আপনারা যারা এই মুহূর্তে রিভিউটি পড়ছেন, তাদের কেউ কেউ আছেন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, কেউ বা আবার ঝুঁকেছেন কম্পিউটারে। যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে কাদের কল্যাণে? চোখ বন্ধ করে এই প্রশ্নের উত্তরের কথা ভাবতেই কিন্তু ‘প্রযুক্তিবিদ’দের কথা মনে পড়বে।
আচ্ছা, ধরুন কোনো এক প্রতিযোগিতা যেমন ‘রোর বাংলা–রকমারি বই রিভিউ প্রতিযোগিতা’ চলছে, এই রোর বাংলার খবরাখবর আমরা কীভাবে পড়তে পারি? অথবা রকমারিতেই বা কীভাবে বইয়ের অর্ডার দিতে পারি? সোজা উত্তর, ইন্টারনেটের সাহায্যে। এই ইন্টারনেটের আবিষ্কারও কিন্তু প্রযুক্তিবিদদের হাত ধরেই।
এমনই কিছু প্রযুক্তিবিদদের জীবনের জানা অজানা নানা ঘটনা উঠে এসেছে দ্বিমিক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তামান্না নিশাত রিনি’র লেখা ‘কৃতিকথন’ বইটিতে। অ্যাডা লাভলেস, জন ভন নিউম্যান কিংবা গ্রেস হোপার, কাকে রেখে কার কথা বলবেন! বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অঙ্কিত হয়েছে প্রযুক্তি দুনিয়ার গতিপথ বদলে দেয়া এক একজন কিংবদন্তির গল্প। জন মকলি, অ্যালান টুরিং, কিংবা এটসখার ডেইকস্ট্রারের প্রযুক্তি নিয়ে নির্ঘুম রাতের গল্প; ডোনাল্ড কেনুথ, ডেনিস রিচি কিংবা কেন থম্পসনের স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলার কাহিনী পাঠককে আকর্ষণ করবে অবিরত।
এক বসাতেই পড়তে ইচ্ছে করবে স্টিভ ওজনিয়াক, রিচার্ড স্টলম্যান আর টিম বার্নাস লি’র জীবনের খণ্ডচিত্র। গিডো ভ্যান রোজ্যাম, টিম কুক কিংবা জ্যাক মা’র প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা, সাধনা, পরিকল্পনা, আর প্রবর্তনের গল্প পাঠক আগ্রহ নিয়ে পড়বে বইয়ের পরতে পরতে। অ্যাডা লাভলেস পৃথিবীর প্রথম নারী প্রযুক্তিবিদ হলেও এ জাদুকরী জগতকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে আরও অনেক তরুণী। মেরিসা মেইয়ার কিংবা শেরিল স্যান্ডবার্গের জীবনচিত্র এখনকার প্রজন্মের তরুণীদের অনুপ্রাণিত করবে আরও বেশি বেশি। খানিক বিরতি দিয়ে আপনি হয়তো হারিয়ে যাবেন লিনাস টরভাল্ডস, ইলন মাস্ক, ল্যারি পেজ, আর সার্গেই ব্রিনের অভিনব রাজ্যে।
রাজ্যের স্বপ্ন, স্বপ্নের রাজ্য। স্বপ্ন তো বিল গেটসও দেখেছিলেন, দেখেছিলেন সালমান খানও। মার্ক জাকারবার্গের কথাই বা আর বাদ যাবে কেন? চলুন একটুখানি ঘুরে আসি স্বপ্নবাজ প্রযুক্তিবিদদের রাজ্যে।
প্রযুক্তিবিদদের কথা বলতে গেলে অ্যাডা লাভলেস, ওরফে অগাস্টা অ্যাডা কিংয়ের কথা চলে আসবে প্রথম সারিতেই। প্রখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের কন্যা অ্যাডা যে পৃথিবীবাসীকে প্রথম প্রোগ্রামিংয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন, তাকে কীভাবে ভোলা যায়? স্যার চার্লস উইলিয়াম ব্যাবেজের সাথে তিনি যখন ডিফারেন্স মেশিন বা অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন নামক প্রাথমিক কম্পিউটার আবিষ্কারের নেশায় মত্ত ছিলেন তখন তিনি কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন, কী এক আশ্চর্য জগতের সন্ধান তিনি পৃথিবীবাসীকে দিতে চলেছেন? ছোটবেলা থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত অ্যাডা বায়রন কি জানতেন, তিনি মনুষ্যজাতিকে এক নতুন জাদুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চলেছেন, যার বদৌলতে বদলে যাবে ভবিষ্যতের দুনিয়া?
মাত্র ৩৬ বছরের জীবনে পৃথিবীবাসীকে তিনি ডুবিয়েছেন বিস্ময়ের সাগরে। প্রযুক্তি দুনিয়ায় এই কিংবদন্তির অবদান এতই গভীর এবং সুদূরপ্রসারী যে, প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় মঙ্গলবার পুরো বিশ্বে ‘অ্যাডা লাভলেস ডে’ হিসেবে পালন করা হয়। পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামার মিসেস অ্যাডা কিংয়ের গাণিতিক প্রতিভা এবং দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে স্যার চার্লস ব্যাবেজ অ্যাডাকে ‘সংখ্যার জাদুকরী’ (The Enchantress of Numbers) উপাধিতে ভূষিত করেন। সর্বপ্রথম মেশিনের উপযোগী করে এলগরিদম ডিজাইন করে ম্যাডাম অ্যাডা এক নতুন স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রযুক্তি জগতে; যেই স্বপ্নের বীজ এখনো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বপ্নের জন্ম দিচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির এই জাদুকরী দুনিয়ায়।
স্বপ্ন তো ডেনিস রিচিও দেখেছিলেন। মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী স্যার ডেনিস ম্যাকএলিস্টেয়ার রিচি, ‘C’ প্রোগ্রামিং ভাষা আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি প্রযুক্তিজগতকে নতুন এক যুগে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। আমেরিকার জাতীয় প্রযুক্তি পদকপ্রাপ্ত এই জ্ঞানতাপস ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের নির্মাতা হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পান দুনিয়া কাঁপানো ‘দ্য সি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইয়ের জন্য। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়েও প্রোগ্রামিং জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ভাষা হিসেবে স্যার ডেনিস রিচি’র ‘C’ প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রোগ্রাম স্ট্রাকচার অ্যান্ড কম্পিউটেশনাল কমপ্লেক্সিটি’তে পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই প্রযুক্তিবিদ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন স্বপ্ন দেখাতেও।
স্বপ্নবাজ আরেক তরুণ সালমান খান। বলিউডের চিত্রনায়ক সালমান খান ভেবে আবার কেউ ভুল করবেন না যেন। বলছিলাম বিশ্ববিখ্যাত অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম ‘খান একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা সালমান খানের কথা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই আমেরিকানের পুরো নাম সালমান আমিন সাল খান। ‘বিনামূল্যে বিশ্বমানের শিক্ষা, সবার জন্য, যেকোনো জায়গায়’ স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে চলা খান একাডেমিতে শিক্ষা অর্জনের জন্য অন্তর্ভুক্ত কোর্সগুলো রয়েছে আমাদের জন্য জানা-অজানা নানা ভাষায়।
২০১০ সালে টেক জায়ান্ট গুগল কর্তৃপক্ষ খান একাডেমিকে ২ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় খান একাডেমির কোর্সগুলোকে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়, বিশেষ করে বহুল প্রচলিত ভাষাগুলোতে অনুবাদ করার জন্য। আরেক শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটসের মালিকানাধীন ‘বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ প্রায় একই সময়ে খান একাডেমিকে ১.৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। খান একাডেমির দারুণ সব কোর্স সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রযুক্তি জগতের কিংবদন্তি বিল গেটস অকপটে স্বীকার করেছেন যে, তার ছেলেমেয়েকে তিনি খান একাডেমির অনুশীলন সফটওয়্যার দিয়ে শিক্ষাদান করে থাকেন। শিক্ষাকে উন্মুক্ত করার স্বপ্নে বিভোর সালমান আমিন সাল খান প্রতিষ্ঠিত খান একাডেমি আজ স্বপ্ন দেখাচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও।
স্বপ্ন দেখা মানুষের তো আর অভাব নেই। কিন্তু ক’জনই বা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে? স্বপ্নকে সত্যি করা এক রূপকথার গল্পের নায়ক বিল গেটস। এই রূপকথা কোনো কল্পকাহিনী নয়; এই রূপকথা প্রযুক্তিজগতের এক নবদিগন্তের সূত্রপাতের গল্প। মাইক্রো-কম্পিউটার এবং সফটওয়্যার, এই দুটো শব্দের মিলনে নামকরণ করা হয় দুনিয়া কাঁপানো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের, আর এই প্রতিষ্ঠানের প্রধানই হলেন ১৩ বার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে তকমা পাওয়া উইলিয়াম হেনরি বিল গেটস। হার্ভার্ডের সবচেয়ে সফল ড্রপআউট এই শীর্ষ প্রযুক্তিবিদ এমন এক জগতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে প্রতিটি ডেস্ক এবং প্রতিটি বাড়িতে থাকবে একটি করে কম্পিউটার। বলা বাহুল্য, তাঁর দেখা সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হবার পথে অনেকটা পথই প্রায় অতিক্রম করে ফেলেছে। প্রযুক্তি দুনিয়ায় হইচই ফেলে দেয়া এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব টাইমস ম্যাগাজিনের বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা প্রথম স্থান দখল করে রাখেন। প্রযুক্তি দুনিয়ার এই স্মরণীয় দিকপাল কম্পিউটার, তথা প্রযুক্তিজগতকেই নিয়ে গিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়!
শেষ করছি মার্ক জাকারবার্গের গল্প দিয়ে। হার্ভার্ডের ডরমিটরি রুমে তৈরি করা সেই সাইটটি আজ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল ওয়েবসাইট। স্বপ্নকে সত্যি করতে ‘জিনিয়াসদের সূতিকাগার’-খ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায় জানিয়েছিলেন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ এই বিলিওনিয়ার। তার স্বপ্ন এবং প্রযুক্তি নিয়ে একটি ছোট্ট তথ্য দেই, ফেসবুকে প্রতি সেকেন্ডে ৮টি একাউন্ট নতুন করে খোলা হচ্ছে। তার মানে, আমার লেখা বুক রিভিউটি পড়তে যদি আপনার ৫ মিনিট বা ৩০০ সেকেন্ড সময় লাগে, তাহলে এই ক্ষুদ্র সময়েই ফেসবুকে নতুন আরও প্রায় ২৪০০ একাউন্ট যোগ হয়েছে । অবাক করা সব তথ্য, তাই না? এরকম আরও অবাক করা তথ্যের জন্য পড়তে হবে এই অনুপ্রেরণাদায়ী বইটি।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
দ্বিমিক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বই হাতে নিলেই প্রযুক্তির প্রতি একটি টান অনুভূত হয়; সেই সাথে নতুন কিছু জানার একটি উত্তেজনা তো আছেই। বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলাম, আর প্রযুক্তিজগতের কাণ্ডারিদের কাণ্ড সম্পর্কে জানছিলাম । জানা-অজানা নানা আবিষ্কারের কাহিনী পড়তে পড়তে কখন যে বইয়ের মাঝে ডুবে গিয়েছি, খেয়ালই করিনি। একটার পর একটা গল্প পড়েছি, আর বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। আমাদের আজকের যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, তা বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই বর্তমান অবস্থায় এসেছে। বইটির লেখা এতটাই সাবলীল হয়েছে যে, পড়তে পড়তে একবারের জন্যও মনে হয়নি, আমি বাইরে কোথাও আছি। বরঞ্চ, হারিয়ে গিয়েছি প্রযুক্তিবিদদের সাথে, তাদের গবেষণার রাজ্যে।
নিরন্তর শুভ কামনা তামান্না নিশাত রিনি’র জন্য। ভবিষ্যৎয়ে এরকম আরও অনেক লেখা তিনি আমাদের উপহার দেবেন, সে প্রত্যাশাই রইল। কিছু প্রিন্টিং ভ্রান্তি আছে, বিরাম চিহ্নের যথাযথ ব্যবহার হয়নি বেশ কয়েক জায়গায়। পরবর্তী মুদ্রণে সংশোধন করা হবে বলে আশা করি। যারা এখনো পড়েননি, পড়ে ফেলুন। আশা করি, নিরাশ হবেন না।
স্বপ্ন ছড়িয়ে যাক, স্বপ্ন সত্যি হোক। পৃথিবী পরিণত হোক এক স্বপ্নের রাজ্যে।
বইয়ের নাম: কৃতিকথন || লেখক: তামান্না নিশাত রিনি
প্রকাশক: দ্বিমিক