Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানের আকাশে বিমর্ষ দুর্যোগের ঘনঘটা

সমৃদ্ধ ইতিহাস, অমলিন গৌরব, পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী বিধৌত খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত, নানা কিংবদন্তির আঁতুড়ঘর খ্যাত অনিন্দ্য সুন্দর প্রাচীন গ্রীসের কীর্তিগাঁথা বলে শেষ করা যায় না। এই দেশের গর্ভে জন্ম নিয়েছে থালেস, পিথাগোরাস, হিপোক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, থিওফ্রাস্টাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড প্রমুখের মতো জগৎ কাঁপানো বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা।

বিজ্ঞানের জন্ম ও সংক্ষিপ্ত বিস্তার প্রাচ্য ভূখণ্ডে হলেও, সে সময়ে কোনো জাতিই বিজ্ঞানকে প্রণালীবদ্ধভাবে আলোচনা করেনি, বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকটা ঢাকা পড়েছিল অনিচ্ছা ও আঁধারের অন্তরালে। যেমন, প্রাচীন মিসরে জ্যামিতির উদ্ভব হলেও সেটা ছিল পরিমিতির নামান্তর। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধন করলেও, মহাকাশের রহস্য নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এই দিকটার কথা চিন্তা করলে, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা ছিল সবার চেয়ে স্বতন্ত্র, আধুনিক ও এক ধাপ এগিয়ে। তারা যেমন লক্ষ্য করেছিল বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিকটা, তেমন নজর দিয়েছিল এর তাত্ত্বিক দিকেও। ফলে সর্বপ্রথম প্রণালীবদ্ধ বিজ্ঞানের পথ চলা শুরু হয় তাদের হাত ধরেই।

আজকে আমরা আধুনিক বিজ্ঞান, বা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি বলতে যা বুঝি তার প্রকৃত রূপকার প্রাচীন গ্রিকরা। এছাড়াও বিজ্ঞানের অনেক নতুন নতুন শাখার জন্ম দিয়ে তারা বিজ্ঞানকে একটা সংঘবদ্ধ অবস্থায় দাঁড় করাতে পেরেছিল। বিজ্ঞান উৎকর্ষের চুড়ায় আহরণ করা গ্রীসের জ্ঞান-বিজ্ঞানও একদিন তলানিতে এসে ঠেকে গেলো, ধ্বস ঘটলো অবরোহণের মাধ্যমে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়তিতে উত্থান-পতন দুটোই স্বভাবসিদ্ধ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যার উত্থান আছে, তার পতন আছে অবশ্যই। ঠিক কী কী কারণে গ্রিক বিজ্ঞানকে অন্ধকার আচ্ছাদন করেছে?

শিল্পীর তুলিতে প্রাচীন গ্রিস; source: twitter.com

প্রথমত, প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পর্যায়কালকে মোটা দাগে মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। পর্যায়কালের প্রথমভাগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেই স্বর্ণযুগকে নির্দেশ করে- যেটি স্থায়ী হয়েছিল দিগ্বিজয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের আমল পর্যন্ত। জনশ্রুতি অনুসারে, আলেকজান্ডারের পিতা ও মেসিডোনিয়ার বাদশা ফিলিপ, গ্রিসকে নিজের অধীনস্থ করার পর সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন কঠোর রাজতন্ত্র। পুরো গ্রিসের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে বিষম রাজতন্ত্রের কালো ধোঁয়ায়।

এতদিন যাবৎ গ্রিকরা যে উন্নতির রথযাত্রা অব্যাহত রেখেছিল, যে সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তারা শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধনে সচেষ্ট ছিল, তার সবকিছুর উপর নেমে আসে দুঃসহ ঘন কালো মেঘ। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সৌজন্য, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা; সবকিছু পিষে যেতে শুরু করে কঠোরতা যাঁতাকলে। সময়ের আবর্তনে একসময় গ্রিসের মসনদে আসীন হলেন মহামতি আলেকজান্ডার। তার সময়ে গ্রিক বিজ্ঞান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে কিছুটা মেলে ধরার চেষ্টা করলেও, সকল বিশৃঙ্খলার সূচনা ঘটে আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুর পর। মূলত তার এই প্রয়াণই গ্রিক বিজ্ঞানের জন্য খুলে দিয়েছিল অন্তহীন দুর্দশার পথ। সমুদ্রে বিধ্বংসী ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজের মাস্তুলের মতো গ্রিক সাম্রাজ্যের বুনিয়াদও ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। উন্মাদনায় রাক্ষসের রূপ ধারণ করলো আলেকজান্ডারের একেকজন সেনানায়ক, লুটের মাল হিসেবে যে যার মতো ভাগ করে নিল গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চল। গ্রিসের ভূখণ্ডে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল গৃহযুদ্ধের আগুন।

দিগ্বিজয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট; source: pixels.com

অবাক করা বিষয় হলো, বিখ্যাত বিজ্ঞান তপস্বী টলেমি সোতার ছিলেন আলেকজান্ডারের অন্যতম একজন সেনানায়ক। তিনি বাগিয়ে নিয়েছিলেন সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের কিছু অংশ। বিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি বিশেষ অনুরাগ থাকায় আলেকজান্ডারের স্মৃতিচারণে মিসরের সে অঞ্চলের নামকরণ করলেন আলেকজান্দ্রিয়া। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাকে এখানেই সমাহিত করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়া নগরীটি প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিঃ পূঃ ৩৩৪ অব্দে। টলেমির উৎসাহে সেই আলেকজান্দ্রিয়াই একসময় হয়ে উঠল বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। এর মধ্যে দিয়েই দ্বিতীয় পর্যায়কালের আবর্তন ঘটান স্বয়ং টলেমি নিজে। দ্বিতীয় পর্যায়ের উত্থানটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম এক স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ, ক্লডিয়াস টলেমি, ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, হিপার্কাস, অ্যারিস্টার্কাস এর মতো খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা ছিলেন দ্বিতীয় পর্যায় থেকে উদ্ভূত।

শিল্পীর তুলিতে আলেকজান্দ্রিয়ার পুঁথিশালা; source: amirite.com

সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত আলেকজান্দ্রিয়ার নগরী ও পুঁথিশালা মুখরিত থাকত বিভিন্ন দেশের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের পদচারণায়। পুঁথিশালাটি টলেমি নির্মাণ করলেও, অ্যারিস্টটলের ছাত্র দিমিরিস ফেলিরোনের বিশেষ অবদান রয়েছে এতে। এ পর্যায়ের মাধ্যমে গ্রিক বিজ্ঞান ফিরে পায় তার হারিয়ে যাওয়া গতি, পূর্ণ দমে শুরু করে দেয় দৌড় প্রতিযোগিতার মহড়া। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিজ্ঞানের গোড়াপত্তন করেছিল আলেকজান্দ্রিয়ার এই বিজ্ঞানচর্চাই।

টলেমি সোতার; source: pinterest.com

শুধু বিজ্ঞানচর্চাই নয়, মেলবন্ধনের এক সেতু হিসেবে খ্যাতির খাতায় নাম লিখিয়েছে আলেকজান্দ্রিয়া। এখানেই সমন্বয় ঘটেছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের। প্রবল স্বজাত্যবোধ ধারণ করা গ্রিকদের সাথে একসময় মিশরীয় এবং ইহুদীরাও বিজ্ঞান চর্চায় আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞান সাগরে নিজেদের তরী ভাসিয়েছেন। রসায়ন শাস্ত্রের প্রথম সুশৃঙ্খল ও প্রণালীবদ্ধ ব্যবহারের পথ চলা শুরু হয় এই আলেকজান্দ্রিয়া থেকেই। অনেকের বিশ্বাস, সেখান থেকেই প্রথম রসায়ন চর্চা বা কিমিয়াস প্রসার ঘটেছিল।

সে সময়কার তিনজন প্রখ্যাত রসায়নবিদের নাম বিভিন্ন সময় ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছে। তারা হলেন, ডেমোক্রিটাস (দ্বিতীয়), জোসিমোস, ও মারিয়া। মারিয়া ছিলেন একজন ইহুদি নারী, যার আগমন ঘটেছিল খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর দিকে। অনেকের মতে তিনিই, ছিলেন বিশ্বের প্রথম নারী বিজ্ঞানী। রসায়নে বহু অবদান রাখা এই নারীর লেখা একটি বইয়েরও সন্ধান পাওয়া যায়।

এভাবেই প্রজ্ঞার আলো পরিস্ফুটিত হচ্ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞান-বাতিঘর থেকে। কিন্তু রোমানদের আক্রমণের সময় নিভে যায় সেই আলো, অস্তমিত হয় এর গৌরব-সূর্য। তারপরেও রোমানদের ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে বেঁচে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার বিরাট পুঁথিশালাটি। ধারণা করা হয়, এতে মজুদকৃত পুস্তকের সংখ্যা ৫০ লক্ষেরও অধিক। এবং অ্যারিস্টটলের সংগৃহীত চার লক্ষের মতো পুস্তক সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছিল।

আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বাতিঘর; source: curiosmos.com

রোমান লেখকদের তথ্যমতে, ৪৮ খ্রিস্টপূর্বে জুলিয়াস সিজারের মিসর আক্রমণের সময় দুর্ঘটনাবশত পাঠাগারটিতে আগুন লেগে যায়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় পুঁথিশালাটি। এছাড়াও গ্রন্থাগার বিলুপ্তি দায় যার ঘাড়ে সবচেয়ে বেশি চাপানো হয় তিনি হচ্ছেন বিশপ থিওফেলাস। খ্রিস্টান ধর্মের আধিপত্য বজায় রাখতে প্যাগান দমন ও নাস্তিকতার অভিযোগে পুঁথিশালাটি অনেকাংশেই ধ্বংস করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

২৭২ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার রানী জেনোবিয়া ও রোমান সম্রাট অ্যারেলিয়ানের মধ্যে হওয়া যুদ্ধে বিদ্রোহ দমন করতে অ্যারেলিয়ান গ্রন্থশালাটির যে অংশটুকু অক্ষত ছিল সেখানে অগ্নিসংযোগ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি চালান।

সিরিয়ার রানী জেনোবিয়া ও রোমান সম্রাট অ্যারেলিয়ান; source: brewminate.com

৩৯১ সালে খ্রিস্টান সম্রাট থিওডোসিয়াস পুঁথিশালায় থাকা স্ক্রলগুলোকে প্যাগানদের নিষিদ্ধ জ্ঞান বলে অভিহিত করে আগুন লাগিয়ে দেন। এভাবেই হারিয়ে যায় অমূল্য প্যাপিরাসের গায়ে লিখে রাখা নানা মূল্যবান তথ্য।

আগুনে পুড়ে যাচ্ছে আলেকজান্দ্রিয়ার পুঁথিশালা; source: roughmaps.com

আবার অনেকে মনে করেন, অষ্টম টলেমির শাসনকালের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে গেছে গ্রন্থাগারটি। খ্রি.পূ. ৮৯-৮৮ অব্দে আলেকজান্দ্রিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হলে পুরো অঞ্চলে একটা হ-য-ব-র-ল বেঁধে যায়। আগুন দেওয়া হয় পুঁথিশালার কিছু অংশে। পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হলেও, গ্রন্থাগারটি আর পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়াও স্ক্রলগুলো বেশিরভাগই লেখা হয়েছিল প্যাপিরাসে, যেগুলোর উপর লেখা টিকে থাকে সাধারণত ২৫-৩০ বছর। তাই সেগুলো পুনরায় লিখার উদ্যোগ না নেয়া হলে, মহাকালের গর্ভে নিজেই নিজেকে করে দেয় বিলীন।

বুঝা যাচ্ছে, ধর্মান্ধতা ও যুদ্ধবিগ্রহের ভারে আলেক্সান্দ্রিয়ার বিখ্যাত রত্নতূল্য সেই জ্ঞানভাণ্ডার নুইয়ে পড়তে পড়তে একসময় একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সেই সাথে অবরুদ্ধ হয়েছে বিজ্ঞান চর্চার পথ। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞান চর্চার উজ্জ্বল দীপ-শিখা একেবারে স্তিমিত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে গ্রিক বিজ্ঞানচর্চার দ্বিতীয় পর্যায়টির। এরপরই ইউরোপের বিজ্ঞান ভুবন তলিয়ে যায় অতল গহীনে, ঘুটঘুটে অন্ধকার গ্রাস করে পুরো ইউরোপের বিজ্ঞানকে। ধর্মীয় অনুশাসনের গণ্ডি পেরিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি সে সময়ের বিজ্ঞান, ধর্মগ্রন্থের সাথে মতের অমিল থাকলে কঠোর হস্তে তা দমন করা হয়েছে। বেশ কয়েক পুরুষ অতিক্রান্ত হবার পর শুরু হলো ধর্মের নামে গোঁড়ামি। এরপর কোনো শাস্ত্র আর গবেষণার মুখ দেখেনি, শুধু জোর দেয়া হয়েছে অনুশাসনের উপর।

বিজ্ঞানের প্রবহমান, একক ও অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো, কোনোরকম কুসংস্কার ও গোঁড়ামি সমাজের টুঁটি চেপে ধরলে এবং সর্বস্তরে নিজের বিকাশ না ঘটাতে পারলে সে ওই জায়গা থেকে চিরপ্রস্থান করে। কুসংস্কার ও গোঁড়ামির কালো ধোঁয়া যখন পুরো গ্রিসকে ছেয়ে ফেলল, তখনই নষ্ট হয়ে গেল গ্রিসের চিরাচরিত বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল কঠোর অধ্যয়ন, সাধনা ও পরিশ্রমলব্ধ রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা রসায়ন ইত্যাদি গুরুত্ব সকল শাস্ত্রের গোলা ভাণ্ডার। পৃথিবী যে এর ফলে আরও কতশত বছর পিছিয়ে গেল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Related Articles