Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সালমান শাহর সেরা ৫ সিনেমা

সালমান শাহ! এই একটি নাম বাংলা সিনেমার জগতে অনেকগুলো প্রতিশব্দ বহন করে। বাংলা চলচ্চিত্রের যুবরাজ বলুন স্টাইল আইকন বলুন, মাথায় এই একটি নামই আসবে। আবার বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির নামও সালমান শাহ। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ক্যারিয়ারে এমন এক প্রভাব তিনি রেখে গেছেন যে, তার প্রস্থানের ২৩ বছর পরেও তাকে নিয়ে হচ্ছে সেই একই পরিমাণ আলোচনা!

এই স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি মোট ২৭টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন, যার মধ্যে সিংহভাগ সিনেমাই ব্যবসায়িক দিক থেকে করেছে বাজিমাত। এই ২৭টি ছবির মধ্যে মাত্র পাঁচটি ছবি বেছে নেওয়া কিছুটা দুরূহ, তবুও ব্যবসায়িক সাফল্য ও সমালোচকদের মতামত– এই দুটি দিক বিবেচনা করে সালমান শাহর ক্যারিয়ারের সেরা পাঁচটি সিনেমা নিয়ে সাজিনো হয়েছে আজকের প্রবন্ধটি।

কেয়ামত থেকে কেয়ামত 

নব্বইয়ের দশকের অধিকাংশ সিনেমার কাহিনী ছিল পরিবার নির্ভর, তরুণ প্রজন্মের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে সিনেমা নির্মাণ সেভাবে হচ্ছিল না। এমনই এক সময়ে নাইম-শাবনাজ জুটির মাধ্যমে তারুণ্যের গল্প আবারো বাংলা সেলুলয়েডের পর্দায় ফিরে আসে। এই জুটির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন এক তরুণ জুটিকে দিয়ে সিনেমা নির্মাণদের সিদ্ধান্ত নেন সোহানুর রহমান সোহান। এই সিনেমার নায়ক হিসেবে ২১ বছরের এক যুবককে বেছে নেন তিনি। শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন নামের সেই যুবকই পরিচালক সোহানের হাত ধরে সিনেমার জগতে লেখান সালমান শাহ হিসেবে। 

স্টাইল আইকন সালমান শাহ; Image Source: Youtube

নায়িকা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় সেই সময়ের আনন্দবিচিত্রা ফটোসুন্দরি মৌসুমিকে। এই নতুন জুটিকে নিয়ে আনন্দমেলা সিনেমার ব্যানারে ১৯৯৩ সালের ২৫শে মার্চ ঈদে মুক্তি পায় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। তুমুল জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ এর অফিসিয়াল রিমেক হওয়ায় গান থেকে শুরু করে কাহিনী– সবকিছুতেই হিন্দি সিনেমাটিকে অনুসরণ করা হয়। সিনেমার মূল কাহিনী শুরু হয় মির্জা ও খান পরিবারের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। তবে এই দ্বন্দ্বের দেয়াল ভেঙে মির্জা পরিবারের ছেলে রাজ ও খান পরিবারের মেয়ে রেশমি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এই প্রেমের কাহিনীকে ঘিরেই পুরো সিনেমার গল্প আবর্তিত হয়েছিল। 

রিমেক হওয়া সত্ত্বেও প্রেক্ষাগৃহে তাক লাগিয়ে দেয় এই সিনেমা, নতুন এই জুটিকে সাদর আমন্ত্রণে গ্রহণ করে নেন এদেশের সিনেমাপাগল মানুষ। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় সালমান শাহর কথা, বলিউডে রাজ চরিত্রে আমির খানের মতো একজন নায়ক অভিনয় করলেও নবাগত সালমান শাহ কিন্তু তাকে অনুকরণ করেননি। তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে এই চরিত্রে অভিনয় করতে আর তার সেই চেষ্টার কারণেই সিনেমাটি এমন দুর্দান্ত ব্যবসা করতে সক্ষম হয়। ঢালিউডের ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ আয় করা সিনেমা এই সিনেমা তখন আয় করেছিলো প্রায় ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। তাছাড়া এই সিনেমার মধ্য দিয়েই সঙ্গীত শিল্পী আগুনের অভিষেক ঘটে, তার গাওয়া সবগুলো গান চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা পায়। 

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: Youtube

প্রথম ছবিতেই এমন অভাবনীয় সাফল্যের কারণে সালমান শাহ-মৌসুমি জুটি নিয়ে সেই সময়ে প্রত্যাশার পারদ ছিল অনেক উঁচুতে, কিন্তু তুচ্ছ একটি ঘটনায় সৃষ্ট মনোমালিন্যর কারণে তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বের সম্পর্কে ফাটল ধরে। ফলে তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও মাত্র চারটি সিনেমা করেই এই জুটির যাত্রা থেমে যায়।

বিক্ষোভ

মৌসুমির সাথে জুটি ভেঙে যাওয়ায় পরবর্তীতে সেই সময়ের আরেক উঠতি নায়িকা শাবনূরের সাথে জুটি বাঁধেন সালমান শাহ। এই জুটি গড়ার আগে অল্প কিছু সিনেমায় শাবনূর অভিনয় করলেও সেগুলোর কোনোটাই ব্যবসায়িকভাবে সাফল্যের মুখ দেখেনি। তাই তাকে নায়িকা হিসেবে নিয়ে সালমান শাহ কতটুকু সাফল্য পাবে তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ ছিল। কিন্তু সবার সব সংশয় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এখানেও তিনি সফল, শাবনূরের সাথে তার জুটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরা জুটিগুলোর তালিকা করলে একদম উপরের দিকেই তাদের নাম পাওয়া যায়।

এই জুটি অভিনীত মোট সিনেমার সংখ্যা ১৪টি, যার মধ্যে অধিকাংশ সিনেমা মূলত রোমান্টিক ধাঁচের। তবে ডি এম ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত বিক্ষোভ সিনেমাটি ব্যতিক্রম, রোমান্টিক এই জুটিকে নিয়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে দারুণ একটি অ্যাকশন নির্ভর সিনেমা তৈরি করেন মহম্মদ হান্নান। 

পোস্টারেও বিক্ষোভকে ব্যতিক্রমধর্মী ছবি হিসেবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল; Image Source: Youtube

গল্পের শুরুটা হয় আসাদ নামের এক শ্রমিক নেতার মৃত্যুর মাধ্যমে, তারই দুই বন্ধু মাহমুদ চৌধুরী ও শারাফাত আলী খান ষড়যন্ত্র করে তাকে খুন করে। তবে একা রাজত্ব করার আশায় শারাফাতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে চৌধুরী, আসাদকে খুনের দায়ে ১৪ বছরের জেল হয়ে যায় শারাফাতের। এই দীর্ঘ সময়ে একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয় মাহমুদ চৌধুরী, নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য কলেজে বিভিন্ন ক্যাডার পুষে তাদের দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চায় সে।

কিন্তু তারই হাতে খুন হওয়া আসাদের ছেলে অনিক তখন সেই কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি, বাবার মতো অনিকও চৌধুরীর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। চৌধুরীর মেয়ে নূপুরও একই কলেজে পড়তো, এই অন্যায়ের প্রতিবাদে অনিকের পাশে দাঁড়ায় সে। এদিকে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেই একটি সংবাদপত্র চালু করে চৌধুরীর সব কুকীর্তি ফাঁস কর‍তে থাকে শারাফাত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব সাথে কলেজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা ঘিরেই এগিয়ে গেছে পুরো গল্প।

সালমান শাহ ও শাবনূর ছাড়া সিনেমার অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডলি জহুর, রাজিব, তুষার খান, নাসির খান, দিলদারের মতো শিল্পীরা, তারা প্রত্যেকেই নিজের সেরাটা দিয়ে সিনেমাটা উপভোগ্য করে তুলেছিলেন। রাজিব ও নাসির খানের মধ্যকার দ্বৈরথটি ছিল ভীষণ উপভোগ্য। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে সিনেমার গানগুলোও ছিল অসাধারণ, বিশেষ করে ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়’ এবং ‘একাত্তরের মা-জননী’ গান দুটি তো আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। এসব কারণে ১৯৯৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবেও দারুণ সাফল্য পায়।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে এই সিনেমাটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে সালমান শাহর ব্যতিক্রমধর্মী অভিনয়ের জন্য, ছাত্রনেতা হিসেবে তার নির্ভীক আচরণ ছিল পুরো সিনেমার মূল আকর্ষণ। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে পরিচিত হলেও অ্যাকশন নায়ক হিসেবে তার যোগ্যতা যে কোনো অংশেই কম ছিল না, এই সিনেমার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়ে যায়।

স্বপ্নের ঠিকানা

সালমান শাহ-শাবনূর জুটির সবগুলো ছবিই ব্যবসায়িকভাবে সফল। তবে এটলাস ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ সিনেমাটির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হবে। ব্যবসায়িকভাবে সালমান শাহর ক্যারিয়ারের সফলতম সিনেমা এই ‘স্বপ্নের ঠিকানা’। এম.এ. খালেকের পরিচালনায় ১৯৯৫ সালের ১১ মে ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পায় এই সিনেমাটি। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই একই দিনে মৌসুমি-ওমর সানি জুটির ছবি মুক্তি পাওয়ায় ঢাকার নামকরা হলগুলো এই সিনেমা নিতে চায়নি! কিন্তু মফস্বলের প্রেক্ষাগৃহে এই ছবির অভাবনীয় সাফল্যের কারণে পরের সপ্তাহেই সিনেমাটি ঢাকায় মুক্তি পায়। 

‘স্বপ্নের ঠিকানা’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: Youtube

সিনেমাটির গল্প অবশ্য খুবই সাদামাটা ছিল, বড়লোকের ছেলে সুমন ও গরীব ঘরের মেয়ে সুমির মাঝে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু সুমনের বাবার বন্ধুর মেয়ে ফারাহ আবার ছোটবেলা থেকেই সুমনকে ভালোবাসে। নব্বইয়ের দশকের সেই চিরচেনা ফর্মুলা ত্রিকোণ প্রেমের টানাপোড়েন নিয়েই এগিয়ে গেছে পুরো গল্প। তবে গল্প চিরচেনা হলেও পরিচালকের মুনশিয়ানায় সেটা হয়েছে উপভোগ্য। সালমান শাহ আর শাবনূরের রসায়নটা ছিল দেখার মতো, ফারাহর মতো আধুনিক মেয়ের চরিত্রে সোনিয়াও দারুণ অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন চরিত্রে রাজীব, প্রবীর মিত্র, আবুল হায়াত, দিলদার, ডলি জহুরের মতো শক্তিমান অভিনেতারা থাকায় প্রতিটি চরিত্রই দারুণভাবে ফুটে উঠেছিলো।

উপমহাদেশে সিনেমা হিট হওয়ার পিছনে গানগুলো অনেক বড় ভূমিকা রাখে, স্বপ্নের ঠিকানাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক আর ‘ও সাথীরে যেওনা কখনো দূরে’ গান দুটি কালজয়ীর আসন দখল করে আছে। তাছাড়া হিন্দি গান থেকে অনুপ্রাণিত ‘নীল সাগর পার হয়ে’ গানটিও বেশ উপভোগ্য ছিল। আর এসব কারণেই প্রায় ১৯ কোটি টাকা আয় করা এই সিনেমা ঢালিউড বক্সঅফিসের ইতিহাসে এখনো দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে।

কন্যাদান

বর্তমান যুগের নায়করা নিজেদের চিরচেনা চরিত্র থেকে বের হয়ে নতুন কিছু করার ব্যাপারে তেমন একটা সাহস দেখান না, কিন্তু এদিক থেকেও সবার থেকে আলাদা ছিলেন সালমান শাহ। গৎবাঁধা সিনেমায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে গল্পনির্ভর পারিবারিক সিনেমাতেও তিনি অভিনয় করেছেন। ১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ‘কন্যাদান’ হচ্ছে এমনই একটি সিনেমা।

গল্পের শুরুটা হয় মানসিক রোগীর ডাক্তার শাহানাকে ঘিরে, তার স্বামীও একজন ডাক্তার। এই শাহানার কাছে শ্রাবণ নামের এক যুবক তার গর্ভবতী স্ত্রী বর্ষাকে নিয়ে আসে। শ্রাবণের ভুলে এক বছরের পুত্রকে হারিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে বর্ষা। শাহানা তার সবটুকু দিয়ে বর্ষাকে সুস্থ করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। এমনই এক সময়ে বর্ষা এক কন্যার জন্ম দেয়, কিন্তু মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় নিজের কন্যার দেখভাল করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এদিকে নিজের ভুলে আগের সন্তানকে হারানোয় এই সন্তানকে একা বড় করে তোলার সাহস শ্রাবণও দেখাতে পারছিলো না। 

চরিত্রের প্রয়োজনে এই সিনেমায় দুটি ভিন্ন পরিসাজে আবির্ভূত হন সালমান শাহ; Image Source: Youtube

শেষে নিঃসন্তান দম্পতি শাহানা ও তার স্বামীর কাছেই নিজের কন্যাকে রেখে আসে শ্রাবণ। এভাবে পাঁচ বছর চলে যাওয়ার পর শাহানার একাগ্র চেষ্টায় বর্ষা সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু এরপরেই শুরু হয় আসল টানাপোড়েন, সুস্থ হয়ে সবকিছু জানার পর নিজের কন্যা ঊর্মিকে ফিরে পেতে চায় বর্ষা। এদিকে ছোটবেলা থেকে নিজের কন্যাসম স্নেহে বড় করে তোলায় শাহানাও কিছুতেই ঊর্মিকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় না। এই টানটান উত্তেজনার মাঝেই এগিয়ে গেছে গল্প। এই সিনেমায় সালমান শাহর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন লিমা, তার পারফরম্যান্স আহামরি কিছু না হলেও শাবানা, আলমগীর আর হুমায়ূন ফরিদীর মতো শক্তিমান তিন অভিনেতা থাকায় সবমিলিয়ে অভিনয়গুণে সিনেমাটি বেশ সমৃদ্ধই ছিল।

সমালোচকদের দৃষ্টিতে সিনেমাটির কাহিনী ভীষণ প্রশংসিত হয়। তাছাড়া এই সিনেমায় দুটি ভিন্ন সময়ের পরিসাজে সালমান যেভাবে নিজের মাঝে পরিবর্তন এনেছিলো তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ব্যবসায়িকভাবে তেমন সাড়া জাগাতে না পারলেও এসব কারণেই ‘কন্যাদান’ সিনেমাটি সালমান শাহর সেরা পাঁচ সিনেমার একটি হয়ে থাকবে।

সত্যের মৃত্যু নেই

খুব অল্প সময়েই সালমান শাহ জনপ্রিয়তার একদম শীর্ষে উঠে যান, সবকিছু বেশ ভালোভাবেই চলছিলো। এমনই এক সময়ে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদটি এলো, ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে সবার প্রিয় নায়ক এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি জমান। সেদিন সকালে তার নিজের ঘরে সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ পাওয়া গেলেও ভক্তরা কিছুতেই প্রিয় নায়কের আত্মহত্যার ব্যাপারটা মানতে পারছিলেন না। হত্যা নাকি আত্মহত্যা – এই প্রশ্নের দোলাচলে পুরো দেশ যখন দোদুল্যমান ঠিক সেই সময়ে সালমান শাহর মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই মুক্তি পায় ছটকু আহমেদ পরিচালিত ‘সত্যের মৃত্যু নাই’

গল্পের শুরুটা হয় সালমা নামের এক সত্যবাদী মহিলার সাহসী পদক্ষেপ দিয়ে, কুখ্যাত সন্ত্রাসী হারকুলারের বিপক্ষে পুলিশের কাছে মামলা দায়ের করে সে। সেটার শোধ তুলতে হারকুলারের লোকজন তার বাসায় হামলা চালায় আর সেই হামলায় সালমার ছোট বোন মারা যায়। এদিকে ছোট বোনের স্বামী কিছুদিন পর আবার বিয়ে করে, সৎ মায়ের সংসারে বোনের ছেলে রানার কষ্ট হতে পারে সেটা ভেবে রানাকে নিজের কাছে রেখে দেয় সালমা।

কিন্তু রানার প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নিতে গিয়ে নিজের ছেলে জয়কে আস্তে আস্তে দূরে ঠেলে দেয় সালমা, ফলশ্রুতিতে রানা বড় হয়ে ব্যারিস্টার হলেও জয় হয়ে যায় রাস্তার ছেলে। সে সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে থাকে। ঘটনাক্রমে রানার বাবার খুনের আসামি হিসেবে অভিযুক্ত হয় যায় আর সেই খুনের সাক্ষী হিসেবে আদালতে ডাকা হয় সালমাকে। পরিস্থিতি ঠিকভাবে বুঝতে না পেরে জয়কে খুনি ভেবে তার বিপক্ষে সাক্ষী দেন সালমা। 

সিনেমা যখন বাস্তবের সাথে অনেক বেশিই মিলে যায়! Image Source: Youtube

নিজের ছেলের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে এগিয়ে দেওয়ায় চারিদিকে সালমার জয়ধ্বনি চলতে থাকে। কিন্তু জয়ের ফাঁসির দিন সালমা জানতে পারে যে জয় আসলে খুনটা করেইনি! যে সত্যকে প্রতিষ্ঠার আশায় নিজের ছেলেকে কুরবানি করতেও সালমা দ্বিধাবোধ করেনি, একদম শেষ মুহূর্তে এসে আসল সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে সালমা কি পারবে জয়কে বাঁচাতে? নাকি মিথ্যার জালে ফেঁসে গিয়ে সত্য ডুবে যাবে গভীর অন্তরালে? এই টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়েই এগিয়ে গেছে ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমার কাহিনী।

সিনেমায় সালমার চরিত্রে শাবানা এবং সালমার ছেলে জয়ের চরিত্রে সালমান শাহ অনবদ্য অভিনয় করেন, এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে আলমগীর, রাজিব, শাহনাজ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, মিশা সওদাগর প্রমুখ শিল্পীরা অভিনয় করেন। সালমান শাহর মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ পর এই সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় সিনেমাটি দেখতে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে জনতার ঢল নেমে আসে। সিনেমায় জয়ের ফাঁসির আগমুহূর্তে তার করুণ দৃশ্যগুলো যেন সালমানের সত্যিকারের মৃত্যুকেই ফুটিয়ে তুলছিলো। বিশেষ করে ফাঁসির চিঠি পাওয়ার পর সালমান যখন ‘চিঠি এলো জেলখানাতে অনেকদিনের পর’ গানটায় অভিনয় করেন, তখন হলের অনেক দর্শকই কান্নায় ভেঙে পড়েন। দর্শকদের এই তুমুল ভালোবাসার কারণে এই সিনেমা সর্বমোট প্রায় সাড়ে এগারো কোটি টাকা আয় করে, যা ঢালিউড বক্সঅফিসের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ আয় করা সিনেমা।      

দূর আকাশের ওই ঠিকানায় সালমান শাহ কেমন আছেন তা আমরা জানি না, তবে তাকে ছাড়া এই দেশের চলচ্চিত্র একদমই ভালো নেই। প্রিয় নায়কের প্রস্থানের ২৩ বছর পার হয়ে গেলেও তার রেখে যাওয়া শূন্যস্থান আজও পূরণ হয়নি। তবে আজকাল অনেকেই সালমানের তুমুল জনপ্রিয়তাকে হেয় করার জন্য নানা ধরনের কথা বলেন, তাদের মতে সালমান শাহর রহস্যময় মৃত্যুই নাকি তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ। এই কথাটা যে সম্পূর্ণ বানোয়াট তার প্রমাণ ঢালিউড বক্সঅফিস, সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমার তালিকায় প্রথম চারটি সিনেমার মধ্যে তিনটি সিনেমাই এই ক্ষণজন্মা নায়কের!

সালমান শাহর জনপ্রিয়তার আরেকটা বড় কারণ ছিল তার নিজস্ব সব স্টাইল, আজ এতবছর পরেও তার সেই সময়কার বিভিন্ন স্টাইলকে অনেক বেশি আধুনিক মনে হয়। আসলে নিজেকে কখনো একটা গণ্ডির মাঝে বেঁধে রাখতে চাননি তিনি, সেকারণেই ব্যাকব্রাশ করা ছোট চিপের চুল দিয়ে তুমুল জনপ্রিয় হলেও পরবর্তীতে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে চুল বড় করে ঝুঁটি বেঁধেও অভিনয় করেছেন। এসব কারণেই ধূমকেতুর মতো অল্প সময় বিরাজমান থেকেও বাংলা চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা হয়ে গেছেন তিনি।যতদিন বাংলা চলচ্চিত্র বেঁচে থাকবে, ততদিন নিজের এসব শিল্পকর্মের মাঝেই চিরঅমর হয়ে বেঁচে থাকবেন আমাদের সবার এই স্বপ্নের নায়ক।      

This article is in Bangla language. It's a review about some famous cinemas of Salman Shah. 

Featured Image: Daily Bangladesh

Related Articles