কল্পনা করুন তো, গভীর রাত। সুনসান নীরবতা চারদিকে। আপনি কোনো কারণে বাইরে বের হয়ে দেখতে পেলেন সূর্যটা ডুবে না গিয়ে ঝুলে আছে দিগন্তে। সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত কমলা আলোকরশ্মিতে আলোকিত হয়ে আছে দিগন্ত। অপার্থিব সেই আলোর আভায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে প্রকৃতি, চারপাশ। মধ্যরাতের সেই সূর্যের আলোয় আপনি পথে হাঁটছেন! অবিশ্বাস্য, তাই না? মধ্যদিবসের সুনীল আকাশে প্রজ্জ্বলিত সূর্য দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। সেই আমাদেরকে যদি মধ্যরাতের অন্ধকার আকাশে জ্বলন্ত সূযের কথা বলা হয় তাহলে চোখ কপালে উঠতেই পারে।
কিন্তু গভীর নিশীথে সূর্যের দর্শন কোন অবাস্তব বা অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা নয়। ‘নিশীথ সূর্য (Midnight Sun)’ একটি অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক ঘটনা। এক্ষেত্রে সূর্য দিনশেষে দিগন্তের ওপারে টুপ করে হারিয়ে যায় না, দিগন্তে স্থির থাকে। মানে এই ঘটনায় সাধারণত দিনের ২৪ ঘন্টাই সূর্যের আলো পাওয়া যায়। কখনো যদি সূর্য ডোবেও, তাহলে সেটা মাঝরাতে। ভোরে আবার সূর্য উদিত হতে দেখা যায়। নিশীথে সূয্যিমামার দেখা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে ইউরোপের দেশ নরওয়েতে।
আমাদের অনেকেরই জানা আছে নিশ্চয়ই, নরওয়েকে ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ বলা হয়। উত্তর নরওয়েতে প্রতিবছর গ্রীষ্মকালের কিছু সময়ে মাঝরাত্রেও সূর্য দেখা যায় বলেই এই আজব উপনামটি জুটেছে দেশটির কপালে ।
নরওয়েই কি একমাত্র ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’?
মানুষ শুধু নরওয়েকে ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ হিসেবে চিনলেও পৃথিবীতে আরো অনেক স্থান আছে যেখানে সূর্য সারারাত জেগে থাকে। আসলে সুমেরুবৃত্ত (উত্তর মেরু থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী অক্ষাংশ দূরে আঁকা একটি কাল্পনিক রেখা) থেকে উত্তরে অবস্থিত এবং কুমেরুবৃত্ত (দক্ষিণ মেরু থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী অক্ষাংশে কল্পিত রেখা) থেকে আরো দক্ষিণে অবস্থিত স্থানগুলোতে গ্রীষ্মকালে অস্ত যায় না। এজন্য এই জায়গাগুলোতে স্থানীয় সময় যখন মধ্যরাত, তখনও আকাশের দিকে তাকালে সূর্য দেখতে পাওয়া যায়। কুমেরুবৃত্তের পরে গবেষকদের তাঁবু ছাড়া আর কোনো জনবসতি নেই। তাই আমরা সেই এলাকার কোনো জায়গার কথা জানি না। তবে সুমেরুবৃত্ত পেরিয়ে গেলে অনেক জায়গা আছে যেখানে লোকবসতি আছে। আমরা জানবো সেই স্থানগুলোর কথা।
উত্তর মেরুর আগে, সুমেরুবৃত্তের পর আছে কানাডার বেশ কিছু এলাকা- আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, গ্রীনল্যান্ড, রাশিয়ার কিছু অংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা।
ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে উত্তরের স্থানে প্রায় দুই মাস সূর্য অস্ত যাওয়ার কথা ভাবেও না। আর ইউরোপের সর্বউত্তরের লোকবসতি নরওয়ের ভালবার্দ দ্বীপপুঞ্জে মোটামুটি ১৯ এপ্রিল থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সূর্যমামা দিগন্তে গা এলিয়ে বিশ্রাম নেন।
তাহলে, দেখা যাচ্ছে নরওয়ে ছাড়াও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সবগুলো দেশ, এমনকি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বাইরের অনেক এলাকায় নিশীথ সূর্যের দেখা মেলে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই মূলত নরওয়েতে এই আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। নরওয়ের অধিবাসীরা রাতে সূর্য দেখে আর আমরা দিনে দেখি। নরওয়ের গ্রীষ্মকালটা হয় দারুণ সুন্দর। কড়া রোদে বরফ গলে হিমবাহ বয়ে যায়, পাহাড়ি ঝর্ণারা গান গায়। রঙ-বেরঙের ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে প্রকৃতি। যেহেতু এ সময় সূর্য ডোবে না। তাই চাইলে সারাদিনই আপনি ঘুরে বেড়াতে পারবেন। গ্রীষ্মে নরওয়েতে ‘মিডনাইট সান’ নামক উৎসবের আয়োজন করা হয়।
আচ্ছা, নিশ্চয়ই আপনার সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে যে দিনে কোনো উৎসবে গিয়েছেন, কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় বাসায় চলে আসতে হয়েছে। তখন আফসোস করে ভেবেছেন, দিনটা যদি শেষ না হতো! আপনার এই ইচ্ছা পূরণ হতে পারেন নরওয়েতে! এখানে যেহেতু সূর্য ডোবে না, প্রাকৃতিকভাবে রাত হয় না। তাই এখানেই কেবল সম্ভব অফুরন্ত দিবস উৎসব। ‘মিডনাইট সান ফেস্টিভ্যাল’ হচ্ছে এমনই একটি উৎসব। এই সময় নরওয়ে থাকে উল্লাসে পরিপূর্ণ। তবে কি নরওয়ের মানুষজন ঘুমায় না? ঘুমায় তো। এখানে রাত হয় ঘড়ির কাঁটায়। কাজকর্ম চলে ঘড়ি ধরে। কারণ আবহাওয়া আর সূর্য দেখে সময় বোঝার উপায় থাকে না। আর রাতে সূর্য আসলে কতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তা নির্ভর করে আবহাওয়া, কুয়াশা, আকাশের মেঘ প্রভৃতি বিষয়গুলোর উপর।
নিশীথ সূর্য দীর্ঘসময় থাকলে
আমরা জেনেছি, দুই মেরু থেকে অগ্রবর্তী এলাকায় বছরের বিশেষ সময়ে মধ্যরাতে সূর্য দেখতে পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি মেরুর কাছাকাছি বা মেরুতে যাওয়া যায় তাহলে কী ঘটবে? সুমেরু বা কুমেরুবৃত্ত থেকে যতই মেরুর কাছাকাছি যাওয়া যায় ততই দীর্ঘদিন ধরে মাঝরাতে সূর্য দেখতে পাওয়া যায়। উত্তর বা দক্ষিণ মেরুতে সবচেয়ে বেশিদিন রাতে সূর্য আলো দেয়। আর এই সময়টা হচ্ছে ছয় মাস। এই ব্যাপারটিকেই বলা হয় মেরুদিবস। মেরুর বরফঢাকা প্রান্তরে কমলা রঙের বলের মতো সূর্য দিগন্তে ঠায় দাড়িয়ে থাকে যেন কার অপেক্ষায়।
ক্ষীণ অন্ধকারে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে নানা আকৃতির বরফখন্ডের আনাচে-কানাচে। অপার্থিব সুন্দর হয়ে প্রতিভাত হয় সেই দৃশ্য! সেই সাথে রহস্যময়ও বটে! একসময় সূর্যের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। আসে মেরুরাত্রি। দীর্ঘ ছয় মাস অন্ধকারে ডুবে থাকে মেরু। সময় বয়ে চলে। আবার সূর্য ওঠে। তাহলে বলা যায়, নরওয়ের নিশীথ সূর্য মেরুদিবসের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ মাত্র।
শুভ্র রাত্রি (White night)
রাতে তো থাকে অন্ধকারের রাজত্ব। চন্দ্র বা নক্ষত্রের আলো না থাকলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই রাত কিভাবে সাদা হতে পারে? অবাস্তব শোনাচ্ছে, তাই না? সাদা রাত্রি বা হোয়াইট নাইট আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য না ঠেকলেও নিশীথ সূর্যের মতোই এটিও একটি বাস্তব ঘটনা। একটি প্রাকৃতিক বিস্ময়। সুমেরুবৃত্ত বা কুমেরুবৃত্ত থেকে কিছুটা আগে, নিরক্ষরেখা থেকে ষাট ডিগ্রী চৌত্রিশ মিনিট অক্ষাংশের একটু পরে অবস্থিত স্থানগুলোতে গ্রীষ্মকালে মধ্যরাতে সূর্য না দেখা গেলেও মধ্যরাতে গোধূলীর (Midnight Twilight) দেখা মেলে। এ স্থানগুলো দিগন্ত থেকে ৬ বা ৭ ডিগ্রী নিচে থাকে। এই জায়গাগুলোতে সারারাত গোধূলীর আকাশের মতো মৃদু সূর্যের আলো থাকে। এ আলোয় পড়াশোনা বা দিনের অন্যান্য কাজ করা যায়। রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ সাদারাত্রির জন্য বিখ্যাত।
বছরের ১১ জুন থেকে ২ জুলাই সময়টাতে এখানে স্থানীয় সময় যখন মাঝরাত, তখন গোধূলী প্রত্যক্ষ করা যায়। জুন মাসের শেষ ১০ দিন এখানে বিশেষ আয়োজন থাকে, নাম White Night Festival। হোয়াইট নাইট ফেস্টিভ্যালে নানারকম জমকালো উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এ উপলক্ষ্যে আকাশে চোখ ধাঁধানো আতশবাজির প্রদর্শনী চলে। আর রক্তলাল রঙের পালতোলা নৌকা নানা রঙের আলোয় সাজিয়ে পানিতে ভাসানো হয়।
এ সময়টাতে স্কুলের শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ায় নিশ্চিন্তে আনন্দে মাতে ছেলেমেয়েরা। উচ্ছ্বাস-আনন্দে বিভোর থাকে সেন্ট পিটার্সবার্গ।
নিশীথ সূর্যের ঘটনা কেন ঘটে?
আসলেই কৌতুহলউদ্দীপক ব্যাপার, তাই না? মাঝরাতে সূর্য! এমনটা হয় কেন? সূর্যটা ডোবে না কেন? তবে কি সূর্য ডুবতে ভুলে যায়? উত্তরটা জানি চলুন। আমরা জানি, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে পশ্চিম-পূর্বে আবর্তন করছে। আবর্তন করার সময় পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর একটু হেলে থাকে। একটু বলতে পৃথিবী এর মেরুরেখার সাথে ২৩.৫ ডিগ্রী কোণ করে হেলে থাকে। কখনো হেলে থাকে উত্তর গোলার্ধের দিকে, কখনো দক্ষিণ গোলার্ধের দিকে। যখন যে গোলার্ধ সূর্যের দিকে থাকে সেই গোলার্ধে সূর্যরশ্মি খাড়াভাবে পড়ে এবং দীর্ঘসময় সূর্যের আলো পাওয়া যায়। ফলে দিন বড় হয়, রাত ছোট হয়। অক্ষাংশ যত বেশি হয় দিন তত বড় হয়। সূর্যের গ্রীষ্মকালীন উত্তরায়নের বা দক্ষিণায়নের সময় অনেক বেশি অক্ষাংশে অবস্থিত জায়গাগুলোতে গ্রীষ্মকালে সূর্য অস্ত যায় না।
তখন মেরু থেকে ১০০ কি.মি. এর মধ্যে অবস্থিত জায়গাগুলোতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত টানা সূর্যাস্ত ঘটে না, আর মেরুতে ছয় মাস। এর বিপরীত ঘটনা ঘটে শীতকালে। মেরুতে পূর্ব দিগন্তে উঁকি দিতেই পারে না ছয় মাস পর্যন্ত। আর মেরুর আগের স্থানগুলোতে কয়েক সপ্তাহ টানা রাত থাকে। উত্তর মেরুতে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর টানা ছয় মাস দিন থাকে আর এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধে টানা ছয় মাস থাকে রাত। আর দক্ষিণ গোলার্ধে যখন দিন তখন উত্তর গোলার্ধে রাত। এই এতসব আশ্চর্য ঘটনার কারণ একটাই, পৃথিবীর হেলে থাকা। এজন্যই পৃথিবী ঋতু বৈচিত্র্যের কল্যাণে একেক রুপে সাজে, এজন্যই নিশীথ সূর্য বা নিশীথ গোধূলীর মতো বিস্ময়কর ঘটনার অবতারণা ঘটে।
ফিচার ইমেজ – AwaraDiaries.com