময়ের পর সময় কেটে যায়, অথচ চাওয়া আর পাওয়ার মাঝের দূরত্ব ঘোচাতে পারে না যে মানুষগুলো, তাদেরই প্রতিনিধি জাফর।
সমাজের ভণ্ডামির চিত্রও মুনতাসিরের মাধ্যমে বলে যান আহমদ ছফা,
যাদের ভয়ঙ্কর প্রগতিশীল মনে করে সভা করে গলায় মালা দুলিয়ে দেই, তারাও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ভালো করে টিপে দেখুন, দেখবেন, মানুষ পঁচা গন্ধ বেরোয়। ভেতরে নোংরা, ওপরের চটকদার চেহারাটুকুই চোখে পড়ছে। রাজনীতিবিদেরা যুবকদের সমাজ পরিবর্তনের কাজে না লাগিয়ে, তোষামোদে কাজে লাগিয়েছে। তাতে করে যুবশক্তির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে।
বাস্তবতার এমন অকিঞ্চিৎকর উপস্থাপন আহমদ ছফার লেখাতেই জীবন পায়।
বিশ্ববিদ্যালয়, যা কি না একজন শিক্ষার্থীর মেধা-মনন-চিন্তাকে বিস্তৃত করার জায়গা বলেই পরিচিত, সেখানটা আদতে কতটা মেধার বিকাশ হচ্ছে আর কতটা বাকি জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে পার করার একটি কাগজিক দলিল হিসেবে সার্টিফিকেটকে অর্জনে ব্যস্ত, তার নিখুঁত উপস্থাপন এ গল্প।
যে সার্টিফিকেটের জন্যে এত তপস্যা, পদে পদে এত কষ্ট, কুইনিন মিকচারের মতো এত লেকচার গেলা, আপাতত তার এক অধ্যায়ের ইতি হল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গেছে শিক্ষার্থীর। কিন্তু তার মাঝে আন্দোলন সংগ্রামের জন্যে যতটা সক্রিয়তা আমরা এখানে দেখেছি ততটাই দেখেছি পড়াশোনা এবং তদসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে উদাসীনতা। একই কথা ‘যদ্যপি আমার গুরু’তেও আহমেদ ছফাকে উল্লেখ করতে দেখা যায়।
সমাজ পরিবর্তনের নিয়মিত পথে না হেঁটে ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছেতে খালেদ ও জাফরকে সঙ্গী পেয়ে কাজে নেমে পড়ে মুনতাসীর। ‘অতন্দ্র’ প্রকাশের দৃঢ় প্রত্যয় তাকে করে তোলে দুর্নিবার। সকালে প্রুফ দেখা, তারপর বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য দোরে দোরে ঘুরে বিকেলে টিউশনি আর নিয়মিত ক্লাস টিউটোরিয়াল মুনতাসীরকে ক্লান্ত করলেও দমাতে পারে না। তাকে দমিয়ে দেয় বন্ধুরাই। ‘বাঙালির ঝোঁক’ বলে যে ভদ্রগালি এদেশে প্রচলিত, সেই বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে সময়ের সাথে সাথে হাত ছেড়ে দেয় বন্ধুরা। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অটল মুনতাসীর যখন তবুও হাল ছাড়ে না তখন এক সময়ের সাহসী যুবকটিই বাকিদের কাছে হয়ে যায় হাসির পাত্র। কথকের ভাষায়,
তাকে দেখলে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বেশ একটা হাসির সাড়া পড়ে যায়। কেন হাসে বলতে পারব না। হয়তো হি হি করে হেসে আমাদের মতো অগভীর মানুষেরা একধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকি। যেমন করে শুষ্ক স্লোগান আওড়াই, ইংরেজি ডিটেক্টিভ উপন্যাস পড়ি, হিন্দি ছবি দেখি তেমনি করে আমরা হাসি।
একসময় পড়াশোনার সত্যিকার ব্যবহার দেখে অব্যহতি নেয়া মুনতাসীর ভীরে যায় নিচুতলার মানুষের সাথে। তাদেরকে নিয়ে, তাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম নিয়ে মুনতাসীরের চোখ দিয়ে আহমেদ ছফা দেখিয়ে যান-
জীবন ক্ষয় হচ্ছে চোখের সামনে। উলঙ্গ অভাব জীবনের বোঁটা ধরে টানাটানি করছে। হতাশা কালো ভালুকের থাবার মতো চেপে ধরছে। চোখের সামনে মালিক শ্রম চুরি করছে। সবকিছুর বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে জীবন ঝিলিক দিয়ে জাগছে। কী তার জিঘাংসা, কী তীব্র দুঃখ, আঘাতে হিমালয়ও বুঝি ধসে পড়বে।
গল্পের অন্যতম আরেকটি চরিত্র তহুরা। প্রেমময় নারী তহুরা সকল পরিস্থিতিতে ভালোবাসার মানুষের পাশে থেকে সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে অবিচল থাকলেও মুনতাসীরের সিদ্ধান্ত তাকে দূরে ঠেলে দেয়। কিন্তু টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে নিয়ত যুদ্ধ করে যাওয়া জীবনের শেষ সময়ে এসে স্বার্থপর এ পৃথিবীর একমাত্র অর্জন তহুরাকেই স্মরণ করে মুনতাসীর।
নিহত নক্ষত্র শুধুই এক ছোট গল্পই না, বরং একটি ইতিহাস। একটি দেশকে গড়ার সূতিকাগার যে বিশ্ববিদ্যালয়, একটি দেশকে বিনির্মাণের হাতিয়ার যে যুবসমাজ, তাদেরকে স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যবহার এবং তাদের ভাবনা ও কাজের মাঝের ক্রমবর্ধমান দূরত্বকে লেখক অত্যন্ত বাস্তবিকভাবে তুলে ধরেছেন। মানুষের চরিত্রের দ্বিচারিতা, ছাত্ররাজনীতির নামে রোম্যান্টিসিজমের চর্চা, জানার অগভীরতা- এ সবই তার লেখায় উঠে এসেছে সূক্ষ্মভাবে। আর এ সবকিছুর মাঝে ব্যতিক্রমী একজনের সমাজকে পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে নেমে পড়া জীবনযুদ্ধে ঝরে পড়ার গল্প ‘নিহত নক্ষত্র’।
আহমদ ছফা তার লেখার দ্বারা অনবরত সমাজের কুৎসিত অথচ বাস্তব রূপ দেখিয়ে গেছেন। ১৯৬৯ সালে লেখা এ রচনার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও সেই চিত্রের আদতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজের ভবিষ্যৎ উদ্ধারে সকলে তৎপর না হলে আরো পাঁচ দশক পরেও একই গল্প একই অনুভূতির জন্ম দেবে অন্য কোনো মুনতাসীরের মনে।