Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?

সম্ভবত এই শতাব্দীতে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তির ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভূমিকা রাখতে পারে বৈশ্বিক উষ্ণতা। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি ২০-৩০ শতাংশ প্রজাতিকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। যদি তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই গড় ২ ডিগ্রীতে গিয়ে পৌঁছায়, তাহলে বেশিরভাগ বাস্তুতন্ত্রের জন্যই টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে এমন বেশিরভাগ প্রজাতিই এমন অঞ্চলগুলোতে বাস করে যা জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন এতটাই দ্রুত ঘটছে যে অনেক প্রজাতির জন্য পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

বাস্তুতন্ত্রের দুনিয়ায়

একটা পুকুরে কি শুধু মাছই থাকে? মাছ নিশ্চয়ই অন্য মাছকে খেয়েই বেঁচে থাকে না, তাই না? পুকুরে জুপ্লাংকটন (ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক প্রাণী), ফাইটোপ্লাংকটনসহ (ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদ) নানা ধরনের জৈব ও অজৈব পদার্থ দেখতে পাওয়া যায়। এরা সকলেই বেঁচে থাকার জন্য একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। পুকুরের এই পরিবেশই একটি জলজ বাস্তুতন্ত্রের উদাহরণ। এমন করে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। বাস্তুতন্ত্র ছাড়া প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকা একপ্রকার অসম্ভবই বটে। কারণ কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদই অপরের সাহায্য ছাড়া বেঁচে থাকার চিন্তা করতে পারে না।

একটি বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠে সাধারণত দুটি মূল উপাদানের উপর ভিত্তি করে: জৈব ও অজৈব উপাদান।

জৈব উপাদান: জৈব উপাদান বলতে যার জীবন আছে সহজ কথায় তাদেরই বোঝায়। এটি হতে পারে উদ্ভিদ, হতে পারে প্রাণী কিংবা ছোট ছোট কীটপতঙ্গ।  

অজৈব উপাদান: অজৈব উপাদান বলতে বোঝানো হয় প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত উপাদানগুলোকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, শীলা ইত্যাদি।

মানুষের স্বার্থেই বাস্তুতন্ত্র বাঁচানো জরুরি; © NetEduProject 

একটি বাস্তুতন্ত্রে যে উপাদানগুলোই থাকুক না কেন, এরা প্রত্যেকেই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এতটাই নির্ভরশীল যে উপাদানগুলোর সামান্য পরিবর্তনও প্রভাব রাখতে সক্ষম পুরো বাস্তুতন্ত্রের উপর। পরিবর্তনের সাথে যদি কোনো কারণে ঐ বাস্তুতন্ত্রে থাকা প্রাণীরা খাপ খাইয়ে না নিতে পারে, তাহলে তারা অন্য বাস্তুতন্ত্রে চলে যায়। 

বাস্তুতন্ত্রের নির্দিষ্ট কোনো আকার বা আয়তন নেই। ছোট একটি পুকুর থেকে শুরু করে মরুভূমির মতো বিশালাকার জায়গাজুড়েও বাস্তুতন্ত্রের বিস্তৃতি হতে পারে।

হুমকিতে বাস্তুতন্ত্র

পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে, বিভিন্ন স্থানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসলি জমি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, বন উজাড় করে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে, ভরাট হচ্ছে পুকুর, নদী, খালের মতো পানির উৎসগুলো। এ সবকিছুতেই অসংখ্য বাস্তুতন্ত্র ছিল বা লড়াই করে টিকে আছে।

একটু আগেই বলা হয়েছে, বাস্তুতন্ত্রে থাকা কোনো একটি উপাদানের সামান্যতম পরিবর্তনও পুরো বাস্তুতন্ত্রেই প্রভাব ফেলতে সক্ষম। তাহলে ভাবুন তো, বৈশ্বিক উষ্ণতা কিংবা জনসংখ্যার লাগামছাড়া বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা কি আশা করতে পারি বাস্তুতন্ত্রগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে? 

এই আবহাওয়াজনিত পরিবর্তনগুলো প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে পৃথিবীর বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পরিবর্তনের সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে একেকটি প্রজাতির শত বছরও লেগে যায়। ফলাফল হিসেবে আমরা অসংখ্য প্রাণ প্রজাতি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে দেখেছি বিগত শতাব্দীগুলোয়। এই নিশ্চিহ্ন বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আগামীর দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করছে মানুষই; © Time magazine 

কতটা ভয়াবহ হতে পারে বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব সেটিই আলোচনা করা যাক ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের ভিত্তিতে।

বন: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে অনেক প্রজাতিই তাদের নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রে টিকতে না পেরে শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোয় পাড়ি জমাতে পারে। কারণ তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় অত্যধিক গরম সহ্য করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়বে অনেক প্রজাতির জন্য। তাছাড়া ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে কে-ই বা পড়তে চাইবে বলুন! তাই স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় নিজেদের নাম লেখাবে অনেক প্রজাতি। সাধারণত এই ধরনের স্থানান্তর হাজার বছরে একেকবার ঘটতে দেখা যায় প্রকৃতিতে। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে সেই সময় কমে আসবে শত কিংবা দশকে! এতে করে অনেক বনই তার নিজস্ব প্রজাতি হারিয়ে ফেলবে, পড়বে অস্তিত্ব সংকটে। স্বকীয়তা হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেও সময় নেবে না অনেক বনাঞ্চল।

পশুচারণ ভূমি: গ্রামে কিংবা শহর ছেড়ে যদি কখনো দূরে কোথাও গিয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই ফাঁকা ঘাসের মাঠ দেখে থাকবেন যেখানে গরুর পাল ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। সকালে গরুর মালিকরা হয়তো গরুদের এখানে ছেড়ে দিয়ে যায়, সারাদিন তারা এখানে পড়ে থাকে, ঘাস খায়। দিনশেষে বাড়ি ফেরে। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পাবে না এই অবলা প্রাণীরাও।

পশুচারণ ভূমি; © Noble Research Institute

কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পশুচারণের এই এলাকাগুলোতেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন, সংকট বাড়বে গো-খাদ্যের। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় গরু বা এই ধরনের ভূমির উপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীর জন্য টিকে থাকা হয়ে পড়বে মুশকিল। আপনি ভাবছেন, অন্য প্রজাতির মতো এরাও তো তাহলে স্থানান্তর হয়ে গেলেই পারে। কিন্তু না। গৃহপালিত বা খামারে বেড়ে ওঠা এসব প্রাণীর ক্ষেত্রে চাইলেও স্থানান্তর সম্ভব নয়। ফলে নানা অসুখ এমনকি মৃত্যুর পথেও হাঁটতে হতে পারে এসব প্রাণীদের।

পোলার আইস ক্যাপ ও মাউন্টেন গ্লেসিয়ার: পোলার আইস ক্যাপ বলতে সাধারণত বরফাচ্ছাদিত এলাকাকে বোঝানো হয়। অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে এই আইস ক্যাপগুলোর দেখা মেলে। এই বছরের (২০২১) মার্চে ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পোলার আইস ক্যাপগুলো ১৯৯০ সালের চেয়ে ছয়গুণ বেশি গতিতে গলছে। এতে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার আশঙ্কাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর প্রভাবে এই শতাব্দীর শেষে গিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ উপকূলীয় বন্যায় বাস্তুহারা হয়ে পড়বে। এসব অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রও বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি বরফের পাহাড় বা মাউন্টেন গ্লেসিয়ার গলতে শুরু করবে। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে কৃষি জমি, নদীর পানি প্রবাহ এবং পানি আটকে রাখা বাঁধের উপর। হারাবে বাস্তুতন্ত্র, নিশ্চিহ্ন হবে অসংখ্য প্রজাতি। ভয়াবহ এক বিপর্যয় থেকে আমরা খুব বেশি দূরে নেই বলেই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

পানির উৎস: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পানির উৎসগুলোয় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেবে। ফলে নদী, পুকুর কিংবা সমুদ্রে যেসব বাস্তুতন্ত্রে নানা ধরনের অসংখ্য প্রজাতির বাস তাদের টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে পানির গুণাগুণে আসবে পরিবর্তন, দেখা দেবে দ্রবীভূত অক্সিজেনের সংকট। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াটা সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে পানিতে বাস করা অনেক প্রজাতির জন্য। বন্যা ও খরার স্থায়িত্ব বাড়লে পানিতে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়বে কয়েকগুণ বেশি, অনেক এলাকায় পানিও মিলবে না দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে বাস্তুতন্ত্রগুলো পড়বে ভয়াবহ হুমকির মুখে।

বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার কেন জরুরি?

যেসব বাস্তুতন্ত্র ইতোমধ্যেই ধ্বংস বা ক্ষতির মুখে পড়েছে সেগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নামই বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার। এই পুনরুদ্ধার বিভিন্ন উপায়েই করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো এলাকায় হয়তো একসময় অসংখ্য গাছপালা ছিল। সেই গাছপালার উপর নির্ভর করে বাস্তুতন্ত্রও গড়ে উঠেছিল। গাছপালা কমে যাওয়ায় সেটির প্রভাব গিয়ে পড়েছে বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য উপাদানের উপরও। তাই যদি আবার গাছপালা লাগিয়ে সেই জায়গাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তাহলে বাস্তুতন্ত্রটি পুনরুদ্ধার হতে পারে।

বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার জরুরি হয়ে উঠেছে। © U A B 

বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ঠিক কতটা জরুরি সেটি বোঝাতে গিয়ে জাতিসংঘ বলছে, আগামী দশ বছর (২০৩০ পর্যন্ত) যদি এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চালু রাখা যায় তাহলে বায়ুমন্ডল থেকে সর্বনিম্ন ১৩ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ গিগাটন গ্রিনহাউজ গ্যাস সরিয়ে ফেলা যাবে। এই প্রক্রিয়ার অর্থনৈতিক সুবিধার কথাও বলেছে সংস্থাটি। বিনিয়োগের চেয়ে নয়গুণ বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা আসবে এই প্রক্রিয়ায়।

সবধরনের বাস্তুতন্ত্রকেই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। এই উদ্যোগ সাধারণ জনগণ যেমন ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করতে পারে, তেমনি সামাজিক, সাংগঠনিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থের বাস্তুতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। বাস্তুতন্ত্র মানুষের বেঁচে থাকার প্রায় সকল উপাদানই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে যোগান দিতে পারে। বাস্তুতন্ত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমায়, মহামারীসহ নানা ধরনের রোগবালাই থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-২০৩০) অর্জনের পথেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বাস্তুতন্ত্র। তাই বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

This Bengali article discusses how regaining ecosystems can contribute towards solving climate change problem.

Feature Image : UN

Related Articles