সুস্থ-সবল থাকতে চাইলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেই হবে। আর এজন্য খাওয়ার আগে ও পরে, ঘরের বাইরে থেকে এসে বা ময়লা কিছু ধরলে যে হাত ধুতে হবে এটা সবাই কম-বেশি বোঝে। ভালো করে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পরেই কেবল বাকি কাজ করতে হবে তা অনেকেই জানেন। তবে সবসময় ঘরের বাইরে বা রাস্তাঘাটে সাবান এবং পানির ব্যবস্থা থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার সাধারণ নিয়মের বদলে দরকার কোনো অভিনব উপায়। আর এজন্যই আজকাল বাজারে বিক্রি হয় ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, হাত ধোওয়ার একপ্রকার প্রসাধনী হলো এই ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’। অনেকে মনে করেন যে, সাবান ও পানির বদলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করলেই বোধহয় সব জীবাণু থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। তবে এই বিশ্বাস একেবারেই ভুল। জরুরি অবস্থা কিংবা কিছুক্ষণের জন্য এটি লাভজনক হলেও সবসময় ব্যবহারের জন্য একদমই অযোগ্য এসব স্যানটাইজার। কখন স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যায় আর কোন ধরনের স্যানিটাইজার ব্যবহারের উপযোগী তা না জানার কারণে অনেকেই বিপদের সম্মুখীন হন। রোগজীবাণু থেকে বাঁচার তাগিদে স্যানিটাইজার ব্যবহার করে উল্টো বড় কোনো রোগের দিকে ঝুঁকে পড়েন অনেকেই।
কীভাবে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হয়
কার্যকরভাবে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হলে প্রথমেই হাতের তালুতে একদম কম করে (বুড়ো আঙুলের নখের পরিমাণ) স্যানিটাইজার নিয়ে পুরো হাতে ভালো করে লাগাতে হবে। এমনকি নখেও যেন ঠিকমতো লাগে সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। অতিরিক্ত জেল টিস্যু বা ন্যাপকিন দিয়ে মুছলে জীবাণু শক্ত করে হাতে লেগে যেতে পারে। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ঘষে ঘষেই এটা শুকিয়ে নেওয়া হয়। অবশ্য যদি ১৫ সেকেন্ড হওয়ার আগেই স্যানিটাইজিং জেল পুরোপুরি শুকিয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে সঠিক পরিমাণ স্যানিটাইজার ব্যবহার করা হয়নি।
স্যানিটাইজার কখন কাজ করে এবং কখন করে না
সত্যি কথা বলতে সাবান এবং পানিই সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় হাত ধোয়ার জন্য। তবে এগুলো না থাকলে এমন স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যাবে যার মধ্যে অন্তত শতকরা ৬০ ভাগ অ্যালকোহল আছে। মোটামুটি শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ অ্যালকোহলপূর্ণ স্যানিটাইজার রোগজীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রে কার্যকর। ইথাইল অ্যালকোহল বা ইথানলপূর্ণ স্যানিটাইজার ব্যবহার করা নিরাপদ যদি এর মধ্যে উপাদানগুলো সঠিক পরিমাণে দেওয়া হয়। অন্যথায়, এ ধরনের স্যানিটাইজার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ঠিকমতো ব্যবহার করলে এই প্রসাধনী জীবাণু বা মাইক্রোবস ধ্বংস করতে পারে তা ঠিক, কিন্তু কোনো কোনো মাইক্রোবের ক্ষেত্রে সাবান ও পানি ছাড়া আর কোনো বিকল্পই নেই। যেমন- ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম, নরোভাইরাস এবং ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল।
কোনো স্যানিটাইজারে অ্যালকোহল না থাকলে তা জীবাণুনাশে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এসব রোগজীবাণু মারেও না, আবার এগুলোর বৃদ্ধিও তেমন কমাতে পারে না। এসব দুর্বল অ্যালকোহলহীন স্যানিটাইজারের বিরুদ্ধে জীবাণুগুলোই একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ফেলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব স্যানিটাইজার ব্যবহারকারীর ত্বকে চুলকানি বা জালাতন দেখা যায়।
সাধারণত দেখা যায় অফিসে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে কিংবা হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল কাজগুলো করার পর স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুলে তা কার্যকর হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে ময়লার পরিমাণ অতিরিক্ত হয় না বা হাত তেল চিটচিটে থাকে না। কয়েকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাত মাটি দিয়ে বা অধিক ময়লায় ভরা থাকলে কাজ করে না। যেমন- খাওয়া-দাওয়ার পর, খেলাধুলা বা বাগানে কাজ করার পর কিংবা সারাদিন ধুলোবালিতে থাকার পর অথবা কোনো রাসায়নিক দ্রব্য হাতে লাগলে স্যানিটাইজার আর কার্যকর হয় না। এসব ক্ষেত্রে হাত ভালো করে পানি এবং সাবান দিয়ে ধোয়াই শ্রেয়।
স্যানিটাইজারে কী কী উপাদান আছে সেটার উপর নির্ভর করে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নাকি ভালো। সত্যি বলতে কোনো স্যানিটাইজারই পুরোপুরি ভালো নয়।
স্যানিটাইজার ব্যবহারের নেতিবাচক দিকগুলো
১. ট্রাইক্লোসান
ট্রাইক্লোসানসম্পন্ন স্যানিটাইজার যে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ ধরনের স্যানিটাইজিং জেল ভালো থেকে খারাপ প্রভাবই বেশি ফেলে। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) তথ্য মোতাবেক, ট্রাইক্লোসান অ্যান্টিবায়োটিক থেকে ব্যাকটেরিয়াকে রক্ষা করে, যদিও উপাদানটি এর বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। তাছাড়া দেহে এমআরএসএ-এর মতো সুপারবাগও সৃষ্টি করতে পারে এই ট্রাইক্লোসান, যা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং স্নায়ুকোষ ধ্বংস করে দেয়। এছাড়া শরীরের প্রয়োজনীয় হরমোন সৃষ্টিতেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এই ট্রাইক্লোসান। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে।
২. প্যারাবিন
স্যানিটাইজারে ভিন্ন ভিন্ন প্যারাবিন ব্যবহৃত হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্যারাবিন হলো ইথাইলপ্যারাবিন, বিউটাইলপ্যারাবিন, মিথাইলপ্যারাবিন এবং প্রপাইলপ্যারাবিন। স্যানিটাইজারের বোতলের গায়ে এসব উপাদানের যেকোনো একটির উল্লেখ থাকলে তা অবশ্যই বর্জনীয়। প্যারাবিন যে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে তা ঠিক। তবে এই একটি গুণের বিপরীতে রয়েছে শত শত দোষ। বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক শারীরিক সমস্যা, যেমন- ক্যান্সার, নিউরোটক্সিসিটি, এন্ডোক্রাইন ডিসরাপসন এবং ত্বকের চুলকানি দেখা যায়।
৩. অ্যালকোহল
বাজারে যেসকল স্যানিটাইজার আছে সেগুলোর মধ্যে অ্যালকোহলপূর্ণ স্যানিটাইজারই সবচাইতে ভালো। তবে এগুলোও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা অ্যালকোহল স্যানিটাইজিং জেল ব্যবহার করে তাদের রক্তেও অ্যালকোহল পাওয়া যায়। আবার অনেক শিশু এসব জেল নেশার কাজে ব্যবহার করে কিংবা অজান্তেই এগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে যায়। কিছু কিছু স্যানিটাইজারে আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহলও থাকে। এটি একধরনের পেট্রোকেমিক্যাল, যা নিউরোটক্সিন নামেও পরিচিত। এই অ্যালকোহল ত্বক শুষে নেয় এবং দেহে বিষের মতো কাজ করে। এসব স্যানিটাইজার ত্বকের সুরক্ষা স্তরগুলোকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে ফেলে। এর মানে এই না যে অ্যালকোহলবিহীন স্যানিটাইজিং জেল ভালো। এগুলো বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান, যেমন- বেনজালকোনিয়াম ক্লোরাইড দিয়ে তৈরি হয়। এই উপাদান ইমিউন ডিসফাংশন এবং হাইপারসেনসিভিটির সাথে সংযুক্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট এবং ক্রোনিক ডার্মাটাইটিসের মতো রোগের সৃষ্টি করে।
৪. সুগন্ধি
স্যানিটাইজারে সুগন্ধি ব্যবহার করা নির্দেশ করে যে এর মধ্যে কোনো রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা অবশ্যই বিষাক্ত এবং দেহের জন্য ক্ষতিকর। ‘এনভায়রনমেন্টাল ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এর তথ্য মোতাবেক স্যানিটাইজারের এসব সুগন্ধি অ্যালার্জি, ডার্মাটাইটিস, শ্বাসকষ্টের মতো রোগ সৃষ্টি করে এবং প্রজননতন্ত্রের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর তাছাড়া সুগন্ধিতে কী কী উপাদান ব্যবহার করা হবে তা ঠিকমতো জানা সম্ভব হয় না। তাই কোন উপাদানের কারণে শরীরে কোন জটিলতার সৃষ্টি হয় তা বোঝা মুশকিল। তাই স্যানিটাইজার কিনলে গন্ধহীন কেনাই ভালো।
৫. অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল স্যানিটাইজার ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করে তা ঠিক। কিন্তু খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সাথে ভালো ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলে এই ধরনের স্যানিটাইজিং জেল, যা শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল জেল।
২০১১ সালে দ্য এপিডেমিক ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইউএস সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের যেসকল স্বাস্থ্যকর্মী সাবানের বদলে প্রতিদিন স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন তাদের নরোভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছ’গুণ বেড়ে যায়। এতে করে অ্যাকিউট গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাত ধোয়ার প্রধান প্রসাধনী নয়, বরং এটা শুধুমাত্র সাবান ও পানি হাতের কাছে না থাকলে ব্যবহারের উপযোগী। স্যানিটাইজার পরিমিতভাবে ব্যবহার করলে তা অবশ্যই লাভজনক। এটি সহজেই ব্যাগে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। ফলে যেসকল স্থানে পানি দুষ্প্রাপ্য বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুযোগ নেই সেসব স্থানে এই জেল দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। আর এটি ব্যবহার করা যেমন সহজ তেমন সময়ও বেশি লাগে না। তাছাড়া শুকনো ত্বকের আর্দ্রতাও ফিরিয়ে আনে। তবে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করলে ক্ষতির সম্মুখীন হতেই হবে। তাই স্যানিটাইজার ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়াই ভালো।