আমি সব সময়ই এটা দেখে মজা পাই যে আমার কাজের বড় প্রশংসাগুলো আসে কল্পনার জন্য। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমার লেখালেখির মধ্যে একটি লাইনও নেই, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। সমস্যা হচ্ছে, ক্যারিবীয় বাস্তবতার সঙ্গে বাঁধনহারা কল্পনার মিল রয়েছে
– গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যিনি গাবো নামেও পরিচিত, একজন কলম্বীয় সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রকাশক এবং ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয়ী লেখক। তবে তিনি সাহিত্যে নোবেলের জন্য পরিচিত নন, তার পরিচয় অসমান্য সব সাহিত্য আর ম্যাজিক রিয়েলিজম দিয়েই।
বিগত একশো বছরেরও বেশি সময়ে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন এখন অবধি প্রায় ১১৬ জনের মতো, তবে বিশ্বসাহিত্যে যদি শ্রেষ্ঠ দশজন লেখকের নাম নেয়া হয়, সেখানেও উপরের সারির তালিকায় যে নামটি আলো ছড়াবে সেটি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, এক অসামান্য জাদুকরী লেখক!
১৯৬৭ সালে ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ (One Hundred Years of Solitude) উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরই মূলত বিশ্বসাহিত্য মার্কেজকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। এই উপন্যাসই ম্যাজিক রিয়েলিজমের জীবন্ত উদাহরণ! লেখক নিজের চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যেই লিখে ফেলেন শত শত বছরের নিঃসঙ্গতার কথা! কীভাবে তা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমাদের যেতে হবে মার্কেজের সাহিত্য আর তার ম্যাজিক রিয়েলিজমের কাছে।
তবে শুধু যে ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ উপন্যাসে ম্যাজিক রিয়েলিজম আছে তা নয়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের অধিকাংশ লেখাতেই এর ছোঁয়া পাওয়া যায়। এমনকি তার অনেক ছোটগল্পেও উঠে এসেছে বিষয়টি। আসলে মার্কেজ মানেই ম্যাজিক রিয়েলিজম!
ম্যাজিক রিয়েলিজম
ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে কথা বলার আগে এ বিষয়ে লেখক নিজে কী ভাবতেন তা জেনে নেয়া যাক। মার্কেজ বলতেন, আমাদের জীবন ম্যাজিক রিয়েলিজমের বাইরের কিছু নয়। আমাদের জীবনেও এমন কিছু ঘটে যা আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না, তবে তা অবাস্তব কিছু নয়!
এক সাক্ষাৎকারে মার্কেজ জীবনের জাদু-বাস্তবতার কথা উল্লেখ করেন এভাবে,
একদিন আমি আর আমার স্ত্রী গভীর ঘুমে ছিলাম। এর মধ্যে শুনতে পেলাম কলিংবেলের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে! দ্রুত আমি দরজা খুললাম এবং একজন মানুষ জানালো সে ইলেক্ট্রিক আয়রন মেশিন ঠিক করতে এসেছে! আমার স্ত্রী বেডরুম থেকেই জানালো, আমাদের আয়রন মেশিনে কোনো সমস্যা হয়নি।তারপর আগুন্তক জানতে চাইলো, “এটা কি এপার্টমেন্ট নাম্বার দুই?” আমি তাকে জানালাম, “না, নাম্বার দুই উপরের তলায়।” এর কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী কাপড় আয়রন করতে গিয়ে সুইচ অন করার সাথে সাথেই আয়রনের তারটি শর্ট সার্কিটে পুড়ে গেল!
দেখুন এটাই অন্যরকম কিছু! আমরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে জানার আগেই সে এসেছিল সমস্যাটি ঠিক করতে! আমাদের জীবনে প্রায়ই এমন হয়! যদিও আমার স্ত্রী হয়তো ঘটনাটি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছে।
আসলে ম্যাজিক রিয়েলিজম অর্থাৎ জাদু বাস্তবতার বিষয়টি এমনই। দুটি আলাদা সত্ত্বা জাদু এবং বাস্তবতা! জাদুর সঙ্গে বাস্তবতার ব্যাপক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মার্কেজ দুটো বিষয়কে একসাথে করে এমনভাবে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন যেন দুটো সত্ত্বা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়! এখানেই আসলে মার্কেজের অনন্যতা! আবার অদ্ভুত একটা কিছু লেখা মানেই জাদু-বাস্তবতা নয়, এখানেও আসলে কিছু প্যাটার্ন আছে। জাদু-বাস্তবতার ঘটনা ব্যাখ্যা করা গেলে সেটা আর জাদু-বাস্তবতা থাকে না, তেমনি জাদু-বাস্তবতার কথা শুনে আমাদের মন যদি অবাস্তব বলে নাকচ করে দেয় তখনও সেটা আর জাদু-বাস্তবতা থাকে না! তাই খুব গভীরভাবে ম্যাজিক রিয়েলিজম নির্মাণের পদ্ধতি সম্পর্কে মার্কেজ বলেছিলেন,
আপনাকে যদি আমি বলি, আকাশে হাতি উড়ে বেড়াচ্ছে, আপনি কখনোই বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আপনাকে যদি বলি, আজ সকাল ৯টা নাগাদ আকাশে চারটা হাতিকে উড়তে দেখা গেছে, আপনি খানিকটা হলেও এটা বিশ্বাস করার দিকে এগোবেন!
আসলে ম্যাজিক রিয়েলিজম এভাবেই কাজ করে। আরও একটু বিস্তারিত বললে বলা যায়, ম্যাজিক রিয়েলিজম শুধু একটা ব্যাখ্যাতীত ঘটনার সম্মুখীন করবে না, একেকটা ঘটনার সাথে একেকটা গভীর অনুভবের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেবে!
বর্তমানে ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে অনেক ভুল ধারণাও বিদ্যমান। অলৌকিক ঘটনা অথবা সায়েন্স ফিকশন আর ম্যাজিক রিয়েলিজম পুরোই আলাদা বিষয়! ম্যাজিক রিয়েলিজম আমাদের ব্যাখ্যাতীত কোনো ঘটনার সামনে নিয়ে যাবে ঠিকই, তবে সেটা বিশ্বাস করার ইন্ধন দেবে, সেই সাথে একটি বোধ অনুভবের সাথেও দেখা করার সুযোগ দেবে।
মার্কেজের ম্যাজিক রিয়েলিজমের পাঠ
মূলত মার্কেজের সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম খুঁজতে হয় না, বরং এটা তার সাহিত্যের একটা সহজাত অংশই বলা যায়। যেমন ধরা যাক, ‘সরলা এরেন্দিরা’ গল্পে দেখানো হয় ইউলিসিস কোনো কাচ ছুঁলেই তা অনবরত রং পাল্টাতে থাকে।
এখন এটা তো আর সত্যি সত্যি হয় না। কিন্তু প্রেম সম্বন্ধে এত কথা আগেই বলা হয়ে গেছে যে এই গল্পের ইউলিসিস যে প্রেমে পড়েছে এটা বলবার জন্য মার্কেজের নতুন একটি প্রকাশভঙ্গি উদ্ভাবন করে নিতে হয়েছিল। কাজেই সেই গল্পে মার্কেজ আমাদের দেখান কাচের রং পাল্টে যাচ্ছে আর এমন বাস্তবভাবে দেখানো হয় যে আমরা ভেবে নেই, “আরে, প্রেমে পড়লে এমন হতেই পারে!“
সম্পর্ক-প্রেম-ভালোবাসা কেমন করে জীবনকে ওলটপালট করে দেয় এসব কথা আসলে সাহিত্যে অজস্রবার বলা হয়ে গিয়েছে। তাই একে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন মার্কেজ, একেবারে অদ্ভুত সুন্দরভাবে। তবে একটি স্পষ্ট- বোধ আর অনুভবের সাথে, সেই বোধ অনুভব হিসেব করলে অন্য লেখকদের মতোই প্রেম-ভালবাসা তার এই গল্পেও এসেছে, শুধু বলবার ধরনটা ছিল ভিন্ন আর গভীর!
এবার বলা যাক একেবারে ছোট পরিসরে লেখা অন্যরকম একটি ছোটগল্পের কথা। গল্পটির নাম ‘আলো, সে তো জলের মতো’ (Light is like water)। এই গল্পে দেখা যায় ছোট দুই ভাই আলো দিয়ে ঘর ভর্তি করে সেই আলোয় নৌকা বাইতে শুরু করে! পুরো ঘর আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে এমন অবস্থা হয় যে, ঘরের সব আসবাবপত্র আলোর ঢেউয়ে ভাসতে থাকে। এমনকি সেই সাথে ভাসতে থাকা তারা আর তাদের অনুভব! একসময় ঘর ভর্তি উপচে পড়া আলো বাইরে ছড়িয়ে পরে,সেই আলোয় পুরো শহর চমকিয়ে ওঠে!
গল্পটি এমন অদ্ভুতভাবেই মানুষের জীবনের বোধ তুলে আনে, পড়ার সময় পাঠকমাত্রই গল্পটি বিশ্বাস করবে, চোখের সামনেই দেখতে পাবে আলোর এক অন্যরকম খেলা! আসলে আমাদের জীবনেও কিন্তু আলোর কিছু ম্যাজিক রিয়েলিজম আছে। যেমন: দিনের একেক সময়ের আলো নিয়ে কিন্তু আমাদের অনুভবের পার্থক্য আছে, আবার আলো নিয়ে আমাদের একজনের সাথে অন্যজনের অনুভবেরও পার্থক্য আছে! অনেক সময় এই পার্থক্যগুলো এতই গভীর আর সূক্ষ্ম যে হয়তো স্বাভাবিকভাবে সহজেই ভাষায় প্রকাশ সম্ভব হয় না, আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলাই ম্যাজিক রিয়েলিজমের কাজ!
এবার বলা যাক বিশ্ব সাহিত্যের বিস্ময় ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ (One Hundred Years of Solitude) এর কথা। বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মকে নিয়ে রচিত মহাকাব্যধর্মী উপন্যাসটি ম্যাজিক রিয়েলিজমের এক সফল উদাহরণ।
এই উপন্যাসের ম্যাজিক রিয়েলিজমের কথা বলে আসলে শেষ করা যাবে না। কী নেই আসলে এই গল্পে! যেন সব আছে, জীবনের সব কথা বলা হয়েছে! এই উপন্যাস যেন পুরো আলাদা এক জগত, যে জগতে দিনে-দুপুরে চাদর জড়িয়ে বাতাসে উড়ে যায় সৃষ্টিছাড়া সৌন্দর্যের অধিকারী নারী, যে জগতে পাপের ফলস্বরূপ জন্ম নেয় শূয়রের লেজসহ শিশু, একটানা চার বছর এগারো মাস দুই দিন ধরে অনবরত ধারায় বৃষ্টি পড়ে তছনছ করে দেয় সবকিছু, যে জগতে অনিদ্রা রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে! আবার সেই জগতের মানুষ মহামারিকে মেনে নেয়, ঘুম যেন একটা বেহুদা অভ্যাস যা নিয়ে আর তারা মাথা ঘামাতে চায় না!
ম্যাজিক রিয়েলিজমে ভর করে ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ আসলে আমাদের শোনায় মানুষের উত্থান-পতনের গল্প। মানুষের ভীড়ে মানুষের একলা হয়ে যাওয়ার গল্প, প্রজন্মের পর প্রজন্মের নিঃসঙ্গতার গল্প, সেই সাথে শোনায় মৃত্যু, ক্ষুধা আর যৌনতার গল্প।
আসলে এই উপন্যাসটি এমনই এক উপন্যাস যেখানে মার্কেজ বাস্তব অবাস্তবের সংজ্ঞাকে ওলট-পালট করে দিয়েছেন! শত শত বছরের জীবনের কথাগুলো পাঠকের সামনে এমনভাবে মেলে ধরেন যেন এক জীবনে হাজার বছরের জীবনযাপন পাঠকের চোখে ধরা দেয়!
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ম্যাজিক রিয়েলিজমগুলো এমনই এক সৃষ্টি যেখানে ব্যাখ্যার সুযোগ নেই, তবে বিশ্বাস না করে উপায় থাকবে না! মনে হবে, আরে এমন তো হয়, আমাদের জীবনেও তো হয় এমন!বিশ্বাস-অবিশ্বাস, বাস্তব-অবাস্তব কত উপকরণ তো আমাদের জীবনেই মিশে আছ।
শেষের কথা
আমাদের জীবন আসলে একটা গভীর বিষয়। কখনো কখনো আমরা যতটা গভীর দাবি করি জীবনটা আসলে এর চেয়েও গভীর কিছু! জীবনের গভীরতা ব্যাপকতার কথা শত শত বছর ধরে বলা হয়েছে নানা ভাষায়, নানা ভাবে। এরই এক চমকপ্রদ ভাষা হলো ম্যাজিক রিয়েলিজম, কারণ জীবন তো অদ্ভুতও বটে, আর সেই জীবন নিয়ে অদ্ভুতভাবে বলতে গিয়েই ম্যাজিক রিয়েলিজমের সৃষ্টি, যা পূর্ণতা পেয়েছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের হাতে! ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যাখ্যাতীত হলেও আসলে শুধু সাহিত্যের অংশ নয়, আমাদের জীবনেরও অংশ।