জন্মেছিলেন ১৯৯৭ সালে। সে হিসেবে ২০১৮ এর শুরুতে কত বছরই বা বয়স হবে? বিশ? জীবনের অল্প সময়েই যেন গভীর পরিপক্বতা অর্জন করেছিলেন চিত্রশিল্পী আফ্রিদা তানজিম। তার প্রতিভা সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করে নাদিয়া ইসলাম বলেন–
“উনার আঁকা ছবি দেখতাম আর ভাবতাম এত কম বয়সে এত প্রজ্ঞা উনি কোথায় পেলেন। … ভাবতাম, ২০ বছরের একটা ভাসা ভাসা চোখের বাচ্চা মেয়ে কোন চিন্তার গভীরতায়, কোন শৈল্পিক পাগলামীতে, কোন একাকীত্বের নিঃসঙ্গতায়, কোন সৃষ্টিতত্ত্বের সন্ধানে এমন জিনিস সৃষ্টি করতে পারেন? ভাবতাম আর অবাক হতাম আমি।”
জানুয়ারির ১২ তারিখে কলা কেন্দ্রে একটি একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজনও করেছিলেন। ঐ প্রদর্শনীর নাম ছিল ‘লস্ট ইন ট্রানজিশন’। শিল্পী হিসেবে নিজের শিল্প নিয়ে খুব বেশি সন্তুষ্ট না হলেও অসন্তুষ্ট ছিলেন না নিজের প্রতি। তার ভাষায়, “…it’s (the paintings) neither bad, nor even good enough“। তার প্রতিটি চিত্রই যেন এক একটি যান্ত্রিক হাহাকার। এমন বয়সে শিল্পী জীবনের এমন অর্জন নিঃসন্দেহে অসাধারণ। কিন্তু সে অসাধারণের ভুবনে বেশি দিন বিচরণ করতে পারেননি শিল্পী আফ্রিদা তানজিম। জীবনের ব্যস্ততম রাজপথকে বিদায় দিয়ে চলে গেছেন চিরকালের জন্য। ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে সঙ্গ করেছেন এ জীবনের লীলা।
শিল্প জগতে খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না। তবে একেবারে অপরিচিতও ছিলেন না। অনেক শিল্পবোদ্ধা মানুষ তার কর্ম সম্পর্কে জানতেন। তার এমন আত্মহননে আফসোস ভরা ব্যথা নেমে এসেছে তাদের মাঝে। আহারে, এমন মেধা কি দিনকে দিন আসবে? এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় না’ক আর। শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনার জন্য সুযোগ পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। মাসখানেক বাদেই যাবার কথা ছিল। এ মেধা যদি আরো অনেকদিন বেঁচে থাকতো আর পূর্ণ স্বাধীনতায় বিকশিত হতো তাহলে এ ভুবন নিঃসন্দেহে অনেক অসাধারণ কিছু পেতো।
আফ্রিদা সম্পর্কে বিডি আর্টস-এ রনি আহম্মেদ বলেন–
যেখানে সব পথ শেষ হয়ে যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে আফ্রিদা আমাদের বলতে চায়, দেখো, বিশ্বের এ অন্ধকারের জন্য তোমরা সবাই দায়ী! তার মৃত্যুর জন্য সমাজের সবাই; আমরা কোনো না কোনো ভাবে দায়ী ও যুক্ত সে কথাটি বলে দেয়। আফ্রিদার প্রত্যেকটি ছবি মূলত একটি চিৎকার। এই চিৎকার আধুনিক সমাজের চাপে পিষ্ট হয়ে যাওয়া বন্দি মানুষের কান্না ও আহাজারি। যেখানে মানুষ পরিচয়হীন, রাষ্ট্রহীন, ধর্মহীন, যেন অস্তিত্বহীন এক জীব। অথচ ক্ষমতার কণ্ঠস্বর তাকে বার বার বলছে তোমার রাষ্ট্র আছে, অস্তিত্ব আছে, পরিচয় আছে, যদিও সে আশ্বাস মূলত সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং মুনাফা লাভের ধূর্ত স্লোগান।
এখানে শিল্পীর কিছু চিত্রকর্ম তুলে ধরা হলো।
আফ্রিদার চিত্রকর্ম সম্পর্কে রনি আহম্মদ আরো বলেন,
আফ্রিদা মনুষ্য মনের মধ্যে শয়তানের সত্ত্বা অনুসন্ধান করতে সক্ষম হয়েছে। এমন দানব যা সমস্ত মন্দ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে! যা অবিরাম দুঃখের জন্ম দেয়। মানুষের, মনস্তাত্ত্বিক অন্ধকারাচ্ছন্ন যে সত্তাকে আফ্রিদা উন্মোচন করেছে তা শয়তান দ্বারা আবৃত মানুষের মনের অন্ধকার দিক। …তার ছবির ফিগারসমূহ কখনো কখনো বাস্তবতার ব্যাকরণ মেনে চলে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে অন্য জগৎকে নিয়ে আসতে চায়। রং ও কম্পোজিশনে এক ধরনের বিষণ্ন মায়াময় পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়, যার অন্তরালে মৃত্যুর হাতছানি সহজেই লক্ষ্যণীয়। এ যেন মানুষের অবদমিত কামনা বাসনা, মৃত্যুপ্রসূত এক গোলকধাঁধার বিশ্ব!
নীচের এই ছবিটিও আফ্রিদার আঁকা। এ ছবিটি যেন অন্য সকল ছবি থেকে আলাদা। এটি যেন আটকে থাকা এক অসহ্য চিৎকার। এটি দেখে কবি ওমর শামস্ দুঃখ করে বলেছিলেন, এ ছবিতে মেয়েটির আত্মহননের পূর্বচিহ্ন স্পষ্ট। কেউ দেখেনি? ছবিতে উল্টো হয়ে বসে থাকা লোকটিই যেন বলে দিচ্ছে আফ্রিদার মনের অবস্থা আর আত্মহত্যার কারণ।
এদিকে শোকে ভেঙ্গে পড়েছেন আফ্রিদার মা রহিমা আফরোজ মুন্নি। তিনি নিজেও একজন লেখক। ২০ বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা তার আদরের মূর্তিটি এভাবে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। চলে যাওয়া মেয়েকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলছেন–
২০টা বছর ধরে তোর মূর্তি আমি একটু একটু করে গড়েছি, কত যত্নেরে বাবু, অন্তত সেটা ভেবে একটু ছাড় দিতি সোনা। তুই জানিস? কয়দিন আগেও আমার ইচ্ছা করছিল এইরকম নিজেকে হাপিস করে দেই। এই কদাকার দুনিয়ায় কী আছে যার জন্য বেচে থাকব? হঠাৎ মনে হলো সামনে তোর এক্সিবিশন, তারপর চলে যাবি বাইরে, এ সময় ঠিক হবে না করা। আচ্ছা বুঝলাম তোর হাসি পাচ্ছে, বাহানা ভাবছিস আমার, হয়তো তা-ই। ইচ্ছা আমার এমন কতবার করলো, চেষ্টাও কমবার করিনি, কিন্তু সত্যি বাবু তোর মতো বুকের পাটা নাই আমার।
চিত্রকলাতেই স্বাচ্ছন্দ খুঁজে পেতেন আফ্রিদা। তার কাছে চিত্রকলা যেন ছিল এক আশ্রয়। “আমি আঁকি, কারণ এই কাজে নিজেকে কখনও জোর করতে হয় না। শিল্প আমাকে অভিভূত করে এবং ভাসমান আবেগ ও আমার অস্তিত্বহীন ভাবনার সমাধিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সময়ের উপলব্ধি আমার কাছে অস্পষ্ট কিন্তু সুখ পাই এই ভেবে যে আমার বর্ণগুলো মনে ধরে আছে”– নিজের কর্ম সম্পর্কে এমনই বলছিলেন আফ্রিদা। জাগতিক অন্য সবকিছু যখন তাকে নীরব রাখতো তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে ব্যস্ত রাখতো রং তুলি। তার ভাষায় “আমার আর্ট আমার অস্তিত্বের জানান দেয়, আমার শত না বলা গল্পের প্রতিচ্ছবি হলো আমার আর্ট।” শত না বলা গল্প নিজের বুকে চেপে নিয়ে গত ১৫ জানুয়ারিতে মায়ার এ জগত ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। একটি ফুল উন্মোচিত হতে হতেই যেন ঝড়ে গেল। এ আফসোস কোনোদিন পূরণ হবার নয়।
ফিচার ছবি- আফ্রিদা তানজিমের ডিভাইন আর্ট একাউন্ট থেকে সংগৃহীত