আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভপ্রতিম কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১)। জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি, ‘কল্লোল’ সাহিত্যসমাজের ধারাবাহিকতার যোগ্য ধারক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই কৃতী পুরুষ মহিমান্বিত প্রথম আধুনিক বাঙালি-মুসলমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র এক ধ্রুপদী সৃষ্টি ‘লালসালু’। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’ প্রকাশের তিন বছরের মাথায় ১৯৪৮ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ঢাকার কমরেড পাবলিশার্স থেকে। উপন্যাসটিকে লেখকের শ্রেষ্ঠতম কৃতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধর্মভীরু গ্রামীণ মুসলিম সমাজে এক কল্পিত মাজারকে পুঁজি করে এক চতুর ধর্মব্যবসায়ী কীভাবে প্রতিষ্ঠা পায়, স্বার্থহাসিলের তাগিদে গড়ে তোলে পাপের সাম্রাজ্য তারই আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে এ উপন্যাসে। এ উপন্যাসের জন্য ১৯৬১ সালে লেখক বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। উপন্যাসটি পরে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান এবং চেক ভাষায় অনূদিত হয়।
‘লালসালু’ সাহিত্যখাত বিচারে মূলত একটি সামাজিক উপন্যাস। এর বিষয় যুগ-যুগ ধরে শেকড়গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব। এর কাহিনী গড়ে উঠেছে মজিদ নামে এক স্বার্থান্বেষী, ক্রুর, ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীকে কেন্দ্র করে। স্বার্থান্বেষণে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে সে উপনীত হয় মহব্বতপুর গ্রামে। গ্রামে এসে সে প্রথম ঘাঁটি গাড়ে গ্রামের মাতব্বর খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে।
গ্রামের অদূরে ছিল বাঁশঝাড়সংলগ্ন একটি কবর। কবরটি যে কার- গ্রামবাসী তা জানে না, জানার তাগিদও অনুভব করেনি কখনও। লোক জমায়েত করে মজিদ প্রচার করে কবরটি এক ‘মোদাচ্ছের’ (নাম না জানা) পীরের এবং স্বপ্নাদেশে সেই মাজার তদারকির জন্যই তার আগমন এ গ্রামে। জাহেল, বে-এলেম ইত্যাদি তিরস্কার এবং স্বপ্নাদেশের বিবরণ শুনে ভয়ে এবং একইসাথে শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয় গ্রামবাসী। জঙ্গলাকীর্ণ কবরটি দ্রুত পরিষ্কার করে ঝালরওয়ালা লালসালুতে ঢেকে দেওয়া হয়। কবরটি অচিরেই পরিণত হয় মাজারে, মজিদ হয় তার খাদেম।
যথারীতি সেখানে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বলে; ভক্ত আর কৃপাপ্রার্থীরা টাকা-পয়সা দিতে থাকেন দেদার।মাজারটি পরিণত হয় গ্রামজুড়ে মজিদের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রধান কেন্দ্রে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মজিদ ঘরবাড়ি, জমি-জিরাত এবং মনোভূমির অনিবার্য আকাঙ্ক্ষায় শক্ত-সমর্থ এবং ঠাণ্ডা-ভীতু স্বভাবের এক জরুর মালিক হয়ে বসে। তার নানাবিধ ভেল্কিবাজি নিরক্ষর গ্রামবাসীর কাছে তাকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন করে তোলে। এর বলেই ধর্মকর্মের পাশাপাশি সে হয়ে ওঠে গ্রামের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তি- উপদেশ দেয় গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, বিচার-সালিশে সে-ই হয় প্রধান সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ব্যক্তি।
স্বয়ং মাতব্বর খালেকও তাকে সমীহ করতে শুরু করলে মজিদের আধিপত্যের সীমা আরও বড় হয়, প্রভাব খাটাতে শুরু করে পারিবারিক জীবনেও। বৃদ্ধ বাপ-মায়ের মধ্যকার একান্ত পারিবারিক ঝগড়া-কলহে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে প্রশ্ন তোলে বাপের কর্তৃত্ব নিয়ে; জনসমক্ষে নিয়ে গিয়ে মাফ চাইয়ে লজ্জিত-অপমানিত বাপকে করে গ্রামছাড়া। আবার আত্মদম্ভে আঁচড় লাগায় মিথ্যে কলঙ্ক আরোপ করে মাতব্বর খালেককে বাধ্য করে তার নিঃসন্তান অসহায় স্ত্রীকে তালাক দিতে। মজিদের প্রতি গ্রামবাসীর ভক্তি-ভীতি আর আনুগত্য এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এত শত কাণ্ডের পরেও তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় না টুঁ শব্দটি। এভাবে গ্রামবাসীর সারল্য ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণার জাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই বিবরণে সমৃদ্ধ ‘লালসালু’ উপন্যাস।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যখন লেখালেখি শুরু করেন, সে সময়টা ছিল ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণ। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অস্থির ও চঞ্চল; নানা রকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঘটনার আবর্তে মধ্যবিত্তের জীবন তখন বিচিত্রমুখী জটিলতায় বিপর্যস্ত। এমতাবস্থায় চেনা জগতকে বাদ দিয়ে একজন নবীন ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্যকৃতির জন্য বেছে নিলেন মানবসুলভ দ্বন্দ্ব-ত্রুটিবিচ্যুতির মুখ্য প্রতিরূপ অপরিবর্তনশীল এবং অনাধুনিক বৈশিষ্ট্যাশ্রয়ী গ্রামীণ সমাজকে।
গ্রামীণ সমাজবাস্তবতাকে তুলে ধরার যাত্রা শুরু হয়েছিলো তার প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ থেকেই।উপন্যাসে প্রতিফলিত সমাজচিত্র থেকে বোঝা যায়, এর পটভূমি গত শতকের ’৪০ কিংবা ’৫০ এর দশকের গ্রামসমাজ। পুরো উপন্যাস পাঠে আমরা দেখি সেসময়ের গ্রামীণ সমাজ অশিক্ষা-কুশিক্ষা-সংস্কারের শৃঙ্খলে নিদারুণভাবে বন্দি-অন্ধকারাচ্ছন্ন, স্থবির। মানুষ অলৌকিকত্বে গভীরভাবে বিশ্বাসী। দৈবশক্তির লীলা দেখে হয় নিদারুণ ভয় পেয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, নয়তো ভক্তিতে আপ্লুত হয়। কিন্তু দৈব বিশ্বাস দিয়ে তো আর পেট চলে না। তাদের জীবন তাই অতিবাহিত হয় অভাব-অনটন-জঠরজ্বালার দুষ্টচক্রে।
এ প্রেক্ষাপটে ধর্ম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা এ দেশের গ্রামাঞ্চলে বহুকাল ধরেই বিদ্যমান। মজিদের শুরুও সেখান থেকেই। স্বগত সংলাপ থেকে জানা যায়, শস্যহীন উষর নিজ অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে-পড়া মজিদ নিজ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়। বসতি স্থাপন করতে এসে সে এমনই এক ‘আদর্শ’ জায়গার হদিশ পায়, কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের যেখানে জয়জয়কার; প্রতারণা, শঠতা আর শাসনের জটিল এবং সংখ্যাবিহীন শেকড় যেখানে জীবনের শেষপ্রান্ত অবধি পরতে পরতে ছড়ানো।
বাঙালি মুসলমান সমাজে জেঁকে বসা পীরপ্রথারও এক বিশ্বস্ত দলিল ‘লালসালু’ উপন্যাসটি। ওয়ালীউল্লাহ্’র পিতা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। পিতার বদলির চাকরিসূত্রে তিনি বাংলাদেশের দূর-দূরান্তে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পান। ফলত, ধর্মীয় বইয়ের পাতা থেকে মানুষের সংস্কারকে পুঁজি করে সমাজে ছড়িয়ে পড়া পীরপ্রথাকে খুব কাছ থেকে দেখেন তিনি। ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাস কিংবা ‘বহিপীর’ নাটকের সমান্তরালে ‘লালসালু’ উপন্যাসেও তার সেই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায়।
ধর্ম-ব্যবসায়ী মজিদকে মানুষ ব্যবসায়ী হিসেবে শনাক্ত করতে না পেরে ভয় পায়। কারণ, তাদের বিশ্বাস লোকটির পেছনে সক্রিয় রয়েছে রহস্যময় অতিলৌকিক কোনো দৈবশক্তি। এই অতিলৌকিক দৈবশক্তির অছিলাই মজিদের টিকে থাকার শক্তি। সে প্রচণ্ড সোচ্চার তার রাজত্বে কোনো দ্বিতীয় অংশীদারের আবির্ভাব ঘটছে কি না, যদি ঘটে তবে নৃসিংহমূর্তি ধারণ করে অতিসত্বর বিদায় করে তাকে। সে খুব ভালো করেই জানে, শিক্ষার আলোই হতে পারে তার হন্তারক। গ্রামবাসী যাতে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মজিদের মাজারকেন্দ্রিক পশ্চাৎপদ জীবনধারা থেকে সরে যেতে না পারে, সেজন্য সে শিক্ষিত যুবক আক্কাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কূটকৌশলে তার স্কুল প্রতিষ্ঠার ‘বেতমিজি’ স্বপ্নকে ছত্রখান করে দিয়ে বাধ্য করা হয় গ্রাম ছাড়তে।
এছাড়া, ভণ্ড মজিদ যে সর্বদা নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ বোধ করে তা নয়। তার মনেও সদা ভয়- হয়তো কোনো মানুষ স্বাভাবিক প্রেরণা ও বুদ্ধির মাধ্যমে তার গড়ে তোলা প্রতিপত্তির ভিত্তিটাকে ধসিয়ে দেবে!আক্কাস, জমিলা, আমেনা বিবি আর ঢ্যাঙাবুড়ির মতো চরিত্রগুলোর আচরণ বিভিন্ন সময়ে মজিদকে ভীত করেছে, আশঙ্কাগ্রস্ত করেছে, যদিও তাদেরকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন করে দমন করা হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এরূপে চিত্রিত সচেতন ও অবচেতন মানবমনের বিচিত্র গতিও এ উপন্যাসকে নতুন মাত্রা দেয়।
‘লালসালু’ উপন্যাসটি শিল্পিত সামাজিক দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় সংযোজন। এর কাহিনী ছোট, সাধারণ ও সামান্যই। বিষয় নির্বাচন, কাহিনী ও ঘটনাবিন্যাসও গতানুগতিকতা বিবর্জিত। অথচ এর মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত রূপ আঁকেন লেখক। এর গ্রন্থনা ও বিন্যাস অত্যন্ত মজবুত। লেখক সাধারণ একটি ঘটনাকে অসামান্য নৈপুণ্যে বিশ্লেষণী আলো ফেলে তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও সমাজ সরল ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত ও ভীতির মধ্যে রেখে শোষণের প্রক্রিয়া চালু রাখে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ তিনি দিয়েছেন ‘লালসালু’ উপন্যাসে।
ধর্মবিশ্বাস তার আক্রমণের লক্ষ্য নয়, তার আক্রমণের লক্ষ্য ধর্মব্যবসা এবং ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্ধত্ব। এই আগাছাগুলোই কল্যাণময় ধর্মের ভিত্তিকে দুর্বল করেছে, মানুষের মনকে করেছে দুর্বল, সংকীর্ণ এবং ভীত। উপন্যাসের লালসালুটি সেই অজানা পীরের কবরই আবৃত করেনি, ঢেকে রেখেছে আমাদের বোধবুদ্ধি আর সচেতনতাকেও। ‘লালসালু’ উপন্যাসটি এই কুসংস্কার আর ভণ্ডামিরই মুখোশ উন্মোচন। অনবদ্য জীবনবোধ, জীবনদর্শন, পরিবেশচিত্রণে জীবন্ত উপমার ব্যবহার, গ্রামীণ ভাষা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি, অপবিশ্বাসের নগ্নরূপ নিরাকরণ- সব মিলিয়ে ‘লালসালু’ বাঙলা সাহিত্যের এক কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি!
ঘরে বসেই বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিঙ্কে:
১) লালসালু