নরম্যান্ডির ট্যাংক যুদ্ধের প্রথম পর্বে বলা হয়েছিল, মিত্রবাহিনীর টার্গেট ছিল নরম্যান্ডিতে সফলভাবে অবতরণ করতে পারলে সেখান থেকে সবচেয়ে কাছে এবং ট্যাংক ও আর্টিলারি যুদ্ধের জন্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি শহর ক্যান তিনদিনের মধ্যে দখলে নিতে হবে। কিন্তু জার্মানদের দুর্দান্ত ডিফেন্সিভ যুদ্ধকৌশল ও হার না মানা মনোভাবের কারণে ক্যানের পতন ঘটাতে ৩৪ দিন সময় লেগে যায়। এসময় জার্মান ট্যাংক, এন্টি ট্যাংক বহরের সাথে পেরে উঠতে না পেরে মিত্রবাহিনীর ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স নির্বিচারে বোমা ফেলে পুরো শহর ধ্বংসস্তুপ বানিয়ে দেয়।
এই আর্টিকেলে আমরা জানবো ক্যান শহরের পতনের পরের ট্যাংকযুদ্ধসমূহ। তার আগে পাঠক আপনার জন্য একটি প্রশ্ন, “দুটো ট্যাংক পরস্পরের টারেটের সাথে টারেট প্রায় লাগিয়ে যদি একদম ক্লোজ রেঞ্জে ফায়ারিং শুরু করে, তবে সেটা কেমন হবে?” কানাডিয়ান স্টাইলে প্যান্থার ট্যাংক ধ্বংসের জন্য আপনি যদি ব্রিটিশ শেরম্যান ট্যাংক নিয়ে ঝোপঝাড়ে পজিশন নিতে গিয়ে দেখেন ঠিক কয়েক ফুট সামনেই একটি টাইগার ট্যাংক আপনার তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে… ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বেশ ভয়ংকর।
অপারেশন গুডউড
ক্যান শহরের দখল হারানোর পর মূলত জার্মানির পিছু হটা শুরু হয়। নরম্যান্ডিতে দুদিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য এমনভাবে আক্রমণ করে যাতে জার্মানি ফাঁদে পড়ে যায়। তবে কানাডিয়ানরা ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারির পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
ব্রিটিশরা চাচ্ছিল কানাডিয়ানরা যেন জার্মানদের পুশব্যাক করে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যায়, যাতে মার্কিনীরা ভয়াবহ আর্টিলারি হামলা করে তাদের শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার কার্ট মায়ার তার ট্যাংক বাহিনী নিয়ে সরাসরি পিছিয়ে গিয়ে ব্যারিয়ার রিজে (গ্রামের নাম ভিলার-বকেশ) গিয়ে ডিফেন্সিভ পজিশন জোরদার করেন। এটি ছিল ভূমি থেকে ৩০ মিটার উঁচু একটি গ্রাম যা ট্যাংক বিধ্বংসী কামানের জন্য সবচেয়ে আদর্শ যুদ্ধক্ষেত্র। যেকোনো দিক থেকে আসা অ্যাটাক রিজ থেকে আগেভাগে দেখা যাবে। এ সময় জার্মানরা ৭২টি ৮৮ এমএম এন্টি ট্যাংক গান মোতায়েন করে। এছাড়া মিত্রবাহিনীর ট্যাংককে আপ্যায়ন করার জন্য ৪০টি প্যানজার ফাইভ ‘প্যান্থার’ ট্যাংক ও জার্মানির সবচেয়ে শক্তিশালী টাইগার/কিং টাইগার ট্যাংক প্রায় ৮০টি মোতায়েন করে!
যথারীতি এবারও ভয়াবহ জার্মান আক্রমণের প্রথম শিকার কানাডিয়ানরা। ভিলার-বকেশে ঢোকার আগে মিত্রবাহিনী খবর পায় যে সেখানে কমপক্ষে ৬৪টি ট্যাংক আছে। কিন্তু তখনকার জার্মানরা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে নিজেদের শক্তিকে বাড়িয়ে দেখাতো সেটা জানতো মিত্রবাহিনী। এজন্য তারা ধরে নেয় যে, সেখানে ৮টি (খুব বেশি হলে ১০টি ট্যাংক) রয়েছে। অর্থাৎ ধরে নিয়েছে ৮×৮ = ৬৪টি ট্যাংক থাকার ঘটনা একেবারে ‘ডাহা মিথ্যা’ কথা। উল্লেখ্য, ফিল্ড মার্শাল রোমেল আফ্রিকার যুদ্ধে তার ট্যাংক এবং আর্মার্ড ভেহিকেলগুলোকে মরুভূমিতে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে নির্দেশ দিতেন। তেলের সংকট সত্ত্বেও তাদের পর্যাপ্ত তেল দিতেন। ফলে দিনে কয়েকবার চক্কর দেয়া মিত্রবাহিনীর রিকনসিস বিমানগুলো (গোয়েন্দা বিমান) একই ট্যাংক কয়েকবার গুনতো এবং কয়েক লোকেশনে আবিষ্কার করতো! মানে একই কুমিরের বাচ্চা বার বার দেখানো আর কী। এতে করে তার বহরে ট্যাংক এবং আর্মার্ড ভেহিকেল ৪৯৪টি থাকলেও সেটাকে ১ হাজার বা তারও বেশি হিসাব করেছিল ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী। এই যুদ্ধে তেমনি ধোঁকা খেয়েছিল সেকেন্ড কানাডিয়ান আর্মার্ড ব্রিগেড।
সেদিন বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল, দৃষ্টির সীমানা ছিল খুবই সীমিত। এমন সময় ট্যাংক যুদ্ধ খুবই বিপদজনক, কেননা সামান্য দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। জার্মানদের ৮-১০টি ট্যাংক আছে এমন হিসাব করে কানাডিয়ানরা অ্যাডভান্স পার্টি হিসেবে মাত্র ১৪টি ট্যাংক পাঠায়। গ্রামের ভেতর কিছুদূর যাওয়ার পর দু’পাশ থেকেই হামলা শুরু করে জার্মান প্যান্থার ও টাইগার ট্যাংক। মুহূর্তেই একে একে ধ্বংস হয় মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহরের প্রথম কলামের বেশিরভাগ ট্যাংক। এ সময় ভিলার-বকেশের অপরপাশে ব্রিটিশ অ্যাট্যাকের সময় তাদের আর্মার্ড বহরের উপর রীতিমতো তান্ডব চালান জার্মানির বিখ্যাত ট্যাংক কমান্ডার মাইকেল উইটম্যান। তিনি একমাত্র টাইগার ট্যাংক নিয়েই মিত্রবাহিনীর ১৩৮টি ট্যাংক ধ্বংসের রেকর্ড গড়েছিলেন। এছাড়া ১৩২টি এন্টি ট্যাংক কামানও ধ্বংস করেন। ভিলার-বকেশের যুদ্ধে জার্মান কমান্ডার মাইকেল উইটম্যান মাত্র ১৫ মিনিটে ১৪টি ট্যাংক, ২টি এন্টি ট্যাংক কামান, ১৫টি অন্যান্য ভেহিকেল ধ্বংস করেন। জার্মানরা তার এই সাফল্যকে ফলাও করে প্রচার করে।
ভয়াবহ জার্মান আক্রমণের ফলে সেকেন্ড কলামের সবাই পিছিয়ে গিয়ে সুবিধাজনক পজিশন নিতে শুরু করে। ফাস্ট কলামের কমান্ডার ফিল লরেন্সের একটি দলছুট শেরম্যান ট্যাংক একটি পাকাবাড়ির পাশের ঝোপঝাড়ের মধ্যে পজিশন নিতে যায়। মূলত কয়েকশ গজ সামনে দিয়ে যাওয়া একটি প্যান্থার ট্যাংকের কলামকে সাইড থেকে আক্রমণ করার সময় পাল্টা আক্রমণ থেকে নিজেকে হেফাজত করার জন্য বাড়ির দেয়ালের পাশে পজিশন নিতে যান কানাডিয়ান ট্যাংক কমান্ডার ফিল লরেন্স। কিন্তু পড়বি তো পড়, একদম বাঘের মুখে! ঐ ঝোঁপে আগে থেকে লুকিয়ে ছিল একটি টাইগার ট্যাংক! এটি গায়ে গাছের ডালপালা দিয়ে ক্যামোফ্লেজে থাকায় উপস্থিতির কথা কমান্ডার ফিল লরেন্স ঘুণাক্ষরেও টের পাননি।
হঠাৎ টাইগারের বিধ্বংসী ৮৮ এমএম ক্যানন দেখে ট্যাংক ক্রুদের প্যান্ট ভিজিয়ে দেয়ার দশা। দেরি না করে টাইগারের উদ্দেশ্যে মাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে তারা ফায়ার করা শুরু করে। কিন্তু ঐ দানবের সামনের আর্মার ছিল ১২০ মিলিমিটার, যা ঐ যুগের কোনো এন্টি ট্যাংক ওয়েপন দিয়ে ভেদ সম্ভব ছিল না! ফলে পর পর কয়েকবার শেল ফায়ারের পরও টাইগারের কিছুই হয়নি! উপরন্তু জার্মান টাইগার ট্যাংকটি খানিকটা দেরি করে ফায়ার শুরু করে। কানাডিয়ানদের দুরবস্থা দেখে সম্ভবত ইচ্ছা করে মজা নিচ্ছিল টাইগার কমান্ডার, অথবা টেকনিক্যাল কারণে পাল্টা ফায়ার করতে একটু দেরি করে। শেষপর্যন্ত টাইগার ট্যাংকটি মাত্র একটি শেল ফায়ার করে, আর এতেই উড়ে যায় শেরম্যান ট্যাংকের টারেটের উপরের অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি টাইগার ট্যাংক তাত্ত্বিকভাবে দুই কিলোমিটার দূর থেকে একটা শেরম্যানকে মারতে পারে। কিন্তু দুই মিটার দূর থেকে শট নিলে কী হবে বুঝতে পারছেন! শেষ পর্যন্ত আগুন ধরে গেলেও ফিল লরেন্সের শেরম্যানটি পিছু হটতে সক্ষম হয়। মূলত দূরত্ব খুবই কম হওয়ায় শেরম্যান ট্যাংকের ক্রুরা সেবারের মতো বেঁচে যান।
মিত্রবাহিনী সেদিন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধ ছিল জার্মানদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার লড়াই। ১,১০০ ট্যাংক নিয়ে ৩ দিন যুদ্ধ করে প্রায় ৪০০ ট্যাংক হারানোর পরও জার্মানদের থেকে রিজের দখল নিতে পারেনি মিত্রবাহিনী। মূলত জার্মানদের ৩৭৭টি ট্যাংকের তুলনায় তাদের কয়েক ডজন এন্টি ট্যাংক কামানগুলো বেশি ক্ষতি করছিল মিত্রবাহিনীর। এগুলো ট্যাংকের চেয়েও দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মোতায়েন করা যেত। এছাড়া জঙ্গলের ভেতর দারুণভাবে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারতো এবং আচমকা হামলা করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে পারতো। পরে ট্যাংক যুদ্ধের এক নতুন কৌশল নিয়ে নতুন উদ্যমে অপারেশন পরিচালনা করেন এক কানাডিয়ান জেনারেল। ব্রিটিশরা এবার কানাডিয়ান মেথড অবলম্বন করে সফল হয়।
অপারেশন টোটালাইজ
প্রতি সারিতে ৪টি করে ৪ কলামে ৪০০ ট্যাংককে মার্চ করতে দেখলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? বিশেষ করে প্রতিপক্ষের যদি যথেষ্ট ট্যাংক বিধ্বংসী কামান থাকে? মনে হবে মরার জন্য আগুনে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে পিপীলিকার দল।
৩ দিন যুদ্ধ করে প্রায় ৪০০ ট্যাংক হারানোর পরও জার্মানদের থেকে রিজের দখল নিতে না পেরে
কানাডিয়ান জেনারেল গাই সিমন্ড এক নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আসেন। তিনি মিত্রবাহিনীর পুরো বহর মানে ট্যাংক, এপিসি, আর্মার্ড ট্রুপস ক্যারিয়ার, সাপ্লাই ট্রাক, মিলিটারি জিপ, স্কাউট মোটরবাইক যা আছে সবগুলোকেকে ৪ থেকে ৬ কলামে ভাগ করেন। সবার সামনে ছিল ট্যাংকগুলো, ২/৩ সারি পর পর ট্রুপস ক্যারিয়ার ট্রাকগুলো।
এক সপ্তাহ চর্চার পর ১৯৪৪ সালের ৮ আগস্ট রাত সাড়ে এগারোটায় জার্মানদের ইস্পাত কঠিন মনোবল ভাঙতে রিজের উপর প্রচন্ড বিমান হামলা শুরু করে করে মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো। এর পর পরই ট্যাংকগুলো চলতে শুরু করে। মূলত জার্মান এন্টি ট্যাংক গানের হাত থেকে বাঁচতে রাতের বেলা অপারেশন চালানো হয়। প্রত্যেকটি ট্যাংক তার সামনের ট্যাংকের লাল ব্রেকলাইট দেখে লাইন-লেন্থ সোজা রাখছিলো। কলাম যাতে আঁকাবাঁকা না হয় সেজন্য ৪ কলামের দুই পাশে ক্রমাগত মেশিনগানের লাল ‘ট্রেসার’ বুলেট ফায়ার করা হচ্ছিল, যাতে জ্বলন্ত লাল বুলেটের স্রোত দেখে লাইন ঠিক রাখা যায়!
এখানে ট্রেসার বুলেট নিয়ে সামান্য ধারণা দেয়া প্রয়োজন, নাহলে অনেকেই ব্যাপারটি বুঝবেন না। এ ধরনের বুলেটের শেষপ্রান্তে পাইরোটেকনিক চার্জ (সহজভাবে বললে আতশবাজির কেমিক্যাল) ব্যবহার করা হয়। ফলে এসব বুলেট ফায়ারিংয়ের পর এর গমনপথ দিনে-রাতে সবসময় উজ্জ্বল আলোর কারণে বোঝা যায়।
এসময় জার্মান ট্যাংক এবং এন্টি ট্যাংক গানগুলো আন্দাজে ফায়ার শুরু করে। শত্রুপক্ষ মার্চ করে আসছে বিধায় তাদের জন্য সহজ টার্গেট হয়। সেদিন এক রাতেই মিত্রবাহিনী ১,২৫৬ জন সৈন্য ও ১৪৬ এর অধিক ট্যাংক হারায়।
হরতালে যদি পুলিশ গুলি শুরু করে আর পিকেটাররা যদি পিছু না হটে ক্রমাগত এগিয়ে যেতেই থাকে তবে একসময় পুলিশ পিছিয়েই যাবে। জার্মানদেরও একই অবস্থা হয়েছিল। মিত্রবাহিনীর ট্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশ ছিল যতই শেল ফায়ার হোক না কেন, কোনোভাবেই থামা যাবে না। ক্রমাগত এগিয়ে যেতে হবে। ফলে ভোরের আগেই জার্মান লাইন অফ ডিফেন্স ভেঙে পড়ে এবং মিত্রবাহিনী অবশেষে ভ্যারিয়ার রিজ দখল করে। এসময় জার্মানি ৩০০০ এর অধিক সৈন্য ও ৪৫টি ট্যাংক হারায়।
এটিই ছিল নরম্যান্ডির শেষ ট্যাংক যুদ্ধ। রিজের দখল হারানোয় দু’পাশ থেকেই নরম্যান্ডি মিত্রবাহিনীর (একপাশে যুক্তরাষ্ট্র, আরেকপাশে ব্রিটিশ-কানাডিয়ান) নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মাঝখানে পকেটে আটকা জার্মানরা মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় মারা যায় কিংবা পরে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। মাত্র ১০টি ট্যাংক ও অনধিক ৩০০ জার্মান সেনা (ব্রিগেডিয়ার কার্ট মায়ারসহ) পিছু হটতে সক্ষম হন।
এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ ট্যাংক যুদ্ধ। নরম্যান্ডিতে জিততে না পারলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ এত তাড়াতাড়ি হত না। জার্মানির পতন ও মিত্রবাহিনীর ইউরোপে অগ্রযাত্রা শুরু হয় নরম্যান্ডি থেকেই, যার শেষ হয় বার্লিনে জার্মানির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটি:
১) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমাহামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য কাহিনী