গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। ক্রিকেটের প্রচলিত একটি পরিভাষা। কালে কালে ক্রিকেট সাক্ষী করেছে অসংখ্য মাহেন্দ্রক্ষণ মুহূর্তের। সেই ক্রিকেটের পরিসংখ্যান ঘাঁটতে গেলে প্রতি মুহূর্তে আপনি চমকপ্রদ তথ্যের সম্মুখীন হবেন। মাঝে মাঝে আপনার চক্ষু চড়কগাছ হবার উপক্রম হবে।
ক্রিকেটে আমরা চাক্ষুষ হয়েছি দ্বি-শতকের, ত্রি-শতকের, কোয়াড্রপল শতক বা একই ইনিংসে দুই ব্যাটসম্যানের দ্বি-শতক, কিংবা আরেকটু এগিয়ে গেলে একই টেস্টে একই ব্যাটসম্যানের দ্বি-শতক ও শতকের। কিন্তু একই টেস্টে কি একই ব্যাটসম্যানের দুটো দ্বি-শতকের সাক্ষী হয়েছি? জানতে হলে তথ্য নিয়ে আগাতে হবে। পাঠক হিসেবে আপনাকেও তথ্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে ইতিহাসের সাগরে ডুব দিতে হবে। কথা না বাড়িয়ে চলুন আসল কাজে আগানো যাক।
আর্থার এডওয়ার্ড ফাগ। ক্রিকেটের পাড় ভক্ত হলে নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? না শুনলেও সমস্যা নেই। আজকের আয়োজনে থাকছেন উনিই।
১৯১৫ সালের ১৮ই জুন কেন্টের চারহামে জন্ম আর্থারের। খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে এবং কাউন্টি ক্লাব কেন্টের হয়ে। মাত্র সতের বছর বয়সে কেন্টের হয়ে আর্থারের কাউন্টি অভিষেক। তার চার বছর পর মাত্র ২১ বছর বয়সে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক, সালটা ১৯৩৬।
যে ঘটনার জন্য পাঠকের এতটুকু সময়ক্ষেপণ, ক্রিকেট বিশ্বকে আর্থার সে ঘটনার সাক্ষী করেন ১৯৩৮ সালে। এসেক্সের বিপক্ষে একই টেস্টের দুই ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করে আর্থার জন্ম দেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নতুন বিশ্ব রেকর্ডের। যে রেকর্ডের সাথে পরিচিত করা এবং পরিচিত হওয়া দুটোর প্রথম এই আর্থার এডওয়ার্ড। সে শৃঙ্গে আর মাত্র একটি পদচিহ্ন পড়েছে, যেটার জন্য সময় লেগেছে পাক্কা ৮০ বছর। ততদিনে ক্রিকেট কত শত-লক্ষ-কোটি পরিসংখ্যান আর রেকর্ডের সাথে সাক্ষাৎ করেছে যেটি এই মুহূর্তে অলীক কল্পনা! আলোচনার বিষয়বস্তুে যেহেতু সে ঘটনাও রয়েছে, আসবো সেখানেও।
আবার ফিরে আসা যাক আর্থারের রেকর্ডে। ১২ জুলাই ১৯৩৮, কেন্টের ম্যাচসূচী এসেক্সের বিপক্ষে। এ ম্যাচের পূর্বে ওই সিজনে ৪ সেঞ্চুরি করে আর্থার এডওয়ার্ড ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন কেন্ট অধিনায়ক জেরি চক (Gerry Chalk)। দ্রুতই ২৮ রানের মধ্যে ২ উইকেট হারিয়ে ফেলে কেন্ট। তারপর শুরু হয় আর্থার শো। লাঞ্চের আগেই মাত্র ৯৪ মিনিটে সেঞ্চুরি সম্পূর্ণ করেন আর্থার। দ্রুত উইকেট পড়ার কারণে কিছুটা ধীরগতিতে খেললেও ১৯৪ মিনিটে ১৫০ পূর্ণ করেন আর্থার।
প্রথম দিনে প্রথম ইনিংসে কেন্টের স্কোরবোর্ডে ৪২৯ রান। যার সৌজন্যে স্কোরবোর্ডের এই সতেজতা তিনি আর কেউ নন, ওই আর্থার এডওয়ার্ড। ডাবলের পথে চতুর্থ পঞ্চাশ করতে সময় নেন আর মাত্র ৪০ মিনিট। টেইলরের বলে লেগ-বিফোরের ফাঁদ পড়ার আগে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় ৫ ঘন্টারও কম সময়ে, অর্থাৎ ২৯৫ মিনিট উইকেটে থেকে আর্থার খেলেন ২৪৪ রানের ইনিংস, যা সাজানো ছিল ৩১টি চারের সাহায্য।
দ্বিতীয় দিনে ব্যাট করতে নামে এসেক্স। লোয়ার-অর্ডার ব্যাটসম্যান রে স্মিথকে সাথে নিয়ে টম পেয়ার্সের দৃঢ়তায় এসেক্সের স্কোরবোর্ডে জমা হয় ৩৫০ রান। টম পেয়ার্সের ১৮৫ মিনিট ক্রিজে থেকে ১৩৭ রানের অপরাজিত ইনিংসে ছিল ১৬টি চারের মার। কেন্ট লিড পায় ৭৯ রানের। ওদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস ছিল, তাই দ্বিতীয় ইনিংসে কেন্ট চাচ্ছিল দ্রুত রান করে ইনিংস ঘোষণা করতে।
দ্বিতীয় ইনিংসে আবারও আক্রমণাত্মক ভূমিকায় হাজির হলেন আর্থার। দ্বিতীয় দিনের শেষ সেশনের খেলা চলছে। প্রথম ইনিংস থেকে আরো ৭ মিনিট কম সময় নিয়ে এবার ৩৫ মিনিটে ফিফটি পূর্ণ করেন আর্থার। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যখন ৭০০০ হাজার রান পূর্ণ করেন, তখন আর্থারের রান ৬৯। পরের পঞ্চাশ করে সেঞ্চুরি পূর্ণ করতে আরো এক মিনিট কম সময় নেন আর্থার। ৮০ মিনিট ক্রিজে থেকে ১০৪ রানে অপরাজিত থেকে দ্বিতীয় দিন শেষ করেন আর্থার। ১৪২ রানে কোনো উইকেট না হারিয়ে কেন্ট দিন শেষ করে ২২১ রানের লিড নিয়ে।
১৫ জুলাই, তৃতীয় দিনের খেলা শুরু হলো। আর্থার এবং তার ওপেনিং সঙ্গী দু’জনের রানের ফোয়ারাও ছুটতে লাগলো। যদিও আর্থার ছিলেন বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকায়। দ্রুত রান তোলার নির্দেশনা থাকায় আর্থারও চালিয়ে খেলতে লাগলেন। ইচ্ছেমতো শটের ফুলঝুরি ছুটিয়ে ১৫০ রানের মাইলফলকে পোঁছান। ২৮৩ রানের ওপেনিং জুটি ভাঙ্গে আর্থারের সঙ্গীর ৮২ রানে রান-আউটের মাধ্যমে।
সঙ্গীর বিদায়ে বোলারদের উপর আরো নির্দয় হয়ে উঠেন আর্থার। ২৭ চারের সাহায্য তিন ঘন্টার কম সময় ১৬৫ মিনিটে ডাবলে পোঁছান আর্থার এডওয়ার্ড ফাগ। দ্বিশতকের পথে শেষ ৯৮ রান করেন মাত্র ৯০ মিনিটে লাঞ্চের আগে। এর মাধ্যমে অংশ হয়ে যান ক্রিকেটের বিরল ইতিহাসের। দ্বিতীয় ইনিংসে আর্থার অপরাজিত থাকেন ২০২ রানে। কেন্ট অধিনায়ক ৩১৩/১ উইকেটের সময় ইনিংস ঘোষণা করেন। যদিও বৃষ্টি বাধায় ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ড্র হয়।
ওই সিজনে চ্যাম্পিয়নশিপে ৫৪.৬৯ গড়ে ৯ সেঞ্চুরিসহ মোট ২২৯৭ রান করেন আর্থার এডওয়ার্ড ফাগ। পুরো সিজনে ৫২.২৫ গড়ে করেন ২,৪৫৬ রান। এই পারফরম্যান্স দিয়ে ইংল্যান্ড দলে পুনরায় ডাক পান আর্থার। জাতীয় দলে সেটিই ছিল শেষবার। প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারে ৪৩৫ ম্যাচে ৩৬.০৫ গড়ে ২৭,২৯১ রান করেন আর্থার। ৫৮টি সেঞ্চুরির পিঠে ১২৮ হাফ সেঞ্চুরি। অসুস্থতার কারণে সাকুল্যে তিন বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে খেলেন ৫ ম্যাচ।
একই শৃঙ্গে দ্বিতীয় পদচিহ্নটি পড়ে ২০১৯ সালে। এবার ঘটনার রূপকার শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো পেরেরা। ১৯৯০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কলম্বোর মোরাতুয়া গ্রামে জন্ম অ্যাঞ্জেলো পেরেরার।
৩০ বছর বয়সী পেরেরা শ্রীলঙ্কার হয়ে ছয়টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। তার মধ্যে চারটি ওয়ানডে ও দু’টি টি টোয়েন্টি রয়েছে। যদিও সেই স্মৃতি খুবই খারাপ পেরেরার জন্য। চারটি ওডিআই মিলে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল মাত্র আট রান। টি-টোয়েন্টিতে করেছিলেন মাত্র চার রান।
কলম্বোর বিখ্যাত পি-সারা ওভালে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর সে ম্যাচে ননডেসক্রেপ্টিস ক্রিকেট ক্লাব মুখোমুখি হয়েছিল সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের। ননডেসক্রেপ্টিস ক্রিকেট ক্লাবের অধিনায়ক পেরেরা দুই ইনিংসেই করেন যথাক্রমে ২০১ ও ২৩১ রান। সাদা চোখে পেরেরার জন্য ব্যাপারটা আরো বেশি কঠিন ছিল। কারণ, তিনি ব্যাট করতে এসেছিলেন পাঁচ নম্বরে। প্রথম ইনিংসে মাত্র ২০৩ বলে ২০১ রান করেন তিনি। ২০ চার আর এক ছক্কায় সাজানো ইনিংসের স্ট্রাইকরেট দেখলে যে কারো চোখ কপালে ওঠার কথা! ৯৯ স্ট্রাইকরেটে এই রান করেন পেরেরা।
যার ফলে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের বিরুদ্ধে ৪৪৪ রান তোলে তার দল, যেটি ওই ম্যাচে হওয়া তিন ইনিংসের সর্বনিম্ন দলীয় রান। পাথুম নিসাঙ্কা ৯৫ রানের ইনিংস খেলেন। দু’জনে মিলে জুটিতে ২৬৭ রান করেন। সান্দুন ভিরাক্কোদির ১৮৯ এবং সচিত্রা সেনানায়কের ৮৯ রানে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব করে ৪৮০ রান। লিড পায় ৩৬ রানের।
এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে আরো আগ্রাসী ভূমিকায় ব্যাটিং করেন পেরেরা। যদিও এবার কাজটা আরো কঠিন ছিল পেরেরার জন্য। দল যখন ৪৪ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে, সেই মুহূর্তে উইকেটে আসেন তিনি।
পেরেরা কঠিনেরে ভালোবাসিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৬৮ বলে ২৩১ রান করেন তিনি। ২৩১ রানের ইনিংসটি সাজান ২০টি চার আর ৩টি ছক্কা দিয়ে। প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি মিস করা পাথুম নিসাঙ্কা দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ১৬৫ রান। ননডেসক্রেপ্টিসের স্কোরবোর্ডে ৬ উইকেটে ৫৭৯ রান। চার দিনের ম্যাচ যদিও শেষ পর্যন্ত ড্র হয়।
রেকর্ড বইয়ে নাম লেখানো দুটো ম্যাচের মধ্যে কাকতাল বলতে কোনো কিছু না থাকলেও ছোট্ট একটি মিল, দুটো ম্যাচই ড্র হয়েছিল। ক্রিকেট রেকর্ড ভাঙা-গড়ার খেলা। রেকর্ড হয়, আবার রেকর্ড ভাঙে। তবে কিছু রেকর্ড অনন্তকাল উচ্চারিত হয়ে যায়! দুটো ম্যাচের চারটে ইনিংস রেকর্ড বইয়ের সেরকমই জ্বলজ্বলে অধ্যায় হয়ে উচ্চারিত হবে।