প্রাচীনকালে মানুষ প্রকৃতির ওপরই ছিল পুরোপুরি নির্ভরশীল। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ ছিল বড় অসহায়। আর তাই প্রকৃতির দেবীকে তুষ্ট করার জন্য তারা সবসময়ে সচেষ্ট থাকতো। প্রকৃতির দেবীকে তুষ্ট করার জন্য সে যুগের মানুষেরা একধরনের নৃত্য কৌশলের মাধ্যমে সমবেতভাবে তাদের প্রার্থনা জানাতো। আবার যখন প্রকৃতি ফুলে-ফলে-শস্যে ভরে উঠতো, তখন তাদের মনের আনন্দ প্রকাশ এবং প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য সেসব মানুষেরা ভাব প্রকাশর হাতিয়ার হিসেবে সেই নাচেরই আশ্রয় নিতো।
আনন্দে, আবেগে, উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে ও ভয় দূর করতে নাচই ছিল সেসময়কার মানুষদের একমাত্র অবলম্বন। সেই নাচের মধ্য দিয়ে তারা ফুটিয়ে তুলতো পশু-পাখির চলার ছন্দ। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের লোকনৃত্য সৃষ্টির মূলে ছিল এই ধরনের আদিম বিশ্বাস।
ছৌ নাচ বা ছোনাচ বা ছনাচ তেমনি এক জনপ্রিয় লোকনৃত্য। ছৌ নাচ বহু প্রাচীন এক লোকনৃত্য। এই বিশেষ ধরনের লোকনৃত্য সূচনালগ্ন থেকে এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। এই নাচের মধ্যে আদিম সমাজের নানা চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। আদিম যুগে শিকার ছিল মানুষের জীবনযাত্রার অন্যতম অঙ্গ। প্রাচীনকালের মানুষদের দুর্গম বনে-জঙ্গলে গিয়ে শিকার করাই ছিল বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। তাই শিকারের যাওয়ার পূর্বে নিজেদের উদ্দীপ্ত করার জন্য তারা নাচানাচি করতো এবং বিভিন্ন পশুপাখির নানা অঙ্গভঙ্গি নাচের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতো, যা একসময় ছৌ নাচের অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল।
যুদ্ধের নানা কৌশলও ছৌ নাচের বিশেষ অঙ্গ। আদিম সমাজে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং আত্মরক্ষার কৌশল আবিষ্কারের নেশায় যুদ্ধের বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করে আদিম যুগের মানুষেরা। পরবর্তী সময়ে এই কৌশলগুলি ছৌ নাচে দৃশ্যায়িত হতে থাকে। আদিবাসী যুদ্ধনৃত্য হিসেবে ছৌ নাচের বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। তাই এই নাচের বিভিন্ন পদক্ষেপে লুকিয়ে রয়েছে বীরপুরুষের ভঙ্গি।
ছৌ নাচের আসল রূপ প্রকাশ পায় খোলা মাঠে। তবে আজকাল মঞ্চেও ছৌ নৃত্যের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেসব শিল্পী ছৌ নাচ পরিবেশন করেন, তারা সকলেই কিন্তু পুরুষ। পুরুষ শিল্পীরাই মহিলার বেশ ধারণ করেন। তবে বর্তমানে ছৌ নাচের প্রদশর্নীতে মহিলারাও অংশ নিচ্ছে। পুরুলিয়ার প্রবাদপ্রতিম একজন ছৌ-শিল্পী ছিলেন গম্ভরি সিংহ মুড়া। তিনি ছৌ নাচকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে মানুষ যখন কৃষি নির্ভর অর্থনীতির মধ্যে প্রবেশ করলো, তখন ভাল ফসলের কামনায় প্রকৃতির দেবীর কাছে নৃত্যের মধ্য দিয়ে বৃষ্টি আনার প্রার্থনা করতো। তারা মনে করতো, নাচের মাধ্যমে তারা বৃষ্টি আনতে পারবেন এবং তার ফলে এই পৃথিবী হয়ে উঠবে শস্যশ্যামল।
সাধারণত চৈত্র পরব বা শিবের গাজন উপলক্ষে ছৌ নাচের অনুষ্ঠান হয়। রুক্ষ, শুষ্ক, অনুর্বর প্রান্তরে বৃষ্টি আনার জন্য চৈত্র মাস থেকে জৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ছৌ নাচের আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, ঝাড়খন্ডের সরাইকেল্লা কিংবা ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের মতো জায়গা রুক্ষ, শুকনো অঞ্চল হিসেবেই পরিচিত। অনাবৃষ্টি বা খরা এসব অঞ্চলের একটি বড় সমস্যা। ফলে সেখানে চাষবাসকে জীবিকা হিসেবে যারা বেছে নিয়েছেন, তাদের কাছে অনাবৃষ্টি মানে অভিশাপ। আর তাই তারা ছৌ নাচের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির দেবীকে সন্তুষ্ট করতে চায়, যেন তাদের উষর, রুক্ষ ভূমিতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হয় এবং ভূমিগুলো শস্যে ভরে ওঠে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এই ঐতিহ্যবাহী ছৌ নাচে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। চিরাচরিত পৌরানিকতার সঙ্গে সমসাময়িক নানা ঘটনা ও দৈনন্দিন জীবনের নানা দিকও প্রাধান্য পাচ্ছে ছৌ নাচের পালায়।
ছৌ নাচের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিয়ে নানা মত প্রচলিত রয়েছে। কারো মতে, ‘ছায়া’ শব্দটি থেকে ‘ছৌ’ শব্দটির উৎপত্তি। আরেক পক্ষ মনে করে, ‘ছম’ শব্দ থেকে ‘ছৌ’ শব্দটি এসেছে। আবার কারো মতে, ‘ছৌ’ শব্দের আঞ্চলিক অর্থ ছলনা বা সং। চোখে-মুখে রং মেখে, ঝকঝকে পোশাক পরে কোনো দেব-দেবী কিংবা পশু-পাখির ছদ্মবেশ ধারণ করাকে বলা হয় সং সাজা। কেউবা বলেন, ‘ছৌ’ শব্দটি এসেছে ‘ছাউনি’ থেকে। ছাউনি শব্দের আক্ষরিক অর্থ অবশ্য সৈন্যবাহিনীর ঘাঁটি বা সেনানিবাস। কারণ ছৌ নাচের বিষয়বস্তুর সঙ্গে যুদ্ধের সম্পর্ক রয়েছে। প্রাচীন যুগে সৈন্যরা যুদ্ধের সময় এরকম মুখোশের আশ্রয় নিত। কেউ আবার বলে, তিব্বতের ‘ছামনৃত্য’ থেকে এর উৎপত্তি। এই ছামনৃত্যও একধরনের মুখোশ-নৃত্য।
পুরুলিয়া ও ময়ূরভঞ্জের মুন্ডা শব্দমালার ‘ছক’ বা ‘ছট’ শব্দ থেকে ‘ছৌ’ শব্দের উৎপত্তি বলে আবার অনেকে মনে করেন। তবে ওড়িয়া ‘ছও’ (ছলনা) শব্দটি সীমান্ত বাংলায় ‘ছো’ রুপে উচ্চারিত হওয়ায় তা থেকে এই নৃত্যের নামকরণ ছো হয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. সুধীর করণ। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য সর্বপ্রথম ছ বা ছো নাচের পরিবর্তে ছৌ নামটি ব্যবহার করেন এবং দেশে-বিদেশে এই নামে পরিচিতি পেতে থাকে এই লোকনৃত্যটি। মুন্ডা, কুড়মি, হো, সাঁওতাল, ওরাওঁ, ডোম ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীর জনগণই মূলত ছৌ নাচের ধারক ও বাহক।
এই নাচের উৎপত্তিস্থল পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড-ওড়িশার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে। তবে কথিত রয়েছে, এই নাচের আদি উৎপত্তি স্থল ওড়িশার সাবেক দেশীয় রাজ্য ময়ূরভঞ্জে। ছৌ নাচের উৎপত্তি ও বিকাশের স্থল অনুযায়ী বিভিন্ন ঘরানার মধ্যে অনেক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়। পুরুলিয়া ছৌ নাচের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায়। উৎকর্ষের দিক দিয়ে পুরুলিয়া ছৌ নাচের গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। সরাইকেল্লা ছৌ নাচের উৎপত্তি অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সরাইকেল্লা খরসাওয়াঁ জেলার সদর সরাইকেল্লায়। এই ছৌ নাচে সূক্ষ্মতা ও গাম্ভীর্য অনেক বেশী। ময়ূরভঞ্জ জেলায় ময়ূরভঞ্জ ছৌ নাচের উৎপত্তি। বীররস ও শৃঙ্গার রসের এক অপূর্ব মিলন দেখতে পাওয়া যায় সরাইকেলা ও ময়ূরভঞ্জ ছৌ নাচে।
ছৌ নৃত্যের বিশেষ প্রয়োজনীয় অংশ হলো মুখোশ। তবে পুরুলিয়া আর সরাইকেল্লা ছৌ-তে মুখোশের ব্যবহার করা হলেও, ময়ূরভঞ্জ ছৌ-তে মুখোশের প্রচলন নেই।
ছৌ নাচের আরেকটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো নানা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। গান-বাজনা সহযোগে এই লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়। নাচের শুরুতে গণেশ বন্দনার মধ্য দিয়ে বাজনাদারেরা নাচের পরিবেশ সৃষ্টি করেন। ঢোল, মাহুরি, চড়চড়ি, ধামসা প্রভৃতি ছৌ নাচের চিরাচরিত বাদ্যযন্ত্র। বর্তমানে নানা আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন- সানাই, পাখোয়াজ, বাঁশি, মৃদঙ্গ প্রভৃতি।
পুরুলিয়ার ছৌ নাচে বর্ণময় মুখোশের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। এই কারুকার্যময় মুখোশ তৈরি করতে অনেকদিন সময় লাগে। হাতের কাছে পাওয়া জিনিসপত্র দিয়েই তৈরি করা হয় ছৌ নাচের মুখোশ। কাগজের মণ্ড দিয়ে ছাঁচে ঢেলে মুখের আদল দেয়া হয়। তারপর মুকুট, চুমকি , কাপড়ের লেইস বসিয়ে সেটাতে অলঙ্করণ করা হয়।
আকারে বেশ বড় হয় মুখোশগুলো। মুখোশের আড়ালে নৃত্যশিল্পীর মুখ লুকানো থাকায় ছৌ নাচে মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। তাই ছৌ নাচে শিল্পীরা হাত-পা-বুক-কোমর প্রভৃতি শরীরের অন্যান্য অংশগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকেন। রংচঙে পোশাক আর মুখোশ পরে ছৌ-শিল্পীরা যখন খোলা মাঠে নৃত্য পরিবেশন করেন, তখন অতি মনোরম লাগে সেই দৃশ্য।
নিপুণ দক্ষতায় ছৌ-শিল্পীরা তাদের নাচের মাধ্যমে বীররস ফুটিয়ে তোলেন। প্রাচীন যে বিশ্বাস থেকে, অর্থাৎ অশুভ শক্তিকে পরাজিত করবার জন্যে মানুষ একদিন নৃত্যের আয়োজন করেছিল, সেই বিশ্বাস আজও ছৌ নাচের মধ্যে ধরা পড়ে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এই ঐতিহ্যবাহী ছৌ নাচে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। চিরাচরিত পৌরানিকতার সঙ্গে সমসাময়িক নানা ঘটনা ও দৈনন্দিন জীবনের নান দিকও প্রাধান্য পাচ্ছে ছৌ নাচের পালায়।
শাস্ত্রীয় ও লোকনৃত্যের এক অপার বন্ধনে গড়ে ওঠেছে এই অনন্য নৃত্যশৈলী, যা সময়ের সাথে সাথে হয়েছে আধুনিক এবং অভিনবত্বে মোড়া। আর তাই এই লোকনৃত্য দেশে-বিদেশে আজও সমাদৃত। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছে এই ছৌ নাচ।
ফিচার ইমেজ- flickr.com