ভাবুন তো, কোনো এক সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি শুনতে পান পৃথিবীতে পরিবেশ দূষণ নামের কোনো শব্দ নেই, হারিয়ে গেছে গ্রিন হাউজ প্রভাবের চোখ রাঙানি- কেমন হবে এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বহুল পরিচিত কাহিনীর উল্টোটা ঘটলে? জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হয় মানুষকেই। নিজেদের স্বার্থে আমরা প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করে যাচ্ছি কোনোরকম বাছবিচার ছাড়াই। আমাদের আচরণ কিংবা মনোভাবের যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত আশঙ্কা বদলাবে না কখনও।
গত মার্চে রোর বাংলায় প্রকাশিত এক লেখায় বলা হয়েছিল এমন স্বপ্নের কথা। বিশ্বের নানা দেশ থেকে পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ কমে আসার খবর সেই স্বপ্নের পালে হাওয়াই দিচ্ছিল যেন।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক এন্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাসোসিয়েশন (NOAA)-এর সাম্প্রতিক কিছু তথ্য ভিন্ন চিত্রেরই আভাস দিচ্ছে। সংস্থাটির গ্লোবাল মনিটরিং ল্যাবরেটরির নিয়মিত পর্যবেক্ষণ বলছে, বৈশ্বিক কার্বন ডাইঅক্সাইডের স্তর দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। ২০২০ সালের এপ্রিলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের গড় ঘনত্ব রেকর্ড করা হয়েছে ৪১৬.২১ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), যেটি ১৯৫৮ সালে হাওয়াইতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাপ শুরু হওয়ার পরে এযাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। আইস কোর রেকর্ডগুলোও ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, গত আট লক্ষ বছরে কার্বন ডাইঅক্সাইড স্তরের এমন উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যায়নি।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (UNEP) ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট সিচুয়েশন রুম ১৯৫৮ সালের মার্চ থেকে ১০০ পিপিএমের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব দ্রুত বৃদ্ধির খবর দিয়েছে।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কী ঘটে?
কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধির ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, দক্ষিণ গোলার্ধের চেয়ে উত্তরের গোলার্ধের জমির পরিমাণ অনেক বেশি এবং গ্রীষ্মের সময় মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে নেয় উদ্ভিদ। উত্তর গোলার্ধের শীতের শেষে মে মাসে বিশ্বব্যাপী কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। তারপরে সালোকসংশ্লেষণ হওয়ার সাথে সাথে নতুন পাতা এলে এটি কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণে সহায়ক হয়ে অঠে এবং অক্টোবরের আগপর্যন্ত প্রায় ৭.৫ পিপিএম ঘনত্বের হ্রাস করে। উত্তর গোলার্ধের শীতকালে পৃথিবীতে সালোকসংশ্লেষণ কম থাকে, তাই কার্বন ডাইঅক্সাইড ঘনত্ব পরবর্তী চক্র পর্যন্ত অবনমিত হয়।
আশঙ্কার জায়গা কোথায়?
মানবসৃষ্ট নানা কারণে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব কেবল বৃদ্ধিই পাচ্ছে না, বৃদ্ধির মাত্রা ত্বরান্বিতও হচ্ছে।
জাতিসংঘ থেকে প্রকাশিত এক লেখচিত্র বছরখানেক আগের এক মাস এবং এই বছরের একই মাসের মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্বের পার্থক্য দেখিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ এই বছরের এপ্রিল এবং গত বছরের এপ্রিলের মাঝে ২.৮৮ এর বেশি পিপিএম ঘনমাত্রা বেড়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এটি দেখায় যে এক বছরেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে এমন বৃদ্ধি যখন ষাটের দশকে ০.৯ পিপিএম ছিল, তখন ২০১০-১৯ এর দশকে এসে এটি গড়ে ২.৪ পিপিএমে গিয়ে ঠেকেছে। এই চিত্রটি স্পষ্টভাবেই কার্বন ডাইঅক্সাইড ঘনমাত্রার দ্রত উর্ধ্বমুখী প্রবণতার বার্তা দিচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণ কী বলছে?
আইস-কোর রেকর্ডগুলো ব্যবহার করে ৮ লক্ষ বছর পূর্বে গভীর অ্যান্টার্কটিক বরফে আটকা পড়া কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিমাপ করা সম্ভব। জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদন বলছে, আমরা গত ৮ লক্ষ বছরে কখনোই ৪১৬ পিপিএম-এ পৌঁছতে পারেনি।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (UNEP) ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট সিচুয়েশন রুমের প্রোগ্রাম ম্যানেজার পাস্কেল পেদুজি বলেন,
অবশ্যই এটি আমাদের জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়, এবং আবারও প্রমাণ করে, আমাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা গড়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার জন্য আমাদের ২০৪০ সালের মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে হবে।
লকডাউনও কেন আশার আলো দেখাতে পারছে না?
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হ্রাসে মানুষের ঘরে থাকা বা লকডাউন পরিস্থিতি মোট বৈশ্বিক নির্গমন বোধহয় হ্রাস করবে। যদিও এটি সত্য যে ২০২০ সালের জানুয়ারির পর থেকে বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গায় যানবাহন ও বিমান পরিবহন এবং সংশ্লিষ্ট দূষণের ব্যাপারগুলোয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।
কিন্তু বৈদ্যুতিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী ঠিক আগের মতোই আছে। বৈশ্বিক বৈদ্যুতিক শক্তির ৬৪ শতাংশই জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে আসে, যার মধ্যে কয়লার পরিমাণ ৩৮ শতাংশ, গ্যাস ২৩ শতাংশ এবং তেল ৩ শতাংশ। এই ক্ষেত্রটিতে যেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, ঠিক তেমনই হিটিং সিস্টেমগুলোও কাজ করছে আগের মতোই। একইসাথে মৌলিক কিছু বিষয়, যেমন- পুর্নব্যবহারযোগ্য জ্বালানী, জরুরি পরিবহন, বন উজাড়ের মতো বিষয়গুলোয় কোনো আশার আলো নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হোক কিংবা মানবসৃষ্ট কারণ, বনাঞ্চলের আগুন এবং দাবানলের হার বাড়ছে। সাম্প্রতিককালের এমন ঘটনা ব্রাজিল, হন্ডুরাস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ভেনিজুয়েলার বিভিন্ন অঞ্চলকে রেখেছে হুমকির মুখে, এসবের ফলে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে।
আগামীর ভাবনা
পাস্কেল পেদুজি বলছেন,
কোভিড-১৯ তার ভয়াবহতার মধ্যেও পরিবেশের সাথে আমাদের অস্থিতিশীল সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ঝুঁকি, সেটা হ্রাস করে আমাদের অর্থনীতিকে আরও পরিবেশগতভাবে দায়বদ্ধ উপায়ে পুনর্গঠনের ব্যাপারে ভাবতে সুযোগ করে দিয়েছে। স্থিতিশীল বাজার, সংস্থা, দেশ, বৈশ্বিক ব্যবস্থা এবং প্রত্যেকের স্বাস্থ্যকর, টেকসই ভবিষ্যত তৈরি করতে আমাদের অবশ্যই মহামারি ও জলবায়ু বিপর্যয়ের মতো বিশ্বব্যাপী হুমকি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন,
ডিকার্বোনাইজেশনের সুবিধা গ্রহণের জন্য রাজস্ব উদ্দীপনা এবং আর্থিক সংস্থানযোগ্য প্যাকেজগুলোকে সমর্থন করা, ত্বরান্বিত নবায়নযোগ্য ও পরিষ্কার জ্বালানী স্থানান্তর কেবল একটি স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক জয় নয়, ভবিষ্যতের স্থিতিস্থাপকতার জন্যও একটি জয় হবে।