বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় বা প্রভাবশালী রাজপরিবারের নাম বলতে হলে প্রথমেই হয়তো উঠে আসবে রয়াল হাউজ অফ উইন্ডসর তথা ব্রিটিশ রাজপরিবারের নাম। ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা দেখেছে অটোমান, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান, রুশ ও জার্মান সাম্রাজ্যের পতন; সাক্ষী হয়েছে বিশ্বমানচিত্রের পটপরিবর্তন, পরিবারের সদস্যদের খুন, নির্বাসন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রসহ নানা ঘটনার। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এতকিছুর পরও তাদের এখনও টিকে থাকার রহস্য কী? তাদের শুরুই বা কোথা থেকে?
আজকে আমরা সংক্ষেপে এ প্রশ্নগুলোরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।
স্যাক্স-কোবার্গ গোথা বম্বারস
১৩ জুন, ১৯১৭; প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জার্মান অধ্যুষিত বেলজিয়ামের বিমানঘাঁটি থেকে ১৪টি বোমারু বিমান একসাথে উড্ডয়ন করলো; গন্তব্য লণ্ডন। সেই ভয়াবহ বিমান হামলায় আঠারোজন শিশুসহ পুরো লন্ডনে মারা যায় ১৬২ জন।
ঘটনার আকস্মিকতা হতভম্ব করে দেয় সবাইকে। আক্রমণকারী দলের নাম ছিলো গোথা বম্বারস; স্যাক্স-কোবার্গ-গোথা। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে এই নামের সাথেই জড়িয়ে আছে সে সময় পুরো ইউরোপজুড়ে ন’টি সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদর্পে টিকে থাকার গল্প!
শেকড়ের সন্ধানে
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের শাখা-প্রশাখা, এবং উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের মাঝে মতভেদ দেখা যায়। তবে, এ ব্যাপারে সবাই একমত, আলেকজান্দ্রিনা ভিক্টোরিয়া তথা মহারানী ভিক্টোরিয়া (রাজত্বকাল ১৮৩৭-১৯০১) এর বাবা ও মা ছিলেন যথাক্রমে জার ও জার্মান বংশোদ্ভূত।
তিনি নিজেও জার্মান এবং ইংরেজি দু’ভাষাতেই অনর্গল কথা বলতে পারতেন। পরবর্তীতে ১৮৪০ সালে তিনি বিয়ে করেন প্রিন্স অ্যালবার্ট অব কোবার্গকে, যে ছিল ‘স্যাক্স-কোবার্গ অ্যান্ড গোথা’ রাজপরিবারের সদস্য; তথা জার্মান। মূলত তখন থেকেই ব্রিটেনের রাজপরিবারের ডাকনাম স্যাক্স-কোবার্গ-গোথা। অর্থাৎ, তাদের দুজনের সন্তান, সপ্তম এডওয়ার্ডও (রাজত্বকাল ১৯০১-১০) ছিলো জার্মান রক্তধারী।
পরবর্তীতে, রাজা এডওয়ার্ড ১৮৬৩ সালে ড্যানিশ রাজকুমারী আলেকজান্দ্রাকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নেন। তাদের দুজনের দ্বিতীয় সন্তান হলো রাজা পঞ্চম জর্জ, (রাজত্বকাল ১৯১০-৩৬), যে প্রকৃতপক্ষে ছিল একইসাথে জার্মান ও ড্যানিশ রক্তের অধিকারী। প্রসঙ্গত, তার স্ত্রী, রানী মেরীও ছিলো জার্মান বংশোদ্ভূত। অর্থাৎ, ব্রিটিশ রাজপরিবারে জার্মান রক্ত হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়, বরং বেশ আগে থেকেই ছিল।
ইউরোপজুড়ে রাজতন্ত্রের জাল
অ্যালবার্ট অব কোবার্গ এবং রানী ভিক্টোরিয়ার নয় সন্তানের মাঝে আটজনেরই বিয়ে হয়েছিলো তৎকালীন ইউরোপের কোনো না কোনো রাজপরিবারে। প্রফেসর জেন রিডলের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই ইউরোপজুড়ে সমস্ত রাজপরিবারের মাঝে জালের মতো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল, অনেকটা ট্রেড ইউনিয়ন অব মনার্ক্সদের মতো। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপজুড়ে রাজতন্ত্রের ভিত মজবুত করা।
এই শাখা প্রশাখার বিস্তৃতি বোঝা যায় আরেকটি তথ্যে- ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ ছিলো যথাক্রমে তদানীন্তন রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাসের খালাতো ও জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলহেমের ফুপাতো ভাই। প্রসঙ্গত, তারা উভয়ই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে সিংহাসন থেকে নিক্ষিপ্ত হন এবং সাম্রাজ্য হারান।
রাজপরিবারে অস্থিরতা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের রাজা ছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জ। প্রখ্যাত সাহিত্যিক এইচ জি ওয়েলস একবার তাকে অ্যাখায়িত করেন ভিনদেশী এবং অদূরদর্শী বলে। রাজার বংশপরিচয় এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে করা এই মন্তব্যের জন্য পরবর্তীতে রাজদরবার থেকে প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করা হয়।
নিপাট ভদ্রলোক, সাবধানী, কিছুটা ঝামেলা এড়িয়ে চলার মানসিকতাপ্রবণ রাজা পঞ্চম জর্জের মাঝে এমন কোনো গুণ ছিলো না, যা কি না তাকে একজন সফল সমরনায়কের পরিচিতি এনে দেবে।
এর বহু বছর পর ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে তার আত্মজৈবনিক সূত্রে জানা যায়- রাজা হবার পূর্বে, জীবনের ২০টি বসন্ত ধরে তিনি পাখি শিকার এবং ডাকটিকিট সংগ্রহ ব্যতীত কিছুই করেননি!
সব কিছু মিলিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজবংশে এমন কেউ ছিলেন না যিনি দেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা দিতে পারেন, একইসাথে সাধারণ মানুষের মাঝে রাজপরিবারের সম্মান অটুট রাখা এবং যুদ্ধের ময়দানে দেশকে দক্ষতার মাঝে চালনা করার মতো কাজে নেতৃত্ব দিতে পারেন।
টিকে থাকো, যেভাবেই হোক!
ব্রিটিশ রাজপরিবার সর্বদাই একটি মূলনীতির ওপর অটল ছিল। তা হলো- ‘টিকে থাকো; যেভাবেই হোক, যেকোনো মূল্যেই হোক!’
১৭ মার্চ, ১৯১৭ সালে রাশিয়ার শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তৎকালীন লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকদের হাত থেকে তাকে রক্ষার জন্য রাশিয়ার সরকার ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ব্রিটেনকে অনুরোধ করেন রোমানভদের সপরিবারে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় দেবার জন্য।
তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ মানবিক কারণেই এই অনুরোধে আপত্তি করেননি। তবে, বাধা এসেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে। রাশিয়ান জার দ্বিতীয় নিকোলাসের আত্মরক্ষার আকুতিতে বাদ সাধেন তারই ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু, খালাত ভাই- রাজা পঞ্চম জর্জ।
জর্জের ব্যক্তিগত সহকারী লর্ড স্ট্যামফোর্ডাম রাজাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, জার এবং তার পরিবারকে ব্রিটেনে আশ্রয়দান হবে মস্ত বড় ভুল। কেননা, লন্ডনের রাজপথে তখন জার পতনের উল্লাস মিছিল। এমতাবস্থায় জারকে লন্ডনে আশ্রয়দান যে শুধু জনগণের মাঝে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ণ করবে তা-ই নয়, এমনকি তাদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। সবকিছু ভেবে রাজা সিদ্ধান্ত নেন লয়েড জর্জকে গোপন বার্তা পাঠানোর, তার ভাই, রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে যেন কোনোভাবেই ব্রিটেনে আশ্রয় না দেয়া হয়।
এর ছ’মাস পরই রাশিয়ার ইয়াকাতেরিনবার্গে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বলশেভিকরা।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রফেসর জেন রিডলে বলেন,
ব্রিটিশ রাজপরিবারের রাজনৈতিক আশ্রয়দানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের বিষয়টি একইসাথে নির্মম ও বাস্তববাদী, যা মূলত তাদের একটি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। যা হলো, নিজেদের অস্তিত্বসংকটে পড়লে নিষ্ঠুর হতেও তারা কখনও দ্বিধাবোধ করে না।
শেষের শুরু
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে সম্ভবত রাজা পঞ্চম জর্জ ভেবেছিলেন ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা রাজতন্ত্রের জাল তাকে দীর্ঘ যুদ্ধ এড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু হলো উল্টোটা! ব্রিটেনের জনগণের মাঝে তখন রাজতন্ত্রবিরোধী মনোভাব প্রবল। ক্ষুব্ধ, ভাগ্যবিড়ম্বিত সাধারণ মানুষের যখন জার্মানবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ বাড়ছে, একইসময়ে যুদ্ধের ময়দানেও ব্রিটেনের বেশ নাজুক দশা। ১৯১৬ সালের ‘ব্যাটল অব সোমে’ ব্রিটেনের শোচনীয় পরাজয়ের দগদগে ঘা তখনো শুকোয়নি। একইসাথে যুদ্ধের সাথে হাত ধরে আসা অর্থনৈতিক মন্দা, সৈন্যদের মৃত্যু, মানুষের মাঝে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
এই উত্তাল সময়ে ব্রিটেনে স্যাক্স কোবার্গ গোথা বম্বারস হামলা চালায়। হামলার পরদিন লন্ডনের সবগুলো পত্রিকার প্রথম পাতায় আক্রমণকারী দলের নাম ছাপা হয়। কাকতালীয়ভাবেই, আক্রমণকারী জার্মান-দলের নামের সাথে ব্রিটেনের রাজপরিবারের নামের ছিল আশ্চর্য মিল। এবং হঠাৎ করেই যেন মনে হলো, জার্মানদের তথা শত্রুদের নির্মম আক্রমণের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ব্রিটিশ রাজপরিবার নিজেই!
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় থেকেই রাজা পঞ্চম জর্জ বুঝতে পেরেছিলেন, আর কিছু হোক বা না হোক, তাদের বংশের নামই তাদের জন্য বিপদ বয়ে আনবে। এই ঘটনার পর সে সিদ্ধান্ত হলো, যেভাবেই হোক, যত দ্রুত সম্ভব বংশের এই নাম বদলে অন্য কোনো নাম দেয়া প্রয়োজন। রাজপরিবারের এই ক্রান্তিকালে আবারও ত্রাতা হিসেবে দৃশ্যপটে স্ট্যামফোর্ডামের আগমন। পরবর্তীতে, পঞ্চাশ বছর পর আবিষ্কৃত গোপন নথিসূত্রে জানা যায়, লর্ড স্ট্যামফোর্ডাম ঠিক সেদিনই, অর্থাৎ ১৩ জুনই ব্রিটেনের রাজপরিবারের জন্য নতুন নাম নির্বাচন করে পাঠান। উইন্ডসর! রয়াল হাউস অব উইন্ডসর।
উইন্ডসর ক্যাসলের দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ সংস্কৃতি-রুচিবোধের ধারক হওয়ার ইতিহাস এবং নামের সাথে কোনো জার্মান সংস্পর্শ না থাকাকে এ নাম নির্বাচনের কারণ হিসেবে মনে করা হয়।
১৭ জুলাই, ১৯১৭-তে রাজপরিবার কর্তৃক জারিকৃত ফরমানে আনুষ্ঠানিকভাবে বংশের জার্মান নাম বদলে ‘হাউস অব উইন্ডসর’ করার কথা ঘোষণা করা হয়।
এর কিছুদিন আগে, ২৬ জুন, প্রধানমন্ত্রী লর্ড রসবেরি স্ট্যামফোর্ডামকে গোপন চিঠিতে লেখেন, “আপনি কি বুঝতে পারছেন একটি সম্পূর্ণ রাজবংশকে আপনি ‘খ্রিষ্টধর্মে’ দীক্ষিত করেছেন? পৃথিবীর খুব কম মানুষই বোধহয় তা করতে পেরেছে। প্রকৃতপক্ষে,কেউই নয় সম্ভবত!“
ব্রিটিশ বুদ্ধিও বোধহয় একেই বলে!