১৮৯৩ সালে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল একটি খুন করেছিলেন। কলমের কয়েকটি আঁচড়ে তিনি শেষ করে দিয়েছিলেন একটি মানুষের জীবন। সেই মানুষটির নাম শার্লক হোমস, সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র।
সেই খুনের আখ্যানই আজ তুলে ধরব আপনাদের সামনে। তবে দাঁড়ান, তাড়াহুড়োর কোনো দরকার নেই। বরং গোড়া থেকে সবটা শুরু করা যাক। ফিরে যাওয়া যাক ১৮৮৭ সালে, যে বছর ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের আঙ্গিনায় আত্মপ্রকাশ করেছিল শার্লক হোমস।
শার্লককে নিয়ে লেখা সেই প্রথম উপন্যাসটি থেকে অবশ্য খুব বেশি আয় হয়নি কোনান ডয়েলের। স্রেফ ২৫ পাউন্ড ঢুকেছিল তার পকেটে। ছিল না কোনো রয়্যালটির বন্দোবস্তও। তবে পাঠকরা মোটামুটি পছন্দ করেছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণশক্তি সম্পন্ন এই নতুন গোয়েন্দাকে। একটু আধটু প্রশংসাবাণীও জুটেছিল কোনান ডয়েলের কপালে। তাই তিনি আরো একটি উপন্যাস লিখে ফেলেন শার্লককে নিয়ে। সেটিও পাঠকসমাজের একাংশ সাদরে গ্রহণ করলে, সাহস করে দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে শার্লককে নিয়ে একের পর এক ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন তিনি।
তখন কোনান ডয়েল ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি, এই শার্লকই একদিন এমন মাত্রার জনপ্রিয়তা অর্জন করবে যে, সেজন্য কপাল চাপড়াতে হবে খোদ এর স্রষ্টাকে।
আসলে ঘটনা হলো, কোনান ডয়েল নিজেকে একজন ঐতিহাসিক উপন্যাসিক হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করতেন। গোয়েন্দা উপন্যাস বা গল্প লিখলেও, এই ঘরানার লেখক পরিচয়ে চিরকালের জন্য আটকা পড়বেন, এমন মনোবাসনা কস্মিনকালেও ছিল না তার।
অথচ একপর্যায়ে কোনান ডয়েল পরম বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলেন, নিজের লক্ষ্য থেকে ক্রমশ বিচ্যুতি ঘটছে তার। যা তিনি লিখতে চান, তা লেখা হয়ে উঠছে না। কিংবা লিখলেও সেগুলোকে কেউ তেমন একটা পুঁছছে না। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ওই হতচ্ছাড়া শার্লক। প্রকাশকও তার কলম থেকে শার্লক বিষয়ক গল্পই চান। আর তাদের চাহিদা পূরণ করতে তাকেও বাধ্য হয়ে শার্লক বিষয়ক গল্পই লিখতে হয় বারবার।
কোনান ডয়েলের উপলব্ধি ঘটল, শার্লকের কারণে সঠিকভাবে তিনি তার প্রতিভা ও সৃজনশীলতার বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারছেন না। একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে তাকে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে, যা তার মতো লেখকের জন্য মেনে নেয়া যারপরনাই কষ্টকর একটি ব্যাপার। তাই তিনি অনেক ভেবেচিন্তে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন: আর লিখবেন না শার্লকাখ্যান। তবে সরাসরি ‘না’ বলার বদলে, একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বিষয়টিকে সামলাবেন।
পরেরবার দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের সম্পাদক তার কাছে শার্লক হোমসের নতুন গোয়েন্দা কাহিনী চাইলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, গল্পপ্রতি ৫০ পাউন্ড করে চাই তার। তিনি ভেবেছিলেন, তার এই দাবি কিছুতেই মানা হবে না। কিন্তু কী আশ্চর্য, দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন তার এই দাবি মানল তো বটেই, পাশাপাশি তার সাথে চুক্তি করে ফেলল ছয়-ছয়টি নতুন গল্পের!
ওই ছয়টি নতুন গল্প লেখা কোনান ডয়েলের জন্য নেহাত সহজ কাজ ছিল না। ভেবে দেখুন, আপনি যে কাজটি করতে একদমই পছন্দ করেন না, সেই কাজটিই যদি আপনাকে একবার নয়, দুবার নয়, পরপর ছয়বার করতে হয়, তা কীরকম স্নায়ুবিধ্বংসী হয়ে উঠবে আপনার জন্য। কোনান ডয়েলের বেলায়ও ঠিক তেমনটিই ঘটল। রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। মাকে লেখা চিঠিতে বললেন, “এই হোমস আমার মনকে অন্য সব শ্রেয়তর জিনিস থেকে ফিরিয়ে আনছে।”
এই ছয়টি গল্পের চুক্তি শেষ হওয়ার পর আর শার্লক হোমস না লেখাটাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল কোনান ডয়েলের জন্য। কিন্তু এবারও তিনি নতুন চাল চাললেন। দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনকে বললেন, তিনি লিখবেন বটে, তবে পরের বারোটি গল্পের জন্য তাকে এক হাজার পাউন্ড দিতে হবে।
ফলাফল: এবারও এক বাক্যে রাজি দ্য স্ট্র্যান্ড।
আসলে ততদিনে শার্লক হোমসের কাহিনী হয়ে উঠেছে ম্যাগাজিনটির জন্য সোনার ডিম। আর কোনান ডয়েল সেই সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তার পেছনে অর্থ ব্যয়ে তারা কীভাবে কিপটেমি করে!
এদিকে মন যতই বিদ্রোহ করুক, অর্থের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণকে কোনান ডয়েলই বা কী করে অগ্রাহ্য করেন! খেটেখুটে অন্য লেখা লিখে সামান্য কিছু অর্থোপার্জনের চেয়ে শার্লককে নিয়ে এক ডজন গল্পে হাজার পাউন্ড পেয়ে যাওয়া তো একজন লেখকের জন্য লটারি জেতার শামিল। তাই তিনি লিখতে শুরু করলেন শার্লককে নিয়ে নতুন বারোটি গল্প।
“তবে এ-ই শেষ, আর না”—দৃঢ়সংকল্প কোনান ডয়েল। এবং কেউ যেন পুনরায় তাকে শার্লক-কাহিনী লেখার জন্য পীড়াপীড়ি করতে না পারে, সেই বন্দোবস্ত করারও প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন তিনি। খুন করবেন তিনি শার্লককে। হ্যাঁ, একদম সরিয়ে দেবেন শার্লককে এই পৃথিবী থেকে, যাতে আর সে এসে তার রাতের ঘুম হারাম করতে না পারে।
মাকে লেখা এক চিঠিতে নিজের উদ্দেশ্যের কথা জানালেন তিনি, “আমি ঠিক করে ফেলেছি, খুন করব ওকে। চিরতরে শেষ করে দেব ওর চিহ্ন।”
এই চিঠি পেয়ে আঁতকে উঠলেন তার কোনান ডয়েলের মা-ও। ফিরতি চিঠিতে তিনি লিখলেন, “তুমি এটা করবে না! এটা তুমি করতে পারো না! অবশ্যই এটা করবে না!”
কিন্তু কোনান ডয়েল নিজ লক্ষ্যে রইলেন অবিচল।
“It is with a heavy heart that I take up my pen to write these the last words in which I shall ever record the singular gifts by which my friend Mr. Sherlock Holmes was distinguished.”
(“খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আজ আমি কলম ধরছি শেষবারের মতো আমার অনন্যসাধারণ গুণাবলিতে বিভূষিত বন্ধু শার্লক হোমসের কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য।”)
লম্বা এই বাক্যটির মাধ্যমেই ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ নামক চুক্তির দ্বাদশ ও সর্বশেষ গল্পে শার্লকের মৃত্যুসংবাদ লিখতে শুরু করলেন তিনি। নির্মাণ করলেন শার্লকের সবচেয়ে বড় শত্রু, প্রফেসর মরিয়ার্টির চরিত্রটি। মরিয়ার্টিকে দিয়েই রাইকেনবাক জলপ্রপাত থেকে শার্লককে ফেলে দিলেন নিচে। মৃত্যু হলো দুজনেরই।
শার্লককে খুন করে গভীর আত্মসুখে ছেয়ে গেল কোনান ডয়েলের মন। কতই বা আর তার বয়স তখন। সবে তো ৩৪। ইতোমধ্যেই সুলেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন, এবং নিজের সবচেয়ে বড় শত্রুটিকেও এবার শেষ করে দিলেন। “আর আমার স্যার ওয়াল্টার স্কট হওয়া কে আটকায়!” মনে মনে ভাবলেন তিনি। জানিয়ে রাখা ভালো, স্কট ছিলেন একজন ঐতিহাসিক উপন্যাসিক, ঠিক যেমনটি হতে চেয়েছিলেন কোনান ডয়েলও।
কিন্তু কোনান ডয়েল ভুলে গিয়েছিলেন, মানুষ যা চায়, সবসময় বাস্তবে তা হয় না। তিনি চাইলেন, আর অমনি শার্লকের সমস্ত অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল, তা যে কোনোভাবেই সম্ভব না। পাঠকের মনে শার্লক অমর। তাই তারা ছাপার অক্ষরে শার্লকের মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নিল না। ফেটে পড়ল তীব্র রোষে।
পাঠকের ক্রোধানলে জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে লাগলেন কোনান ডয়েল। দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকেও ক্রমাগত চাপ আসতে লাগল। কারণ শার্লকের মৃত্যুর পর যে তাদের সাবস্ক্রিপশন তলানিতে এসে ঠেকেছে। তবু বহুদিন লড়ে গেলেন তিনি। আশায় বুক বেঁধে রইলেন, একদিন না একদিন ঠিক স্তিমিত হয়ে আসবে সব বিক্ষোভ। পাঠক মেনে নেবে, শার্লক আর নেই। ইতি ঘটবে শার্লককে নিয়ে যাবতীয় উন্মাদনা।
কিন্তু একপর্যায়ে কোনান ডয়েলের বোধোদয় হলো। তিনি এমন এক চরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, যা তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল। কে বড়, কোনান ডয়েল না শার্লক, সে প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন, নিজের কল্পনায় গড়া চরিত্রের সাথে ডুয়েল লড়ে হেরে গেছেন তিনি। পালাবার আর পথ নেই। আত্মসমর্পণ করতেই হবে।
আট বছর বাদে তাই, ১৯০১ সালে, শার্লককে নিয়ে নতুন গল্প লিখলেন কোনান ডয়েল। ‘দ্য হাউন্ড অভ দ্য বাস্কারভিলস’ নামের সেই গল্পে বর্ণিত হলো শার্লকের মৃত্যু-পূর্ববর্তী সময়কালের কাহিনী। এবং ১৯০৩ সালে, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অভ দি এম্পটি হাউজ’-এর মাধ্যমে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলেন তিনি। পুনরুত্থান ঘটালেন শার্লকের। গোটা বিষয়টিকে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ করে তোলার চেষ্টাও করলেন তিনি। ব্যাখ্যা দিলেন, রাইকেনবাক থেকে সেবার শুধু প্রফেসর মরিয়ার্টিরই মৃত্যু হয়েছিল। শার্লক তো শুধুই মৃত্যুর ভান করেছিল।
এই অতিমাত্রার অনুমেয় ও সস্তামানের ব্যাখ্যাকেও পাঠকসমাজ দু’হাত মেলে আলিঙ্গন করল। শার্লকের প্রতি তাদের ভালোবাসা যে সকল যুক্তি-তর্কের উর্ধ্বে। ফলে শার্লকের কাছে আরো একবার হার মানতে বাধ্য হলেন কোনান ডয়েল। একইভাবে বৃথা গিয়েছিল তার লেখা শেষ গল্পে শার্লককে অবসর নেয়ানোর প্রচেষ্টাও।
আজ এতদিন বাদেও আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব, শার্লক হোমস আসলেই হারিয়ে দিয়েছে কোনান ডয়েলকে। বিশ্বব্যাপী শার্লক হোমস নামটি যতজনের পরিচিত, কোনান ডয়েল নামটি সম্ভবত তার অর্ধেকেরও পরিচিত নয়। সৃষ্টি যে কখনো কখনো স্রষ্টার চেয়েও উপরে উঠে যেতে পারে, তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এটি।
আজ আর শার্লক হোমস কোনান ডয়েলের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটি এখন পরিণত হয়েছে একটি পাবলিক ডোমেইনে। অর্থাৎ যার যা খুশি করতে পারবে শার্লক হোমস চরিত্রটিকে নিয়ে। বই, ভিডিও গেমস, চলচ্চিত্র, কমিকস, অ্যাকশন ফিগার, টিভি-ওয়েব সিরিজ- কোনোকিছুতেই নেই কোনো বাধা।