আমাদের প্রত্যেকের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে করোনাভাইরাস। দীর্ঘ সময়ের লকডাউনে এই গৃহবন্দী, মাস্ক আর গ্লাভসের জীবনই যেন নতুন স্বাভাবিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করে অফিস খোলা থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে মার্চ থেকে। এই দীর্ঘ সময়ের বিরতিতে অসুবিধার মুখে পড়েছে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা। অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনা এবং এর কার্যকারিতা নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন। অস্থায়ী নানা পন্থায় বর্তমানে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে পুরো বিশ্বে।
কোভিড-১৯ এর কারণে গত মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শুরুতে এক মাসের জন্য বন্ধ করলেও সেই সময় এখন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায়। আমেরিকাতে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরো একাডেমিক ইয়ার অনলাইনে করার সিদ্ধান্তে পৌছেছে আর অধিকাংশই পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে কিছু প্রধান শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই খোলা রেখেছে।
মার্চের শুরুর দিকে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও এপ্রিল থেকে সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে কানাডাতে। জাপানে করোনার কারণে জরুরি অবস্থা যতদিন রাখা হয়েছে ততদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। করোনার সূত্রপাত যে শহর থেকে হয়েছিল, উহান, সেখানে গত ৬ মে ২০২০ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
অনলাইনে পাঠদান
করোনা মহামারিতে মানুষের হাতে-কলমে শেখার পথ বন্ধ হয়ে গেলেও অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই অনলাইনে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকরা নানা অনলাইন প্লাটফর্মে লাইভ ক্লাসের মাধ্যমে কিংবা প্রি রেকর্ডেড ভিডিও লেকচারের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের ক্লাস প্রচার করছে। ইংল্যান্ডের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে টেলিভিশনে স্কুল পর্যায়ের পাঠ দান অব্যাহত আছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মাঝে ল্যাপটপ বিতরণ, ইন্টারনেটের ব্যবস্থাসহ নানা সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে সেদেশের সরকার।
বিবিসি টেলিভিশন এবং অনলাইনে শিক্ষা বিষয়ক নানা তথ্যমূলক সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘জুম’ অনলাইন প্লাটফর্ম বিপুল পরিসরে ব্যবহৃত হচ্ছে। মিটিং থেকে শুরু করে লাইভ ক্লাস নেওয়া পর্যন্ত সকল কার্যক্রমে জুমের ব্যবহার লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে। মূলত জুমের ইউজার ফ্রেন্ডলি এবং সহজে ব্যবহার করতে পারাই এর মূল কারণ। এতকিছু সত্ত্বেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত অনলাইন কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকার কারণে। বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও অনলাইনভিত্তিক পাঠদান পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
অনলাইনে ক্লাস নেওয়া গেলেও পরীক্ষা কিংবা গ্রেডিং এর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশ এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কুইজ বা মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেনের মাধ্যমে ক্লাস এসেসমেন্ট করছে, কিন্তু এর কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনও সন্দেহ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়গুলোতে মূলত অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা গ্রুপ রিসার্চভিত্তিক পেপার তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যেহেতু অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টিতে স্বচ্ছতার প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আর প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস কিংবা অ্যাসেসমেন্টের বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। এছাড়া মিশরের হেলওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে জুমের ‘ব্রেক-আউট রুম’ রয়েছে, যেখানে ক্লাস করার আগে পূর্বের ক্লাস সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এতে করে শিক্ষার্থীরা প্রতিটি লেকচারে মনোযোগী হয় আর শিক্ষকরাও ক্লাস অ্যাসেসমেন্ট সহজেই করতে পারেন, যদিও এটি স্বল্পমাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে এখন পর্যন্ত।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরীক্ষা সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের দেশেই উচ্চ মাধ্যমিক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। ইউনেস্কোর সার্ভেকৃত ৮৪টি দেশের মধ্যে ৫৮টি দেশ পরীক্ষা পিছিয়েছে বা স্থগিত করেছে, ১১টি দেশ বাতিল করেছে, ২৩টি দেশ বিকল্প পদ্ধতি অবলবন করেছে আর ২২টি দেশ পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এছাড়া প্রায় সকল দেশই এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম এবং ফরেন স্টুডেন্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রাম আপাতত স্থগিত করেছে। এতে অনিশ্চয়তার মাঝে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থী।
ইন্টারনেট সুবিধা এবং সহজলভ্যতা
বর্তমান অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি পরিচালনায় ইন্টারনেট সংযোগ অবশ্যই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আবশ্যক। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ডিজিটালাইজেশানের মাধ্যমে বিশ্বের প্রত্যেক জনগোষ্ঠী এবং প্রতিটি মানুষের মাঝে ইন্টারনেটের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ২০১৮ সালের এক তথ্যমতে, পুরো বিশ্বের মাত্র ৫০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সুবিধার আওতাধীন ছিল ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এর মাঝে আমাদের এই উপমহাদেশের মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সেবার অন্তর্ভুক্ত, আফ্রিকার ২৫ শতাংশ, ল্যাটিন আমেরিকার ৬৬ শতাংশ, নর্থ আমেরিকার ৮৮ শতাংশ, মধ্য এশিয়ার ৮০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সুবিধার আওতাধীন। এছাড়া ইন্টারনেটের গতি একটি বড় অন্তরায় আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য। বিশ্বের অর্ধেক মানুষ যেখানে ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত, সেখানে অনলাইনে পুরো শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বাস্তবসম্মত নয় এখন পর্যন্ত।
এছাড়া দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলগুলোতে ইন্টারনেট সেবার জন্য এখনও প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়, যা নিম্ন আয়ের মানুষের সাধ্যের বাইরে। এই সমস্যাগুলো নিয়ে এখন ভাবনার সময় এসেছে। পুরো পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে সকলের ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা জরুরি।
করোনা পরিস্থিতিতে সংক্রমণ রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা হয়েছে, অপরদিকে এই দীর্ঘ সময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির স্থায়িত্ব বিবেচনায় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু এই সবকিছুর জন্য পুরো বিশ্ব প্রস্তুত ছিল না। বিশ্ব যেখানে ইন্টারনেটের গতির সাথে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে, সেখানে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এই সেবা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষা সকলের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার যে আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন যাবত, সেটাই এখন বিশাল একটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সমাজের বৈষম্য এবং সমস্যাগুলো নিয়ে পুনরায় ভাববার সময় এসেছে।