হলিউড সিনেমার কল্যাণে জম্বি এখন আমাদের খুব পরিচিত একটি ভৌতিক সৃষ্টি। অসংলগ্ন পদক্ষেপ, পচন ধরা দেহাবশেষ, গোঁ-গোঁ শব্দ, ছেঁড়া পোশাক, মানুষের মৃতদেহ থেকে মাংস খুবলে খাওয়া, হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে শরীর থেকে মাংস আলাদা করে নেওয়া; জম্বি কথাটি শুনলে আমাদের মনে এসব দৃশ্যপটই ফুটে ওঠে। কখনো খুব ধীর, আবার কখনো উসাইন বোল্টকে হারিয়ে দেওয়ার মতো দৌড়- সিনেমায় জম্বির প্রকাশে এগুলো চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। কোথা থেকে এলো জম্বি চরিত্র, প্রথম কবে কোথায় জম্বির উৎপত্তি? অথবা জম্বি কি হলিউডের নিজস্ব উদ্ভাবন? মগজখেকো জম্বিকে নিয়ে এসব প্রশ্ন কি কখনো আপনার মগজে খেলে গিয়েছে? সেসব প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়া হবে এই লেখায়।
জম্বি কী?
‘জম্বিল্যান্ড’-এ ডুব দেওয়ার আগে জম্বি সম্বন্ধে একটু জেনে নেওয়া যাক। এক কথায় বলতে গেলে, জম্বি মানে জিন্দালাশ। যে লাশ মৃত্যুর পর আবার জেগে ওঠে তা-ই জম্বি হিসেবে পরিণত হয়। জম্বি শব্দটির উৎপত্তি পশ্চিম আফ্রিকার দুটো ভাষা থেকে। গ্যাবন-এর মিতসোগো ভাষায় ‘জুম্বি’ (ndzumbi) মানে হলো ‘লাশ’। আবার কঙ্গো ভাষায় ‘জাম্বি’ (nzambi) মানে হচ্ছে ‘মৃত ব্যক্তির আত্মা’। জম্বি না মৃত, না জীবিত; বলা যায় জীবন্মৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবিত ও মৃত ছোটগল্পটির মূল আভাসের সাথে জম্বির ধারণার বেশ মিল রয়েছে। ওই গল্পের প্রোটাগনিস্টকে ভুলে মৃত ভেবে শ্মশানে পাঠানো হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি জেগে উঠে নিজের বাড়িতে ফিরে যান। তবে তার আচরণ ওপরে বর্ণিত জম্বির মত হয়ে যায়নি কারণ তিনি প্রকৃত অর্থে কখনো মৃত্যুবরণ করেননি।
জম্বি কিংবদন্তির দুটো আলাদা আলাদা রূপ (Archetype) রয়েছে। এর আদি উৎপত্তিতে দেখায় যায়, ন্যাক্রোমেন্সার বা জাদুকরেরা মৃত ব্যক্তিকে মন্ত্রবলে পুনরুজ্জীবিত করে নিজেদের দাস হিসেবে ব্যবহার করতেন। অধুনা পশ্চিমা জম্বি ন্যারেটিভে জম্বি সৃষ্টির জন্য জাদুবিদ্যার প্রয়োজন পড়ে না। এখানে জম্বির উত্থান হতে পারে ভাইরাসের কারণে, তেজস্ক্রিয়তার কারণে, অন্য জম্বির কামড়ের কারণে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ভুলের কারণে ইত্যাদি। তবে দু’ধরনের জম্বিরই কিছু সমধর্মী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জম্বির নিজের ইচ্ছায় পরিচালিত হওয়ার অপারগতা, সারাক্ষণ মানুষের মাংস খেতে চাওয়া, স্খলিতপদ ইত্যাদি।
জম্বির উৎপত্তি
আপনি যদি জম্বি নামের এই ভীতিকর সৃষ্টিকে হলিউড থেকে চিনে থাকেন তাহলে আপনার মনে হতেই পারে জম্বি হয়তো পশ্চিমা ফোকলোরের নিজস্ব দানব। মূলত জম্বির ধারণাটি বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে পশ্চিমা শিল্পমাধ্যমই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। তবে জম্বির শেকড় খুঁজতে গেলে আমাদেরকে যেতে হবে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশ হাইতিতে। সতের বা আঠার শতকের হাইতি তখন ‘সেইন্ট-ডমিংগ’ নামে পরিচিত ছিল। ফ্রান্সের অধীনে থাকা হাইতিতে আখের আবাদ ও চিনিকলে কাজ করার জন্য আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের দাস হিসেবে আনা হতো। সেসময়ের আর সব শ্বেতাঙ্গ দাসমালিকের মতো ফরাসিপ্রভুরাও ছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তাদের নিষ্ঠুরতার মাত্রা এতটাই নির্মম ছিল যে আফ্রিকা থেকে আনা শ্রমিকদের অর্ধেকই কাজ করতে করতে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন।
এই হতভাগ্য শ্রমিকেরা বিশ্বাস করতেন মৃত্যুই ছিল তাদের একমাত্র মুক্তি। তারা মনে করতেন মৃত্যুর পর তাদের পুনর্জন্ম হবে ‘ল্যান গিনি’ তথা গিনি বা আফ্রিকাতে। সেখানে তারা মুক্ত মানুষ হিসেবে জন্ম নেবেন। কিন্তু এই স্বাধীনতা লাভের জন্য আত্মহত্যা করা যাবে না। কারণ আত্মহত্যা করলে মুক্তি তো মিলবেই না বরং ওই পুরনো দেহপিঞ্জরেই আত্মাছাড়া অবস্থায় অনন্তকালের জন্য আটকে থাকতে হবে। আত্মহত্যার এই শাস্তিটুকুই হচ্ছে জম্বিতে রূপান্তরিত হওয়া।
‘আত্মারাম খাঁচাছাড়া’ বলে বাংলায় একটা প্রবাদ রয়েছে। জম্বি মানেও একটি দেহরূপ খাঁচা যার ভেতরে প্রাণ বা আত্মার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু বাংলায় প্রবাদটি কিছুটা হাস্যরসের ছলে বলা হলেও হাইতিয়ান জম্বির ক্ষেত্রে এটি বেশ করুণ একটি বিষয়।
১৭৯১ সালে হাইতিতে বিপ্লবের মাধ্যমে ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তিকে উৎখাত করা হয়। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর ১৮০৪ সালে সেইন্ট-ডমিংগো নাম থেকে পরিবর্তিত হয়ে হাইতি প্রথম স্বাধীন কৃষ্ণাঙ্গ দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। জম্বি কিংবদন্তি তখন হাইতিয়ান লোকগাথার অংশ হয়ে যায়। ভুডু ধর্মবিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত এই কিংবদন্তিতে মনে করা হয়, জম্বি তৈরির কারিগর হচ্ছেন খারাপ জাদুকর বা ডাইনি। এই জাদুকরেরা বকর (Bokor) নামে পরিচিত। বকররা মৃত মানুষকে জড়িবুটি দিয়ে জীবিত করে জম্বি বানিয়ে নিজেদের দাস হিসেবে ব্যবহার করতেন।
ভুডু বকর ও কালাজাদু বিশ্বাসের জম্বির এই রূপান্তরিত রূপটিই আমেরিকান সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে। কালো জম্বি এরপর সাদা জম্বিতে পরিণত হয়। কিছু বই ও কয়েকটি হলিউড সিনেমার মাধ্যমে জম্বি ধীরে ধীরে মার্কিন সমাজে বিস্তার লাভ করে। এরপর সময়ের সাথে সাথে ইউরোপ পেরিয়ে এশিয়াতেও পৌঁছে যায় জম্বি কিংবদন্তি।
জম্বির ‘গ্রিন কার্ড’
ইউরোপের কাছে স্বাধীন হাইতি তখন লজ্জা ও পরাজয়ের জ্বলজ্বলে বাস্তবতা। তাই হাইতিকে ইউরোপীয়রা দেখতে থাকে নৃশংসতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, মৃত্যুর দেশ হিসেবে। বিশ শতকের শুরুতে, ১৯১৫ সালে আমেরিকা হাইতি দখল করে। ‘আধুনিকায়নের’ উদ্দেশে সেখানে গেলেও দেখা যায় হাইতির নিজস্ব জম্বি সংস্কারকেই সাথে করে নিয়ে এসেছে আমেরিকানরা। ১৯২০ ও ‘৩০-এর দশকের মার্কিন পাল্প ম্যাগাজিনগুলোর বর্ণনায় ফুটে ওঠে কীভাবে প্রতিহিংসাপরায়ন জিন্দালাশ কবর থেকে উঠে তাদের খুনীদের তাড়া করছে সে গল্প। কিন্তু জম্বিকে মার্কিন মুলুকে আরও পাকাপোক্ত আসন দেওয়ার কাজটা করে কয়েকজন লেখক, ও হলিউড।
’২০-এর দশকের শেষের দিকে দুজন মার্কিন লেখক হাইতি ভ্রমণ করেন। ১৯২৭ সালে হাইতিতে যান উইলিয়াম সিব্রুক। তিনি যথেষ্ট গুণধর ছিলেন এবং ভ্রমণ-লেখক, সাংবাদিক, অকাল্টিস্ট ইত্যাদি গুণের সাথে সাথে মদ্যপানেও তার বিশেষ প্রতিভা ছিল। হাইতি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দ্য ম্যাজিক আইল্যান্ড (১৯২৯) নামে একটি বই লিখেন। সিব্রুক নিজেকে ‘নিগ্রোফাইল’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। নিগ্রোফাইল তাদেরকে বলা হয় যারা নিজের সুখী জীবনকে ত্যাগ করে ‘আদিমতা’কে আঁকড়ে ধরে আরাম পান। অন্য অর্থে বলা যায়, যেসব শ্বেতাঙ্গ নিজেদের আয়েসী জীবনের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের কষ্টের জীবনকে বেশি পছন্দ করেন তারাই নিগ্রোফাইল। সিব্রুক হাইতিতে গিয়ে ভুডু ধর্মের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তার বইয়ের একটি চ্যাপ্টার, ‘ডেড ম্যান ওয়ার্কিং ইন কেইন ফিল্ডস’, এ তিনি জম্বি দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। হাইতিয়ান-আমেরিকান সুগার কর্পোরেশন-এর আখের আবাদে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জম্বি দেখানোর জন্য। এই জম্বিরা রাতের বেলায় ওই বাগানে কাজ করে।
‘ওদেরকে দেখেই মনে হচ্ছিল ওরা মানুষ নয়, জানোয়ারসদৃশ। খুব ধীরে ধীরে একনাগাড়ে মেশিনের মতো কাজ করে যাচ্ছিল। তাদের চোখগুলো ছিল ভয়ংকর কুৎসিত। সত্যি বলতে কী, ওই চোখগুলো দেখলেই মনে হচ্ছিল যেন একেবারে মরা মানুষের চোখ; অন্ধ নয়, অথচ কোনো দিকে তাকাচ্ছেও না, দৃষ্টিহীন, নিষ্প্রাণ।
কিছুক্ষণের জন্য থমকে যান সিব্রুক। তার মনে হলো এতদিন যা শুনেছিলেন হাইতির জম্বি কুসংস্কার নিয়ে, তার সবটাই সত্যি। পরে ধাতস্ত হয়ে এর ব্যাখ্যায় পৌঁছান তিনি: জম্বিটম্বি কিছুই নয়, স্রেফ একদল নির্বোধ, উন্মাদ মানুষ যাদেরকে দিয়ে জোর করে কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
হাইতি ভ্রমণকারী দ্বিতীয়জন ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ ঔপন্যাসিকা জোরা নিল হার্সটন। ’২০-’৩০-এর দশকের হার্লেম নবজাগরণের অনেক প্রথিতযশা কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যিকই হাইতিকে নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। ভুডু ধর্মযাজক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য পেশাদার নৃতাত্ত্বিক হার্সটন হাইতিতে তিন মাস অবস্থান করেন। ১৯৩৭ সালে লেখা তার বই টেল মাই হর্স-এ হার্সটন জম্বির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং স্পষ্ট করে তিনি কীভাবে জম্বিকে ছুঁয়ে দেখেছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছিলেন।
একটি সাক্ষাৎ জম্বিকে দেখা ও স্পর্শ করার বিরল সুযোগ হয়েছিল আমার। এর গলার ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বর শুনলাম, এবং তারপর আগে যেটা কেউ করে উঠতে পারেনি সে কাজটাই করলাম। আমি এর ছবি তুললাম।
কিন্তু যার ছবি হার্সটন তুলেছিলেন তিনি অবশ্য একজন সাধারণ মানবিই ছিলেন। বেচারীর নাম ছিল ফেলিসিয়া ফেলিক্স-মেন্টর। তাকে সমাজ থেকে একঘরে করা হয়েছিল। তার জায়গা হয়েছিল মানসিক হাসপাতালে।
এ প্রসঙ্গে বাংলা অঞ্চলের ডাইনিদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সমাজে ডাইনিদের খুব একটা সমাদর ছিল না। তারাশঙ্করের লেখা স্বর্ণ ডাইনির গল্প-এর প্রথম কয়েকটা লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি।
স্বর্ণ ডাইনিকে মনে পড়ছে।
শুকনো কাঠির মতো চেহারা। একটু কুঁজো, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, হাটে তরি-তরকারি কিনে গ্রামের ঘরে ঘরে বেচে বেড়াতো। চোখ দুটো ছিল নরুনে – চেরা চোখের মতো ছোট। দৃষ্টি তীক্ষ্ণই ছিল, কিন্তু ডাইনি শুনে মনে হতো সে যেন আমার বুকের ভেতরে ঢুকে আমার হৃদপিণ্ডটা খুঁজে ফিরছে।
অথবা পথের পাঁচালী‘র আতুরি বুড়ির কথা? সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, গাঁয়ের বাইরে একান্তে নীরবে, নিভৃতে বাস করা এক অশীতিপর বৃদ্ধা। সমাজের নির্মম দুনিয়ার এই বাসিন্দারা আমাদের এখানে ডাইনি আর অনেক অনেক দূরের হাইতিতে জম্বি হয়ে যান।
হাইতি থেকে হলিউড
সিব্রুক আর হার্সটন-এর লেখার হাত ধরেই জম্বির আগমন মার্কিন মুলুকে। এর পরের কাজটি করে হলিউড।
দ্য ম্যাজিক আইল্যান্ড প্রকাশের তিন বছর পর হোয়াইট জম্বি (১৯৩২) নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। এরপর জম্বি নিয়ে রিভল্ট অভ দ্য জম্বিজ (১৯৩৬), কিং অভ দ্য জম্বিজ (১৯৪১), আই ওয়াকড উইদ আ জম্বি (১৯৪৩) মুক্তি পায় পর্যায়ক্রমে।
তবে হলিউডের জম্বির জনক হিসেবে পরিচালক জর্জ এ. রোমেরো-কে মানা হয়। ১৯৬৮ সালে তার পরিচালনায় নাইট অভ দ্য লিভিং ডেড সিনেমায় অ্যান্টাগনিস্ট হিসেবে এক দঙ্গল নরমাংসভোগী মানুষকে দেখানো হয় যাদেরকে ‘ঘোউল’ (ghouls) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। জম্বিকে নিয়ে প্রথম এ সিনেমাটি বানানো হলেও এতে কখনোই জম্বি শব্দটি উচ্চারণ করা হয়নি। এরপর দশ বছর পরে আরেকটি সিনেমা, ডন অভ দ্য ডেড (১৯৭৮)-এ প্রথমবারের মতো জম্বি শব্দটি ব্যবহার করেন রোমেরো। এর পরের কয়েক দশকে রোমেরো আরও কয়েকটি জম্বি সিনেমা পরিচালনা করেন।
এরপর ধীরে ধীরে জম্বি ফিল্ম জনপ্রিয়তা লাভ করে মার্কিন দর্শকদের কাছে। জম্বির বৈশিষ্ট্যেও ক্রমশ নতুন নতুন পরিবর্তন আনা হয়। প্রথমদিকে জম্বিকে ধীরপদ হিসেবে দেখানো হলেও পরবর্তী সময়ের সিনেমা ইত্যাদিতে আমরা জম্বিকে দৌড়াতেও দেখি। সিনেমার বাইরে জম্বিকে নিয়ে টিভি সিরিজ, গেইম তৈরি করা হয়। দ্য ওয়াকিং ডেড (২০১০) সিরিজ, বা রেসিডেন্ট ইভল গেমের ভয়ধরানো জম্বিওয়ার্ল্ড থেকে শুরু করে কমেডি-হরর শন অভ দ্য ডেড (২০০৪) বা জম্বিল্যান্ড (২০০৯)- জম্বি এখন বৈশ্বিক বিনোদন জগতের অন্যতম অনুষঙ্গ।
চাইলেই বানানো যাবে জম্বি?
ভুডু ধর্ম এখনো ক্যারিবিয়ান, ব্রাজিল, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে চালু আছে। বকরেরা ‘কুপ পুদ্রে’ নামক একধরনের সাদাটে পাউডার তৈরি করেন। এই পাউডার একজন সুস্থসবল মানুষকেও ‘জম্বি’ বানিয়ে দিতে পারে। ১৯৮০’র দশকে হার্ভার্ডের এথনোবোটানিস্ট ওয়েড ডেভিস ‘জম্বি পাউডার’ নিয়ে গবেষণা করার জন্য হাইতি ভ্রমণ করেন। তার অনুসন্ধানে তিনি খুঁজে পান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূলত মানবদেহের পোড়া হাড়, কয়েকধরণের ব্যাঙ, পোকা, পাফারফিশ ইত্যাদি মিশিয়ে এ পাউডার তৈরি করা হয়। এই পাফারফিশের ভেতর থাকা মারাত্মক বিষ (toxin) টেট্রডোটক্সিন (Tetrodotoxin) মানুষকে মৃত্যুর দ্বার অব্দি পৌঁছে দিতে পারে।
অল্প পরিমাণ টেট্রডোটক্সিন শরীরে প্রবেশ করলে মানুষের শরীর অসাড় হয়ে যেতে পারে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় থাকে না ব্যক্তি বেঁচে আছেন কী মরে গেছেন। শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় থেমে যায়, হৃদস্পন্দন শূন্যের কাছাকাছি নেমে যায়। তবে ব্যক্তির জ্ঞান বজায় থাকে কিন্তু তিনি কথা বলতে পারেন না।
ডেভিস মনে করেন এই টক্সিনই হচ্ছে জম্বি পাউডারের মূল ভিত্তি। ডেভিসের ব্যাখ্যা হলো, কোনো ব্যক্তিকে যথাযথ পরিমাণে এই বিষ দেওয়া হলে ব্যক্তি এমন একটি অবস্থায় পৌঁছান যে দেখে মনে হয় তিনি মরে গেছেন। এরপর তাকে কবর দেওয়ার পর সেই ‘লাশ’ কবর থেকে তোলেন বকর। এরপর ওই জম্বিকে দ্বিতীয় আরেকটি ড্রাগ দেওয়া হয়। জিমসন উইড ((Datura stramonium) থেকে তৈরি এই ঔষধ রোগীর স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় কার্যক্রমকে ব্যহত করে।
তবে হাইতিতে গিয়ে চাইলেই আপনি জম্বি বানাতে পারবেন না। জম্বিফিকেশন ও দেশে এতটাই বাস্তব ব্যাপার যে এটি প্রতিরোধের জন্য আইন পর্যন্ত করতে হয়েছে। হাইতিয়ান পেনাল কোডের ২৪৯ আর্টিকেলে বলা আছে কেউ যদি জম্বি তৈরি করতে চায় তবে তা হত্যাচেষ্টা বলে পরিগণিত হবে। আর এ উদ্দেশে কাউকে কবর দেওয়া হলে সেটা খুন বলে গণ্য করা হবে।
‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ও অন্যান্য
১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেট তিনটি জম্বিফিকেশনের কথা জানায়। একটি ঘটনায় একজন মহিলাকে মৃত্যুর পর কবর দেওয়া হলেও তিন বছর পর তিনি আবার ফিরে আসেন। পরে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার কবর খোঁড়া হলে সেখানে পাথর ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। তার পরিবার তাকে গ্রহণ করবে কিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকলে পরে তাকে একটি মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই ভদ্রমহিলার সাথেই দেখা হয়েছিল জোরা নিল হার্সটন-এর।
আমেরিক্যান কেমিক্যাল সোসাইটি’র প্রকাশনা কেমম্যাটার্স-এ আরেকটি জম্বিবৃত্তান্ত জানা যায়। ১৯৬২ সালে ক্লেয়ারভায়াস নারসিস শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ডাক্তারেরা তাকে পরে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর পরপরই তাকে কবর দেওয়া হয়। এর ১৮ বছর পর আঞ্জেলিনা নারসিসের দরজায় এক লোক এসে নিজেকে তার ভাই ক্লেয়ারভায়াস নারসিস হিসেবে দাবী করেন। তিনি জানান তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার পর কবর থেকে তোলা হয়েছিল। এরপর তাকে জম্বি বানিয়ে দূরের কোনো এক আখের আবাদে দাস করে রাখা হয়। যে ডাক্তার নারসিস-কে মৃত ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সহ গ্রামের অনেকেই এই নবাগতকে ক্লেয়ারভায়াস নারসিস বলে শনাক্ত করেন।