উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় হ্রদ এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিঠা পানির হ্রদ সুপিরিয়র। এ হ্রদ উত্তর আমেরিকা ও কানাডার এক বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে বিশ্বের স্বাদু পানির দশ ভাগ রয়েছে। হ্রদটি প্রায় ৩১,৭০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্রের মতো তার এপার-ওপার দেখা যায় না। লেক সুপিরিয়র বিশ্বের সবচেয়ে দ্বিতীয় গভীরতম, শীতলতম এবং বিশ্বের সমস্ত লেকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন।
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এর সৃষ্টি। তিনশোর বেশি ঝর্ণা ও নদীর পানি এসে মিশেছে এই হ্রদে। এই হ্রদের চারপাশে বৈচিত্র্যময় প্রাণিজগৎ প্রকৃতির এক অনবদ্য অবদান। এখানে আশিরও বেশি প্রজাতির জলজ প্রাণী এবং একশোর বেশি পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। অনন্য এই হ্রদ, তাকে ঘিরে থাকা আশ্চর্যের ভূমিরূপ, প্রাচীন গগনচুম্বী মহীরুহে ভরা অরণ্য, আরণ্যক ঝর্ণা ও অসংখ্য নদী- সবমিলিয়ে এ যেন ধরিত্রীর এক বিস্ময়। তাহলে চলুন, সেই বিস্ময়ালোকের কয়েকটি দর্শনীয় স্থান থেকে ঘুরে আসি।
তাহকামেনন জলপ্রপাত
উত্তর আমেরিকার মিশিগান আপার পেনিনসুলার নিউবেরি ও প্যারাডাইস নামে জায়গা দু’টির মাঝে এই তাহকামেনন ফলস স্টেট পার্ক। প্রায় ২০০ ফুট চওড়া এই জলপ্রপাত। সেকেন্ডে প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার লিটার পানি নিয়ে ৫০ ফুট নিচে আছড়ে পড়ছে এটি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এর পানির বর্ণ কমলা-বাদামি। এর জন্য আসলে দায়ী সেডার গাছের ট্যানিন, যা নদীর সাথে বয়ে এসে প্রপাতকে এমন রঙিন করে তোলে।
এই জলপ্রপাত থেকে সৃষ্ট নদী তাহকামেনন। এ নদী প্রায় ৫০,০০০ একর জায়গা নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাহকামেনন রিভার ফরেস্টের পাশ দিয়ে এ নদী বয়ে চলেছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এ নদীর চারপাশ। এ নদী সবসময় ভ্রমণার্থীদের কাছে আকর্ষণীয়।
নদীতে জলজ প্রাণীর পাশাপাশি তাহকামেনন রিভার ফরেস্টে পাওয়া যায় নানা দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড। নদীতে বোটিং, জঙ্গলে অজানার উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানো কিংবা পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের নেশায় ছুটে যাওয়া যেকোনো পর্যটকের কাছেই পরম পাওয়া।
পেনিনসুলার পিকচার্ড রক ন্যাশনাল লেকশোর
লেক সুপিরিয়র ভ্রমণে আসা অধিকাংশ পর্যটক মিশিগান রাজ্যের আপার পেনিনসুলার পিকচার্ড রক ন্যাশনাল লেকশোরকে ভ্রমণের জন্য বেছে নেন। কারণ, এখান থেকে ২৪ কিলোমিটার বিস্তৃত বিভিন্ন শিলার রঙিন স্যান্ডস্টোন উপকূল দেখা যায়। ছবির মতো সুন্দর এই পিকচার্ড রক। এই পিকচার্ড রকের চারপাশের বালুময় সৈকত, ছোটবড় বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ঝর্ণা এবং গভীর অরণ্য পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। এই প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণের জন্য ১৯৬৬ সালে একে ন্যাশনাল লেকশোর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। লেক সুপিরিয়রের প্রায় ৪০ মাইল এলাকা জুড়ে এই লেকশোর বিস্তৃত। এই সংরক্ষণের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে ইউনাইটেড স্টেটসের ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসেস। এখানে ক্যাম্পিং, হাইকিং এবং বোটিংয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে।
রঙিন পাথরের ক্লিফের গায়ে কেভস অব অল কালার্স, রেইনবো কেভস নামে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি গুহা তৈরি হয়েছে। মাইনার্স ক্যাসেল, চ্যাপেল রক, পেইন্টেড কেভ-পর্যটকদের কাছে এক নতুন দিগন্তের দুয়ার খুলে দেয়। বিস্ময় ও মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকতে হয়। লেকশোর থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থিত টুইন ফলস নামের একটি দ্বৈত ঝর্ণা।
এই ঝর্ণার আশেপাশের এলাকাটি টুইন ফলস প্ল্যান্ট প্রিজার্ভ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এলাকার মধ্যেও বেশ কয়েকটি পাহাড় রয়েছে। অনেকখানি চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেসব পাহাড়ে পৌঁছা যায়। কোথাও সরু, কোথাও ঢালু আর আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে ঝর্ণার দিকে এগিয়ে যেতে হয়। তাই হাইকিংয়ের জন্য অনেকের কাছে জায়গাটি আদর্শ।
ওয়াগনার ফলস
এটি মিউনিসিং এলাকার সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। পার্কিং স্পট থেকে প্রায় আধ মাইল হেঁটে এই ঝর্ণার কাছে পৌঁছতে হয়। এই জলপ্রপাতের কাছেই রয়েছে ছোটখাটো এক অরণ্য। অরণ্যের মাঝখানে সরু পথ। হলুদ, নীল, বুনো ফুলে পুরো এলাকাটি স্বর্গীয় রূপ ধারণ করে। রূপসী ওয়াগনার ফলস জঙ্গলের মাঝে তার কমনীয় উচ্ছ্বাসে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে।
পাথরের খাঁজে খাঁজে ফুটে আছে হলুদ বুনো ফুলের থোকা, পাইনের সারি, ঘন সবুজের মাঝে শ্বেতশুভ্র ওয়াগানার জলপ্রপাতের জলধারা, বৃষ্টি ও ঝর্ণার জলীয় বাষ্প মিলে ধরণী তখন রহস্যময় সুন্দরী। ঝর্ণার সাথে অরণ্যের এই রূপ দেখতে দেখতে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে কে না চায়?
গ্র্যান্ড আইল্যান্ড দ্বীপ
লেক সুপিরিয়রে নৌবিহারের জন্য পর্যটকদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি থাকে। দিনের বিভিন্ন সময়ে লেকের দর্শনীয় নৌকাগুলো ভ্রমণার্থীদের নিয়ে একেকটি সফরে বেরোয়। বোটে করে গ্র্যান্ড আইল্যান্ড দ্বীপের ইস্ট চ্যানেল লাইট হাউসের সামনে থেকে ঘুরে আসা যায়। ভারি সুন্দর দেখতে এই পুরনো লাইট হাউসটি। এর আশেপাশেই বেশ কয়েকটি ঝর্ণার দেখা মিলবে। পাহাড়েরর খাঁজের গা বেয়ে ঝর্ণার পানি সোজা হ্রদের জলে এসে পড়েছে। ব্রাইডাল ভেইল ফলস, মসকিউটো ফলস রঙিন পাথরের গা বেয়ে নিচে নেমে আসছে।
উপকূলের রঙিন পাথরের ক্লিফের একেক জায়গার আকার ও গঠন একেক রকম। বহু যুগ ধরে পরিবেশের ক্ষয় ও সঞ্চয়ের ভাঙা-খেলায় সৃষ্টি হয়েছে আশ্চর্য সুন্দর গঠনের এসব শিলা। কোথাও তা দেখতে ফুলদানির মতো, কোথাও যেন দাঁড়িয়ে থাকা এক কেল্লা। রয়েছে লাভার্স লিপ, গ্র্যান্ড পোর্টাল নামের ধনুকাকৃতির প্রাকৃতিক খিলানও।
মেমোরিয়াল ফলস
মিউনিসিং সিটির খুব কাছেই এটি অবস্থিত। বর্ষাকালে এ ঝর্ণার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। গুহার মতো দেখতে পাথরের খাঁজের ওপর থেকে তিরতির করে ঝরে পড়ছে ছোট্ট ঝর্ণা। সে পানি পাহাড়ি পথ বেয়ে ঘন সবুজ গাছগাছালির মাঝে মিশে গেছে। বসুধার এই অপরূপ শোভা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। পাহাড়ি রাস্তা, প্রাচীন মহীরুহ, ঝর্ণা, হ্রদ, বৃষ্টি- বিপুল এক বিস্ময় নিয়ে পর্যটকদের সামনে উপস্থিত হয় মেমোরিয়াল ফলস। এর মধ্যে দিয়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা।
মাইনার্স ক্যাসেল
পিকচার্ড রক ন্যাশনাল লেকশোর সাড়ে ৬ মাইল পূর্বে মাইনার্স ক্যাসেল অবস্থিত। এখানে সবসময় পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। এখান থেকে শিলার নানা বৈচিত্রময় গঠন ও আকৃতি স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। এখানের নির্দিষ্ট বাঁধানো এক জায়গা থেকে লেক সুপিরিয়রের অন্য এক রূপ দেখা যায়। সোজা ২০০ ফুট নিচে, পাড়ের কাছে দেখা যাচ্ছে নীলাভ সবুজ জল। ছোট ছোট ডিঙি নিয়ে পর্যটকদের কেউ কেউ হাইকিংয়ের নেশায় বেরিয়ে পড়েন। পিকচার্ড রকের আশেপাশে প্রচুর হাইকিং ও ক্যাম্পিংয়ের জায়গা আছে। ২০০৬ সালে এক দুর্যোগে মিনার্স ক্যাসেলের এক বিশাল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মাইনার্স ক্যাসেল থেকে অল্প কিছু দূরত্বে রয়েছে মাইনার্স ফলস। মাইনাস ফলস নেচার ট্রেইল ধরে এগিয়ে গেলে বেশ সুগভীর নানা বৈচিত্র্যময় গাছভর্তি বন রয়েছে। অজস্র বনফুল পথের দু’পাশের জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নানা রঙ-বেরঙের পাতা ও ফুল দেখে মনে হতেই পারে এখানে বসুন্ধরা যেন রঙের খেলায় মেতে উঠেছে। নানা প্রজাতির পাখির দেখাও মেলে। মাইনার্স ক্যাসেল থেকে মাইনাস ফলস আসা-যাওয়া মিলিয়ে মোট দু’ কিলোমিটার হাঁটা পথ।
এলগার ফলস
মিউনিসিং ও মিশিগান শহরের দক্ষিণের এম-৮ হাইওয়ের খুব কাছেই এই দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণাটি অবস্থিত। হাইওয়ের খুব কাছে হওয়ায় দর্শনার্থীরা এই জলপ্রপাত দেখা কখনও মিস করেন না। কারণ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা পথের দূরত্বে এই ঝর্ণা। এমনকি গাড়ি থেকেই এই ঝর্ণা দেখা যায়। গ্রীষ্মকালে ঝর্ণায় জলপ্রবাহ অনেক কমে আসে।
বসন্তকালেই এ জলপ্রপাত দেখার আদর্শ সময়। কারণ এ সময় এলগার পাহাড়ের গা বেয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি নেমে আসে। তাই বসন্তকালে এ ঝর্ণা থাকে উচ্ছল, সে তার হারিয়ে যাওয়া যৌবন ফিরে পায়। এসময় এলগার ফলসের চারপাশের বনানীও তার নবজীবনের প্রাপ্তিতে যেন উদ্ভাসিত হতে থাকে। এই সময়টাই প্রচুর সংখ্যক পর্যটক এলগার ফলস ও তার চারপাশের অপরূপ দৃশ্যাবলী দেখতে আসেন।
টুয়েলভ মাইলস বীচ
টুয়েলভ মাইলস বীচ পিকচার্ড রক ন্যাশনাল লেকশোর খুব কাছেই অবস্থিত। এই সৈকতকে ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্যাম্প গ্রাউন্ড। ক্যাম্পিং করতে আসা পর্যটকদের কাছে জায়গাটি দর্শনীয়। অনেকে দল বেঁধে আসে। তারা এই ক্যাম্প গ্রাউন্ডগুলোতে কয়েকদিন অবস্থান করেন। এখানে ক্যাম্প করা, থাকা, খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। এই ক্যাম্প গ্রাউন্ডগুলোতে থাকার জন্য অনেকসময় ভ্রমণার্থীদের এমন চাপ থাকে যে আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়।
একপাশে জঙ্গল, রঙিন পাহাড়ি ক্লিফ, আরেক পাশে হ্রদ, তার মাঝে বালুকাময় সৈকত। হাইকিংয়ের জন্য বেশ চমৎকার জায়গা। নান্দনিক এই সৌন্দর্যের রূপ-রস উপভোগ করার জন্য অনেকেই ছুটে যান এসব অঞ্চলে। অনেকে প্রকৃতির নির্জনতার মাঝে কিছুটা সময় বিশ্রাম নেন। চারদিকে বর্ণময় নুড়িপাথর পড়ে রয়েছে। কোনোটা হলদেটে, কোনওটা সবুজ, আছে কমলা, লাল আর নীলাভও।
চ্যাপেল রক
৮০ ফুট উচ্চতার এই জলপ্রপাত পিকচার্ড রক ন্যাশনাল লেকশোর আরেক আকর্ষণ। এই ঝর্ণাটি মাইনার্স ক্যাসেলের পূর্বে অবস্থিত। পার্কিং স্পট থেকে ৩ মাইল দূরত্বের এই ঝর্ণা দেখতে প্রায় এক ঘণ্টার মতো ট্রেকিং করতে হয়। তাই ট্রেকিংয়ের নেশা আছে, এমন পর্যটকরাই স্থানটি ভ্রমণের জন্য বেছে নেন।
লে চ্যাপেল নামের একজন ইউরোপীয়ান ভূপর্যটক এই স্থানটি প্রথম আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারে এই স্থানটির নামকরণ করা হয়। এখানে বেলে পাথরের তৈরি একটি প্রাকৃতিক খিলান রয়েছে, যা চ্যাপেল রক নামে পরিচিত। ১৯৪০ সালে এই খিলানের বেশ কিছু অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। চ্যাপেল রকের কাছে রয়েছে এক দর্শনীয় বীচ ও চ্যাপেল লেক। বোটিং, হাইকিং ও সার্ফিংয়ের জন্য জায়গাটি অনেকেরই পছন্দ।
মিউনিসিং ফলস
মাইনার্স ক্যাসেলের মতো মিউনিসিং ফলসও ভ্রমণার্থীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি স্পট। তার কারণও আছে। পার্কিং লট থেকে সামান্য হেঁটেই খুব সহজেই এই জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। ছোট বাচ্চা থেকে বয়স্ক মানুষ, যে কেউ এই ঝর্ণার কাছ থেকে ঘুরে আসতে পারেন। এই জলপ্রপাতের কাছেই পাইন গাছের বন রয়েছে। ঝর্ণা দেখার সাথে পাইন বনের অপরূপ সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মন মোহিত করে রাখে।