২০০০ সালের আশেপাশের সময়টাতে যারা শৈশব কৈশোর কাটিয়েছেন, তারা অনেকেই ফ্যান্টমের সাথে পরিচিত। না, সাইফ আলি খানের ফ্যান্টম মুভির কথা বলা হচ্ছে না, আমাদের ছোটবেলার প্রিয় কমিকবুক হিরো ফ্যান্টমের কথা বলছি। ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডার-ম্যানদের সাথে পরিচিত হওয়ার আগে এই ফ্যান্টমই ছিল আমাদের সুপারহিরো। চলুন আরেকবার স্মৃতির পাতায় ডুব মারি এবং জেনে আসি ফ্যান্টমের আদ্যোপান্ত!
আঁটসাঁট বেগুনি পোশাক এবং ডমিনো মাস্ক পড়া চরিত্রটিকে সর্বপ্রথম দেখা যায় ১৯৩৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক পত্রিকার কমিক স্ট্রিপে। ম্যানড্রেক দ্য ম্যাজিশিয়ান চরিত্রের নির্মাতা লি ফকই ছিলেন । ‘দ্য সিং ব্রাদারহুড’ স্টোরি দিয়ে শুরু হয় ফ্যান্টমের পথচলা ফ্যান্টমের কারিগর। অন্য ফিকশনাল চরিত্র- মোগলি, টারজান এবং যোরোর মিশেলে তিনি রচনা করেন তার ফ্যান্টম। তবে তিনি ভেবে রেখেছিলেন, মাসখানেক চালানোর পর ফ্যান্টম সিরিজটির ইতি টানবেন। অবশ্য এর পেছনে কারণও ছিল। ফ্যান্টম নামে এর আগেও বেশ কয়েকটি চরিত্র পাওয়া গিয়েছিল বিধায় ফক ভেবেছিলেন, ধূসর কস্টিউম পরিয়ে চরিত্রটির নাম দেবেন ‘গ্রে ঘোস্ট’। কিন্তু শেষমেশ ওই ফ্যান্টম নামটাই তিনি বেছে নেন। যে চরিত্র মাসখানেকের বেশি ধরে রাখতে চাননি, সেই চরিত্রই ফককে অমর করে দিল।
ভক্তদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠা চরিত্রটিকে নিয়ে আসা হয় কমিকস বইয়ের দুনিয়ায়। বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হতে থাকে ফ্যান্টম কমিকস। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর বাংলা অনুবাদ করা হয়। ভারতীয় বাংলার অরণ্যদেব বা বেতাল হচ্ছে এই ফ্যান্টমই। ১৯৯৯ সালে মারা যান ফক। তার শেষ দুটি গল্প ‘টেরর অ্যাট দ্য অপেরা’ আর ‘দ্য কিডন্যাপারস’ শেষ করেন তার স্ত্রী এলিজাবেথ। এখন ফ্যান্টম সিরিজ লেখেন টনি ডি পল।
আফ্রিকার এক কাল্পনিক দেশ বাংগালার জংগলে এক জনশ্রুতি আছে, এক চলমান অশরীরীকে নিয়ে, (দ্য ম্যান হু ওয়াকস) যে কিনা যুগ যুগ ধরে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে অসহায়দের রক্ষক হিসেবে। এতটা সময় ধরে টিকে থাকার কারণে অনেকেরই ধারণা সে অমর। প্রকৃতপক্ষে, ফ্যান্টম হচ্ছে বংশানুক্রমে টিকে থাকা ক্রাইম ফাইটার, যা বর্তমান ফ্যান্টমের পূর্বের ২০ বংশ ধরে চলছে। বংশানুক্রমে তারা প্রত্যেকেই একই পোশাকের ফ্যান্টম পরিচয় গ্রহণ করে যে কারণে, বাইরের লোকদের কাছে কখনো প্রকাশিত হয় না। এভাবেই ফ্যান্টম নিজের অমরত্বের গুজব বাস্তব করে রেখেছে সবার কাছে। প্রত্যেক ফ্যান্টমের মৃত্যুর সময় তার ছেলে দায়িত্ব গ্রহণ করে সেই বিখ্যাত খুলির শপথ পাঠ করে,
“আমি জলদস্যু, লোভ, নিষ্ঠুরতা, অন্যায় এবং তাদের সকল মাধ্যমের ধ্বংসে আমার জীবন উৎসর্গ করছি। আমার সন্তান এবং তার উত্তরসূরিরাও আমার পথ অনুসরণ করবে।”
ফ্যান্টমের ইতিহাস শুরু হয় ক্রিস্টোফার ওয়াকার নামের এক তরুণ নাবিককে দিয়ে। ১৫১৬ সালে ক্রিস্টোফারের জন্ম হয় পোর্টসমাউথ শহরে। জীবিকা হিসেবে নাবিক বাবার পথই সে অনুসরণ করে। ক্রিস্টোফার ওয়াকার সিনিয়র ছিলেন আমেরিকাগামী কলম্বাসের জাহাজ সান্তা মারিয়ার নাবিক।
১৫৩৬ সালে ২০ বছর বয়সী ক্রিস্টোফার তার বাবার শেষ সমুদ্রযাত্রার সঙ্গী হয়। জলদস্যুদের আচমকা আক্রমণ আসে জাহাজে এবং ক্রিস্টোফার সিনিয়রের মৃত্যু হয়। পুরো জাহাজে বেঁচে থাকা একমাত্র জীবিত ব্যক্তি ক্রিস্টোফার অচেতন অবস্থায় বাংগালার সমুদ্র সৈকতে ভেসে উঠে। বাংগালা দেশটির অবস্থান কখনো দেখানো হয়েছে এশিয়াতে, কখনো আফ্রিকায়। সেখানকার বান্দার গোত্রের পিগমিরা তাকে খুঁজে পেয়ে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলে। মৃত বাবার খুলি হাতে নিয়ে সেই শপথ করে ক্রিস্টোফার। পিগমিরা তাকে মানুষের খুলির আকৃতির এক গুহার সন্ধান দেয়, যেটায় বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে বসবাসের উপযোগী করে তোলে সে। খুলিগুহা (দ্য স্কাল কেইভ) হয়ে ওঠে তার ঘর। এক দেবতার উপর ভিত্তি করে বানানো পোশাক পরে সে সবার কাছে ফ্যান্টম হিসেবে পরিচিতি পায়। ক্রিস্টোফারের মৃত্যুর পর তার ছেলে ফ্যান্টম হয়। ২য় ফ্যান্টমের মৃত্যুর পর তার ছেলে ফ্যান্টম হয়ে ওঠে, বংশানুক্রমে এই ধারা চলতে থাকে। তবে, সব সময় ছেলেরাই যে ফ্যান্টম হয় তা না, সময়ের প্রয়োজনে কখনো নারী ফ্যান্টমও দেখা যায়। ১৭তম ফ্যান্টমের আহত থাকা অবস্থায় তার যমজ বোন জুলি ওয়াকার ফ্যান্টম কস্টিউম পরে একদল জলদস্যুকে হারায়। এভাবে ২১ বংশ ধরে ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে রয়েছে ফ্যান্টমের অস্তিত্ব। সে হয়ে ওঠে বাঙ্গালার জঙ্গলের রক্ষক। মানুষজন তার নাম দেয় ‘দ্য ঘোস্ট হু ওয়াকস’ এবং ‘দ্য ম্যান হু ক্যান নট ডাই’
বর্তমান ফ্যান্টম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ২১তম ফ্যান্টম, কিট ওয়াকার। বাংগালার জঙ্গলে শৈশব কাটানো কিট, ১২ বছর বয়সে লেখাপড়া করতে মিসৌরির ক্লার্কসভিল শহরে যায় তার আন্টি লুসি এবং আংকেল জ্যাসপারের সাথে। এখানেই সে পরিচিত হয় প্রেমিকা ডায়ানা পামারের সাথে। শিক্ষাজীবনে কিট অত্যন্ত দক্ষ খেলোয়াড় হয়ে ওঠে, এমনকি তখনকার ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়নকেও সে হারায়। সফল ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে সে বাংগালার জঙ্গলে ফিরে যায়। কিটের প্রিয় বন্ধু পিগমি গোত্রের সর্দার গুরান (একমাত্র পিগমিরাই ফ্যান্টমদের আসল পরিচয় জানে) তাকে জানায় যে, কিটের বাবা ছুরিকাঘাতে মারা যাচ্ছে। কিটের বাবার খুনি ছিল রাম সিং নামের এক জলদস্যু যে ২০তম ফ্যান্টমকে সিং ব্রাদারহুডের জাহাজ আটক করতে সহায়তা করার নামে বিশ্বাসঘাতকতা করে পিছন থেকে ছুরি মেরে ফ্যান্টমের বিশেষ গানবেল্ট হাতিয়ে নিয়ে পালায়। কিট অবশেষে গুলিক দ্বীপে রাম সিংকে খুঁজে পায় এবং তাকে হারিয়ে বাবার গানবেল্ট পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু রামা সিং পুলিশের কাছে ধরা দেবার বদলে বোমা মেরে নিজের সঙ্গীসাথীসহ আস্তানা বোমা মেরে উড়িয়ে আত্মহত্যা করে।
কিট ওয়াকারের ছদ্মনাম হচ্ছে জিওফ্রে প্রেসকট। ফ্যান্টম হিসেবে কিটের অবিচ্ছেদ্য দুই সঙ্গী ছিল ডেভিল (বাঘা) নামের এক পাহাড়ি নেকড়ে এবং হিরো (বিদ্যুৎ) নামের এক ঘোড়া। এছাড়াও তার পোষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফ্রাকা নামের এক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বাজপাখি এবং সলোমন ও নেফারতিতি নামের দুই ডলফিন। ১৯৬২ সালে সে রেক্স কিং নামের এক অনাথ ছেলেকে দত্তক নেয় পরবর্তীতে জানা যায়, রেক্স হচ্ছে বাঙ্গালার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বারোনকানের যুবরাজ। ১৯৭৭ সালে ইউনাইটেড নেশন্সে কর্মরত প্রেমিকা ডায়ানা পামারকে বিয়ে করে কিট। দাম্পত্যজীবনে কিট এবং হেলিওজ নামে তাদের দুই যমজ সন্তান হয়।
অফিশিয়াল কস্টিউম হিসেবে সব ফ্যান্টমদের পোশাক হল আঁটসাঁট বেগুনি বডিস্যুটের সাথে পরিচয় গোপনের জন্য কালো ডমিনো মাস্ক। একটি খুলি আঁকা গানবেল্ট এবং একটি ড্যাগার ছাড়াও আগ্নেয়াস্ত হিসেবে দুটি .৪৫ পিস্তল ব্যবহার করে। যদিও ফ্যান্টম তার শত্রুদের কখনো খুন করার উদ্দেশ্যে গুলি করে না। টিপিকাল সুপারহিরোদের মত ফ্যান্টমের কোন সুপারপাওয়ার নেই, সে পুরোপুরি নিজের বুদ্ধিমত্তা, ক্ষিপ্রতা এবং মার্শাল আর্ট ট্রেনিং এর উপর নির্ভর করে। সে সময়ে যোরো, দ্য শ্যাডো, দ্য ক্লকের মত ক্রাইমফাইটাররা থাকলেও প্রথম ফিকশনাল ক্যারেক্টার হিসেবে ফ্যান্টমই স্কিনটাইট কস্টিউম এবং ডমিনো মাস্ক ব্যবহার শুরু করে যা পরবর্তীতে সুপারহিরোদের ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়ায়। ফ্যান্টমের আরেক বিশেষত্ব হচ্ছে তার ২ হাতের আংটি। বাম হাতের আংটিতে চারটি তলোয়ারের তৈরি ক্রসচিহ্ন নির্দেশ করে ‘দ্য গুড মার্ক’ যে সে তার বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের দিয়ে থাকে যোগাযোগ রক্ষার জন্য। ডান হাতের আংটিতে রয়েছে খুলির নকশা, শত্রুদের সাথে লড়াইয়ের সময় ফ্যান্টমের ঘুষিতে শত্রুদের দেহে এই খুলির দাগ রয়ে যায়।
ফ্যান্টমের শত্রুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছে সিং ব্রাদারহুড নামের জলদস্যু দল যারা শতবছর ধরে সক্রিয় এবং ২০তম ফ্যান্টমের খুনি। ফ্যান্টমের সাথে বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে আরেকটি অপরাধী সংগঠন স্কাই ব্যান্ড, মহিলা আকাশদস্যুদের একটি দল।ইস্টার্ন ডার্ক অঞ্চলের কুখ্যাত অপরাধীদের বিরুদ্ধেও বংশানুক্রমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ফ্যান্টমরা। এছাড়াও জলদস্যুনেতা ব্যারন গ্রোভার, সন্ত্রাসী কমান্ডার স্কাল, চরমপন্থি জেনারেল বাবাবুরা হচ্ছে ফ্যান্টমের জনপ্রিয় ভিলেনরা। বর্তমান ফ্যান্টমের অন্যান্য শত্রুদের মধ্যে রেবেকা ম্যাডিসন (ফ্যান্টম ২০৪০ সিরিজ) এবং জেন্ডার ড্র্যাক্স (১৯৯৬ সালের চলচ্চিত্রে) অন্তর্ভুক্ত।
১৯৪৩ সালে কলম্বিয়া পিকচারস দ্বারা নির্মিত হয় “দ্য ফ্যান্টম” টিভি সিরিজ যেখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন টম টাইলার। ১৯৯৬ সালে প্যারামাউন্ট পিকচারস নির্মাণ করে ফ্যান্টমের লাইভ অ্যাকশন মুভি । বিলি জেন এবং ক্রিস্টি সোয়ানসন মুভিটিতে যথাক্রমে ফ্যান্টম এবং ডায়ানা পামারের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
এছাড়াও ‘ফ্যান্টম ২০৪০, ডিফেন্ডার অভ দ্য আর্থ’ নামক অ্যানিমেটেড সিরিজগুলোতে ফ্যান্টমকে দেখা যায়। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার ফ্যান্টমের মুভি করার কথা থাকলেও ভক্তদের হতাশ হতে হয় শেষ পর্যন্ত।