যা ঘটেছে তা ব্যাখ্যা করা একজন কবির কাজ নয়, তার কাজ হলো যা ঘটতে পারে তা ব্যাখ্যা করা, কারণ সেগুলো ঘটতে পারে এজন্য যে ঐ অবস্থাতে ওগুলো হয় সম্ভাব্য, নয়তো অপরিহার্য।
– এরিস্টটল (কাব্যতত্ত্ব)
কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে সংগীত আমাদের কেন ভেতর থেকে নাড়া দেয়? বিবর্তনবাদের জনক ডারউইন তো বলেই ফেললেন যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন মানবজাতির পথচলা সবে শুরু, তখন তারা কথা বলার জন্য যে শব্দের প্রয়োজন হয়, তার সাথে পরিচিত হবার অনেক আগেই পরিচিত হয় সুর বা ছন্দের সাথে। অর্থাৎ কথা বলতে শেখার আগেই তারা গান গাইতে শিখেছিল! এই বিষয়টি কতটা সত্যি আমরা জানি না, তবে আমরা ঠিকই বুঝতে পারি গান কিংবা কাব্যভাষার মাঝে বিরাট এক শক্তি অন্তর্নিহিত আছে যা শুধু শিল্পবোদ্ধারাই নয়, সাধারণ মানুষও বোঝে। আর তাই কিছু মানুষ কখনো করুণ সুরে, কখনো অপূর্ব সব শব্দের গাঁথুনিতে তাদের সৃষ্টিকে এক অন্য মাত্রা দান করেন।
এসব সৃষ্টির মাধ্যমে তারা মানুষকে কখনো দেখান আশার আলো, কখনো জানান দেন অনাগত ভবিষ্যতের কথা। সেদিক থেকেই উল্লেখযোগ্যভাবে একজন সফল মানুষ বব ডিলান। আসল নাম রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যন। আমেরিকার সর্বকালের অন্যতম সেরা এই গীতিকার সবসময়ই গেয়েছেন মানুষকে কিছু না কিছু জানান দেবার জন্য। কখনো গান লিখেছেন প্রকৃতিকে ভালোবেসে, কখনো নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন জীবনের নানা দিক, কিংবা কখনো প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসায় বা অভিমানে। তবে তার শাণিত কণ্ঠ সবচেয়ে বেশি প্রতিধ্বনিত হয়েছে যুদ্ধবিরোধী গানগুলোর জন্য। ২০১৬ সালে এই অমর অবদানগুলোর উত্তম স্বীকৃতিস্বরূপ ইতিহাসের প্রথম গীতিকার হিসেবে তিনি অর্জন করেন সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার।
বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণেই বব ডিলানের গান অন্য যে কারো চেয়ে আলাদা। গানের মাঝে নেই তৎকালীন জনপ্রিয় সব বাদ্যযন্ত্রের ছোঁয়া; রক, ব্লুজ কিংবা হেভি মেটাল গানের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই; গান গাইবার সময় সুরের স্কেল ঠিক রাখবারও কোনো ইচ্ছে নেই, তবুও একের পর এক বিখ্যাত গান দিয়ে ভক্ত ও শ্রোতাদের মন জয় করে নিতে পেরেছেন এবং লিখেছেন যুগোপযোগী গান। শব্দ হচ্ছে রচনাকারীর অলঙ্কার- এই মূলনীতির উপর বিশ্বাস রেখেই অসাধারণ শব্দচয়নে জীবনমুখী গান লিখে শুধু একটা হারমোনিকা আর একুয়াস্টিক গিটার দিয়েই মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। একজন গীতিকারের আগে তিনি যে একজন কবি তা ভালো করেই বুঝিয়েছেন। গভীরে থাকা মর্মার্থ উদ্ধারের জন্যে তার হেঁয়ালিপূর্ণ, রূপকমন্ডিত গানগুলো বার বার শুনতে হয়, তবে কখনো ক্লান্ত হতে হয় না!
এই প্রবন্ধে বব ডিলানের কয়েকটি বিখ্যাত গানের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ইংরেজি ভাষায় লেখা গানের কথাগুলো খুব বেশি ভাষান্তর করার চেষ্টা করা হয়নি। পাছে পাঠক মূল ভাষার কথাগুলোর রসাস্বাদনে ব্যর্থ হন! আশা করি পাঠক মূল গানের কথাগুলোও পড়বেন বা শুনবেন। নইলে ডিলানের বার্তা পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। তবে চলুন, শুরু করা যাক!
১. মি. ট্যাম্বুরিন ম্যান
১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া ডিলানের পঞ্চম অ্যালবাম ‘Bringing it All Back Home’ এর অংশ ‘ফোক’ জনরার এই গানটি। গানের কথার ধরনের জন্যে একে অনেকেই মাদকাসক্তি সম্পর্কিত গান বলে ভুল করে থাকেন (My senses have been striped/ My hands can’t feel the grip/ My toes too numb to step/, ইত্যাদি)। তবে এটি আসলে লেখা হয়েছে সঙ্গীতের মাহাত্ম্যকে উপলব্ধি করানোর জন্য।
গানের লেখক একজন ট্যাম্বুরিন ম্যান (বাংলায় আমরা বলতে পারি ‘খঞ্জর বাদক’)-কে অনুরোধ করছেন তার জন্য একটি গান গাইতে। তিনি পাশাপাশি সেই ট্যাম্বুরিন ম্যানকে তার মানসিক অবস্থার কথাও জানান দিচ্ছেন- তার ঘুম পাচ্ছে না, তবে তিনি ভীষণ ক্লান্ত। কেন ক্লান্ত? এটি ব্যাখ্যা করাই গানটির আরেকটি উদ্দেশ্য। গানের লেখক তার চারপাশের মিথ্যা চাকচিক্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, দিন শেষে যার আসলে কোনো মানেই থাকে না। তিনি বলেছেন-
“Though I know that evening’s empire is returned into sand
Vanished from my hand
Let me blindly here to stand but still not sleeping.
My weariness amazes me I’m branded on my feet,
I have no one to meet
And the ancient empty street’s too dead for dreaming.”
তিনি বলছেন, ‘সন্ধ্যের রাজত্ব’ (Evening’s Empire) ধুলোয় মিশে গেছে। যা তার হাতে একসময় ছিলো, কিন্তু এখন আর নেই। এই ‘সন্ধ্যের রাজত্ব’ই হচ্ছে পৃ্থিবীর সেই মিথ্যা চাকচিক্য, যা তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। আরেকটি জিনিস তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে, যাকে তিনি এই অংশে বলেছেন Ancient empty street, যা দিয়ে তিনি অতীত জীবনের সকল স্মৃতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। স্মৃতির কথা তিনি আরেকটি অংশেও বলেছেন-
“And take me disappearing through the smoke-rings of my mind,
Down the foggy ruins of time
Far past the frozen leaves,
The haunted frightened trees
Out to the windy beech
Far from the twisted reach of crazy sorrow”
লাইনগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে তিনি অতীতের সকল স্মৃতি, যা বার বার ফিরে আসে, সেসব থেকে দূরে যেতে চাইছেন (Far from the twisted reach of crazy sorrow)। তিনি অতীতকে কীভাবে দেখেন, তা বিশ্লেষণ করেছেন Smoke rings of mind, Foggy ruins of time, Frozen leaves, Haunted frightened trees ইত্যাদি রূপকের মাধ্যমে।
লেখকের এসব সমস্যা, যা তাঁর ক্লান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা থেকে তিনি মুক্তি চাইছেন ট্যাম্বুরিন ম্যানের কাছ থেকে একটি গান শুনতে চেয়ে। তার শরীর ক্লান্ত, তবু ঘুম পাচ্ছে না, গান শোনার এই তো উপযুক্ত সময়! গানের মধ্যে যে জাদুকরী কোনো এক শক্তি লুকোনো আছে, সে কথাও তিনি বলেছেন ‘Take me on a trip upon your magic swirling ship’ লাইনটির মাধ্যমে। তিনি ট্যাম্বুরিন ম্যানকে অনুরোধ করছেন গান শুনিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে, যাতে তিনি সকল ক্লান্তি থেকে সাময়িক ছুটি নিয়ে গভীর স্বপ্নে ডুবে যেতে পারেন। সেজন্যে বলেছেন,
“I’m ready to go anywhere, I’m ready for to fade
With on my own parade, cast the dancing spell my way
I promise to go under it”.
বিভিন্ন জঞ্জাল থেকে পরিত্রাণের এই আশাকেই অনেকে মাদকের প্রভাব বলে গানটির ভুল ব্যাখ্যা দেন। কারণ ডিলান নিজেই অকপটে বলেছেন, অতীতের স্মৃতি কিংবা ভবিষ্যতের ভাগ্য (Memory and Fate)- কোনোকিছু নিয়েই এখন আর মাথা ঘামাতে চান না তিনি।
গানের কথায় লুকিয়ে রয়েছে আরো অনেক গভীর রূপক। তবে সব ছাপিয়ে সবকিছু থেকে মুক্তি পাবার আকাঙ্ক্ষাই সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে ডিলানের কন্ঠে- “Let me forget about today until tomorrow.”
২. ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড
তাকে বলা হয় ‘The Voice of Protest’। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই তাকে চেনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আয়োজিত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ঐতিহাসিক কনসার্ট ‘The Concert For Bangladesh’- এ অংশ নেয়ার কারণে। যুদ্ধের বিপক্ষে সর্বদাই সরব থেকেছে ডিলানের কণ্ঠ। যুদ্ধকে তিনি চিরকাল ঘৃণা করে গেছেন। যুদ্ধের বিপক্ষে লেখা ডিলানের প্রতিবাদী বা সচেতনতামূলক গানগুলোর মধ্যে ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ সবচেয়ে আলোচিত। এই গানে তিনি নৈরাজ্যকাঙ্ক্ষী মানুষের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন,
“How many roads must a man walk down
Before you call him a man?
How many seas must a white dove sail
Before she sleeps in the sand?”
গানের এই চারটি লাইন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি জিজ্ঞেস করছেন একজন পুরুষকে সবাই পুরুষ বলার আগে তাকে কতটা পথ হাঁটতে হবে? এখানে হাঁটা বলতে মূলত সৈনিকদের কুচকাওয়াজ করে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার কথা বোঝানো হয়েছে। একসময় সৈনিকদেরই মনে করা হতো সবচেয়ে উত্তম পুরুষ। যারা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যুদ্ধে যোগ দিতো না, তাদের কাপুরুষ ভাবা হতো। আশা করি পাঠক এখন বুঝতে পারছেন যে বব ডিলান আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন!
এরপর বলা হয়েছে, শান্তিতে ঘুমোতে যাবার আগে একটা সাদা পায়রাকে কতটা সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে? এখানে সাদা পায়রা একটি রূপক। সাদা পায়রাকে শান্তির প্রতীক বলে ধরা হয়, আমরা বিভিন্ন সম্মেলন বা অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে শান্তির বার্তা-স্বরূপ সাদা পায়রা ওড়াতে দেখেছি। লেখক জানতে চেয়েছেন, এমন কি কোনো দিন আসবে না, যেদিন শান্তির বার্তা বহন করার জন্যে কোনো পায়রাকে সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে না, কারণ তখন চারিদিকে শুধু শান্তিই বিরাজ করবে?
গানের অন্য একটি অংশে তিনি আমেরিকার দাসপ্রথা নিয়েও সমালোচনা করেছেন। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপটায় ক্ষয়ে যেতে থাকা পাহাড়ের সাথে তুলনা করে বলেছেন,
“How many years can some people exist
Before they’re allowed to be free?”
এখানে লক্ষ্যণীয় ব্যাপারটি হলো, তিনি তাদের জীবনধারণ বোঝাতে ‘Live’ শব্দটি ব্যবহারের বদলে ‘Exist’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তারা পুরোপুরি বেঁচে নেই, তারা শুধু টিকে আছে।
লেখন গানে যেসকল প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, তার উত্তর হিসেবে শুধু বলেছেন ‘The answer is blowing in the wind.’। একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে এসব প্রশ্নের আসল উত্তর জিগ্যেস করা হলেও তিনি একই উত্তর দিয়েছিলেন। তবে এই কথাটির মানে কী? আসলে এর দ্বারা লেখক বোঝাতে চাইছেন, উত্তরটা খুবই সহজ, এবং আমরা সবাই তা জানি। মানুষ যখন চাইবে, তখনই যুদ্ধ, নৈরাজ্য সব বন্ধ হবে, শুধুমাত্র চাওয়াটাই জরুরি। তিনি সবাইকে বলতে চাইছেন, এত সহজ কাজও আমরা করতে পারছি না, কারণ মানুষ সবসময়ই যুদ্ধ চায়। নিজের প্রবৃত্তিকে উপেক্ষা করা মানুষের জন্য সহজ ব্যাপার নয়। তাই হয়তো তিনি বারবার বলেছেন, উত্তরটা কোথাও লুকোনো নেই, ওটা আমাদের মধ্যেই আছে!
৩. লাইক অ্যা রোলিং স্টোন
মানুষের দম্ভ কতটা স্থায়ী? ভাগ্য কতটা স্থির? জীবনের চরাই-উৎরাই পেরোতে গিয়ে আমরা হরহামেশাই এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হই এবং জীবনই এর জবাব দিয়ে দেয়। বব ডিলানের বিভিন্ন ‘Ballad’ ধাঁচের গানও ভক্ত-শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়, যেসব গানের কথায় তিনি বিভিন্ন টুকরো ঘটনার উল্লেখ করে তার জীবন-দর্শন ব্যক্ত করেছেন। ‘লাইক অ্যা রোলিং স্টোন’ বোধহয় সেসবের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত। এই গানটি তিনি আরম্ভ করেছেন ‘Once upon a time’ কথাটি দ্বারা, যা ইংরেজি রূপকথা ধাঁচের গল্প শুরু করার প্রচলিত রীতি। তিনি এই গানে যেসব শব্দ (Princes, Diplomat, steeple ইত্যাদি) ও ঘটনাপ্রবাহ ব্যবহার করেছেন, সেগুলোও রূপকথা ধাঁচের। প্রতিটি রূপকথা বা Fairy Tales থেকে আমরা কোনো না কোনো শিক্ষা নিই। লেখক এমনটা এজন্য করেছেন যে গানটির ঘটনা বা উপদেশ থেকে শিক্ষা নেয়ার ব্যাপারেও আমরা যাতে সচেতন থাকি।
এই গানের কথাগুলো লেখক এমন একজন মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলছেন যে তার পূর্বের সকল বিষয়-সম্পত্তি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে। একসময় তার নিজের যা কিছু ছিলো, সেসবের জন্য সে গর্ব করতো, তবে কালের পরিক্রমায় তার সেই গর্ব আর নেই। একসময় সে ভালো কাপড় পরতো, অপ্রয়োজনে প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করতো। সে সবচেয়ে ভালো স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করেছে, তবে তাকে কখনো শেখানো হয়নি কী করে রাস্তায় রাত কাটাতে হয়। এগুলো কোনো স্কুলে শেখানো হয় না, জীবন আর পরিস্থিতিই আমাদের ওসব শেখায়। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে সে প্রকৃত জীবনের অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলো।
হাজার মানুষের সতর্কবাণী সে উপেক্ষা করেছে। ‘People call say ‘beware doll, you’re bound to fall‘- গানের একথাটি থেকে বোঝা যায়, লেখক এখানে তাকে ‘Doll’ বলে লোকমুখে সম্বোধন করিয়েছেন প্রকৃ্ত অবস্থা সম্পর্কে তার অজ্ঞানতার কারণে।
মানুষের মনের প্রকৃত খবর যে জানা যে এক দুঃসাধ্য কাজ, সে ব্যাপারটি লেখক বলেছেন এভাবে-
“Ah you never turned around to see the frowns
On the jugglers and the clowns when they all did tricks for you”
সে মনে করতো তার চারপাশের সবাইকে সে হাসিমুখে দেখছে এজন্যে যে সবাই তাকে বিনোদন দেয়ার কাজে ব্যস্ত। তবে তাদের মনের প্রকৃত খবর সে কখনও জানতে চায়নি। তার প্রধান সহকারি, যে কি না তার এই দুরবস্থার কারণ, তাকে লেখক এভাবে চিত্রায়িত করেছেন-
“You used to ride on a chrome horse with your diplomat
Who carried on his shoulder a Siamese cat”
তার কূটনৈতিক সহকারীর কাঁধে বেড়াল কেন? এই চিত্রটি আমাদেরকে বিভিন্ন গুপ্তধন-সংক্রান্ত কাহিনীর খলনায়ক সমুদ্রের জলদস্যুদের কথা মনে করিয়ে দেয় না? তাছাড়া কাঁধের ওই বেড়ালটি তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা কুপ্রবৃত্তিকেও নির্দেশ করে।
গানের কথাগুলো থেকে বোঝা যায়, লেখক নানাভাবে ঐ মেয়েটিকে আঘাত করতে চেয়েছেন। কারণ এটাও বোঝা যায় যে তিনিও তার দ্বারা একসময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই হয়তো তিনি বারবার বলছিলেন ‘How does it feel?’ লেখক বেশ কিছু উপমা টেনেও তার পূর্ববর্তী জীবনের ভুলগুলো তুলে ধরছিলেন।
আমরা প্রথমেই দেখেছিলাম, ডিলান ঘটনাটি থেকে সবাইকে শিক্ষা নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কারণ সমাজে এমন আরো বহু লোক আছে যারা ‘প্রকৃত জীবনের’ অর্থ ভুলে গিয়ে মিথ্যা চাকচিক্য নিয়ে মেতে থাকে। তাই গানের শেষদিকে তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,
“Princess on a steeple and all the pretty people
They’re all drinking, thinking that they’ve got it made”
৪. অ্যা হার্ড রেইনস অ্যা গনা ফল
ডিলানের এই গানটিই হয়তো সাধারণ শ্রোতাদের বোঝার পক্ষে সবচেয়ে দুষ্কর। গানের কথা অসংখ্য হেঁয়ালি আর রূপকে পরিপূর্ণ। আগেরটির মতো এটিও ডিলানের সেই বিখ্যাত ‘Folk Ballad’ জনরার গান। গানটি ১৯৫৯ (যদিও মূল গানটি লেখা হয়েছিলো আরো অনেক আগে) সালে মুক্তি পাওয়া একই জনরার আরেকটি গান ‘Lord Randal‘ থেকে অনুপ্রাণিত এবং কিছু ক্ষেত্রে গানটির অনুকরণ। ডিলানের গানটি লেখা হয়েছিল ১৯৬২ সালে, যখন আমেরিকা এবং কিউবার মধ্যেকার রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছে এবং অনেকেই একটি পরমাণু-যুদ্ধের আশংকা করছিলেন। তাই অনেকে বলে থাকেন, গানটি ঐ প্রেক্ষাপটে রচিত। কিন্তু পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে ডিলান ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
গানের শুরুতে দেখা যায় একজন মা তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করছেন সে এতক্ষণ কোথায় ছিল। মা তার ছেলেকে ‘Blue eyed son’ বলে সম্বোধন করেন, যেখানে ‘Blue eye’ ছেলেটির নিষ্পাপ চরিত্রের প্রতীক। তাই সে যা দেখে এসেছে তা-ই তার মাকে খুলে বলে। তবে যা সে দেখেছে তা মোটেও ভালো কিছু ছিল না। সে পৃথিবীর মানুষের নিকৃষ্টতা প্রত্যক্ষ্য করে এসেছে। প্রথমে, সে কোথায় গিয়েছিলো, সে সম্পর্কে তার মাকে বলেছে,
“I’ve stumbled on the side of twelve misty mountains,
I’ve walked and I’ve crawled on six crooked highways,
I’ve stepped in the middle of seven sad forests,
I’ve been out in front of a dozen dead oceans,
I’ve been ten thousand miles in the mouth of a graveyard.”
প্রথম লাইনে বলা আছে সে ’12 misty moutains’ এর কাছে হোঁচট খেয়েছিল। এখানে রয়েছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যা। কেন ১২টি পাহাড়ের কথা বলা হলো? উত্তর পাওয়া যাবে ধর্মের পুস্তক আর ইতিহাসে পাতায়। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষ ১২-কে ধর্মীয় দিক থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা মনে করতো। তারা মনে করতো এর বদৌলতে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার উত্তরসূরী ক্যালিডীয় সভ্যতা প্রথম দিন ও রাতকে ১২+১২=২৪ ঘন্টায় ভাগ করে। তারাই ডজন এককের প্রচলন করে (১ ডজন = ১২ একক)। তারা আকাশের ১২টি নক্ষত্রপুঞ্জকে কেন্দ্র করে ১২টি রাশির জন্ম দেয়। ব্যাবিলনীয়দের প্রধান দেবতা ‘বা’ল’ এর মন্দিরে তারা ১২টি পশু বলি দিত। তার আগে মন্দিরের পুরোহিত পুরো মন্দির ১২ বার প্রদক্ষিণ করে আসত।
দেখাই যাচ্ছে, ব্যাবিলনীয়দের কাছে ১২ একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যা ছিলো। শুধু ব্যাবিলনীয়রাই নয়, ইহুদীরাও ১২ এর ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিল। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলেও ইসরাইল গোত্রের ১২টি শাখার কথা বলা আছে। যিশু খ্রিস্টের সহচরের (Apostle) সংখ্যাও ছিলো ১২।
তবে এসবের সাথে বব ডিলানের গানের কী সম্পর্ক? লক্ষ্য করুন, গানে 12 misty mountains এর কথা বলা আছে। ১২ সংখ্যাটি যেহেতু বিভিন্ন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তাই এ দিয়ে ঈশ্বরের ধারণা ব্যাক্ত করা হয়েছে। আর গ্রিক, জাপানী, ভারতীয় ইত্যাদি পুরাণ মতে ঈশ্বরের বাসস্থান Mountain বা পর্বতে। ছেলেটির 12 misty mountains-এ হোঁচট খাওয়া সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের যোগাযোগের অপারগতাকে নির্দেশ করেছে। মানুষের মধ্যে পাপ-পঙ্কিলতা যতই বাড়ছে, ঈশ্বরের সাথে মানুষের যোগাযোগ ততই কমছে।
আর ‘7 sad forests’ এর মাঝখানে যাওয়ার ব্যাপারটা? Forest বা বন কে ডিলান Sad বলে আখ্যা দিয়েছেন গাছপালার প্রতি মানুষের উদাসীনতা ও নিষ্ঠুর আচরণের কারণে।
গানের পাঞ্চলাইনে ছেলেটি বারবার বলেছে ‘It’s a hard rains a gonna fall’। অ্যাব্রাহামিক ধর্মগ্রন্থগুলোর বর্ণণা অনুসারে মানুষের পাপ-অনাচার চরমে পৌঁছে গেলে সৃষ্টিকর্তা ‘নোয়াহ’ (হযরত নূহ আঃ)-কে তাদের সতর্ক করার জন্য পাঠান। তবুও তারা সৃষ্টিকর্তার বাণী না মানলে তিনি এক মহাপ্লাবন দ্বারা সৃষ্টিকর্তার বাণী অমান্যকারীদের ধ্বংস করে দেন। মানুষের নিকৃষ্টতা প্রত্যক্ষ্য করে এসে নিষ্পাপ শিশুটিও তেমনি একটি মহাপ্লাবনের আশংকা করছে।
এরপর ছেলেটির মা তাকে জিগ্যেস করেন যে সে সেসব জায়গায় কী কী দেখেছে। সে উত্তর দেয়, পর্বতের কাছে (যেখানে ঈশ্বরের বাসস্থানের ইঙ্গিত করা হয়েছে) সদ্যোজাত শিশুদের চারপাশে হিংস্র নেকড়েদের দেখেছে। হিংস্র নেকড়ে এখানে মানুষের কুপ্রবৃত্তির প্রতীক। ডিলান বলতে চেয়েছেন, যেখানে সদ্যোজাত শিশুদের সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদপ্রাপ্ত হয়ে বড় হবার কথা, সেখানে তারা মানুষের হিংস্রতার মাঝখানে বড় হচ্ছে। তার বর্ণনায় মধ্যযুগের ইতালিয়ান কবি দান্তে আলিঘিয়েরির মহাকাব্য ‘The Devine Comedy’-র প্রভাব সুস্পষ্ট, যেখানে কবি পরকালে স্বর্গ ও নরকের মধ্যে দিয়ে কাল্পনিক ভ্রমণ বর্ণনা করেন। উক্ত বর্ণনাতে কবি স্বর্গে যাবার খাড়া পাহাড়ের পথে একটি স্ত্রী-নেকড়ের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হন। ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগের পথে ডিলানও তেমনি বাধার বর্ণনা দিয়েছেন।
ছেলেটি আরও বলেছে সে একটি ‘Highway of diamonds’ দেখেছে (২য় পংক্তি) ও ছয়টি জটিল পথ (Crooked highways) দেখেছে (১ম পংক্তি)। লক্ষণীয় বিষয় হলো জটিল পথ রয়েছে ৬টি, কিন্তু ‘Highway of diamonds’ মাত্র একটি, যাতে কেউ ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই অসৎ বা ভুল পথ অনেকগুলোই থাকতে পারে, তবে সঠিক পথ সবসময়ই একটি। আর মানুষ সেই পথে হাঁটতে চায় না।
১ম পংক্তিতে Seven sad forests এর কথা বলা আছে। ২য় পংক্তিতে ছেলেটি বলেছে সে সেখানে গিয়ে গাছের কালো ডাল থেকে রক্ত ঝরতে দেখেছে (I saw a black branch with blood that kept dripping)।
এর ব্যাখ্যা বোঝার জন্যে আবার আমাদের দান্তের ‘Devine Comedy’-তে ফিরে যেতে হবে। আত্মহত্যা মহাপাপ। তাই দান্তের বর্ণনানুসারে যারা আত্মহত্যা করে, তাদেরকে নরকে রক্তাক্ত গাছে পরিণত করে রাখা হয়। বন ধ্বংস করা মানুষের জন্যে নিজেরই ধ্বংস ডেকে আনার মতো, অর্থাৎ আত্মহত্যার মতো। ডিলানের গানে ছেলেটির রক্তাক্ত গাছ দেখার মাধ্যমে বন ধ্বংসের ফলে মানুষের উক্ত পরিণতির দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
২য় পংক্তিতে ছেলেটি আরো বলেছে, মৃত সমুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে (যা ১ম পংক্তিতে উল্লেখ আছে) একটি সাদা মই সমুদ্রে ডুবে যেতে দেখেছে (I saw a white ladder all covered with water)। বাইবেলে জ্যাকবের একটি স্বপ্নের উল্লেখ রয়েছে যেখানে একটি সাদা মই বেয়ে সে নিজেকে স্বর্গে উঠে যেতে দেখেছে ঈশ্বরের সাথে দেখা করার জন্য। বব ডিলানের গানে ছোট ছেলেটির একটি সাদা মই মৃত সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্বর্গের সাথে মর্ত্যের বা ঈশ্বরের সাথে মানুষের যোগাযোগের পথ বন্ধ হবার ব্যাপারটি প্রকাশ পেয়েছে, কারণ মানুষ ধীরে ধীরে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
গানটিতে আরো প্রচুর উপমা ও প্রতীক টেনে মানুষের পাপের কথা জানান দেয়া হয়েছে। ছেলেটি দেখেছে কিছু লোকের হাতের হাতুড়ি থেকে রক্ত ঝরছে। এখানে স্বার্থের দ্বন্দে ভুল বিচারে প্রাণ হারানো নিষ্পাপ লোকদের কথা ও বিচারালয়ের অনৈতিকতার কথা বলা হয়েছে (কোর্টে প্রধান বিচারকের হাতে হাতুড়ি থাকে)। কবিদের কথা মানুষের আবেগকে স্পর্শ করতে পারছে না, প্রকৃতির করাল থাবাও মানুষকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে ইত্যাদি। তবে এতসবের মাঝেও আশার আলোর কথা বলেছেন বব ডিলান। গানে ছেলেটি তার মাকে একটি মেয়ের কথা বলেছে, যে তাকে একটি রংধনু উপহার দিয়েছে (I met a young girl; she gave me a rainbow)। নোয়াহর কাহিনী থেকে আমরা জানি, মহাপ্লাবন শেষ হবার পর নোয়াহর সাথে নৌকায় থাকা বিশ্বাসী লোকেরা রংধনু দেখতে পায়। ছেলেটি তার মাকে বলেছে সে সেই রংধনু নিয়ে (আশার আলো নিয়ে) নোয়াহর সময়ের মতো মাহাপ্লাবন শুরু হবার আগে সেসমস্ত অভিশপ্ত জায়গায় আবার যাবে (I’m a-goin’ back out ‘fore the rain starts a-fallin’)। মানুষকে সত্য ও সঠিক পথের কথা বলবে।
এমনই সব গভীর তাৎপর্যপূর্ণ চিন্তা-ভাবনায় বব ডিলান তার গানগুলোকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছেন। ভবিষ্যতে তার আরো গানের তাৎপর্য নিয়ে লেখার ইচ্ছে রইলো। তার গানগলো শুধু সংগীতাঙ্গণে বা সাহিত্যে নয়, টিকে থাকবে মানুষের বুদ্ধিদীপ্ততার নিদর্শন হয়ে।