সাইক্লোপসের নাম আমরা হয়তো প্রায় সবাই শুনেছি। রোমান কিংবা গ্রিক পুরাণের গল্পগুলোতে প্রায়ই এই একচোখা দৈত্য বা সাইক্লোপসদের বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। সাইক্লোপস (Cyclops) বহুবচনে Cyclopes শব্দটির অর্থ ‘গোল চোখ বিশিষ্ট’। সাইক্লোপস হলো জায়ান্টস বা দৈত্যদের এক বিশেষ জাত যাদের কপালের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি মাত্র চোখ। বহু প্রাচীন লেখকদের মতে, এরা হলো টাইটানদের সহোদর ও গ্রিক সমুদ্র দেবতা পোসাইডনের পুত্র। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এরা দেবতা হেফেস্টাসের জন্য এটনা পর্বতের কেন্দ্রে এক কারখানায় কাজ করতো।
বাস্তবে সাইক্লোপসদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আসলে কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বহু প্রাচীন লেখকের লেখাতেই শুধু এদের কথা উঠে এসেছে। যার ফলে ধরে নেওয়াই যায় এরা কোনো লেখকের কল্পনার ফসল। তবে সাইক্লোপসদের এসব কাহিনী বহু প্রজন্ম ধরে পৃথিবী মানুষকে মুগ্ধ করে এসেছে। প্রধানত ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার মানুষের মধ্যেই এই কাহিনীগুলো বেশি প্রচলিত ছিল। এসব কাহিনী উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে রচিত হয়েছে নানা বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম। সাইক্লোপসদের এই গল্প রূপ নিয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত গল্পে। চলুন আজকে পৌরাণিক সেই সাইক্লোপস ও তাদের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
কেমন ছিল সাইক্লোপসরা?
শারীরিক গঠন
সাইক্লোপস হলো বিশাল মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট বুনো ও বর্বর এক জাত। এরা এতটাই বিশাল আকৃতির যে এদের পাশে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দাঁড়ালে তার উচ্চতা সাইক্লোপসের পায়ের গোড়ালির চেয়েও কম হবে। এদের মাথার আকৃতি অনেকটা চারকোণা। এদের নাকের ঠিক উপরেই কপালের মাঝামাঝি রয়েছে একটি গোলাকার চোখ।
আকৃতি মানুষের মতো হলেও প্রাকৃতিকভাবে এদের চেহারা ছিল অসভ্য বর্বরের মতো। এরা নিজেদের চেহারার প্রতি কোনো যত্নও নিতো না। এরা বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া দিয়ে তৈরি রুক্ষ পোশাক পরতো ও কখনো গোসল করতো না। বিখ্যাত গ্রিক কবি হোমার তার ওডিসিতে এক সাইক্লোপসের বর্ণনায় বলেন-
“সে হলো বিকটাকার এক দৈত্য, মানুষের মতো নয়। জীবনের কখনো হয়তো সে রুটি খেয়ে দেখেনি। দেখতে রুক্ষ পর্বত চূড়ার মতো সে সবার থেকে আলাদা হয়ে একাকী দাঁড়িয়ে ছিল।”
হোমারের পরবর্তী অন্যান্য লেখকরা হোমারের বর্ণিত সাইক্লোপকেই আদর্শ হিসেবে নেন ও তার আলোকে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেন।
স্বভাব
গল্পের অন্যান্য দানবের বাহ্যিক গঠন দেখে সচরাচর তাদের স্বভাব বোঝা না গেলেও সাইক্লোপসদের অসভ্য চেহারা দেখে সহজেই এদের স্বভাবও আঁচ করা যায়। এদের স্বভাব সম্পর্কে বলতে গেলে, প্রথমত এরা ভীষণ রকম অসামাজিক। এরা কোনো ধরনের সামাজিক জীবনযাপন করতো না। এরা কোনো দেবতাকেও ভয় পেতো না। মানুষের তৈরি কোনো আইনকানুনও মেনে চলতো না এরা। এদের নিজেদের মধ্যেও ছিলনা কোনো সখ্যতা। ছোট ছোট গোত্রে ভাগ হয়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করতো। এসব গোত্রের মধ্যে কোনো রকম শাসনব্যবস্থা ছিল না। প্রতিটি সাইক্লোপসের নিজের একটি গুহা থাকতো এবং এই গুহায় সে একা বাস করতো। কোনো কোনো সাইক্লোপস আবার তার গুহায় নিজের স্ত্রী কিংবা বাচ্চা নিয়ে বাস করতো। কোনো মানুষ কখনো ভুল করে তাদের গুহায় ঢুকে পড়লে তার ঘটতো করুণ পরিণতি। তাকে আমন্ত্রণ জানানো দূরের কথা, তার হাত-পা ছিড়ে তাকে পেটের মধ্যে চালান করে দিতো সাইক্লোপস পরিবার।
নানা কাহিনী থেকে জানা যায়, সাইক্লোপসরা ছিল খুবই অলস প্রকৃতির। মানুষের মতো এরা চাষাবাদ না করে আশেপাশের বন জঙ্গল থেকে নানা শস্য ও ফলমূল সংগ্রহ করে খেতো। কেউ কেউ আবার পার্শ্ববর্তী শহর থেকে নানা খাদ্যদ্রব্য চুরি করতো।
তবে কিছু কিছু যায়গায় সাইক্লোপসদের কর্মঠ হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, হোমারের ওডিসিতে বর্ণিত সাইক্লোপসটি ছিল পরিশ্রমী মেষপালক। সে ভেড়া পালতো এবং তাদেরকে চমৎকার এক খোঁয়াড়ে রাখতো। এছাড়াও সে ভেড়ার দুধ দিয়ে মাখন ও দই বানাতো! গ্রিক কবি হেসিওড ও কাল্লিম্যাকাসের মতে, তারা ছিল চমৎকার কারিগর। এরা বিভিন্ন বড় বড় ভবন ও দেবতাদের জন্য নানা অস্ত্র তৈরি করতো।
বিশেষ ক্ষমতা
প্রচন্ড শারীরিক শক্তি বিশিষ্ট সাইক্লোপসদের তেমন বিশেষ কোনো গুণ ছিল না। মানুষের মতো এরা নতুন কিছু শিখতে পারতো না।
তবে দুয়েকটি গুণের মধ্যে এদের কারিগরি ক্ষমতাই সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল। কামার হিসেবে এরা ছিল অতুলনীয়। এদের ভূগর্ভস্থ বিশাল বিশাল হাপরগুলো অনেকে আগ্নেয়গিরি ভেবে ভুল করতো। সূর্যের আলো, চাঁদের আলো কিংবা বজ্রকে এরা এদের নির্মিত অস্ত্রের সাথে মিশিয়ে দেবতাদের জন্য নানা রকম অস্ত্র তৈরি করতো। রাজমিস্ত্রি হিসেবেও এদের সুনাম ছিল। প্রচণ্ড শারীরিক শক্তির মাধ্যমে বড় বড় পাথর দিয়ে বিশাল বিশাল দেয়াল ও ভবন তৈরি করতে পারতো এরা।
যুদ্ধক্ষেত্রেও অনেক সময় সাইক্লোপসদের ব্যবহার করা হতো। এদের যুদ্ধের কোনো দক্ষতা না থাকলেও রক্তের নেশায় এরা প্রতিপক্ষের জলজ্যান্ত সৈন্যকে ধরতো আর টপাটপ মুখে পুরতো। ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেত নাটকীয় ভাবে!
সাইক্লোপসের কাহিনীগুলোর উৎস
সাইক্লোপসদের বর্ণনা প্রধানত দুটি উৎস থেকে এসেছে। একটি হলো হোমারের ‘ওডিসি’ এবং অপরটি হলো গ্রিক কবি হেসিওডের ‘থিওগনি’। এ দুটি লেখাই খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর দিকে লেখা হয়। এর দুই লেখা প্রকাশের পর মানুষের মধ্যে সাইক্লোপস অনেক জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে পরবর্তী বহু কবিতা, গল্প, লোককাহিনীতে সাইক্লোপসের আবির্ভাব ঘটে। এছাড়াও প্লেটো, ওভিড, প্লিনির মতো বিখ্যাত লেখক ও দার্শনিকরাও এটিকে গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন।
ইতিহাসের যত বিখ্যাত সাইক্লোপস
পৌরাণিক ইতিহাসের বহু স্থানে সাইক্লোপসদের কথা উল্লেখ থাকলেও তাদের বেশিরভাগই ছিল অজ্ঞাতনামা। তবে সাইক্লোপসদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল পলিফেমাস। হোমারের ওডিসিতে এই পলিফেমাসের কথা উঠে আসে। পলিফেমাস ছিল মেষপালক। সে পর্বতময় এক দ্বীপের গুহায় বাস করতো। গ্রিক বীর অডিসিউস বা ইউলিসিস যখন তার সৈন্যদল নিয়ে পলিফেমাসের সেই দ্বীপে নোঙর করেন তখন তিনি পলিফেমাসের চমৎকার ভেড়ার পাল দেখতে পান। তিনি ভাবেন, পলিফেমাসের কাছে হয়তো কিছুদিনের আশ্রয় পাওয়া যাবে। দীর্ঘ যাত্রা শেষে হয়তো এখানে কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়া যাবে।
এই ভেবে তিনি তার দলবল নিয়ে পলিফেমাসের গুহায় প্রবেশ করেন এবং দেবতার নামে তাদেরকে আশ্রয় দিতে বলেন। তবে আমরা যা আশা করি তা তো আর সব সময় ঘটে না। পলিফেমাস ইউলিসিসকে আশ্রয় দেওয়া বদলে গুহার মুখে বিশাল এক পাথর চাপা দিয়ে দেয় এবং তারপর ইউলিসিসের সৈন্যদের একের পর এক ধরে ধরে খাওয়া শুরু করে। কয়েকজন সৈন্যকে হারানোর পর ইউলিসিস পলিফেমাসের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন তার নাম, ‘Noman’ বা ‘কেউনা’।
পরেরদিন সকালে পলিফেমাস তার ভেড়ার পাল বাইরে বের করার জন্য গুহার মুখের পাথর সরিয়ে দেয়। এই সুযোগে ইউলিসিস বিশাল এক গাছের গুড়ি সংগ্রহ করেন এবং তার এক মাথা ধারালো চোখা করে নেন। পরে পলিফেমাস ঘুমালে তিনি সেই গাছের গুড়ি পলিফেমাসের একটি মাত্র চোখে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে অন্ধ করে দেন। পলিফেমাস যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকলে দ্বীপের অন্যান্য সাইক্লোপসরা এসে তার কাছে কী ঘটেছে জানতে চায়। পলিফেমাস তাদের বলে, “Noman (no man) had attacked him.” যার অর্থ দাড়ায়, কেউই তাকে আক্রমণ করেনি। তার কথা শুনে অন্যান্য সাইক্লোপসরা বিরক্ত হয়ে চলে যায়। ফলে সেই যাত্রায় পালিয়ে বেঁচে যান ইউলিসিস। তবে পরবর্তীতে পলিফেমাসের পিতা দেবতা পোসাইডনের অভিশাপে তাকে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়।
বিখ্যাত সাইক্লোপসদের মধ্যে পলিফেমাসের পরেই যাদের নাম আসে তারা হলো তিন ভাই- ব্রন্টেস (বজ্র), স্টেরোপেস (বিদ্যুৎ ঝলক) ও আর্গেস (উজ্জ্বল আলো)। গ্রিক কবি হেসিওডের ‘থিওগনি’ অনুসারে ইউরানাস (আকাশ) ও গাইয়ার (পৃথিবী) মিলনের ফলে এই তিনজনের জন্ম হয়। তবে তারা প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হওয়ার তাদের পিতা তাদেরকে টার্টারাস নামের এক ভয়াবহ নরকে বন্দী করে রাখেন। পরবর্তীতে দেবতা জিউস এদেরকে মুক্ত করেন এবং বিনিময়ে এরা জিউসকে তার অস্ত্র বজ্র নির্মাণ করে দেয়। এরপর টাইটানদের উচ্ছেদের পরে জিউস তাদেরকে পৃথিবীতে মুক্ত করে দেন। কিন্তু দীর্ঘদিন মাটির নিচের নরকে কাটানোর ফলে পৃথিবীর পরিবেশ তাদের ভালো লাগেনি। ফলে তারা ভূগর্ভস্থ এক কারখানায় আশ্রয় নেয় এবং সেখানে থেকে দেবতাদের জন্য বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করতে থাকে। সমুদ্র দেবতা পোসাইডনের ত্রিশূল, আর্টেমিসের ধনুক ও চন্দ্রালোকের তীর, অ্যাপোলোর ধনুক ও সূর্যালোকের তীর এবং হেডিসের অদৃশ্য হওয়ার শিরস্ত্রাণ প্রভৃতি এই তিন সাইক্লোপসই নির্মাণ করতো।
সাইক্লোপসদের কল্পকাহিনীর পেছনের গল্প
সাধারণভাবে সাইক্লোপসদের এসব গল্প কেবলমাত্র উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার ফসল বলে মনে হলেও আধুনিক গবেষকরা সাইক্লোপসদের এই কাহিনীর পেছনে কিছু বাস্তব ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন।
গবেষকদের একটি দল মনে করেন এই সাইক্লোপসরা আসলে বাস্তবে মানুষ ছিল। এরা ছিল প্রচন্ড শক্তিশালী একদল কামার। সেসময় নানা অস্ত্র তৈরি ও লোহার কাজ করার জন্য বিপুল শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হতো। এর কামারের দল এসব কাজ করতে করতে এতটাই দক্ষ ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে তাদের শরীরের পেশি দেখলে তাদেরকে স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হতো না। এছাড়াও সেসময় তারা চোখকে লোহার টুকরা ও গুড়া থেকে বাঁচানোর জন্য একটি চোখে চামড়ার পটি পরতো। ফলে অনেকেই তাদেরকে ‘একচোখা’ বলে ডাকতো। ফলে ধারণা করা হয়, এ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে সাইক্লোপসদের কিংবদন্তির সৃষ্টি হয়।
আবার আরেকদল গবেষকের মতে, সাইক্লোপসের গল্প চালু হয়েছিল একধরনের বামন হাতির কঙ্কাল থেকে। এই বামন হাতিগুলো গ্রিকদের আগমনের বহু আগে গ্রিসে বিচরণ করতো। এই হাতির খুলিতে কপালের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে থাকতো একটা বড় ছিদ্র, যেটি আসলে হাতির নাকের ফুঁটো হিসেবে কাজ করতো। এখানেই থাকতো হাতির শুঁড়। কিন্তু হাতির মাথার খুলির মাঝের সেই ফুঁটো দেখে যেসব গ্রিসের অধিবাসী কখনো এই হাতি দেখেনি তারা ভেবেছিল এই ছিদ্রটি বোধহয় চোখের কোটর। ফলে তারা সেই খুলিটিকে কপালের মাঝে চোখওয়ালা এক বিশাল দানবের খুলি ভেবে ভুল করেছিল। ধারণা করা হয়, এই ভুল থেকেই হয়তো পরবর্তীতে সাইক্লোপসদের কাহিনীর প্রচলন ঘটে।
তবে যেভাবেই আসুক না কেন, সাইক্লোপসদের কাহিনী আজও পৃথিবীর বহু স্থানের মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। আজও সাইক্লোপসদের নিয়ে লেখা বিখ্যাত সাহিত্যকর্মগুলো পড়ানো হয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
ফিচার ইমেজ – daviantart.com