১৭৯৬ সালের কথা। ইংল্যান্ডের বার্কলিতে অবস্থানরত একজন চিকিৎসক ডঃ এডওয়ার্ড জেনার একদিন লক্ষ্য করেন যে, বাড়ি বাড়ি গরুর দুধ দিয়ে বেড়ানো মেয়েটির দেহে স্মলপক্স অর্থাৎ গুটিবসন্ত রোগের সংক্রমণ হয়নি। আশেপাশের মানুষজন গুটিবসন্তে আক্রান্ত হচ্ছে, কিন্তু প্রচন্ড সংক্রমণশালী এই গুটিবসন্ত মেয়েটিকে কিছুতেই সংক্রমণ করতে পারছে না। তখনকার দিনে শতবছর ধরে টিকে থাকা এ রোগে মানুষের মৃত্যুহার ছিলো অনেক বেশি। গত শতাব্দীতেও প্রতি দশজনে তিনজনের মৃত্যু হতো, এতটাই ভয়ানক এক রোগ এই গুটিবসন্ত।
ডঃ জেনার সাহেব সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি এই মেয়েটিকে পরীক্ষা করে দেখবেন, কোনো একভাবে নিশ্চয়ই মেয়েটির শরীরে গুটিবসন্ত সৃষ্টিকারী ভ্যারিওলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা তৈরি হয়েছে। যদি সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি পুনরায় তৈরি করা যায়, তবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো যাবে। ডঃ এডওয়ার্ড জেনার এই বিষয়টিকে খতিয়ে দেখতে একদিন মেয়েটির বাড়ি যান। তিনি দেখতে পান যে, মেয়েটির বাড়িতে গরুগুলো সবই গোবসন্তে আক্রান্ত। গুটিবসন্তের মতো গরুতেও একধরনের বসন্তরোগ হয়ে থাকে, এরই নাম ছিলো গোবসন্ত। গরুর শরীরেও তরলপূর্ণ ছোট ছোট গুটি দেখা যেতো।
জেনার সাহেব বুঝতে পারেন যে, হয়তো কোনো একভাবে গরুটির সংস্পর্শে থেকে মেয়েটির শরীরে গোবসন্ত সংক্রমিত হয়েছে, গোবসন্ত মানবদেহে কোনো রোগ তৈরি করতে পারেনি, একইসাথে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
ডঃ জেনার সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি এই ধারণাটি পরীক্ষা করে দেখবেন। ৮ বছর বয়সী একটি বাচ্চা ছেলের দেহে তিনি একটু ক্ষতসৃষ্টি করে সেখানে গোবসন্তের ক্ষত থেকে সংগৃহীত তরল লাগিয়ে দেন। বাচ্চাটির ক্ষতস্থানটি তাৎক্ষণিক ভাবে ফুলে উঠলেও কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায় সবকিছু।
ডঃ জেনার কিছুদিন পর বাচ্চাটির দেহে আবারো একইভাবে জীবাণু প্রবেশ করান। তবে এবার গোবসন্তের জীবাণু নয়, তরতাজা গুটিবসন্তের জীবাণু প্রবেশ করান তিনি। বাচ্চাটি অল্প অসুস্থ হয়ে কয়দিনের ভেতর সুস্থ হয়ে উঠে, গুটিবসন্ত শিশুটিকে আর আক্রান্ত করতে পারছে না। ডঃ জেনার বুঝতে পারেন যে, এভাবে গুটিবসন্তের কবল হতে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে এই টিকা পদ্ধতির খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সব এলাকায় চিকিৎসকরা একইভাবে মানুষকে টিকা প্রদান করতে শুরু করেন।
দিনে দিনে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয়েছে আরো উন্নত ধরনের টিকাপদ্ধতি। শুধু তা-ই নয়, মারণক্ষয়ী ছোঁয়াছে রোগ পোলিও, হাম, যক্ষ্মা, হেপাটাইটিস-বি, হুপিং কাঁশি, ধনুষ্টংকারসহ প্রভৃতির বিরুদ্ধেও টিকা আবিষ্কৃত হয়। মানবজাতি সভ্য হবার সময়কাল থেকেই ক্ষতিকারক সব জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিকার এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে, চিকিৎসাবিজ্ঞান যখন উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে, জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিকার এবং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে।
সব রোগেরই প্রতিকার অর্থাৎ কোনো রোগ হলে সেটির চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়েছে। এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা কেউ যদি আক্রান্ত হয় একসময় তার এইডস দেখা দেয়, তার মৃত্যু নিশ্চিত কিন্তু সেখানেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের চিকিৎসা উপস্থিত। ‘অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ড্রাগ’; এর মাধ্যমে একজন এইডস রোগীর জীবনকে কিছু দীর্ঘায়ু করা সম্ভব, রোগী যতদিন বেঁচে থাকবেন, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করে যেতে পারবেন। আর যে সমস্ত রোগের সমাধা করা যায়নি, সেসব নিয়েও বিশ্বজুড়ে চলছে বিস্তর গবেষণা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি কথা রয়েছে যে, প্রতিকারের চেয়ে কোনো রোগকে প্রতিরোধ করতে পারাটাই সবচেয়ে ভালো। চিকিৎসাবিজ্ঞান সবার পূর্বে এই ব্যাপারে কাজ করেন যে, রোগটির বিরুদ্ধে পুরোপুরি প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় কিনা। এসব নিয়েও চলছে গবেষণা। পৃথিবীর প্রতিটি বিন্দুতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র জীবাণু। খালি চোখে দেখতে পাই না আমরা, কিন্তু এদের অস্তিত্ব অনুভব করি।
প্রাণী কিংবা উদ্ভিদে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় এসমস্ত অণুজীবেরা। কিছু অণুজীব আমাদের মানবজাতির জন্য নানান বিষয়ে উপকারী, আবার কিছু প্রজাতি অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসমস্ত ক্ষতিকর অণুজীবেরা মানুষের শরীরে কিংবা আমাদের উপকারী প্রাণী কিংবা উদ্ভিদদেহে রোগ সৃষ্টি করে থাকে। সমস্ত অণুজীবের জন্যই তাদের পোষকদেহ নির্দিষ্ট, কেননা নির্দিষ্ট পরিবেশ ছাড়া তারা বাঁচতে সক্ষম নয়। যেমন ম্যালেরিয়া পরজীবী, তার জীবনচক্রের অর্ধেকটা কাটায় মানবদেহে আর বাকি অর্ধেকটা মশকীদেহে। মশকীদেহ বলতে সবধরনের মশার প্রজাতিতে নয়, কেবলমাত্র অ্যানোফিলিস মশকী। কারণ অন্যসব মশকীদেহের লালাগ্রন্থিতে উপস্থিত এক বিষাক্ত এনজাইমের কারণে এরা ধ্বংস হয়ে যায়।
রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাবলীকে নির্ভর করতে হয় মানবদেহে স্রষ্টা প্রদত্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর। মানবদেহের সবচেয়ে বিস্ময়কর একটি ব্যবস্থা হলো এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। খুবই শক্তিশালী এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট অণুজীব যা দিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা রোগে আক্রান্ত হই, কোনোভাবে যদি অণুজীবগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়, তবেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি সেসব অণুজীবের বিরুদ্ধে কাজ করে সক্ষম হবে। মানব ইতিহাসের প্রথম টিকা গুটিবসন্ত টিকা আবিষ্কারের সময়, ঠিক এই ধারণাটিই কাজে লাগিয়েছিলেন ডঃ এডওয়ার্ড জেনার।
ভ্যারিওলা ভাইরাস বসন্ত রোগ সৃষ্টি করে, এর ভিন্ন দুইটি টাইপের (এই ভাইরাসের সর্বমোট ৪টি টাইপ রয়েছে) একটি থেকে গরুদেহে, আরেকটি থেকে মানবদেহে বসন্ত হয়। গরুদেহের ভাইরাস মানবদেহে উপস্থিত থাকার কারণে অন্য টাইপটি বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারে না। আর গোবসন্তের জীবাণুও মানবদেহে রোগ তৈরিতে অক্ষম। কেবলমাত্র এই ধারণাকে ব্যবহার করেই তৈরি করা হয়েছে অন্যান্য রোগের টিকাগুলো। ১৮৮৫ সালে লুই পাস্তুর যখন জলাতংকের প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলেন, তিনিও ডঃ জেনারের পদ্ধতি অনুসরণ করেন।
রোগকে প্রতিরোধ করতে টিকা প্রদান করা হয়। নবজাতককে জন্মের পরপরই ১০টি রোগের বিরুদ্ধে ৬টি টিকা বাংলাদেশ সরকার EPI কর্মসূচীর মাধ্যমে ইতোমধ্যেই নিশ্চিত করেছে। একটি শিশুর জন্মের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় টিকাদান, ১৫ মাস বয়স পূর্ণ হতে হতে সবগুলো টিকা দিয়ে শেষ করা হয়। গুটিবসন্ত রোগটির ইতিহাস বহু পুরনো, প্রাচীন মিশরীয় মমিতেও গুটিবসন্তের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিলো।
গুটিবসন্তের গ্রাস থেকে বাঁচাতে মানবজাতিকে টিকাদানের ফলে, গুটিবসন্তের ভাইরাসটিই পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়ে গেছে একটাসময়। বিংশ শতাব্দীতেই পুরো বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ মারা যায় এই গুটিবসন্ত রোগে। অবশেষে ১৯৮০ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা দেয় যে, গুটিবসন্ত রোগটি শতভাগ নির্মূল সম্ভব হয়েছে। শেষবার এ রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছিলো ১৯৭৭ সালে।
গুটিবসন্তের সর্বশেষ রোগীদের মাঝে বাংলাদেশী একটি শিশুও ছিলো। তখনকার সময়ে কেউ গুটিবসন্তের সন্ধান দিতে পারলে পুরষ্কার দেবার ঘোষণা করা হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের দিকে, তিনবছর বয়সী শিশুকন্যা রহিমা বানুর খোঁজ যখন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়, রহিমাকে নিজের বাড়িতে সবার থেকে আলাদা করে রাখার উদ্যোগ নেয়া যাতে আশেপাশের মানুষের মধ্যে এ রোগ ছড়াতে না পারে। ঐ এলাকায় দ্রুত সবাইকে গুটিবসন্তের টিকা দেয়া শুরু করা হয়। এছাড়াও পুরো গ্রামে গুটিবসন্ত নির্মূল কর্মসূচী থেকে নিযুক্ত একজন কর্মকর্তা পরীক্ষা করে দেখেন কারো মাঝে গুটিবসন্তের লক্ষণ পাওয়া যায় কিনা। রহিমার সুস্থতা নিশ্চিত হবার পরই কেবল তাকে পরিবারের সবার সাথে মিশতে দেয়া হয়।
পরবর্তীতে সোমালিয়ায় একজনকে খুঁজে পাওয়া যায়, যাকে প্রাথমিকভাবে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ভাবা হয়। বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গুটিবসন্ত নির্মূল কর্মসূচীর একজন কর্মী নিশ্চিত করেন যে, মানুষটি গুটিবসন্তে আক্রান্ত। পর্যাপ্ত চিকিৎসা এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় চিকিৎসার মাধ্যমে তাকেও সুস্থ করে তোলা হয়।
ডঃ জেনার সাহেব আবিষ্কৃত প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনুসরণ করে করে গুটিবসন্ত রোগকে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করতে প্রায় ২০০ বছরের মতো সময় লেগে যায়। এই গুটিবসন্তের টিকা ছিলো প্রথম আবিষ্কৃত টিকা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অবদানে টিকাদানের ফলে এই গুটিবসন্তই বর্তমানে প্রথম ও একমাত্র নির্মূলকৃত রোগ।