Buffalo Soldier, Dreadlock Rasta
There was a Buffalo Soldier
In the heart of America
Stolen from Africa, brought to America.
Fighting on arrival, fighting for survival.
(Buffalo Soldier, Bob Marley)
বব মার্লির এই গান অনেকের কানেই হয়তো পৌঁছে গিয়ে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে পরিচয় পাওয়া যায় বাফেলো সোলজারদের সম্পর্কে। ১৮৬৬ সালে গঠিত আমেরিকার ১০ নং অশ্বারোহী রেজিমেন্ট, প্রথমদিকে যা ‘কালো অশ্বারোহী’ হিসেবে খ্যাত হলেও পরে আফ্রো-আমেরিকান রেজিমেন্টের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। দাস ব্যবসার নাম করে আফ্রিকা থেকে ধরে আমেরিকায় আনা সেই সব হতভাগ্য মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামের কথাই বব তার গানে বলেছেন। কিন্তু গানটাতে উল্লেখিত ‘জটাধারী রাস্তা’ কী?
বিশেষজ্ঞরা অনেক কথাই বলেন। কিন্তু ধর্ম যুগে যুগে তার আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে মানুষের সামনে। বনি ইসরাইলকে দাসত্বের অভিশাপ থেকে মোজেস (মুসা আ.) মুক্ত করেন। নবী মুহম্মদ (সা.) এর সাহাবীদের বড় অংশ সামাজিকভাবে নিচু শ্রেণির। শ্রী চৈতন্যের সংগ্রাম ছিল জাতিবর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে।
ধর্মকে যুগে যুগে শাসক বা অভিজাতেরা ব্যবহার করেছে সত্য, তবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ধর্মকে সম্পৃক্ত করার নজিরও কম নেই। বিশ শতকের গোড়ার দিকে এমনই একটি প্রয়াস রাস্তাফারাই। বর্ণবাদ, পুঁজিবাদ ও পশ্চিমা আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। একটা ধর্ম। ক্যাম্পবেলের কথাটা স্মরণযোগ্য-
উপনিবেশে যখন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়াটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার, তখন অত্যাচারিতের ক্ষোভ আর বিদ্রোহ ধর্মের মাধ্যমেই প্রকাশিত হবার প্রয়াস পায়। (Horace G. Cambell, Rastafari and pan arfican in the Caribbean and Africa)
রাস্তাফারি
এ শব্দটি দুইটি পৃথক শব্দ থেকে উৎসারিত। ‘রাস’ ইথিওপিয়ার সম্রাটের উপাধি। ‘তাফারাই’ সম্রাট হাইলে সেলাসির সিংহাসনে আরোহণ করার আগের নাম Tafarai Makonen থেকে নেওয়া। ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে জ্যামাইকার বস্তি থেকে উঠে আসা ধর্ম রাস্তাফারি। আফ্রিকার ঐতিহ্যের প্রভাব ছিল এই সংস্কৃতির গঠনে। বিশ্বাসের মোড়কে এসেছে বাইবেলের প্রভাব। সবচেয়ে জনপ্রিয় রাস্তাফারিদের মধ্যে বব মার্লি একজন। যার গান জ্যামাইকা কিংবা আফ্রিকার আন্দোলনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাঠে।
তফাৎ করার মতো তেমন কোনো আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব নেই এ ধর্মে। অনুসারীদের অনেকেই একে ধর্ম হিসেবে না; বরং জীবনের পথ (লাইফস্টাইল) হিসেবে আখ্যা দিতে চান। আবার কারো কারো কাছে ধর্মের চেয়ে বেশি কিছু্। যেখানে মিলিত হয়েছে ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসিকে ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত বলে বিশ্বাস করা হয়। চলমান অত্যাচারের প্রতিরোধ এবং আফ্রিকার ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ তিনি। ধর্ম ও জাতীয়তাবোধ যেন গলাগলি করে হাঁটছে। ব্রিটেনের Race Relations Act 1976 অনুসারে-
রাস্তাফারাইদের একটা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। অন্যদের থেকে পৃথক তাদের একটা সমৃদ্ধ দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। আছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারা, ভাষা এমনকি ধর্মও। (‘Are Rastafarians an Ethnic Group?’ Michael Banton, 1989 Journal of Ethnic and Migration Studies. 16 (1): 153–157)
অন্ধকারে বসবাস
গল্পের শুরুটা অনেক আগের। ১৫১৭ সালে আফ্রিকা থেকে দাস আনা শুরু হয় স্পেনীয় বণিকদের। অবশ্য তারও আগে থেকেই ইউরোপীয় দস্যুতায় মারা গেছে অনেক স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ। খুন, ধর্ষণ, হাত-পা কেটে ফেলা, নানা প্রকার অসহনীয় শাস্তি- কোনো প্রকার নির্যাতনই বাকি রাখা হয়নি।
ধীরে ধীরে স্পেনীয়দের সরিয়ে সেই স্থানে নেমে পড়লো ব্রিটিশ। ভাগ্যের কিন্তু বদল ঘটলোনা। জাহাজের পর জাহাজ বোঝাই করে চালান করা হলো দাস। পরবর্তীতে দাসবাহী এক জাহাজের ক্যাপ্টেন রেভারেন্ড জন নিউটন অনুতপ্তের সুরে স্বীকার করেছেন-
হতভাগ্য প্রাণীগুলো একে অপরের সাথে এমনভাবে লোহার শিকলে বাঁধা পড়ে থাকতো যে নড়বার উপায় ছিল না। পাশ ফেরানোও সম্ভব ছিল না আঘাত না পেয়ে কিংবা কাউকে আঘাত না দিয়ে। প্রতি সকালেই দেখা যেত একজন জীবিতের সাথে একজন মৃত একত্রে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। (রাস্তাফারাই, রেগে ও বব মার্লি, পৃষ্ঠা- ১৫)
এরকম অজস্র উদাহরণে কালো হয়ে আছে ইউরোপ এবং আমেরিকাতে আসা প্রতিটা আফ্রিকানের পেছনের ইতিহাস। কঠোর পরিশ্রমের প্রতিদানে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের আখ্যান।
জমতে থাকা আলো
বাইবেলে কিছু জায়গায় ইথিওপিয়ার কথা আছে। উদাহরণস্বরূপ যবুর অংশের কথা উল্লেখ করা যায়।
‘মিশর থেকে রাষ্ট্রদূতেরা আসবেন। ইথিওপিয়া তাড়াতাড়ি ঈশ্বরের কাছে হাত বাড়িয়ে দেবে।’ (যবুর, ৬৮: ৩১, পৃষ্ঠা- ৭৩৪, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ২০০৬)
কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মপ্রচারকরা প্রসঙ্গগুলো প্রায়ই দরদ ভরে টেনে আনতেন। ১৮২৯ সালে রবার্ট আলেকজান্ডার ইয়াং– এর The Ethiopian Manifesto তার বড় প্রমাণ। ১৮৬৫ সালে ম্যারেন্ট বে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ধর্মীয় নেতা পল বোগল। ব্রিটিশ সরকার তার ফাঁসি দেয়। সেই সাথে ফাঁসি দেয় শ্যাম শার্পকেও। মৃত্যুর আগে শ্যামের বক্তব্য ছিল-
ফাঁসিতে মরি, তাও ভালো। দাস হয়ে আর এক মিনিট বাঁচতে চাই না। (রাস্তাফারাই, রেগে ও বব মার্লি, পৃষ্ঠা- ২০)
১৮৯৬ সালে ইতালির আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য ইথিওপিয়ান রাজবংশের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। ১৯২১ সালে নিজেকে যীশু বলে দাবি করেন আলেকজান্ডার বেডওয়ার্ড। উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তা ব্যর্থ হয় করুণভাবে। তাকে পাঠানো হয় পাগলা গারদে। তারপরেও চাইলেন অত্যাচারীর আঁচলের নিচে থেকে আফ্রিকাকে উদ্ধার করতে।
মার্কেস গার্ভে দীর্ঘ শত বছরের নির্যাতন ও পীড়নের মধ্যে যুদ্ধ করে টিকে থাকা কৃষ্ণাঙ্গদের ভেতরে জ্বালিয়ে দিলেন প্রতিবাদের বারুদ। ডাক দিলেন Back to Africa আন্দোলনের। দাবি করতেন আফ্রিকানরাই সত্যিকার বনি ইসরাইল। যাদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নির্বাসনে দেওয়া হয়েছে। ঘোষণা করলেন-
আমরা জানি ঈশ্বর কোনো বর্ণের নন। কিন্তু এতদিন সাদারা ঈশ্বরকে দেখেছে সাদা চশমা দিয়ে। এবার আমাদের পালা- আমাদের মতো করে দেখার। (রাস্তাফারাই, রেগে ও বব মার্লি, পৃষ্ঠা-১৯)
ধীরে ধীরে গার্ভে হয়ে উঠলেন নিপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গদের কণ্ঠস্বর। যদিও নিজেকে তিনি পরিপূর্ণ নেতা মনে করতেন না। বরং ছিলেন বাইবেলের জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের মত। সেভাবেই ১৯২৭ সালে দৃঢ় কণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী জানালেন।
“আফ্রিকার দিকে তাকাও। নতুন রাজা আসবে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্য থেকে”।
নভেম্বরের ২ তারিখ, ১৯৩০ সালে রাস তাফারাই ম্যাকোনেন ইথিওপিয়ার সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হলেন। ১৯৭৪ সাল অব্দি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। সিংহাসনে বসার পূর্বে নাম নেন হাইলে সেলাসি বা ‘ট্রিনিটির ক্ষমতা’। Conquering Lion of the Tribe of Judah এবং Elect of God and King of the Kings of Ethiopia এর মতো উপাধিও নেন। উপাধিগুলো মূলত ঐতিহ্যগত। যা বাইবেলের কথাকে জোর দেয়ার জন্য পূর্ববর্তী শাসকরাও ব্যবহার করতো। কিন্তু রাস্তাফারাইদের জন্য সেলাসির এই অভিষেক ছিল বুক অব রেভেলেশনের আয়াত ৫:৫ এবং ইজিকিয়েলের আয়াত ২৮:২৫ এবং সেই সাথে মার্কেস গার্ভের ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা।
হাইলে সেলাসি ক্ষমতায় আসার সময় কেবলমাত্র তিনিই আফ্রিকার স্বাধীন সম্রাট। তার গায়ের রং ছিল কালো। তার উপরে ১৯৩৬ সালে মুসোলিনি ইথিওপিয়া আক্রমণ করেও পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এরকম ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে সেলাসি আফ্রিকান মানুষের জন্য মুক্তির দূত হিসেবে দেখা দিলেন। এই সম্রাট কখনো নেতা, কখনো মেসিয়াহ কখনোবা স্বয়ং ঈশ্বর বা Jah।
মার্কেস গার্ভে কিন্তু নিজেকে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেননি। বরং সেলাসির ও ইথিওপিয়াতে শোষণের সমালোচনা করেন। ১৯৩৭ সালে সম্পাদকীয়তে লিখেন ‘The Failure of Haile Selassie as Emperor’। কানাডায় CBC News-এর দেয়া সাক্ষাৎকারে সেলাসি নিজেও নিজের স্বর্গীয় সত্তা ও মনোনয়ন অস্বীকার করেন। তারপরেও একদল ভক্তকে বিচ্যুত করা যায়নি যে, সম্রাট ঐশ্বরিক।
রাস্তাফারাইরা দৃশ্যমান হয় ১৯৩০-এর দশকে। জ্যামাইকার কিংস্টনের ছোট্ট বস্তিতে। প্রতিষ্ঠিত হলো শান্তি সংঘ। সেদিন হয়তো কেউ বুঝতেই পারেনি এর ভবিষ্যৎ। কীভাবে ধীরে ধীরে তাদের উত্থান জন্ম দেবে স্বতন্ত্র ভাষা, চুলের ধরন, শিল্প এবং গানের।
লিওনার্ড হাওয়েল এবং তারপর
প্রথম দিকের নেতাদের মধ্যে লিওনার্ড হাওয়েল একজন। তিনি ছয়টা মূলনীতি প্রচার করেন। নীতিগুলোর মধ্যে শ্বেতাঙ্গ-বিদ্বেষ প্রবল হয়ে উঠেছে। যদিও পরের দিকে চিন্তার অগ্রগতির সাথে সাথে অনেক নীতিই বাদ দেওয়া হয়। জ্যামাইকার সরকার হাওয়েলকে গ্রেফতার করে ১৯৩৩ সালে। কারণ ছিল রাজা পঞ্চম জর্জের চেয়ে ইথিওপিয়ান সম্রাট সেলাসিকে প্রাধান্য দেওয়া।
সম্রাট সেলাসি রাস্তাফারাইদের জন্য ইথিওপিয়ায় জায়গা ছেড়ে দেন। তবে রাস্তাফারাই ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ২১শে এপ্রিল, ১৯৬৬ সালে সম্রাট সেলাসির জ্যামাইকা ভ্রমণ। এই সময়টাতেই বব মার্লির স্ত্রী রিটা মার্লি রাস্তাফারাই মতবাদে দীক্ষিত হন। সেলাসি তাদের পরামর্শ দেন জ্যামাইকার মানুষদের মুক্ত করার আগ পর্যন্ত ইথিওপিয়াতে না যাওয়ার। এই নির্দেশনা পরিচিতি পায় Liberation before Repatriation নামে। এর ফলে আন্দোলন বৈধতা পায়। ২১শে এপ্রিল পালিত হয় রাস্তাফারাই ছুটির দিন হিসেবে।
বিশ্বাস
রাস্তাফারাইরা মূলত ইহুদি-খ্রিষ্টান ঐশ্বরিক ধারণাকেই গ্রহণ করে। ঈশ্বরকে তারা বলে যাহ্। শব্দটি ইহুদিদের ইয়াহওয়েহ থেকে আগত। যাহ্ দুনিয়ায় আগমন করেন যীশুর রূপে। অবশ্যই যীশু এখানে কৃষ্ণাঙ্গ এবং সম্রাট হাইলে সেলাসি স্বয়ং। সেলাসিকে স্মরণ করা হয় His Imperial Majesty বা সংক্ষেপে H.I.M. যাকে আবার উচ্চারণ করা হয় him বলে।
সেলাসিকে অপসারণ করা হয় ১৯৭৪ সালে। সামরিক অভ্যুত্থানকারীরা তাকে বন্দী করে রাখে বাসায়। ১৯৭৫ সালে তিনি মারা যান বন্দীকারীদের হাতেই। অনেক রাস্তাই বিশ্বাস করে, তার মৃত্যুটা ছিল কৌশল। সেলাসি বিচার দিবসের আগে পর্যন্ত জীবিত থাকবেন। অন্যরা বিশ্বাস করে প্রতিটা রাস্তাফারাইয়ের ভেতরেই তাঁর বসবাস। তাকে স্বর্গীয় মনে করার পেছনে দলিল দেওয়া হয়- রেভেলেশনের ৫: ২-৫, ১৭:১৪, ১৯:৬, এজেকিয়েলের ৩০, যবুরের ৯, ১৮, ৬৮, প্রভৃতি আয়াত থেকে। রাস্তাফারাইরা বাইবেলে উল্লেখিত নবীদেরকেও শ্রদ্ধা করে।
তাদের মতবাদে মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। বরং আফ্রিকাকে এবং বিশেষ করে ইথিওপিয়াকে মনে করা হয় প্রতিশ্রুত ভূমি বা যায়ন। সত্যিকার রাস্তাফারাই শারীরিক ও আধ্যাত্মিক- উভয়ভাবেই অমর। ‘তুমি এবং আমি’ ধারণার বদলে রাস্তাফারাইরা প্রতিষ্ঠা করেছে ‘আমি এবং আমি’ ধারণার। এতে মূলত মানব জাতির এককত্ব প্রকাশ করা হয়।
আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাসের নাম ব্যাবিলন। স্মরণ করা যেতে পারে, সাইরাসের মাধ্যমে মুক্ত হবার আগে পর্যন্ত ইহুদিরা ব্যাবিলনে নির্যাতিত হয়েছে। ইতিহাসে তা ব্যাবিলন বন্দীদশা নামে পরিচিত। রাস্তাফারাই মতে, শ্বেতাঙ্গদের ক্ষমতা ও আধিপত্যে গঠিত ইউরোপ ও আমেরিকাই ব্যাবিলন। প্রত্যেকটা রাস্তাফারাইয়ের উচিত ব্যাবিলনীয় আগ্রাসন বন্ধ করার চেষ্টা করা। যারা একসময় তাদের নিষ্ঠুরভাবে ধরে এনে দাস বানিয়েছে। তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে অশিক্ষা, অসাম্য, দারিদ্রের বোঝা। তাদের থেকে মুক্ত হয়ে হিজরত করা আফ্রিকার দিকে।
পবিত্র গ্রন্থ ও প্রতীক
রাস্তাফারাইদের পবিত্র কিতাব ‘হোলি পিবি’-কে বলা হয় ব্ল্যাক-ম্যান’স বাইবেল। বইটি সংকলিত হয়েছে রবার্ট এথলিয়ী রজার্সের মাধ্যমে ১৯১৩-১৭ সালের মধ্যে। প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালের দিকে। খ্রিষ্টীয় বাইবেল থেকে পরিবর্তন করে সৃষ্ট। মনে করা হয়, ইংরেজি বাইবেল বিকৃত। শ্বেতাঙ্গরা এই কাজ করেছে নিজেদের আধিপত্য রক্ষার জন্য। হোলি পিবি এই বিকৃতির অপসারণ। ইথিওপিয়ার জাতীয় মহাকাব্য ‘কইবরা নিগাস্ত’– কেও দেখা হয় শ্রদ্ধার চোখে।
লায়ন অব জুদাহ রাস্তাফারাইদের প্রধান প্রতীক। আসলে এর জন্ম বনি ইসরায়েলের মধ্যে জুদাহ গোত্রের প্রতীক হিসেবে। যেহেতু ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসিকে মনে করা হয় জুদাহের উত্তরাধিকারী। সেলাসিকে উপাধি দেয় হয় ‘লায়ন অব জুদাহ’ বলে এবং প্রতীকটি ইথিওপিয়ার পতাকাতে সন্নিবিষ্ট করা হয়। জটা রাস্তাদের অন্যতম প্রতীক হিসাবে দৃশ্যমান।
এছাড়া প্যান-আফ্রিকান রঙগুলোও নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে আছে লাল, কালো, সবুজ এবং সোনালি। লাল ইতিহাসের বিভিন্ন নির্যাতনে শহীদের রক্তের প্রতীক। কালো রঙ কালো মানুষগুলোর জন্য, সবুজ আফ্রিকার উর্বরতা এবং সোনালি আফ্রিকার সম্পদ-সমৃদ্ধিকে প্রকাশ করে।
চর্চা ও আচার
প্রধানত দুইটি আচার রাস্তাফারাইদের মধ্যে অধিক দেখা যায়। প্রথমত বৈঠক, অনানু্ষ্ঠানিকভাবে কোনো জায়গায় মিলিত হওয়া এবং আলোচনা করা। সেখানে অবশ্যই গাঁজার উপস্থিতি থাকবে। দ্বিতীয়ত নায়াবিঙ্গি বা উৎসব নৃত্য। বেশির ভাগ রাস্তাফারাই নিরামিষাশী।
খাবারের ক্ষেত্রে তারা কতিপয় আইন মেনে চলে, যা ইতাল নামে পরিচিত। তার অর্থ স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক খাদ্যগ্রহণ। মদ গ্রহণ নিষেধ। প্রথমত মদ শ্বেতাঙ্গদের টোপ, দ্বিতীয়ত এটি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয় এবং তৃতীয়ত এরা প্রাকৃতিক না। গাঁজাকে পবিত্র হিসেবে গ্রহণের পেছনে মূলত এর বিপরীত কারণ বিদ্যমান।
অনেক রাস্তাফারাই জটা রাখে। বাইবেলের লেভিটিকাসে ২১:৫ আয়াতে চুল কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। সিংহের মতো কেশর তৈরি আফ্রিকার শক্তি ও শৌর্য এবং লায়ন অব জুদাহকে রূপায়িত করে। অন্যদিকে চুল রেখে দেয়ার মানে প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলা।
শেষ করার আগে
কালক্রমে তিনটা প্রধান উপদলের জন্ম হয়েছে রাস্তাফারাইদের মধ্যে। বোবো শান্তি উপদল প্রতিষ্ঠিত হয় ইমানুয়েল চার্লস এডওয়ার্ডসের হাতে। ১৯৫০ সালের দিকে জ্যামাইকায়। উপদল নায়াবিঙ্গি রাস্তাফারাইদের নামকরণ করা হয় উগান্ডার রাণীর নামানুসারে। যিনি উনিশ শতকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তৃতীয় উপদল ‘দ্য টুয়েলভ্ ট্রাইবস অব ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে ড. ভেরননের মাধ্যমে। এখানে রাস্তাফারাইকে তার জন্মের মাস ও সময়ের ভিত্তিতে বনি ইসরাইলের বারোটি গোত্রের একটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাকি দুটির চেয়ে তারা উদার।
সে যা-ই হোক, সমাজ রাজনৈতিক নির্যাতনে মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হিসাবেই আত্মপ্রকাশ করে রাস্তাফারাই। ইউরোপীয় নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে তুলেছে স্বতন্ত্র ধর্ম, ভাষা, আচার এমনকি উপকথাও। কখনোই হয়তো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে না রাস্তাফারাই। কিন্তু বিশ্বব্যাপী শোষিত ও নির্যাতিত কালোদের মনে একটা দাগ ঠিকই রেখে গেছে। পশ্চিমা পুঁজিবাদের অত্যাচারে এখনো হয়তো তাদের কানে বেজে চলে সকাল-সন্ধ্যায়, ‘Back to Africa’।