আগের পর্বে আমরা সূর্যের জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত আলোচনা করেছি। সূর্যের পরবর্তী জীবন কিন্তু আরও বেশি চমকপ্রদ!
বার্ধক্যে সূর্য
বর্তমানে সূর্যে ক্রমাগত হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হচ্ছে এবং শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর পরে সূর্যের ঔজ্বল্য বেড়ে যাবে ৪০%। আর সাড়ে চার বিলিয়ন বছর পরে সূর্যের সমস্ত হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয়ে যাবে। তারপর কী হবে?
পরবর্তী ঘটনা জানার আগে অন্য একটি বিষয়ে একটুখানি জানা জরুরি। আর তা হলো সূর্যের আকৃতি। সূর্যের ব্যাস ১.৩৯২ মিলিয়ন কিলোমিটার। তুলনা করার জন্য বলা যায়, এর ব্যাস বরাবর সমান্তরালে প্রায় ১০৯টি পৃথিবী বসানো সম্ভব। সূর্য তার প্রায় পুরো জীবনেই এই আকৃতি বজায় রাখে কী করে? সহজভাবে বলতে গেলে সূর্য পুরোটাই একটি গ্যাসীয় পদার্থ, এবং আমরা জানি গ্যাসের নির্দিষ্ট আকার থাকে না। সূর্যের এই আকৃতির মূলে রয়েছে নিউক্লিয়ার ফিউশন এবং মাধ্যাকর্ষণের বৈরিতা।
সূর্যের কেন্দ্রে রয়েছে প্রবল মাধ্যাকর্ষণ, যা প্রতিনিয়ত টানছে সূর্যকে এবং চাইছে সংকুচিত করতে। অপরদিকে সেই কেন্দ্রে চলছে নিউক্লিয়ার ফিউশন, যা ক্রমাগত কেন্দ্রকে বাইরের দিকে চাপ দিচ্ছে। এই চাপ এবং টান নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী একে অপরকে কাটাকাটি করে ফেলছে এবং সূর্য একটি সাম্যাবস্থায় টিকে আছে। কিন্তু যখন কেন্দ্রের সব হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হবে, কেন্দ্রে ফিউশন বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বিক্রিয়া তার প্রয়োজনীয় জ্বালানী পাবে না।
প্রবল মহাকর্ষের টানে তখন হিলিয়াম সংকুচিত হতে থাকবে। ধীরে ধীরে তার তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে এবং কেন্দ্রের বাইরে যে হাইড্রোজেন থাকবে, তা ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করবে। এখন ছোট একটু সমস্যা, এতদিন বিক্রিয়া চলছিল কেন্দ্রের ভেতরে, তাই সূর্য একটি সাম্যাবস্থায় ছিল। এখন বিক্রিয়া শুরু হয়েছে কেন্দ্রের বাইরে। ফলে এই সাম্যাবস্থা ভেঙে যাবে, বাইরের দিকের চাপে সূর্য হঠাৎ ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করবে! ফুলতে ফুলতে গ্রাস করে ফেলবে বুধ এবং শুক্র গ্রহের কক্ষপথ, এমনকি পৃথিবীকেও গ্রাস করার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিশালাকৃতির সূর্যের নাম দেওয়া হয়েছে রেড জায়ান্ট বা লাল দৈত্য। আর এ ঘটনাটা ঘটবে আজ থেকে প্রায় ৭.৫৯ বিলিয়ন বছর পরে। একে লাল দৈত্য বলার কারণও আছে। সূর্য থেকে এখন বর্ণহীন আলো বের হয়। রেড জায়ান্ট হবার পর লাল আলো বের হবে। নক্ষত্রের তাপমাত্রা কমে গেলে এমনটা হয়। সূর্য বিশালাকৃতি ধারণ করলে যদিও এর মোট শক্তি বেড়ে যাবে কিন্তু শক্তিটা বিশাল পৃষ্ঠদেশ থেকে বের হবে বলে গড় তাপমাত্রাও কমে যাবে।
সূর্যের শেষ দিনগুলি
রেড জায়ান্ট অবস্থায় সূর্য টিকে থাকবে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর। এসময় কেন্দ্রের বাইরের হিলিয়ামগুলো কেন্দ্রে গিয়ে জমা হবে এবং কেন্দ্রের মাধ্যাকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে সূর্য সংকুচিত হতে থাকবে এবং বর্তমান আকারের চাইতে সামান্য ছোট অবস্থায় চলে আসবে। সঠিকভাবে বলতে গেলে বর্তমান আকারের ১০ ভাগের ১ ভাগ। কেন্দ্রের প্রবল তাপে সেখানে আবার ফিউশন শুরু হবে, তবে এবার সম্পূর্ণ নতুন এক বিক্রিয়া, হিলিয়াম থেকে কার্বন। সূর্য তার জীবনের শেষ শক্তিটুকু পাবে এ বিক্রিয়া থেকে। সূর্যের ঔজ্বল্য তখন থাকবে বর্তমানের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে সামান্য কমে যাবে।
কেন্দ্রের সমস্ত হিলিয়াম কার্বনে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না, মোটামুটি ১০০ মিলিয়ন বছর। এরপর পূর্বের সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। প্রবল মহাকর্ষের টানে কার্বনগুলো কেন্দ্রীভূত হতে থাকবে, এবং পুনরায় কেন্দ্রের বাইরের হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হবে, সূর্য আবার পরিণত হবে রেড জায়ান্টে। তবে এবার আগের চেয়েও বড় এবং দ্রুতগতিতে। এবার সে গ্রাস করে নেবে বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথ। স্বভাবতই পৃথিবী নামক কোনো গ্রহের তখন আর অস্তিত্ব থাকবে না।
সূর্যের মৃত্যু
দ্বিতীয় রেড জায়ান্ট অবস্থায় সূর্য ১০০ মিলিয়ন বছর টিকে থাকবে এবং তারপর তার বাইরের অংশ হারাতে শুরু করবে। ১ লক্ষ বছরের ভেতরেই সূর্যের বাইরের অংশটুকু গ্যাস হয়ে ছড়িয়ে পড়বে এবং পরিণত হবে প্ল্যানেটারি নেবুলায়।
কেন্দ্র কিন্তু আবার সংকুচিত হতে আরম্ভ করবে, তাপমাত্রাও বাড়তে বাড়তে প্রায় ১ লক্ষ ডিগ্রী সেলসিয়াস হয়ে যাবে, তবে এবার কোনো বিক্রিয়া শুরু হবে না। কেন্দ্রে এখন রয়েছে শুধুই কার্বন, যা পদার্থের সুস্থিত একটি অবস্থা। এই কেন্দ্রের আকার মাত্র কয়েক হাজার মাইল, অর্থাৎ পৃথিবীর কাছাকাছি। এটি তখন একটি মৃত, উত্তপ্ত নক্ষত্র। এই অবস্থার নাম হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন।
প্ল্যানেটারি নেবুলাটুকু পরবর্তী দশ হাজার বছরের মধ্যেই বিকীর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু হোয়াইট ডোয়ার্ফ টিকে থাকবে আরও ট্রিলিয়ন বছর। ধীরে ধীরে এটি শীতল হবে, ধীরে ধীরে এর থেকে আলো বের হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক যেভাবে জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে থাকে। একসময় এর থেকে আলো বের হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সেই নক্ষত্রকে তখন বলা হবে ব্ল্যাক ডোয়ার্ফ বা কালো বামন।
সূর্যের মৃত্যু–পরবর্তী অবস্থা
কোনো নক্ষত্রের মৃত্যু হলে সেটি ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন স্টারে পরিণত হয়। অথবা সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে পুরো গ্যালাক্সি আলোকিত করে ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বে। কোনটি ঘটবে তা নির্ভর করে সেই নক্ষত্রের ভরের ওপর। সূর্যের সাথে এমন কোনো কিছু ঘটবে না কারণ সূর্যের ভর যথেষ্ট নয়। সূর্য থেকে মাত্র দেড়গুণ বড় নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটে সুপারনোভা বিস্ফোরণে। নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতে গেলে অবশ্য সূর্যের মিলিয়ন কিংবা বিলিয়ন গুণ ভরের নক্ষত্রের প্রয়োজন।
যা-ই হোক, সূর্যের হোয়াইট ডোয়ার্ফ অবস্থায় একটু ফিরে যাওয়া যাক। সূর্যের আকার তখন হবে পৃথিবীর কাছাকাছি, কিন্তু ঘনত্ব অচিন্তনীয়। এক চা চামচ হোয়াইট ডোয়ার্ফের ভর হবে ৩০ টন ট্রাকের সমান! এত ঘন পদার্থের শীতলীকরণ প্রক্রিয়া দীর্ঘতম হওয়াটাই স্বাভাবিক। এক্স-রে, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি এবং দৃশ্যমান বিকীরণের মাধ্যমে হোয়াইট ডোয়ার্ফ ধীরে ধীরে শীতল হবে।
এখন পর্যন্ত যত হোয়াইট ডোয়ার্ফ খুঁজে পাওয়া গেছে, সবগুলোর তাপমাত্রা ৭,৭০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৩৯,০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে, যা ক্রিস্টালাইজেশনের জন্য যথেষ্ট বেশি। কাজেই পুরোপুরি ক্রিস্টালে পরিণত নক্ষত্র এখনও আমাদের চোখে ধরা দেয়নি। এবং যেহেতু এর থেকে কোনো আলোও বের হয় না, তাই একে খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর।
কী হবে যদি হোয়াইট ডোয়ার্ফ পুরোপুরি ক্রিস্টাল হয়ে যায়? কার্বনঘটিত হোয়াইট ডোয়ার্ফ যথেষ্ট শীতল হয়ে যখন ব্ল্যাক ডোয়ার্ফে পরিণত হয়, তখন প্রথমে এর উপরিভাগে ক্রিস্টালাইজেশন শুরু হয় এবং পরে ধীরে ধীরে সমস্ত নক্ষত্রটি পরিণত হয় বিশাল ক্রিস্টালে। এ ধরনের ক্রিস্টাল বা স্ফটিককে আমরা বলি হীরা।
অর্থাৎ আমাদের অতি পরিচিত সূর্য আজ থেকে আট-দশ বিলিয়ন বছর পর পরিণত হবে পৃথিবীর আকারের একটি হীরকখন্ডে। ব্ল্যাক ডোয়ার্ফের পর তার অন্তিম এই পরিণতিকে আমরা বলতে পারি ডার্ক ডায়মন্ড।
মহাকাল অপেক্ষায় আছে সেদিনের!