ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর একটা বিশাল অংশও একে ঘিরেই তৈরি হয়েছে। যাদের বেশিরভাগেরই মূল গল্প হলো ধ্বংসের অতলের দিকে আরো দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকা পৃথিবী।
এখন পর্যন্ত এরকম যতগুলো সিনেমা দেখেছেন বা গল্প পড়েছেন, তাদের মধ্যে কয়টায় পৃথিবীর সামাজিক ব্যবস্থা ধ্বসে পড়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে বায়ু দূষণের প্রভাবকে দায়ী করা হয়েছে ভাবুন তো! খুঁজে পাচ্ছেন না সম্ভবত। প্রচ্ছন্নভাবে কোথাও কোথাও এলেও, মূল বিষয় হিসেবে এরকম কিছুর দেখা পাওয়া যায় না খুব একটা। অথচ গবেষণা বলছে, বায়ু দূষণ মস্তিষ্কের উপর যে প্রভাব ফেলে, তার ফলে মানুষের বিবেচনা বোধ এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। বেড়ে যেতে পারে মানসিক সমস্যা ও অপরাধ প্রবণতা।
এখন প্রশ্ন হলো বায়ু দূষণের প্রভাবে আসলেই কি অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে? ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হবে।
বর্তমান পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ শহরে বসবাস করে। ফলে বাসে বা গাড়িতে যাতায়াতের সময় নিয়মিতহারে প্রচণ্ডরকম দূষিত বাতাস টেনে নিচ্ছে মানুষ।ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেন (WHO) বলছে, পৃথিবীর প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই ভয়াবহ দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছে। বর্তমান হিসেবে প্রতিবছর প্রায় সাত মিলিয়ন মানুষ কেবল বায়ু দূষণের প্রভাবে মারা যাচ্ছে। তাহলে ভাবুন তো আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজের চিত্রটা কেমন হতে যাচ্ছে?
২০১১ সাল। সেফি রথ নামের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এক শিক্ষক বায়ু দূষণের বিভিন্ন প্রভাব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। ভাবলেন, চিন্তাশক্তির উপর এর কোনো প্রভাব পড়ে কিনা- একটুখানি পরীক্ষা করে দেখা যাক।
শিক্ষার্থীদের কয়েকটি পরীক্ষার দিনকে বেছে নেওয়া হলো। সেসব দিনে বায়ু দূষণের মাত্রা কেমন থাকে, সেটা দেখা হলো। বিশেষ করে বায়ু বাদে বাকি সব উপাদান যেন একই থাকে, সেটা খেয়াল রাখা হলো। যেমন, ভিন্ন ভিন্ন দিন পরীক্ষা নেওয়া হলেও অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী একই হতে হবে। পরীক্ষা হতে হবে একই জায়গায়, প্রশ্নের মান হতে হবে একইরকম ইত্যাদি।
গবেষক দল আবিষ্কার করলেন, বায়ু দূষণের মাত্রা যেদিন বেশি ছিল, সেদিন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাও খারাপ হয়েছে। তার মানে, বায়ু দূষণ আসলেই শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তির উপর খারাপ প্রভাব ফেলছে।
বাস্তব জীবনে যা হয়, গবেষক দল তারপর সেটাই দেখালেন। যারা সেদিনের পরীক্ষা খারাপ করেছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে গেছে। তুলনামূলক ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের পড়ার সুযোগ না পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। যার ফল পড়বে তাদের চাকরি জীবনেও। যেটা আবার তাদের ভবিষ্যত পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলবে। মানে, কেবল পরীক্ষার দিনটায় যে এলাকার বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি থাকবে, সারা জীবনের জন্য সে এলাকার শিক্ষার্থীরা কোনো কারণ ছাড়াই অনেকটা পিছিয়ে যাবে। পরবর্তী প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১৬ সালে, আরেকদল গবেষক এ নিয়ে পরীক্ষা করে একই ফলাফল পেলেন।
রথ এবং তার দল পরবর্তীতে তাদের গবেষণা আরেক ধাপ এগিয়ে নিলেন। দুই বছরে লন্ডনের ৬০০ ইলেক্টোরাল ওয়ার্ডে (ভোটের হিসেবে ভাগকৃত এলাকা) যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেসব তথ্য নিয়ে কাজ করলেন। দেখা গেল, যেরকম এলাকাই হোক না কেন, ভয়ংকর সব অপরাধ যেসব দিনে ঘটেছে, সেসব দিনের বায়ু দূষণের মাত্রা অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি ছিল। হ্যাঁ, এর মাঝে অন্য অনেক ব্যাপারই থাকতে পারে। শুধু এটুকু যুক্তি দিয়ে গবেষণার ফলাফল টেনে ফেলা যায় না। তাহলে, এই ব্যাপারটা সঠিক কিনা, সেটা পুরোপুরি বোঝার উপায় কী?
গবেষকরা কিছু এলাকা বেছে নিয়ে, দূষিত বায়ু শনাক্ত করে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বাতাস যেদিকে বইবে, দূষিত বায়ু ধীরে ধীরে সেদিকেই সরে যাবে। সে হিসেবে, একটা শহরে সময়ে সময়ে বায়ু দূষণের পরিমাণ কম-বেশি হবে। রথের ভাষায়-
আমরা কেবল সেই দূষিত বায়ুমেঘটাকে অনুসরণ করে গিয়েছি। সেই সঙ্গে সেসব এলাকার অপরাধ প্রবণতার দিকেও লক্ষ্য রেখেছি। দেখা গেল, দূষিত বায়ু যে এলাকা দিকে যাচ্ছে, অপরাধের হার তুলনামূলকভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
এ গবেষণা থেকে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলেও, ভয়াবহ অপরাধগুলোর উপর এর প্রভাব সেভাবে বোঝা যায়নি। কিন্তু ২০১৮ সালের আরেক গবেষণা থেকে খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধের উপরেও এর প্রভাবের সম্ভাব্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এই গবেষণাটি এমআইটির গবেষক জ্যাকসন লু’র নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। প্রায় নয় বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ৯ হাজারের মতো এলাকা নিয়ে কাজ করেছেন তারা। দেখা গেল, ছয়টি ভয়াবহ অপরাধ যেমন খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ইত্যাদির উপরেও বায়ু দূষণের প্রভাব পড়ছে। এবং যেসব শহরে দূষণের মাত্রা বাড়ছে, সেখানে অপরাধের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সে শুধু তথ্য বিশ্লেষণই করে না, বরং বিশ্লেষিত তথ্য ব্যবহার করে অনুমান করতে পারে, কী ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। দেখা গেল, জ্যাকসন লু’র গবেষণা শুধু তথ্য বিশ্লেষণই করছে না, বরং বায়ু দূষণের মাত্রা হিসেব করে বলে দিতে পারছে, কোন শহরে কোন দিন অপরাধের হার কেমন হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই গবেষণায় বয়স, লিঙ্গ, চাকরিজীবীদের পেশাগত পদ এবং সেই হিসেবে তাদের আয়-ব্যয়, জনসংখ্যা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো (ইংরেজিতে ফ্যাক্টর বা ভ্যারিয়েবল বলে) হিসেবে রাখা হয়েছে।
পরবর্তীতে আরেকদল গবেষক অপরাধমূলক আচরণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন, প্রতারণা কিংবা স্কুল পালানো থেকে শুরু করে ছোটখাটো চুরি, ভাংচুর ইত্যাদির উপরেও বায় দূষণের প্রভাব আছে। এই গবেষণায় ৬২৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ডায়ানা ইউনান এবং তার সহকর্মীরা এই গবেষণা চালিয়েছেন।
তারা বিশেষ করে বাতাসে PM2.5 কণার দূষণের দিকে খেয়াল রেখেছিলেন। মানুষের চুলের প্রায় ৩০ গুণ ছোট যেসব কণা বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে বায়ু দূষণ ঘটায়, এরাই পিএম ২.৫ নামে পরিচিত। কল-কারখানা, মোটর গাড়ি বা পুড়ানো কাঠ থেকে এ ধরনের কণা উৎপন্ন হতে পারে এবং বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে পারে।
যেহেতু দীর্ঘদিন কিছু নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ এ ধরনের দূষিত বায়ু শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিচ্ছে, মোটামুটি ১২ বছরের মতো এ ধরনের দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিলে কী অবস্থা হতে পারে, সেটা হিসেব করে দেখেছেন তারা। তাদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আগের গবেষণাগুলোকে ভালোভাবে সমর্থন করেছে। এই গবেষণায় ইউনান এবং তার দল পারিবারিক শিক্ষা, দারিদ্য, এলাকার প্রতিবেশীদের ব্যবহারসহ ইত্যাদি অনেকগুলো ফ্যাক্টর ধরে ধরে হিসেব করে দেখেছেন। এবং দেখা গেছে, বায়ু দূষণের প্রভাব বাদ দিয়ে শুধু অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলোর কথা হিসেব করলে মানুষের এরকম অপরাধ প্রবণতাকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না।
শুধু তা-ই নয়, মানুষের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। জ্যাকসন লু এবং তার সহকর্মীরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন, বায়ু দূষণের প্রভাব মস্তিষ্কের স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায়।
তারা বিভিন্ন দেশের মানুষকে আলাদাভাবে বসিয়ে, খুব দূষিত এলাকার ছবি দেখিয়ে জানতে চাইলেন, তারা সেসব এলাকায় বসবাস করতে রাজি আছেন কিনা। এর মধ্যে আমেরিকান যেমন ছিলেন, তেমনি ভারতীয় অধিবাসীও ছিলেন। এ সময় তাদের মস্তিষ্কের ব্রেইনওয়েভ, পালস ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। লু’র ভাষায়-
আমরা তাদেরকে মানসিকভাবে বায়ু দূষণের অনুভূতি দিয়েছি। বলেছি, এরকম পরিবেশে থাকতে তাদের কেমন লাগবে। একইসঙ্গে পরিষ্কার কোনো এলাকায় থাকতে কেমন লাগবে, সেটাও তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, শুধু মানসিকভাবে দূষিত এলাকায় থাকার অনুভূতিও মানুষের মাঝে দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা এবং স্বার্থপর ভাবনা জাগিয়ে তোলে। শান্ত মাথায় অপরাধ করা বা কাউকে ঘুসি মেরে বসার চেয়ে, উদ্বিগ্ন অবস্থায় মেরে বসার সম্ভাবনা বেশি। তারমানে, বায়ু দূষণ আপনার ব্যবহারের উপর খারাপ প্রভাব ফেলছে।
গবেষকদের মতে, শুধু উদ্বেগ বা স্বার্থপর ভাবনাই না, জৈবিক কারণও আছে এর পেছনে। দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিলে আপনার মস্তিষ্ক প্রয়োজনের চেয়ে কম অক্সিজেন পায়। এরকম অবস্থায় সে যে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাছাড়া, দূষিত বায়ু নাক-কান-গলা-ফুসফুসের উপরেও প্রভাব ফেলে। এসবের ফলে মস্তিষ্কে স্নায়বিক সংযোগের ক্ষতি হতে পারে। এই ক্ষতিটা মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল লোবে হয়। আর, মস্তিষ্কের এই অংশটিই মূলত আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, বিবেচনাবোধ ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
২০১৯ সালের মার্চের এক গবেষণা বলছে, মানসিক সাস্থ্যের সঙ্গেও বায়ু দূষণের যোগ আছে। যেসব কিশোর-কিশোরী অনেক বেশি দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয়, তাদের মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। লন্ডনের কিংস কলেজের গবেষক জোয়ান নিউবুরি বলেছেন,
বায়ু দূষণ শরীরের জন্য ক্ষতিকর, এ কথা সবাই জানে। যেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর, রক্তের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে গেলে, সেটা মস্তিষ্কেরও ক্ষতি করবে। তাছাড়া, বায়ু দূষণের জন্য ডিমেনশিয়ার মতো রোগ হওয়ারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন গবেষকরা। ইউনান বলেন,
বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন বয়সী মানুষকে নিয়ে এ ধরনের গবেষণা হওয়া উচিত। যাতে আরো স্পষ্টভাবে আমরা সবকিছু বুঝতে পারি।
আশার কথা হচ্ছে, অনেক জায়গায় সরকারিভাবেই দূষণ কমানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়ায় দূষণের মাত্রা অনেকটা কমে আসার ফলে অপরাধ কমে গেছে বলে জানা গেছে। ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল থেকে লন্ডনে আল্ট্রা লো এমিশন জোন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে গাড়ি চালানোর ফলে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি বায়ু দূষণ ঘটলে আগের ১১.৫০ পাউন্ডের সাথে আরো ১২.৫০ পাউন্ড করে অতিরিক্ত জরিমানা করা হবে। সেই সঙ্গে ‘ক্লিনার এয়ার ফর লন্ডন’ উদ্যোগের অধীনে কম দূষণ ঘটায়, এমন অনেকগুলো গ্রিন বাস চালু করা হচ্ছে।
হ্যাঁ, কোনো একটা এলাকার বায়ু দূষণ নিয়ে আমরা রাতারাতি কিছু করে ফেলতে পারবো না। তবে, গাছ লাগানো, রাস্তায় প্লাস্টিক, পলিথিন ইত্যাদি না ফেলা- এ ধরনের কাজগুলো নিজে অভ্যাস করার চেষ্টা করলেই এ ব্যাপারে অনেকটা ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। শুধু মানবিকতা বোধ আমাদেরকে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। মানবিকতা নিয়ে সবাই যদি সবার পাশে দাঁড়াই, সচেতন হই- আশা করা যায় বায়ু দূষণের এই ভয়ানক প্রভাবও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো।