ধরুন, আপনার সাথে কারো অনেক বছর ধরেই মন দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক আছে। হঠাৎ করে যেকোনো কারণেই হোক, সেই সম্পর্কটি ভেঙে গেল। স্বাভাবিকভাবেই আপনি এই ব্যাপারটি সহজে মেনে নিতে পারবেন না। আপনার কাছে মনে হবে, আপনাদের দুজনের যে কারো ভুলের কারণে সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায়নি। আপনার মনের ভেতর এই নিয়ে ক্রোধ বা হতাশা সৃষ্টি হবে। ভুল যারই হোক, একটা সময় পর সে দায় নিজের কাঁধে নিয়ে আপনি সম্পর্কটা হয়তো ঠিক করার চেষ্টা করবেন। সে চেষ্টা বিফলে আপনার মন বিষাদে ভরে যাবে, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই বোধহয় ম্লান হয়ে যাবে। এতকিছুর পরও আপনি একদিন সব মেনে নিতে শিখে যাবেন। এটাই বোধহয় আমাদের জীবনের গল্প।
ড. এলিজাবেথ কুবলার রস। ১৯২৬ সালে সুইজারল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই সুইস-আমেরিকান মনোচিকিৎসক ছোটবেলাতেই স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু বাবা চেয়েছিলেন, মেয়ে তার ব্যবসায় সহযোগিতা করুক। শেষ পর্যন্ত বাবার অবাধ্য হয়ে ১৬ বছর বয়সেই ঘর ছাড়েন রস। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বাসা ছেড়ে এসে কুবলার রস পোল্যান্ডে যুদ্ধকালীন একটি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে এসে তার স্বপ্নপূরণের পথচলা শুরু হয়। এ সময় তিনি মেডিকেল শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালে তিনি মেডিকেল ডিগ্রী গ্রহণ করেন।
পরের বছর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। তখন তিনি বেশ বিরক্তির সাথেই লক্ষ্য করেন, চিকিৎসা প্রদানকারী সম্প্রদায় অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স বা মেডিকেল কর্মীরা মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের বিষয়টি মেনে নিতে সহায়তা না করে উল্টো ব্যাপারটিতে একধরনের অনীহা প্রকাশ করছে এবং সেসব রোগীকে যথাযথ চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে না। ১৯৬৫ সালে কলোরাডো মেডিকেল স্কুলে মনোবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় একদল ধর্মতত্ত্বের শিক্ষার্থী তার সান্নিধ্যে এসেছিল, তিনি তাদের মৃত্যু বিষয়ক নানা তত্ত্ব নিয়ে পড়াতেন।
এর অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর সাক্ষাৎকার নিতে হয়। রোগীদের এসব সাক্ষাৎকার থেকে কুবলার রস বেশিরভাগ রোগীর মাঝে বেশ কিছু ব্যাপারে সাদৃশ্য লক্ষ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্যাপারগুলোকে পাঁচটি স্টেজ বা পর্যায়ে ভাগ করেন; লেখেন ‘অন ডেথ অ্যান্ড ডায়িং’ নামে একটি বই (১৯৬৯)।
কী সেই পরীক্ষণীয় বিষয় আর কোন ধাপগুলোর কথাই বা তিনি বলেছিলেন? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।
১. অস্বীকৃতি (Denial)
যা হবে, তা আপনি মোটেও মেনে নিতে চাইবেন না। এটা অবাস্তব, এটা হতেই পারে না। কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। যা হয়েছে তা মিথ্যা। এই স্বীকার না করার প্রবণতাই ঘিরে ধরবে আপনাকে। অস্বীকৃতি এমন এক পর্যায়, যা প্রাথমিকভাবে আপনাকে ক্ষতি থেকে বাঁচতে সহায়তা করতে পারে। আপনি ভাবতে পারেন, জীবনের কোনো অর্থ নেই এবং এটি হয়তো খুব বেশি অপ্রতিরোধ্য।
ধরুন, যদি আপনার কোনো মারাত্মক রোগ ধরা পড়ে, তবে আপনি প্রথমেই ভেবে নেন যে খবরটি তো ভুলও হতে পারে। পরীক্ষায় কোথাও কোনো ভুল হয়েছে– তারা আপনার স্যাম্পলের সাথে অন্য কারোটা গুলিয়ে ফেলেছে। আপনি যদি প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর পেয়ে থাকেন, তবে সম্ভবত আপনি কোনো মিথ্যা আশায় আটকে গেছেন যে, তারা ভুল ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে। অস্বীকারের পর্যায়ে আপনি ‘প্রকৃত বাস্তবতা’য় বাস করছেন না, বরং আপনি একটি ‘পছন্দনীয় বাস্তবতা’য় বাস করছেন।
মজার বিষয় হলো, এই অস্বীকার এবং আচমমকা আঘাত আপনাকে শোকের ব্যাপারটি মোকাবেলা করতে এবং টিকে থাকতে সহায়তা করে। অস্বীকৃতি আপনার দুঃখের অনুভূতিগুলোকে প্রশ্রয় দেয়। পুরোপুরি শোকের সাথে অভিভূত হওয়ার পরিবর্তে আমরা একে অস্বীকার করি, এটি গ্রহণ করি না এবং একসময় আমাদের উপর এর সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তৃত করে। একে আপনার দেহের সহজাত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে ভাবলে বিষয়টি সহজ হয়ে ধরা দেবে। অস্বীকার এবং আঘাতের বিষয়টি যখন বিবর্ণ হতে শুরু করে, তখন নিরাময় প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২. ক্রোধ (Anger)
যখন অস্বীকার করাটা আর সম্ভব হয়ে উঠছে না, তখন আপনি রেগে যাবেন।
আমি কেন? কেন আমার সাথে এটা হলো? সব আমার সাথেই কেন হবে? এটা কোনোভাবেই সঠিক বিচার নয়।
গবেষক এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একমত যে, এই রাগী ভাবটি দুঃখের প্রয়োজনীয় পর্যায় এবং একসময় আপনাকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। ক্রোধ অনুভব করা তখন আসলেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আপনার ক্রোধের অনুভূতি দমন করা স্বাস্থ্যকর নয়, এটি একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া, এবং সম্ভবত, তর্কসাপেক্ষে, প্রয়োজনীয়ও। প্রতিদিনের জীবনে, আমাদের সাধারণ পরিস্থিতি এবং অন্যের প্রতি আমাদের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়।
আপনি যখন কোনো শোকের ব্যাপার অনুভব করেন, তখন আপনি বাস্তবতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবেন যে, আপনার আর কোনো ভিত্তি নেই। আপনার জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে এবং আঁকড়ে ধরে বাঁচার মতো কিছু নেই। কোনোকিছুর বা কারও প্রতি ক্রোধের দিকনির্দেশটি হলো- এটি আপনাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে পারে, আবার অন্য মানুষের সাথে যুক্তও করতে পারে।
৩. রফাদফা করার চেষ্টা (Bargaining)
এই পর্যায়ে আপনি বুঝবেন যে রেগে আর কোনো লাভ নেই। কোনো রকমে এটাকে বদলানো যায় কি না দেখবেন। সেটি হতে পারে কাউকে বলে-কয়ে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে।
এ পর্যায়ে এসে এভাবে রফাদফার চেষ্টা চলে, যদিও এটি মিথ্যা আশা। এবং সে সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত পরে ক’জনই বা মেনে চলে, সেই প্রশ্ন না হয় তোলা থাকুক। আপনি নিজেকে মিথ্যাভাবে বিশ্বাস করাতে পারেন যে, আপনি একধরনের আলোচনার মাধ্যমে দুঃখ এড়াতে পারবেন। আপনি মরিয়া হয়ে থাকেন জীবনের সুখের দিনগুলো ফেরাতে। অপরাধবোধ দর কষাকষির একটি সহজাত বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন।
৪. বিষণ্নতা (Depression)
আপনার সকল চেষ্টাই যখন বৃথা যাবে, তখন আপনি বিষণ্ন হয়ে পড়বেন। “আমার সব শেষ, আর বেঁচে থেকে কী লাভ? সব তো খুইয়েছি, আর এগিয়ে কী হবে?”- এমন ভাবনা মনে উঁকি দেবে।
হতাশা একটি সাধারণভাবে মেনে নেওয়া শোক, বেশিরভাগ লোক হতাশাকে ‘তাৎক্ষণিক’ আবেগের সাথে মিলিয়ে ফেলে। এটি বাস্তবে বেঁচে থাকাকালীন আমাদের শূন্যতা অনুভব করায় এবং আমরা ভাবি যে, পরিস্থিতি আর আমাদের হাতে নেই, হাজার চাইলে বদলানো যাবে না কিছু। এ পর্যায়ে আপনি জীবন থেকে সরে আসতে পারেন, অসাড় বোধ করতে পারেন এবং দিনের পর দিন হয়তো বিছানা থেকেই উঠতে চাইবেন না। আপনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য পৃথিবীকে বড় অদ্ভুত-অচেনা মনে হবে। আপনি অন্যের আশেপাশে থাকতে চাইবেন না, কথা বলার মতো বোধ করবেন না এবং হতাশ অনুভব করবেন। এমনকি আপনার মাথায় নিয়মিত আত্মঘাতী চিন্তা-ভাবনার অস্তিত্বও অনুভব করতে পারেন।
৫. মেনে নেওয়া (Acceptance)
শেষমেশ আপনি সব মেনে নেবেন। নিজেকে বোঝাবেন, “আমি ঠিক আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি লড়াই চালিয়ে যাব। কোনোকিছুই তো আর অসম্ভব না।” কুবলার রস দ্বারা চিহ্নিত শোকের শেষ পর্যায়টি হচ্ছে গ্রহণযোগ্যতা। এ পর্যায়ে আপনার অনুভূতিগুলো স্থিতিশীল হতে শুরু করতে পারে। আপনি বাস্তবতায় পুনরায় প্রবেশ করবেন। আপনি ‘নতুন’ বাস্তবতাটি নিয়ে এসেছেন যে, এবং আপনি নিদারুণ সত্যটি মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন। এটি খুব ভালো কিছু নয়, তবে এর মাধ্যমে আপনি বেঁচে থাকতে পারেন।
ভালো দিন ও খারাপ দিন পালাক্রমে আসে-যায়। এ পর্যায়ে চলে আসার অর্থ এই নয় যে, আপনার আর কখনও খারাপ দিন আসবে না। খারাপ দিন আসবেই; তবে আপনি একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এ পর্যায়ে, আপনি আপনার আকাশে জমে থাকা মেঘকে কাটিয়ে নতুন আলো দেখতে পারেন। আপনি আপনার জীবনের অবশিষ্ট মানুষগুলোর সাথে জড়িয়ে পড়া শুরু করতে পারেন এবং সময় বাড়ার সাথে সাথে নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন। আপনি বুঝতে পারেন, কোনো প্রিয়জনকে কখনোই প্রতিস্থাপন করা যাবে না, তবে আপনি এ পর্যায়ের মধ্য খাপ খাইয়ে নেয়ার নতুন বাস্তবতায় নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারেন।
কুবলার রস এই পাঁচটি পর্যায়ের একত্রে নাম দিয়েছেন ‘কুবলার-রস মডেল’। যেকোনো মৃত্যু, ব্যক্তিগত ক্ষতি, প্রিয়জনের মৃত্যু, দুঃখ অথবা সম্পর্কের ইতি কিংবা ট্র্যাজেডির এরকম পাঁচটি পর্যায় থাকে। কুবলার রস বলেছেন, সবাই একই সময়ে একই ধরনের অগ্রগতি অনুসরণ করে না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ পর্যায়গুলোর অস্তিত্ব প্রমাণিত। এ পর্যায়গুলোর চিহ্নিতকরণ ছিল সেই সময়ে একটি বৈপ্লবিক ধারণা, এবং তখন থেকেই ব্যাপকভাবে এটি গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে।
কুবলার রসের মডেলটা বুঝলে যেকোনো দুঃখ মেনে নেয়া সহজ। আপনি নিজেই বুঝবেন যে একটু ধৈর্য ধরলে আপনি শেষের পর্যায়ে চলে যাবেন। মেনে নিতে পারবেন। এই মডেল মানলে কমে আসতে পারে আত্মহত্যার প্রবণতাও।
মৃত্যু নিয়ে দিনরাত গবেষণা করা এই ব্যক্তি ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। মৃত্যু তার কাছে বেঁচে থাকার মতোই স্বাভাবিক ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন,
“আপনি যদি নিজের জীবনের প্রতিটি দিন সঠিকভাবে বেঁচে থাকেন তবে আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”