শুরুর আগে
একবার হাওয়াইতে আমাকে এক বৌদ্ধমন্দির দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই মন্দিরের একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। এটা আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না, আমি জানি।’ তারপর তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক মানুষকেই স্বর্গের দরজার চাবি দেয়া হয়। কিন্তু এই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে।’
বিজ্ঞানের ব্যাপারেও একই কথা। এটা স্বর্গের দরজার চাবি হলেও, একই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে। তবে, কোনটা যে কীসের দরজা- সেই ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই। তাহলে, আমরা কি এই চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেব? এবং স্বর্গে প্রবেশের সম্ভাবনা বন্ধ করে দেব চিরতরে? নাকি, কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে এই চাবি ব্যবহার করা যায়- এ প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করে যাব? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। তবে আমার মনে হয়, স্বর্গের দরজার চাবির মূল্য আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
– মিনিং অফ ইট অল, রিচার্ড ফাইনম্যান
যুদ্ধে জেতার জন্য দরকার উন্নত অস্ত্র, আর সেজন্যে চাই উন্নত প্রযুক্তি। কিন্তু প্রযুক্তির পেছনের বিজ্ঞান না এগোলে উন্নত প্রযুক্তি আসবে কোত্থেকে? সেজন্যেই, শান্তির সময় বিভিন্ন দেশের সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পেছনে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে, যুদ্ধের সময় করে তার দশগুণ। এটাই নির্মম সত্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সরকারের সেরকম একটি প্রজেক্ট ছিল ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। এই প্রজেক্টের কথা প্রায় সবাই জানে। পারমাণবিক বোমা বানানোর জন্য প্রয়োজন পারমাণবিক প্রযুক্তি। সেজন্য পরমাণু বিজ্ঞান এবং কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে হবে। বিপুল অর্থ এবং বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীকে এক করে এই প্রজেক্ট শুরু করেছিল আমেরিকা। তবে, হুট করেই বিজ্ঞানীরা এতে কাজ করার জন্য রাজি হয়ে যাননি। পার্ল হারবারে আক্রমণ এই প্রজেক্টের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আশংকা। উড়ো খবর থেকে শোনা যাচ্ছে, হিটলার পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করছেন। যদি সফল হয়ে যায়!
ফলে আইনস্টাইন, ফার্মি থেকে শুরু করে ওপেনহাইমার- তাবৎ বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীরা এক ছাদের নিচে গবেষণা করতে রাজি হয়েছেন। এতসব বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে কাজ করার জন্য ডাক পেয়ছে এক তরুণ বিজ্ঞানী। তার বয়স কেবল বিশের কিছুটা উপরে। তরুণ সেই বিজ্ঞানী প্রজেক্টে যোগ দেয়ার পর থেকে জটিল সব গাণিতিক হিসেবনিকেশের দায়িত্ব তার ঘাড়ে এসে পড়ল। গাণিতিক হিসেবগুলো ঠিকঠাক করে করাটা এ ধরনের প্রজেক্টে সবচেয়ে গুরুদায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কারণ, সেই হিসেবের উপরে ভিত্তি করেই তৈরি হবে যন্ত্রাংশ। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভুলের জন্যও গুণতে হতে পারে চড়া মাশুল। তরুণ যেন জাদু জানেন। দারুণ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিলেন সবকিছু। সেই সঙ্গে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আর ইউরেনিয়াম-২৩৮ কে কীভাবে আলাদা করা যায়, সেটা নিয়েও কাজ করেছিলেন তিনি।
তরুণ সেই বিজ্ঞানীর নাম রিচার্ড ফাইনম্যান। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে যার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে সময়ের শেষ পর্যন্ত। মানুষ যাকে চিনবে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষক হিসেবে। তবে, তার গল্প শোনার জন্য আমাদেরকে প্রথমে ফিরে যেতে হবে ১৯১৮ সালে, ব্রুকলিনে।
১
রিচার্ড ফাইনম্যানের বাবা-মা ছিলেন ইহুদি। বাবা মেলভিল ফাইনম্যানের জন্ম বেলারুশের মিন্স্ক শহরে। পাঁচ বছর বয়সে পরিবারের সাথে পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকা। নানারকম ব্যবসার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। আসলে, বিজ্ঞান ভালোবাসতেন। কিন্তু এ নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাননি সেভাবে।
এদিকে মা লুসিল ফিলিপস বেড়ে উঠেছেন আমেরিকার এক ইহুদি পরিবারে। তার বাবা-মাও মূলত আমেরিকান ছিলেন না। পোল্যান্ড ছেড়ে আমেরিকায় এসে শুরু করেছেন নতুন জীবন। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করাতেন লুসিল। ১৯১৭ সালে মেলভিল এবং লুসিলের বিয়ে হয়। তার এক বছর পরে, ১৯১৮ সালের ১১ই মে-তে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান, রিচার্ড ফিলিপস ফাইনম্যান।
মেলভিল খুব চাইছিলেন প্রথম সন্তান ছেলে হোক। ইচ্ছেপূরণের খুশিতে ছেলেকে যতভাবে সম্ভব, বিজ্ঞানে উৎসাহী করে তোলার চেষ্টায় নামলেন তিনি। অযথা চাপ দেননি অবশ্য। তবে, একজন মানুষের জীবনের গতিপথ কেমন হবে, এর পেছনে শৈশবের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ফাইনম্যানকে নিয়ে গ্লেইক[১] লিখেছেন,
ফাইনফ্যান তার সিরিয়াস স্বভাব আর জ্ঞানের জন্য আগ্রহ পেয়েছেন বাবার দিক থেকে। আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন গল্প বলার চমৎকার ক্ষমতা এবং রসিকতাবোধ।
সব পরিবারেই কিছু জটিলতা থাকে। কষ্ট হানা দিয়ে যায়। মাত্র চার সপ্তাহ বয়সে রিচার্ড ফাইনম্যানের ছোট ভাই মারা যায়। সে সময় রিচার্ডের বয়স কেবল পাঁচ বছর। বাবা-মা এলোমেলো হয়ে গেল অনেকটা। জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠল। পরের চার বছর প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে বেড়ে উঠেছেন ছোট্ট ফাইনম্যান। এর মধ্যে পরিবার অনেকবার বাসা পাল্টেছে, যেন পালিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে দুঃসহ এক স্মৃতি থেকে। এরকম সময় পৃথিবীতে এলো ছোটবোন জোয়ান। পরের বছর ফার রকওয়েতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করল ফাইনম্যান পরিবার।
স্কুলে যাওয়ার আগেই বিজ্ঞান আর গণিতে হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল রিচার্ডের। নিজে নিজেই শিখেছেন সবকিছু। সেসময় তো আর এরকম ইন্টারনেট ছিল না। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সাহায্য নিয়েছিলেন ফাইনম্যান। সেই সঙ্গে বাসায়, নিজের ঘরে একটা ল্যাবরেটরিও বানিয়ে নিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ নিয়ে টুকটাক পরীক্ষা চালাতেন সেখানে। ফার রকওয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দেখা গেল, তার সমস্ত আগ্রহ বিজ্ঞান এবং গণিতে। ইতিহাস, কলা ইত্যাদিতে কোনো আগ্রহই নেই। এমনকি ফাইনম্যানের কাছে মনে হতো, মানুষ আবার কবিতা পছন্দ করে কীভাবে![২]
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাই স্কুলে থাকতে ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি ইত্যাদি নিজে নিজে করতে গিয়ে sin, cos, tan, f(x)— এসবের বদলে নিজস্ব নোটেশন বা চিহ্ন ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন ফাইনম্যান। তার কাছে নাকি নিজস্ব নোটেশন ব্যবহার করতেই সহজ লাগত। খাতা ভর্তি সেই নোটেশন দেখে এক বন্ধু তাকে একবার বলল একটা গণিত বুঝিয়ে দিতে। বোঝাতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, নোটেশন জিনিসটা কারো ব্যক্তিগত জিনিস নয়!
গণিত আর বিজ্ঞানে যত ভালোই হোন না কেন, অন্যান্য বিষয় পারতেন না একেবারেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় এটা ভয়াবহ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আছে তার ধর্মীয় পরিচয়। ফাইনম্যান ছিলেন ইহুদি, এদিকে আমেরিকায় ইহুদিদেরকে মানুষ তখন সহজে নিতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আছে, সেই কোটার চেয়ে বেশি ইহুদি ভর্তি করে না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাকে নেয়নি। তা হোক, কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার ফি ১৫ ডলার নিয়ে সেটাও আর ফিরিয়ে দেয়নি তারা। সেজন্য ফাইনম্যান জীবনভর তাদেরকে ক্ষমা করতে পারেননি! যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT) তে।
২
১৯৩৫ সালে এমআইটিতে ভর্তি হয়েছিলেন। অনার্স শেষ করতে করতে ১৯৩৯। এই সময়টাকে ফাইনম্যানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যেতে পারে। পড়তে গিয়েছিলেন গণিত। পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, কোর্সটা এমনিতে বেশ সহজ। কিন্তু ওর মধ্যেকার কোন জিনিসটা বাস্তবে কাজে লাগবে, সেটা তিনি বুঝতেই পারছিলেন না। এমন সময় আর্থার এডিংটনের লেখা ম্যাথম্যাটিক্যাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বইটা পড়ে ফেললেন ফাইনম্যান। টের পেলেন, আসলে এরকম কিছুই শিখতে চান তিনি। বাস্তব জগতের সমস্যা সমাধানে গণিত ব্যবহার করতে চান। তখনো তিনি প্রথম বর্ষের ছাত্র। চট করে গণিত থেকে সরে আসলেন, ভর্তি হলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। কিন্তু অল্প কয়েকদিন পরেই বুঝলেন, মন টানছে না। আবারো বিষয় বদলে নিয়ে ভর্তি হলেন পদার্থবিজ্ঞানে। শুরু হলো তার জীবনের নতুন অধ্যায়।
৩
পদার্থবিজ্ঞানের যে কোর্সটা নিয়েছিলেন, সেটা ঠিক স্ট্যান্ডার্ড কোর্স ছিল না। ইন্ট্রোডাকশন টু থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স নামের এই কোর্সটা ছিল অনার্স শেষ করে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য। অথচ ফাইনম্যান তখন মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কিন্তু সেই কোর্স নিয়েও তিনি ঠিক তৃপ্তি পেলেন না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপরে সরাসরি কোনো কোর্স ছিল না। কাজেই টি. এ. ওয়েল্টন নামের এক আরেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে মিলে এ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন তিনি। তখন ১৯৩৬ সাল। সে বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে তাদের মধ্যেকার চিঠিগুলো থেকে জানা যায়, নিজেরা মিলে স্থান-কালের এমন একটা রূপ তারা ডেভেলপ করতে চাচ্ছিলেন, যেখানে[২]–
… মহাকর্ষ যেমন স্থানের সঙ্গে যুক্ত একটা ঘটনা, বৈদ্যুতিক বলকেও তেমনি স্থানের সঙ্গে যুক্ত একটি ঘটনা হিসেবে প্রকাশ করা যাবে।
বছরখানেক পরে ফাইনম্যান পল ডিরাকের লেখা দ্য প্রিন্সিপালস অফ কোয়ান্টাম মেকানিক্স বইটা পড়ে ফেললেন। বুঝতে চেষ্টা করছিলেন, ডিরাকের আইডিয়ার সঙ্গে তার নিজস্ব ভাবনা কতটা মেলে বা আদৌ মেলে কি না। ফাইনম্যানের জীবনে ডিরাক আদর্শতে পরিণত হলেন। এক জীবনে ডিরাকের চেয়ে বেশি সম্মান আর কোনো বৈজ্ঞানিককে তিনি দিয়েছেন বলে জানা যায় না।
যা-ই হোক, অনার্স শেষ করে চিন্তা করলেন পিএইচডি করবেন। এমআইটিতে পড়াশোনা করে বেশ খুশি ছিলেন ফাইনম্যান। কাজেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান জন স্লেটারের কাছে আবেদন করলেন, তিনি এখানেই পিএইচডি করতে চান। স্লেটার উত্তরে জানালেন, ফাইনম্যানের নিজের ভালোর জন্যেই এখানে না করে অন্য কোথাও পিএইচডি করা উচিত। এবং এজন্য প্রিন্সটন বেশ ভালো হবে।
ইহুদি ছিলেন বলে সামান্য সমস্যা হতেও পারতো। প্রিন্সটনের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান হ্যারি স্মিথ, স্লেটারকে লেখা এক চিঠিতে জানতেও চেয়েছিলেন, ফাইনম্যান ইহুদি কি না। তবে স্লেটার চিঠিতে ফাইনম্যানের বেশ প্রশংসা করলেন। ইতিহাস, সাহিত্য, কলা ইত্যাদি বিষয়ে রেজাল্ট ভালো না হলেও পদার্থবিজ্ঞানে তার অসম্ভব ভালো রেজাল্ট ছিল। ফলে, সুযোগ পেয়ে গেলেন প্রিন্সটনে। এখানে তার পিএইচডি সুপারভাইজর হিসেবে ছিলেন জন হুইলার। কিন্তু হুইলারের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনোরকম কুলকিনারা না পেয়ে, আবারো নিজের আগের আইডিয়াগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ফাইনম্যান। এবং প্রিন্সটনে তিনি প্রথম যে সেমিনারে বক্তৃতা দেন, সেখানে দর্শকসারিতে আইনস্টাইন, পাউলির মতো বিজ্ঞানীরাও উপস্থিত ছিলেন। পাউলি তার সব কথা শুনে বললেন,
জিনিসটা ঠিক মনে হচ্ছে না। কী যেন একটা সমস্যা আছে…
ফাইনম্যান পরে কাজ করতে গিয়ে বুঝলেন, আসলেই কিছু সমস্যা আছে। ফলে, আরেকদিক থেকে নতুন করে এগোলেন তিনি। ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক তত্ত্বের তরঙ্গ মডেলটাকে অন্য আরেকটা মডেল দিয়ে বদলে দেয়ার চেষ্টা করলেন। এই মডেলটা স্থান-কালের সঙ্গে কণাদের মিথষ্ক্রিয়ার উপরে ভিত্তি করে তৈরি। এই সময় ফাইনম্যানের ক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু বোঝা গেল। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন, বলা যায়। গ্লেইক লিখেছেন,
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সমীকরণ নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে ফাইনম্যানের যে দক্ষতা, সেরকম দক্ষতা আইনস্টাইন, ডিরাক বা লেভ লাউন্দাউয়ের মতো হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া আর কারো মাঝে ছিল না।
থিসিস নিয়ে গবেষণার শেষ বর্ষে ছিলেন তিনি। ঠিক এ সময় এলো ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করার প্রস্তাব। প্রথমে একবাক্যে না করে দিয়েছিলেন। তার ভাষায়[১],
থিসিসের কাজে আবারো ফেরত গেলাম। তিন মিনিট এ নিয়ে ভাববার পরেই আমার চিন্তা অন্যদিকে ঘুরে গেল। হিটলারের নৃশংসতা ততদিনে পৃথিবী দেখে ফেলেছে। সে যদি আমাদের আগে পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে কী হবে, সেটা ভাবতে গিয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল।
ফলে, ফাইনম্যান ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করা শুরু করলেন। তার মূল গবেষণার বিষয় ছিল, কীভাবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ থেকে ইউরেনিয়াম-২৩৮কে আলাদা করা যায়। ওদিকে হুইলার তখন শিকাগো চলে গেছেন। ফার্মির সঙ্গে মিলে পারমাণবিক রিয়্যাক্টর বানানোর জন্য কাজ শুরু করেছেন। হুইলারের অনুপস্থিতিতে ফাইনম্যানের থিসিসের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ইউজিন উইগনার। তিনি ফাইনম্যানকে বললেন, থিসিস পেপারটা লিখে ফেলতে। পেপার লেখা শেষ হলে উইগনার নিজেই পেপারটা দেখে দিলেন। এর মাধ্যমে ১৯৪২ সালে রিচার্ড ফাইনম্যানের পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন হলো।
৪
প্রেমিকা আরলিন গ্রিনবমের এ অময় টিউবার্কিউলোসিস ধরা পড়ল। যখন পরিবারের সমর্থন সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন পরিবারের কাছ থেকে মানসিক সমর্থন পাননি একটুও। সবার অমতে, পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আরলিনকে বিয়ে করেন ফাইনম্যান। এ সময়ে সেখানে তার পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিল না। ব্যক্তি ফাইনম্যান কেমন ছিলেন, সেটা বোঝার জন্য আর কিছু জানার কি আদৌ দরকার আছে?
৫
১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে দেখার আগেই আরলিন মারা যান। ফাইনম্যান আবারো নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজ বলতে, এ সময় তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। গবেষণা বাদ দিয়ে সেটা নিয়েই দিন কাটাতে থাকেন তিনি।
প্রায় বছর পাঁচেক শিক্ষকতা ছাড়া তেমন কোনো কাজ করেননি। তারপরেই আগের সেই তাড়নাটা আবার ফিরে এলো। গবেষণা করতে হবে। এ সময়, ১৯৫০ সালে, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (CALTECH) এ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। সেখানেই তিনি বাকি কর্মজীবন কাটিয়েছেন।
এ সময় তিনি আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। তার মূল অবদান কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতেই। আরো ঠিক করে বললে, কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স-এ। নতুন একধরনের ডায়াগ্রামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আমাদেরকে। তার নামে এই ডায়াগ্রামের নাম দেয়া হয়েছে ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম। সিস্টেম বা ব্যবস্থার সাথে মিথষ্ক্রিয়াশীল কণাদের আচরণ গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করতে এই ডায়াগ্রাম ব্যবহার করা হয়।
কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্সে চমৎকার অবদানের জন্য ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন রিচার্ড ফাইনম্যান।
৬
কণা পদার্থবিজ্ঞানে আরো বেশ কিছু কাজ করেছেন তিনি। যেমন, কণাদের স্পিন নিয়ে কাজ করেছেন। দ্য থিওরি অফ ‘পার্টন’স নামে একটা তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন ফাইনম্যান। এই মডেলটি হ্যাড্রন (প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি) কণাদেরকে নিয়ে কাজ করে। কণা-পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান কাজে তার এই মডেল দারুণ সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।
১৯৭৯ সালে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। পাকস্থলিতে ক্যানসার ধরা পড়লে সেটার অপারেশন করান তিনি। সফল হয়েছিল অপারেশনটা। ততদিনে ফাইনম্যান বিখ্যাত হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। তার পদার্থবিজ্ঞানের বক্তৃতা বা লেকচারগুলোর সংকলন বের হওয়ার পরে অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। এর মধ্য দিয়ে তিনি পুরোপুরি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
তার বিখ্যাত সব বইয়ের তালিকায় আছে Six Easy Pieces, The Feynman Lectures on Physics, Quantum Electrodynamics, QED: The strange Theory of Light and Matter, Meaning of It All ইত্যাদি। ক্যালটেক ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিক্সের পুরো সংকলনটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
দারুণ সব স্বীকৃতি পেয়েছেন নিজের কাজের জন্য। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স এবং রয়্যাল সোসাইটি অফ লন্ডনের স্বীকৃতি উল্লেখযোগ্য।
১৯৮৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ৬৯ বছর বয়সে সেই ক্যানসারের ভুগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রিচার্ড ফাইনম্যান।