পার্থিব স্বল্পকালীন সফলতা আর ক্ষমতার বিনিময়ে নৈতিক শুদ্ধতাকে বিক্রি করে দেয়াকে বলা হয় ফাউস্টিয়ান চুক্তি। খোদায়ী পক্ষ ত্যাগ করে নেহায়েত লৌকিক স্বার্থে শয়তানের পক্ষে যোগ দেয়াই ফাউস্টিয়ান কর্ম। প্রচলিত এই ধারণার সাথে জড়িত প্রভাবশালী সাহিত্যিক চরিত্র, ফাউস্ট। পাশ্চাত্য রেনেসাঁ চিন্তা এবং আধুনিকতার উন্মেষের পথে অন্য কোনো চরিত্রই বোধ হয় ফাউস্টের মতো সার্বজনীনতা অর্জন করেনি।
মানুষ মূলত ঐশ্বরিক। অনন্ত শান্তির স্বার্থেই তাকে নৈতিক মানদণ্ড মেনে চলতে হয়। অথচ নিজেকে ক্ষমতাধর এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলার ইচ্ছা তাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। দর্শন, চিকিৎসা, কাব্য এবং ধর্মতত্ত্ব সেখানে উপযোগহীন। ফাউস্ট সকল বিদ্যায় পণ্ডিত হয়েও ইহজগতকে শাসন করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করেনি। তাই ডুব দিয়েছে যাদু এবং নিষিদ্ধ বিদ্যায়। শয়তানের সাথে চুক্তিতে বরণ করে নেয় পরবর্তী অনন্ত শাস্তি; বিনিময়ে পার্থিব জীবনের আধিপত্য। কিন্তু ফাউস্ট তো মানুষ। তাই ভালো-মন্দের টানাপোড়েন থামে না।
- ফাউস্ট কি সত্যিই অতিমানব হয়ে উঠতে পারবে?
- নিজেকে রক্ষা করতে পারবে শেষ অব্দি? নাকি হারিয়ে যাবে দুর্বলতায়।
- মুক্তি কি তাহলে সম্ভব?
- মানুষ কি ঈশ্বরের আশ্রয় থেকে বের হয়ে নিজে নিজে অস্তিত্বের মোকাবিলা করতে সক্ষম?
জন্ম দেয় এমন হাজারো প্রশ্নের। এই পটভূমিতেই উদ্ভাবিত হয়েছে অজস্র আখ্যান, যা প্রভাবিত করেছে বহু লেখক, সংগীতজ্ঞ, চিত্রকর এবং শিল্পের অন্যান্য অঙ্গনে।
সূত্র
৬ষ্ঠ শতকের দিকে থিওফিলাস অব আদানার আখ্যান বেশ প্রচলিত। বিশপ হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তিনি শয়তানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। অবশ্য সেই সমাজের কাঠামোও অনেকটা তেমনই ছিল। কারো মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা গেলেই সাধারণ মানুষ তাকে দেখতো সন্দেহের চোখে। ধারণা করতো অপশক্তির সাথে তার কোনো আঁতাত আছে কি না। এমনকি পোপ সিলবেস্টারের (৯৪৬-১০০৩ খ্রি.) মতো পণ্ডিত এবং ধার্মিক লোককে শয়তানের সাথে চুক্তিবদ্ধ তকমা পেতে হয়েছে। মধ্যযুগের ডাইনি হত্যার যে মহাসমারোহ, তার পেছনে প্রধান যুক্তিই ছিল ডাইনিরা শয়তানের কাছে নিজেদের শুদ্ধ শক্তিকে বিক্রি করে দিয়েছে।
ফাউস্টকে নিয়ে হাজার ধরনের গল্প প্রচলিত রয়েছে। কবিতা, সংগীত, নাটক, সিনেমা, চিত্র থেকে ধ্রুপদী সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তার পদচারণা। `দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে থেকে লিটল শপ অব হররস অব্দি। ফলে সকলের বিবরণ এবং পরিণতি একরকম থাকেনি। অবশ্য গ্যোটের ফাউস্টকেই মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়।
পনেরো শতকের শেষ দিকে উত্তর জার্মানিতে ফাউস্ট নামে একজন যাদুবিদ্যা চর্চাকারী এবং আলকেমিস্ট বসবাস করত। কারো মতে, ফাউস্ট কেবল কিংবদন্তি, কেউ সূত্র টেনেছেন বাইবেল অব্দি। ‘ব্যাভিচার, ডাকিনীবিদ্যা, ঘৃণা, বিবাদ, দ্বন্দ্ব, ক্রোধ, বিদ্রোহ, ধর্মদ্রোহ, হত্যা, মদপান, আমোদফূর্তি এবং ইতোমধ্যে যে সবের কথা বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি এমনটা করবে, খোদার রাজ্যে তার কোনো অধিকার নেই।’ (কিং জেমস বাইবেল, গ্যালেশিয়ানস, ৫:২০-২১) বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে মাজুসি সাইমন বলে এক যাদুবিদ্যা চর্চাকারীর বিবরণ উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি যীশু খ্রিষ্টের শিষ্যদের মতো আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করার প্রয়াস চালান। তবে আনুগত্যের মধ্য দিয়ে না, অর্থের জোরে। আধ্যাত্মিকতা খোদাপ্রদত্ত, ক্রয় বা বিক্রয় করার জন্য না। তার নাম থেকেই ‘সিমনি’ নামের উদ্ভব; অর্থ আধ্যাত্মিক শক্তিকে ক্রয় বা বিক্রয় করার পাপ। ফাউস্ট চরিত্র চিন্তনের পেছনে এর প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক না।
ষোড়শ শতকের পোল্যান্ডে জনৈক প্যান টারডোস্কিকে নিয়ে লোককথা বেশ জনপ্রিয় ছিল। তিনি নিজের আত্মাকে বিক্রি করে দেন শয়তানের কাছে কেবল অলৌকিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য। পরবর্তীকালে সমকালীন রাজার মৃত স্ত্রীকে কবর থেকে উত্তোলন করে তাক লাগিয়ে দেন। মৃত্যুর পরে শয়তান তাকে বয়ে নিয়ে যায় চাঁদে। এখন অব্দি প্যান সেখানেই বসবাস করছে।
এগারো শতক থেকে প্যারিসের ডাক্তার সিনোডোক্সাসের কিংবদন্তি বেশ প্রচলিত ছিল। জ্যাকব বিডারম্যান তাকে নাটকে রূপান্তরিত করেন পরবর্তীতে। সিনোডোক্সাস দয়ার্দ্র এবং শুদ্ধ মানুষ ছিলেন। নানা রকম সৎ কাজে নিজেকে লিপ্ত করতেন। কিন্তু নিজের কর্মের দিকে তাকিয়ে অহংকারী হয়ে উঠতে দেরি হয়নি। অবশেষে সেই অহঙ্কারের জন্যই পান শাস্তি। চতুর্দশ শতকের দিকে পশ্চিম জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডের ইতিহাসের পাওয়া যায় একটু ভিন্ন উপকথা। শয়তানের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন ম্যারি নামের এক তরুণী। তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন অলঙ্কারবিদ্যা, সঙ্গীত, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, জ্যামিতি, গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যা। পরবর্তীতে অবশ্য ম্যারি নিজে ক্ষমা প্রার্থনা করেন খোদার কাছে। ক্ষমা লাভ করে গমন করেন স্বর্গে।
জন ডি ছিলেন ষোড়শ শতকের গণিতজ্ঞ। জ্যোতিষ, আলকেমি, যাদু এবং গুপ্তবিদ্যার চর্চায় তার পরিচিতি ছিলো। প্যান টারডোস্কি কিংবা সিনোডোক্সাসের মতো তাকে নিয়েও প্রচলিত ছিলো কিংবদন্তি। ক্রিস্টোফার মারলোকে যা অনুপ্রাণিত করেছে ফাউস্টের চরিত্র অঙ্কনে। মধ্যযুগের ইউরোপে গুপ্তবিদ্যা, তন্ত্রশাস্ত্র এবং আলকেমির আধিপত্যও এই আখ্যানের নিয়ামক হিসাবে ভূমিকা পালন করতে পারে।
যা-ই হোক, ফাউস্ট সম্পর্কে সর্বপ্রথম লেখা ১৫৮৭ সালের দিকে প্রাপ্ত পুঁথিতে। ১৫৯২ সালের আগেই পুঁথিটি জনৈক পি. এফ. জেন্টের মাধ্যমে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। নাম ‘হিস্টোরিয়ে অব দ্য ডেমনেবল লাইফ এন্ড ডিজার্ভ ডেথ অব ডক্টর জন ফাউস্টাস’। খুব সম্ভবত বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মারলো এর মাধ্যমেও প্রভাবিত হয়েছেন। সেই প্লট অনুসরণ করে রচনা করেন ‘দ্য ট্রাজিক্যাল হিস্ট্রি অব ডক্টর ফাউস্টাস’। অন্যদিকে ইউহান উলফগ্যাং ভন গ্যোটে জার্মান হয়েও পড়েছিলেন মারলোর লেখা। দেখেছিলেন ফাউস্টকে কেন্দ্র করে নির্মিত নাটক। সকল কিছুর নির্যাস নিয়েই পরবর্তী জীবনে উপহার দেন জার্মান সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘ফাউস্ট’।
সাধারণ বয়ান
কিছুটা রকমফের পরিলক্ষিত হয় ফাউস্টের বর্ণনায়। গ্যোটের আখ্যানের শুরুটা স্বর্গে। ফেরেশতারা খোদার উপাসনা করছে। শয়তান মেফিস্টোফেলিস খোদার কাছে উত্থাপন করে অভিযোগ। দুনিয়ার মানুষ দুর্নীতিগ্রস্থ। চাইলে সে ডক্টর ফাউস্টের মতো জ্ঞানীকেও পথভ্রষ্ট করে দিয়ে প্রমাণ দেখাতে পারবে। খোদাও মেফিস্টোফেলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। নাহ, ফাউস্ট সৎ বান্দা হয়েই থাকবে।
পণ্ডিত মানুষ ফাউস্ট। তারপরও ভেতরে সীমাহীন শূন্যতা। নিজেকে হত্যা করতে গিয়েও ফিরে আসে। আলকেমি, চিকিৎসাশাস্ত্র কিংবা ধর্মতত্ত্ব পিপাসা পূরণ করতে পারে না। সবকিছু ফাঁপা আর অর্থহীন মনে হয়। ঠিক সেই সুযোগই কাজে লাগায় শয়তান মেফিস্টোফেলিস। ফাউস্টের সাথে কথা হয়। পণ্ডিতের বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে ভর্ৎসনা করে মেফিস্টোফেলিস। দেখায় নিজের অলৌকিক ক্ষমতা। চাইলে ফাউস্টও পেতে পারে এমন শক্তি, তার চেয়েও বেশি শক্তি। বিদ্যুৎ খেলে যায় পণ্ডিতের শিরায়। বিগত জীবনের দর্শন, চিকিৎসা এবং ধর্মতত্ত্ব তাকে হতাশ করেছে। অথচ এ তো সুবর্ণ সুযোগ। ফাউস্ট চায় সেই ক্ষমতা। মেফিস্টোফেলিসের আপত্তি নেই। সে তার সমস্ত শক্তি নিয়ে ফাউস্টের অধীন হয়ে ইচ্ছাপূরণ করে যাবে। কেবল একটা শর্ত। পরবর্তী অনন্ত জীবন ফাউস্টকে মেফিস্টোফেলিসের দাস হয়ে থাকতে হবে।
এই চুক্তি ফাউস্টের ভাগ্য বদলে দেয়। পরিণত হয় ইহজীবনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুরুষে। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে মেফিস্টোফেলিস প্রমাণ করে আনুগত্য। গ্রেচেন নামক তরুণীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ফাউস্ট। নিহত হয় গ্রেচেনের ভাই। অভিযুক্ত পণ্ডিত গা ঢাকা দেয় অনেকটা। অনুতপ্ত গ্রেচেন নিজের সন্তানকে হত্যা করে বসে। হত্যাকারী মাকে ধরে নিয়ে কারাগারে প্রেরণ করে মানুষ।
এদিকে ফাউস্টের স্বর্ণসময়। মেফিস্টোফেলিসের সহায়তায় গ্রেচেনকে বের করতে যায় কারাগারে। কিন্তু ক্ষমতায় তো সব হয় না। অনুশোচনায় নিজের ভাগ্য গ্রেচেন সমর্পণ করে দিয়েছে খোদার হাতে। পাপের মাথায় পৌঁছে হলেও আত্মসমর্পণ করেছে। ফলে ব্যর্থ হয় ফাউস্ট। মেফিস্টোফেলিসের মাধ্যমে ফিরে আসে নিজের জগতে। ক্রিস্টোফার মারলোর আঁকা ফাউস্টের সাথে অবশ্য ভালো আর মন্দ- দুই ফেরেশতা দেখা যায়। যারা প্রতিনিয়ত ফাউস্টকে নির্দেশনা দানের সংঘাতে লিপ্ত। বারবার ফাউস্ট মন্দ ফেরেশতার কথাই অনুসরণ করে। শয়তানও সহযোগিতা করে সকল ক্ষেত্রে। ফাউস্টের মেয়াদ পূর্ণ হলে মেফিস্টোফেলিস তাকে নিয়ে অনন্ত জাহান্নামে গমন করে। এবার বেচারা অনুতপ্ত হয় নিজের সিদ্ধান্তের জন্য।
দার্শনিকতা
ফাউস্ট আখ্যানের শুরু নৈতিক শিক্ষার অন্যতম চরিত্র হিসাবে। খোদার সাথে বিদ্রোহ কিংবা অবিশ্বাসীর পরিণাম নিয়ে ধর্মপ্রচারকগণই বহুল প্রচার করতেন। ফাউস্ট যেন পথভ্রষ্টতার একটা স্পষ্ট নজির, যে ইহজাগতিকতায় ডুবে গেছে। সাদামাটা চোখে তার মুক্তি অসম্ভব। কিন্তু পরবর্তী লেখকদের চিন্তায় তাকে মুক্তিও দেয়া হয়েছে। যেখানে ফাউস্ট দিনশেষ সুপথে ফিরে আসে। অর্জন করে খোদার সন্তুষ্টি।
মানুষের সীমাবদ্ধতা ফাউস্টকে প্রতিনিয়ত খুবলে খেয়েছে। সে এই বাধাকে অতিক্রম করতে চায়। শাসন করতে চায় দুনিয়াকে। মানুষ সত্তাগত ভাবেই ভুল করে। তাকে প্রতিনিয়ত ভালো আর মন্দের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে উপলব্ধি করতে হয়। বেছে নিতে হয় দুয়ের মধ্যকার যেকোনো একটা পথ। অজস্র লোভ আর আকর্ষণের পরেও দিনশেষে নিজের নৈতিক অবস্থানকে উচ্চে তুলে রাখতে হয়। মানুষ নিখুঁত না। সৎ হবার জন্য নিখুঁত হওয়া জরুরিও না।
গোটা আখ্যানে ফাউস্ট মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার সহজাত বৈশিষ্ট্যকেই প্রতীকায়িত করে। ভালো আর মন্দ- দুই ফেরেশতার দ্বন্দ্ব মূলত তার ভেতরকার সত্তার দুই রূপেরই দ্বন্দ্ব। প্রকৃতির বেধে দেয়া আইন লঙ্ঘনের পরিণাম শুভ না। ফাউস্টও প্রতিটি সীমালঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে গভীরতর অন্ধকারে তলিয়ে যায়। তার মানে ফাউস্ট হতাশাপূর্ণ কোনো চরিত্র না। অন্তত গ্যোটে ফাউস্টকে আশাবাদী হিসাবে উপাস্থাপন করতে চান। প্রতিষ্ঠা করতে চান বিশ্বশক্তির প্রধান নিয়ামক হিসাবে। খোদায়ী উত্তরাধিকারই মানুষকে দুনিয়ায় শাসক রূপে প্রতিষ্ঠিত করে।
প্রবচনসমগ্র
ফাউস্ট চরিত্র চিত্রিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি চরিত্রের দার্শনিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন অনেক রচয়িতা। ক্রিস্টোফার মারলো তাদের একজন। ভাষাগত দক্ষতায় তার মুন্সিয়ানা কেবল শেক্সপিয়ারের সাথেই তুলনীয়। ডক্টর ফাউস্টাস অনুসারে, মেফিস্টোফেলিসের সাথে চুক্তি করার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ফাউস্ট জিজ্ঞাসা করেছিলো-
– আচ্ছা মেফিস্টোফেলিস, আমার আত্মা দিয়ে তোমার প্রভুর লাভটা কী?
– তার সাম্রাজ্যের বৃদ্ধি।
– শুধু এই কারণেই তিনি আমাদের প্ররোচনা দেন?
– হতভাগার জন্য দুঃসময়ে সঙ্গী পাওয়াটা কম সান্ত্বনা না।
দোযখের প্রশ্নে মেফিস্টোফেলিসের উত্তর ছিল অনেকটা বাইবেলের পুনরুচ্চারণ। `অপরিশোধিত মানুষের জন্য সকল অবস্থাই দোযখে থাকা। ‘যখন সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, প্রত্যেকটা প্রাণীকে করা হবে পরিশোধিত। সেই সময়ে যা বেহেশত না, এমন প্রতিটা স্থানই দোযখ’। ফাউস্ট নিজেও বুঝতে পেরেছে তার বিচ্যুতি। বারবার দ্বিধা ফুটে উঠেছে কণ্ঠে। সবিশেষ অনুশোচনায় আর্তনাদ বের হয়েছে ঠোঁটে।
হায় শরীর, তুমি বরং বাতাস হয়ে যাও
না হলে লুসিফার তোমায় দোযখে নিয়ে যাবে।
হায় আত্মা, পরিণত হয়ে যাও ক্ষুদ্র পানিবিন্দুতে,
তারপর সমুদ্রে মিশে যাও, যেন আর খুঁজে পাওয়া না যায়।
ওহ খোদা, আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ো না,
হে সাপ আর বিচ্ছুরা, আরেকটু সময় দাও,
উন্মোচিত হয়ো না দোযখের দুয়ার, এসো না লুসিফার,
আমি আমার বই পুড়িয়ে ফেলবো! আহ, মেফিস্টোফেলিস!’
গ্যোটের উচ্চারণ আরো সাহসী। ‘যতক্ষণ অব্দি নিজেকে বিশ্বাস করবে, ততক্ষণ তুমি জীবনযাপনের তরিকা সম্পর্কে জ্ঞাত।’ ‘মানুষ দুনিয়ায় মূলত তা-ই প্রত্যক্ষ করে, যা সে অন্তরে ধারণ করে।’ গ্যোটের ফাউস্টের কণ্ঠে তাই যেন প্রকৃত রেনেসাঁ পুরুষেরই প্রতিধ্বনি-
মানুষের নিয়তি যেটাই হোক,
আমি সত্তার গভীর থেকে স্বাদ নিতে চাই।
জড়িয়ে ধরতে চাই সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন বিন্দু,
চাই বুকে ধারণ করতে সমস্ত সুখ ও দুঃখকে।
স্বীয় সত্তাকে এভাবে সর্বোচ্চ সক্ষমতায় বর্ধিত করতে।
সবিশেষ সকল কিছুর সাথে তলিয়ে যেতে।
ফাউস্টের আবেদন তারুণ্যের জন্য। ‘আমার কিছু ছিলো না। কিন্তু যৌবনের জন্য তা পর্যাপ্ত- মায়ার মধ্যে উচ্ছ্বাস, সত্যের প্রতি তীব্র পিপাসা। দাও অপ্রতিরোধ্য পুরোনো আবেগ, বেদনার তল স্পর্শকারী সুখ, ঘৃণা করার ক্ষমতা এবং ভালোবাসার গভীর একনিষ্ঠতা। উফ, ফিরিয়ে দাও আমার যৌবন’।
অবশেষ
অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছে। বদলেছে ইউরোপ, বদল ঘটেছে খোদ খ্রিষ্টধর্মের। তাই ফাউস্টের পরিণতিতেও পরিবর্তন ঘটেছে। রেনেসাঁ পরবর্তী ইউরোপে মানবতাবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, ইহজাগতিকতার প্রসার ঘটেছে। চার্চের খড়গ সরিয়ে রেখেছে একপাশে। ফাউস্ট যেন ইউরোপ নিজেই। পাঁচ শত বছর ধরে ইউরোপের পোপশাসিত সমাজব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজে রূপান্তরের স্বাক্ষর বহন করে। তাই আধুনিক চলচ্চিত্র, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, চিত্রকলা, গান, এমনকি কমিক বুকেও উঠে আসে ফাউস্টের প্রসঙ্গ।
ফাউস্ট খোদা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পার্থিবতাকে আঁকড়ে ধরেছিল। ইউরোপ সেভাবেই ধর্মকে পাশ কাটিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পার্থিব প্রতিষ্ঠাকে জড়িয়ে ধরেছে। ফাউস্টের পরিণাম কোথাও শুভ এবং আশাবাদী; কোথাও ধ্বংসাত্মক এবং নৈরাশ্যবাদী। তাহলে ইউরোপের পরিণাম কোথায় ঠেকবে? বাইবেল বলছে, ‘আত্মার অপমান করে সারা দুনিয়ার মালিক হলেই দিন শেষে লাভটা কী’?