২০২০ সালের শুরুতেই বিশ্ব মুখোমুখি হয়েছে বিপদজনক এক মহামারির। যেখানে বিশ্বের সেরা সব অর্থনীতি আর স্বাস্থ্যসেবা সমৃদ্ধ দেশগুলোও বিপর্যয়ের মুখে, সেখানে আমরা কেবলই নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্য এর ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দায় পরিণত হতে পারে।
দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প হুমকির মুখে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪.২১ শতাংশ আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। আর সেই পোশাক শ্রমিকদের চাকরি জিম্মি করে তাদের বাধ্য করা হয়েছিল কর্মস্থলে আসতে। যেখানে মহামারি থেকে বাঁচার একমাত্র পন্থা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সেখানে তারা বাধ্য হচ্ছে ট্রাকে করে, ফেরিতে করে, এমনকি পায়ে হেঁটে হলেও কাজে যোগ দিতে। শেষ পর্যন্ত সমালোচনার মুখে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বিজেএমইএ গার্মেন্টসগুলো বন্ধ রাখতে অনুরোধ করলেও মালিক পক্ষ খুব বেশি সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সব থেকে বড় রপ্তানি বাজার ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা এই মুহূর্তে অসহায় তাদের জীবন বাঁচাতে, এমন সময় কেউ পোশাক কিনবে না। বড় বড় ব্র্যান্ডের হাজার হাজার শো রুম বন্ধ। ২৬ মার্চ পর্যন্ত ৯৫৯ কারখানার ২৬৭ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়েছে ।
সেন্টার ফর গ্লোবাল ওয়ার্কার্স রাইটের এক রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের ৪৫.৮% সাপ্লাই বলছে, তাদের অর্ডারের মধ্যে পুরোপুরি তৈরি এবং প্রায় তৈরি অর্ডারগুলো বাতিল করা হয়েছে। ৭২.১ % ক্রেতা এমনকি কাঁচামালের টাকা দিতেও অস্বীকার করছে। এরই ফলাফল মালিকদের লসের মাশুল গুনতে হবে শ্রমিকদের। একই রিপোর্টে উঠে এসেছে- প্রায় ১০ লক্ষ শ্রমিক সাময়িক বা পুরোপুরি চাকরি হারাতে হচ্ছে এবং ৯৮.১% মালিক তাদের আংশিক বেতন দিতেও অনীহা দেখাচ্ছে। যার মধ্যে ৭২.৪% শ্রমিক ইতিমধ্যে বেতন ছাড়াই বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে ৫ তারিখে কাজে যোগদানের জন্যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা এসেছিল শ্রমিকরা।
করোনা মহামারির আগে থেকেই দেশের পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি কমছিল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেব মতে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের জুলাই-নভেম্বর ৫ মাসে ১,৭০৭ কোটি ডলার রপ্তানি আয় ছিল। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে মোট রপ্তানি আয় ছিল ১,৫৭৭ কোটি ডলার, যা গেল বছরের চেয়ে ৫ শতাংশ কম। দেশের রপ্তানি বাজারে ক্রমেই ভারত আর ভিয়েতনাম ভাগ বসাচ্ছে- এমনটাই বলেছিলেন বিজেএমই এর চেয়ারম্যান রুবানা হক। বিশেষজ্ঞরা এটি ঠেকাতে অনেক আগে থেকেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমাতে পরামর্শ দিচ্ছিল। এমন অবস্থায় করোনা ভাইরাস বিপদের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সারা বিশ্বই সুনিশ্চিত এক অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপারে। এদিকে সর্বশেষ ২০০৭-০৮ এর দিকের অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি দেশের লাখ লাখ প্রবাসীর ঘাম ঝরানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে। এই রেমিট্যান্সও এখন ঝুঁকির মুখে। মহামারির কারণে অনেক দেশেই এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো বন্ধ। ফেব্রুয়ারি-মার্চ এই দুই মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৩৬ কোটি ডলার।অর্থনৈতিক মন্দা কতদিন স্থায়ী হয় সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে কত দ্রুত বিশ্বের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসবে তার ওপর।
এরই মাঝে বিভিন্ন দেশের জিডিপি কমে গেছে, শিল্পের উৎপাদন প্রায় বন্ধ, পর্যটন শিল্প হুমকিতে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, সারা বিশ্বের দুই কোটি মানুষ বেকার হবে। তার মধ্যে বাংলাদেশের প্রবাসীরাও থাকবে। যারা এতদিন দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে তারা দেশ থেকে কতটুকু সহায়তা পাবে সেটা সময়ই বলে দেবে।
এছাড়াও করোনা পরিস্থিতি শুরু হবার পর থেকেই দেশে প্রচুর প্রবাসী ফিরে এসেছে। এর প্রভাবেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই কমবে। প্রতিবছরই বাজেট ঘাটতি থাকা আমাদের অর্থনীতির চাকা যাদের উপর ভর করে টিকে আছে, সেখানে ধস নামলে এর ফলাফল নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘমেয়াদি হবে। যেভাবে দেশের অভ্যন্তরে সব ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে, তাতে করে দিনমজুরসহ সঞ্চয় নেই এমন মানুষগুলার মাঝে দুর্ভিক্ষ নেমে আসতে পারে। বেসরকারিভাবে ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তা দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
দেশের বিপুল পরিমাণ মানুষের চাকরি যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। যেখানে বিনা কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় সিন্ডিকেটরা, সেখানে এই অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ-ছোঁয়া হলেও অবাক থাকবে না। এখনই চিকিৎসা ব্যবস্থা হুমকির মুখে, মানুষ হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছে, হাসপাতালগুলোও রোগী নিতে ভয় পাচ্ছে, ফলাফল বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হচ্ছে। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বিশ্বজুড়ে মন্দা চলাকালীন সময়ে এগুলা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
ইতিমধ্যে সরকার ৭২,৭৫০ কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত এ তহবিল আশা জাগাচ্ছে মানুষের মনে। তাঁর বক্তব্য বাস্তবায়িত হলে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা সম্ভব হলেও হতে পারে। কিন্তু তিনি মূলত ৩ পর্যায়ে ৪টি প্যাকেজ কার্যক্রমের কথা বলেন, যেগুলোর মধ্যে একটি মূলত ব্যবসায়ীদের ৯ শতাংশ হারে ঋণের বিপরীতে উদ্দীপনা প্যাকেজ প্রণয়ন। যার অর্ধেক সুদ সরকার ভর্তুকি দিবে, কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ প্রদানে কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারা পাবে, কারা পাবে না, ক্ষতিগ্রস্তরা কতটা সহায়তা পাবে এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপও ঘটতে পারে। প্রদেয় ঋণ ঠিকভাবে আদায় হবে কি না সেটি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
দেশে বেকারদের জন্যে এমনিই কোনো ব্যবস্থা নেই। মন্দা চলাকালে বেকার সংখ্যা বাড়লে কী অবস্থা হবে তার জন্যে কোনো পরিকল্পনাও দেখা যায়নি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শহরের ছিন্নমূল মানুষগুলো। আজীবন সবকিছু থেকে বঞ্চিত এরা। এদের অনেকের জীবিকা নির্ভর করে মানুষের দানের ওপর। আসন্ন দুর্ভিক্ষ সবার আগে প্রকট হবে এদের বেলাতেই।
করোনা ঝুঁকিতে এরা সবাই যতটা, তার চাইতে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বেশি। এদের একটা বড় অংশই শিশুশ্রমের সাথে যুক্ত। যারা এই মুহূর্তে না পারছে কাজ করতে, না পাচ্ছে নিরাপদ স্বাস্থ্য সুবিধা।
দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকা শক্তি থাকে অনেকটাই কৃষি-নির্ভর এবং গবাদিপশু পালনের উপর। এই মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গবাদিপশু পালকরা। যাদের অনেকেই কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে পশুপালন করছিল। বিপর্যয়ের মুহূর্তে এরা বিপাকে পড়বে। যারা নিয়মিত গরুর দুধ-মাংস বিক্রি করতো তাদের এখন থেকেই লস গুনতে হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষকদের ফসল তোলার সময় আসন্ন। দেশের অনেক জায়গাতেই শ্রমিকের অভাবে এখনই ধান কাটতে বিপাকে পরেছে কৃষকেরা। তার মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশ খাদ্য সংকটে পড়তে পারে।
সবকিছু কাটিয়ে ওঠা যেখানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর জন্যেই কষ্টসাধ্য, সেখানে পদে পদে অসাধু ব্যবসায়ীদের ভোগবাদী মন-মানসিকতা কাটিয়ে আসন্ন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার খুব বেশি আশা করা যায় না। ততদিনে অন্য দেশের মতো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকা দেশের করোনা সমস্যার পর জনসংখ্যা কত দাঁড়ায় সেটাই এখন ভাববার বিষয়।