আর্গো
কলচিসে যেতে আর ফিরে আসতে পাড়ি দিতে হবে ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ সাগর। জ্যাসন তাই তৎকালীন শ্রেষ্ঠ জাহাজ নির্মাতা আর্গো/আর্গাসের শরণাপন্ন হলেন। দেবী অ্যাথেনার নির্দেশনায় তিনি তৈরি করলেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, কিংবদন্তির জাহাজআর্গো। পঞ্চাশ দাঁড়ের এই বিশাল জাহাজের ডেকে অ্যাথেনা ডোডোনাতে অবস্থিত জিউসের ওরাকলের মন্দিরের কথা বলা ওক গাছের একখণ্ড কাঠ স্থাপন করেন। এই কাঠ জাহাজের নাবিকদের প্রয়োজনে নির্দেশনা দিতে পারত।
আর্গো ছিল সমসাময়িক যেকোনো জাহাজের থেকে মজবুত আর দ্রুতগতির। তুমুল ঝড় আর পাহাড় সমান ঢেউ জাহাজের কোনো ক্ষতি করতে পারত না। জাহাজের অভ্যন্তর ছিল কারুকার্যখচিত আর রাজসিক। বিস্ময়করভাবে এই জাহাজ ছিল এতটাই হাল্কা যে চাইলে নাবিকেরা একে ঘাড়ে তুলে বহন করে নিতে পারত। নাবিক হিসেবে জ্যাসন চিরনের স্কুল থেকে তার পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের ডেকে পাঠাল। বীরত্বপূর্ণ অভিযানে শামিল হবার সুযোগ পেয়ে তারা খুশিমনেই সম্মত হয়। জাহাজের নামানুসারে এর নাবিকদের নামকরণ হলো আর্গোন্যাটস।
আর্গোন্যাটস
জ্যাসন তো নেতা। এছাড়া আর কারা কারা ছিল জ্যাসনের সাথে। চলুন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম একটু দেখে নেয়া যাক।
- টাইফাস, জাহাজের দিক নির্দেশক আর চালক।
- মেসেনিয়ার যুবরাজ লাইসিনাস ।
- হেরাক্লস (রোমান হারকিউলিস)।
- পেলেউস (গ্রীক বীর একিলিসের পিতা)।
- টেলেমন (আরেক নামকরা গ্রীক যোদ্ধা অ্যাজাক্স দ্য গ্রেটের বাবা)।
- স্পার্টার রানী লেডার যমজ সন্তান ক্যাস্টর আর পোলাক্স। ক্যাস্টরের পিতা স্পার্টার রাজা টিন্ডেরাস, আর পোলাক্সের বাবা জিউস। তাদের বোন হেলেন, যাকে নিয়ে পরে সূচীত হয়েছিল ট্রোজান যুদ্ধ।
- সেফেউস আর অ্যাম্ফিডামাস, আর্কেডিয়া রাজ্যের দুই যুবরাজ
- নেলেউস, পাইলস নগরের কিংবদন্তীর রাজা নেস্টর তারই সন্তান।
- পেলিয়াসের কন্যা অ্যালসেস্টেসের স্বামী, ফিরির রাজা অ্যাডমেটাস।
- মেলেজার, যিনি ক্যালিডোনিয়া অঞ্চল তছনছ করা প্রকাণ্ড ভালুকের হন্তারক।
- গ্রীসের সর্বশ্রেষ্ঠ সুরস্রষ্টা এবং গায়ক অর্ফিয়াস।
- মেনক্টিয়াস। তার ছেলে পেট্রোক্লেস ট্রোজান যুদ্ধে একিলিসের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন।
- থেসেউস। মিথোলজির আরেক বিখ্যাত চরিত্র। পরবর্তীকালে এথেন্সের রাজা।
- পিরিউস-থেসেউসের বন্ধু। তার বাবা ইক্সিওন থেসালির অন্তর্গত ল্যাপিথ গোত্রের রাজা।
- পলিফেমাস, ল্যাপিথের আরেক বীর। কোনো কোনো মতে তিনি হেরাক্লসের বোনের স্বামী ছিলেন।
- হাইলাস, হেরাক্লেসের দত্তক পুত্র।
- পসেইডনের পুত্র ইউফেমিস।
- অলিয়াস। তার সন্তান আরেক গ্রীক বীর অ্যাজাক্স। ইতিহাসে অ্যাজাক্স দ্য লেসার নামে পরিচিত।
- উত্তর বাতাসের দেবতা বোরিয়াসের দুই ডানাওয়ালা ছেলে জেটিস আর ক্যালাইস।
- অ্যাপোলোর ছেলে, ভবিষ্যতদ্রষ্টা ইডমন।
- আরেক নামজাদা ভবিষ্যতদ্রষ্টা মপ্সাস।
সব মিলিয়ে পঞ্চাশজনের মতো সাথী নিয়ে জ্যাসন প্রস্তুত হলো। কয়েকজন লেখক দাবী করেছেন আর্গোর অভিযাত্রী কারা কারা হবে তা জানতে জ্যাসন যখন ওরাকলের সাথে পরামর্শ করে তখন অন্যান্য নামের সাথে ওরাকল আটলান্টার নামও বলে। আটলান্টা ছিলেন আর্কেডিয়ার রাজকুমারি। ছোট থেকে বড় হয়েছিলেন জঙ্গলে, ভালুক আর শিকারিদের সাথে। সমসাময়িক পুরুষদের থেকে তিনি ছিলেন আরো দক্ষ শিকারি। বায়ুর মতো দ্রুত ছিল তার গতি। মেলেজারের সাথে ক্যালিডোনিয়া ভল্লুকের দেহে প্রথম আঘাত করেছিলেন দুঃসাহসী আটলান্টাই। কিন্তু বলা হয়, সহযাত্রীরা সুন্দরী আটলান্টার উপস্থিতিতে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় জ্যাসন রাজি হয়নি, আবার কেউ বলে তিনি নিজেই জ্যাসনের সঙ্গী হতে চাননি। আরেক দলের দাবি আটলান্টা পুরো অভিযানেই জ্যাসনের পাশে ছিলেন এবং অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
যাত্রা হলো শুরু
নিজেদের সাফল্যের জন্য জ্যাসন দেবতাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করল। অ্যাথেনা তাকে দিল বেগুনি এক আলখাল্লা। পোসাইডনের নামে উৎসর্গ দেয়া হলো। জিউসের সাহায্য কামনা করে আচার অনুষ্ঠান করলেন সবাই। এরপর মপ্সাস নানা চিহ্ন দেখে উপযুক্ত দিনক্ষণ গণনা করলেন। নির্দিষ্ট শুভদিনে আর্গো সাগরে ভেসে পড়ল। পাল উড়িয়ে দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলল ঢেউয়ের কোলে চেপে।
লেম্নস
ইজিয়ান সাগরের দক্ষিণের একটি দ্বীপ লেম্নস। এখানকার মহিলারা অনেক বছর আগে অল্প সময়ের উন্মত্ততার জের ধরে দ্বীপের সমস্ত পুরুষ মানুষকে হত্যা করে ফেলেছিল, একমাত্র রানী হিপ্সিপাইলের বৃদ্ধ পিতাকে ছাড়া।সেই থেকে রাজ্যের সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করত নারীদের সশস্ত্র এক বাহিনী। কোনো অজানা জাহাজের দেখা পেলেই তারা ছুটে যেত সাগরপাড়ে, যাতে কোনো শত্রু তাদের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়তে না পারে।
গ্রীস থেকে বেরিয়ে আর্গো বেশ প্রতিকূল আবহাওয়ার সম্মুখীন হলো। পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত জ্যাসন আশেপাশের কোনো দ্বীপে নোঙর ফেলে সময়টা কাটিয়ে দেবার ফয়সালা করল। কাছাকাছি ছিল লেম্নসের বন্দর। জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে যাত্রা করা হলো। এদিকে লেম্নসের নারীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছুটে এল। আগন্তুকেরা বিপদজনক কি না তারা বুঝতে চাইছিল। তাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে জ্যাসন এক সাথীকে পাঠাল বন্ধুত্বের বার্তা দিয়ে। হিপ্সিপাইল প্রথমে ভেবেছিল নাবিকদের প্রয়োজনীয় সবকিছু তাদের জাহাজে পৌঁছে দেয়া হবে, যাতে তারা দ্বীপে পা রাখতে নিরুৎসাহিত হয়। কিন্তু তার অভিজ্ঞ উপদেষ্টা তাকে পরামর্শ দিল নাবিকদের দ্বীপে নিয়ে আসতে। সে যুক্তি দেখাল দ্বীপে কোনো পুরুষ না থাকায় মেয়েরা স্বামী খুঁজে পাচ্ছে না। এখন এই অভিযাত্রীদের মধ্যে থেকে তারা পছন্দমত স্বামী বেছে নিতে পারবে। তার কথা হিপ্সিপাইলের মনে ধরল।
রানীর আমন্ত্রণ পেয়ে জ্যাসন ও সাথীরা জাহাজ থেকে নেমে এলো। হেরাক্লসের সাথে অল্প কয়েকজন রয়ে গেলেন জাহাজের দেখাশোনা করার জন্য। রানীর সাথে সাক্ষাতের কথা ভেবে জ্যাসন পরিধান করেছিল অ্যাথেনার দেয়া মহামূল্যবান আলখাল্লা। জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকে বলিষ্ঠ জ্যাসনকে দেখে রানী হিপ্সিপাইল বাকহারা হয়ে গেলেন। সংবিৎ ফিরে পেয়ে তিনি অভিযাত্রী এই যুবককে বসালেন তার রাজ সিংহাসনের পাশেই, তার হাতে তুলে দিলেন পিতার রাজদণ্ড। সুন্দরী হিপ্সিপাইলকে দেখে জ্যাসনও আকৃষ্ট হয়েছিল। সে রানীর উপহার গ্রহণ করল। তার সঙ্গীরাও দ্বীপের অন্যান্য রমণীদের সাথে আমোদ প্রমোদে মত্ত হয়ে উঠল।দিনের পর দিন মজার খাওয়াদাওয়া আর সুন্দরী নারীদের সেবা পেয়ে নিজেদের আসল উদ্দেশ্যই তারা ভুলতে বসল।
এদিকে দিনের পর দিন সঙ্গীরা না ফেরায় হেরাক্লস চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি নিজে এবার জাহাজ থেকে নেমে লেম্নসে প্রবেশ করলেন। খুঁজতে খুঁজতে সঙ্গীদের খাদ্য, পানীয় আর নারীতে মশগুল দেখে তিনি তাদের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এবার সবার মনে পড়ল কী কারণে তারা জন্মভূমি থেকে বের হয়েছে। তাড়াহুড়া করে সবাই আবার জাহাজে এসে উঠল।
ছয় হাতওয়ালা দৈত্যদের দেশে
জাহাজ এসে পৌঁছল ডোলিওনেসদের দ্বীপে। এর অবস্থান প্রোপোন্টিসে (বর্তমান তুরস্কের মারমারা সাগর)। এদের রাজা ছিলেন সাইজিকাস। ডোলিওনেসেরা পসেইডনের বংশধর ছিল। এই দ্বীপে আরো বাস করত ছয় হাতের বেশ কিছু ভয়ঙ্কর দানব। পোসাইডন সবসময় তাদের কাছ থেকে নিজ সন্তানদের রক্ষা করতেন।
সাইজিকাস আর্গোন্যাটসদের মহাসমাদরে গ্রহণ করলেন। অতিথিদের সম্মানার্থে রাজপ্রাসাদে বিরাট আয়োজন করা হলো। হেরাক্লসকে পাহারায় রেখে বাকিরা চলে গেল অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। এদিকে হেরাক্লস দেখতে পেলেন দৈত্যরা বিশাল বিশাল পাথর দিয়ে বন্দরের মুখ বন্ধ করে দিতে চাইছে, যাতে তারা বের হয়ে যেতে না পারেন। অবিলম্বে হেরাক্লস ধনুকে তীর পরিয়ে নিশানা করলেন। তার অব্যর্থ লক্ষ্যে মুহূর্তেই কয়েকটি দানব নিহত হয়। বিপদের খবর পেয়ে হেরাক্লসের সাথীরাও ছুটে এল। তাদের সম্মিলিত আক্রমনে দানবেরা তিষ্ঠোতে পারল না। তারা পালিয়ে গেলে জ্যাসন দ্বীপবাসীদের থেকে বিদায় নিয়ে আবার জাহাজ ভাসালেন।
কিন্তু বিধি বাম। প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়াতে আর্গো বারে বারে পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়তে থাকল। নিরুপায় জ্যাসন ঠিক করল ঝড় না কমা পর্যন্ত ডোলিওনেসদের বন্দরেই ফিরে যাওয়ার। এদিকে তখন রাত হয়ে গিয়েছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটায় চাঁদের আলোও নেই। ফলে জ্যাসনরা যখন বন্দরে প্রবেশ করল দ্বীপবাসীরা বুঝতে পারল না যে কিছুক্ষণ আগে চলে যাওয়া অতিথিরাই আবার ফেরত এসেছেন। শত্রু ভেবে তারা আর্গোন্যাটসদের উপর হামলা করল। রাতের গাঢ় আঁধারে চলতে লাগল মরণপন লড়াই। জ্যাসন নিজের হাতে হত্যা করল সাইজিকাসকে। রাজাকে হারিয়ে আতঙ্কিত ডোলিওনেসরা পালিয়ে গেল নিজেদের শহরে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রতিক্ষা করতে থাকল সূর্যের।
সকাল হলে দুই পক্ষই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় মুষড়ে পড়ে। জ্যাসন যখন জানতে পারল নিজ হাতে বন্ধুপ্রতিম সাইজিকাসকে সে হত্যা করেছে তখন সে-ও বেশ ভেঙে পড়ে। তিন দিন আর্গোন্যাটসরা ডোলিওনেসদের সাথে থেকে তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সকল আচারে অংশ নেয়।