‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের হোসেন মিয়ার কথা মনে আছে? হোসেন মিয়া সেই ব্যক্তি, যিনি গ্রামের অসহায়, গরীব এবং সহজ-সরল মানুষকে জীবনের গতিপথ পাল্টানোর লোভ দেখিয়ে ময়নাদ্বীপ নিয়ে যেতেন। এই ময়নাদ্বীপকে তিনি মানুষের কাছে উপস্থাপন করতেন এক টুকরো স্বর্গ হিসেবে, যেখানে কেবল সুখ আর সুখ। আর সেই সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে মানুষ তার স্বপ্নের নৌকা ভাসিয়ে ময়নাদ্বীপ যখন পৌঁছুতো, তখন আকাশ থেকে উড়ন্ত পাখির মাটিতে পতনের মতোই এক ধাক্কায় তাদের সব আশা ভরসা ভেঙে যেতো। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাসের এ দৃশ্যপট কাল্পনিক হলেও অনুরূপ ঘটনা বাস্তবেও ঘটেছে, কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে, ভিন্ন সময়ে।
অষ্টাদশ শতকের ঘটনা, যখন ফ্রান্সে হোসেন মিয়া রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন জন ল। ফ্রান্সের ডিউক অব অরলিন্সের সাথে ব্যক্তিগত খাতিরের কল্যাণে তিনি দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নির্ধারণী পর্যায়ে চলে যান। দ্রুতই তিনি ফরাসি সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে বহাল হন এবং ‘জেনারেল ব্যাংক’ নামক একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাংকের আওতায় জন ক্রয় করেন ‘মিসিসিপি কোম্পানি’, যা কিনা উত্তর আমেরিকায় সুবিশাল ফরাসি কলোনির উন্নয়নের দায়িত্ব পায়। দায়িত্ব নিয়েই মিসিসিপি কোম্পানি ফ্রান্সের জনগণকে মিসিসিপি সম্বন্ধে অলীক সব গল্প শোনালো। তারা মিসিসিপির শেয়ারে দাম উর্ধ্বাকাশে চড়িয়ে দিলো এ-ই বলে যে, সম্পদে সমৃদ্ধ মিসিসিপিতে দু’হাত ভরে আয় করা যাবে। অথচ দিনশেষে সেই মিসিসিপি ছিল ময়নাদ্বীপের মতো নিছক গপ্পো।
মিসিসিপি বাবল গল্পের শুরু ১৭১৫ সালে। ফরাসি সরকার তখন দেউলিয়া হবার দ্বারপ্রান্তে। উপায়ান্তর না দেখে তারা সরকারি সুদের হার কমিয়ে দিয়ে জনগণের উপর ব্যাপক হারে কর চাপিয়ে দিলো। কিন্তু, এতে কাজের কাজ কিছু তো হলোই না, বরং অর্থনীতি আরো টালমাটাল হলো। সরকারের এহেন অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে ফ্রান্সে স্বল্প মাত্রায় শুরু হলো অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রামানে শুরু হলো ব্যাপক ওঠানামা। উল্লেখ্য, ফরাসি সরকার তখন পরিচালিত হতো কয়েকজন রাজপ্রতিনিধির দ্বারা, যারা ‘রিজেন্ট’ নামে পরিচিত ছিলেন। রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের বয়স তখন মাত্র ৫ বছর, যে কারণে রিজেন্টরাই দেশ পরিচালনা করতেন। এই রিজেন্টদের মাঝে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ডিউক অব অরলিন্স। তিনিই সমাধান হিসেবে জন ল’কে দৃশ্যপটে আনবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
জন ল অবশ্য সেসময় অর্থনীতির একজন উদীয়মান পণ্ডিত। স্কটল্যান্ডের এক ধনী ব্যাংকারের ঘরে জন্ম নেয়া এই অর্থনীতিবিদ মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই নিজের বাবার সাথে ব্যাংকের কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন এবং অর্থনীতি অধ্যয়ন করতেন। অবশ্য পিতার মৃত্যুর পর তার জীবন বেশ নাটকীয় হয়ে উঠেছিল। তিনি অর্থনীতি নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে লন্ডন পাড়ি জমান। সেখানে গিয়ে পড়ালেখা তার হয়নি, উল্টো জুয়ার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। একবার এক স্থানীয়ের সাথে জুয়ার আসরে মারামারি করে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন জন। এ যুদ্ধে তিনি মুহূর্তেই তার প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যা করতে সক্ষম হলেও পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পাননি। লন্ডনের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু চতুর জন কিছুকাল জেলে কাটিয়ে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ইংল্যান্ড থেকে পালান।
ইংল্যান্ড থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে পুনরায় অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন জন। আমস্টারডাম, ভেনিস আর জেনোয়ার মতো শহরে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে ১৭০৫ সালে দেশে ফেরেন। সে বছরই তিনি মুদ্রার প্রকৃতি নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি মূল্যবান ধাতব মুদ্রার (সোনা, রূপা) পরিবর্তে কাগুজে মুদ্রা ব্যবহারের উপকারিতা বর্ণনা করেন। এই প্রবন্ধ তাকে অর্থনীতিবিদ হিসেবে প্রথম সুনাম অর্জনে সহায়তা করে। ব্যাংক ব্যবস্থা এবং মুদ্রা ব্যবস্থার উপর তার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা ছিল সত্যিই মূল্যবান।
এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে দেশের সংকট কাটাতেই তাকে স্মরণ করেছিলেন ডিউক অব অরলিন্স। জন দেখলেন, নিজের মুদ্রানীতি প্রয়োগের এটাই মোক্ষম সুযোগ। তিনি জেনারেল ব্যাংকের মাধ্যমে কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষের সংগ্রহে থাকা স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার গচ্ছিত রাখার বিনিময়ে কাগুজে মুদ্রা সরবরাহ শুরু করে জেনারেল ব্যাংক। আর ব্যাংকের রিজার্ভ গঠিত হয় প্রচুর পরিমাণ শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, এটিই ছিল ফ্রান্সে প্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন।
এদিকে, জন ল’র প্রভাব তখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। নিজের প্রভাব খাটিয়ে তিনি ‘মিসিসিপি কোম্পানি’ নামক ধুঁকতে থাকা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি কব্জা করেন এবং এর নাম দেন ‘কম্পানি দো’ক্সিদো’ বা পশ্চিমা কোম্পানি। তবে তখনো এটা ‘মিসিসিপি কোম্পানি’ নামেই লোকমুখে পরিচিত ছিল। এই কোম্পানিকে ফরাসি সরকার মিসিসিপি রাজ্যে উন্নয়নের জন্য একচেটিয়া দায়িত্ব প্রদান করে। এই রাজ্য বর্তমানকালে আমেরিকার বিশাল লুইজিয়ানা প্রদেশ থেকে শুরু করে কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মিসিসিপি কোম্পানি সাধারণ মানুষের মাঝে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয় যে মিসিসিপি রাজ্যে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন- কয়লা, মূল্যবান ধাতু যেমন সোনা, রূপা আর মূল্যবান পশুপাখির চামড়া পাওয়া সম্ভব।
এদিকে এই কোম্পানির ক্ষমতা ও প্রভাব এত বৃদ্ধি পায় যে কয়েক মাসের মাথায় এই কোম্পানি ইউরোপের বাইরে ফ্রান্স সরকারের যাবতীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলো। শীঘ্রই সরকারি রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্বও এই কোম্পানির হাতেই গেলো। এমতাবস্থায় জন ল নিজের ‘যুগান্তকারী’ পরিকল্পনা (অন্তত তিনি ভাবতেন, তার পরিকল্পনা যুগান্তকারীই হতে চলেছে) প্রণয়ন শুরু করেন। ফরাসি সরকারের ঋণ পরিশোধ পরিকল্পনাকে তিনি নিজের মতো করে ঢেলে সাজান এবং সরকারি ঋণ কোম্পানির শেয়ারের বিনিময়ে ঋণ পরিশোধ করার পদ্ধতি চালু করেন।
১৭১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মিসিসিপি কোম্পানি তাদের ৫০০ লিভার (তখন ফরাসি মুদ্রার নাম ছিল লিভার) মূল্যের শেয়ার বাজারে ছাড়া শুরু করে। এ শেয়ার দ্বারা ব্যাংক নোট কেনা কিংবা সরকারি ঋণ পরিশোধ করা যেতো। জন ল প্রচার করলেন, এ শেয়ার ক্রয় করে মিসিসিপি রাজ্যে বিনিয়োগ করে দ্রুত বিত্তশালী হওয়া সম্ভব। আর বিনিয়োগকারীরাও জনের প্রতিটি তথ্য সানন্দে গ্রহণ করেছিল। জানুয়ারিতে যে শেয়ারের মূল্য ছিল ৫০০ লিভার, সেই শেয়ারের মূল্য ডিসেম্বর নাগাদ ১০ হাজার লিভারে দাঁড়ায়! মাত্র ৩৬৫ দিনের ব্যবধানে মিসিসিপি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য আকাশ ছুঁয়ে ফেললে ধনী-গরীব আর মধ্যবিত্ত, সর্বস্তরের মানুষ এই শেয়ার ক্রয় করেন অধিক মুনাফার আশায়। আর জন ল ততদিনে সমগ্র ইউরোপের সবচেয়ে বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন তার অবিশ্বাস্য মূল্যের শেয়ারের বদৌলতে।
এদিকে সাধারণ জনগণের মাঝে শেয়ার ক্রয়ের উন্মাদনা দেখে সার্বিক পরিণতির কথা ভুলেই গিয়েছিল জেনারেল ব্যাংক। তারা মানুষের অসীম চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকনোট বাজারে ছেড়েই যাচ্ছিল। এতে করে এক বছরের মধ্যে বাজারে তরল অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ১৮৬ শতাংশ! মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহ পরিণতির সূচনা হতেও সময় লেগেছিল ঐ ১ বছরই। ১৭১৯ সালের শেষ নাগাদই ফ্রান্সের বাজারে পণ্যমূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায়, বাসা-বাড়ির ভাড়া বৃদ্ধি পায় ২০ গুণের মতো! ইতিহাসবিদরা বলেন, বাড়ি ভাড়া দেবার জন্য বাড়িওয়ালারা তাদের সকল জমির উপর বাড়ি নির্মাণ করতে শুরু করেন। এমন একটা সময় এসেছিল, যখন মনে হচ্ছিল ফ্রান্সে ভাড়াটিয়ার চেয়ে বাড়ি বেশি!
এদিকে দ্রুত শেয়ারের দাম বৃদ্ধি ও এর সার্বিক পরিণতির কিছুটা আঁচ পাচ্ছিলেন জন নিজেও। কিন্তু তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেননি অন্য কারণে। জেনারেল ব্যাংক তাদের কাছে গচ্ছিত সোনা, রূপার তুলনায় ৩/৪ গুণ বেশি কাগুজে নোট বাজারে ছেড়ে দিয়েছে ততদিনে। গচ্ছিত সম্পদ ও তরল অর্থের মধ্যে এই বিপুল ব্যবধান কমাতে তিনি মিসিসিপি উপনিবেশ থেকে সোনা-রূপার স্বদেশমুখী প্রবাহের আশায় ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মিসিসিপির উপর বিনিয়োগের অর্থ দিয়ে তিনি ঘাটতি মেটাবেন। কিন্তু হলো উল্টো।
১৯২০ সালের শুরুর দিকেই মিসিসিপি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য পড়তে শুরু করে। অনেক বিনিয়োগকারীই মূল্য চূড়ায় থাকতে লাভ তুলে নিতে চাইছিলেন। তারা তাদের শেয়ার বিক্রয় করে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ফেরত নিতে গেলে জন আইন করে শেয়ার বিক্রয়ের সর্বোচ্চ সীমা মাত্র ১০০ লিভার নির্ধারণ করে দেন। তার এই আইনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। এর কিছুকালের মধ্যেই কোম্পানির শেয়ার মূল্য অতিরিক্ত নির্ধারিত হয়েছে, এমন ঘোষণা দিয়ে মূল্য কমিয়ে দেন জন। শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ায় ব্যাংকনোটের মূল্যও ৫০ শতাংশ পড়ে যায়, শুরু হয় জনরোষ। গণ আন্দোলন শুরু হয়ে যেতে পারে, এ ভয়ে ব্যাংকনোটের মান আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিলেও ব্যাংকে গচ্ছিত মূল্যবান ধাতব মুদ্রার অভাবে কাগুজে মুদ্রার সাথে ধাতব মুদ্রার বিনিময় সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে গণ-অসন্তোষ কমার পরিবর্তে আরো বৃদ্ধি পায়।
এদিকে দুর্যোগ আঁচ করতে পেরে অনেক বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী একযোগে শেয়ার বিক্রি করায় শেয়ারের দাম এক ধাক্কায় ১,০০০ লিভারে নেমে আসে। অবশিষ্ট বিনিয়োগকারীরাও ততদিনে মিসিসিপি রাজ্যের সোনা-রূপায় সমৃদ্ধ হবার ছেলে ভোলানো গল্পের সত্যতা নির্ণয় করে ফেলেছেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। একসময়ের মিলিয়নিয়াররা নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন, শ্লোগান দেন জনের বিরুদ্ধে। জনের ভুলে ভরা পরিকল্পনায় এত সংখ্যক মানুষের সর্বনাশ হওয়ায় ততদিনে তার কোম্পানির দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ার তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে চলে গেছে।
শুধু বিনিয়োগকারীদের সর্বনাশই নয়, জন পুরো ফরাসি অর্থনীতিরই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। একই সময়ে ব্রিটেনেও ‘সাউথ সি বাবল’ নামক একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকেন্দ্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেছিল। দুয়ে মিলে পুরো ইউরোপের অর্থনীতিকেই দুর্বল করে দেয়। ফ্রান্সে তো মিসিসিপি বাবলের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কয়েক দশক ধরে ফ্রান্সে চলতে থাকে মন্দা। এ মন্দার রেশ ধরেই ফরাসি বিপ্লবের জ্বালানী পুঞ্জীভূত হয়েছিল। পুরো ফ্রান্সসুদ্ধ মানুষের শত্রু তখন জন ল। কিন্তু জন কোথায়? তাকে তো পাওয়া যাচ্ছে না! নাহ, জনকে ফরাসিরা খুঁজে পায়নি। শেয়ারবাজার ধ্বসের অন্তিমকালে নারীর ছদ্মবেশে দেশ থেকে পালিয়েছিলেন এই ব্যর্থ অর্থনীতিবিদ!