যেকোনো ঘটনা সামগ্রিকভাবে জানা এবং এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্তদের মুখ থেকে জানা- এই দুইয়ের মাঝে আসলে বেশ পার্থক্য রয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে হয়তো সেই ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি জানা যায়, কিন্তু সেই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট আবেগ ঠিক সেভাবে ফুটে ওঠে না। ওদিকে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সেই ঘটনার পুরো চিত্র না আসলেও তা থাকে আবেগে পরিপূর্ণ, কারণ সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার নিজের চোখে দেখা, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বর্ণনাই দেন সেখানে। বলা বাহুল্য, ইতিহাসের কোনো ঘটনাকে প্রকৃতরূপে জানার জন্য, অনুধাবনের জন্য এই দুই ধরনের বর্ণনার সাথেই পরিচিত হওয়া বাঞ্চনীয়।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানার্জনের অভিপ্রায়ে বছরখানেক আগে থেকে বিভিন্ন নতুন-পুরাতন বই সংগ্রহ শুরু করি, যেখানে আমার আগ্রহ দেখে অনেকে বিভিন্ন বই উপহার হিসেবেও কুরিয়ার করে পাঠিয়েছেন। সেসব বই পড়ে ভাল লাগছিল, জানতে পারছিলাম নতুন কিছু। কিন্তু কোথায় যেন একটা শূন্যতা থেকে যাচ্ছিল, শুধু খুঁজে পাচ্ছিলাম না সেই শূন্যস্থান। অবশেষে বুঝতে পারলাম এই লেখার প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বিষয়টি- বিভিন্ন বই পড়ে সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠলেও আত্মিকভাবে সংযুক্ত হতে আমার জানা দরকার এমন সব মানুষের ঘটনাও, যারা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরবেন।
এরপর থেকে এই ধরনের নানা বই নিজের সংগ্রহে যুক্ত করতে থাকি, যার মাঝে অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা, এবং একইসাথে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (১৯৫২-২০১৮) সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা – সম্মুখ সমরের যোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা’ বইটি। এর আগে আমার সংগ্রহে থাকা এমন প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতা, ইংরেজিতে যাকে বলে আইউইটনেস এক্সপেরিয়েন্স (Eyewitness Experience), সম্বলিত বইগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল যে সেসবে উঠে আসা কম-বেশি সকলেই তাদের উপর, চারদিকে চলা নির্যাতন, গণহত্যা ও বিভিন্ন অমানবিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে এই বইটি যখন শিরোনামেই জানিয়ে দিল যে এখানে কেবল ‘সম্মুখ সমরের যোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা’ই উঠে আসবে, তখন বইটি সংগ্রহ না করে পারা যায়নি।
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন বইটির প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়, তখনই ‘সম্পাদকের কথা’ অংশে মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া উল্লেখ করেছিলেন,
একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা আগামী পনেরো বা বিশ বছরের মধ্যে এ পৃথিবী থেকে চলে যাবেন। যারা থাকবেন তারা বয়সের ভার কাঁধে নিয়ে বাঁচবেন বার্ধক্যজনিত রোগবালাই নিয়ে। লেখালেখির সময় তখন আর তাদের থাকার সম্ভাবনা নেই।
যোদ্ধাদের অধিকাংশের মাঝেই প্রথাগত শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা, মুক্তিযুদ্ধের কথ্য ইতিহাসের স্বল্পতা, যুদ্ধ ইতিহাসের অপর্যাপ্ততা অনুধাবন করে ‘সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ’ এর উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে ৭ খণ্ডে সমাপ্ত এই সিরিজ ‘স্বাধীনতা – সম্মুখ সমরের যোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা’, যার শুরুটা ফেব্রুয়ারি ২০০৭-এ, আর শেষ ঠিক এক দশক পরের (২০১৭) আরেক ফেব্রুয়ারিতে।
পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ- জীবনের নানা স্তর, জীবিকার্জনের নানা উপায় থেকেই দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে বইগুলোতে। পশ্চিম পাকিস্তানের দুই দশক ধরে চলা বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে ঝুঁকি নিয়ে ভারত গমন, ট্রেনিংয়ের নানা কথা, যুদ্ধের নানা অভিজ্ঞতা, জয়-পরাজয়ের আনন্দ-বেদনা, গ্রামবাসীদের নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে দেয়া সাহায্য, সহযোদ্ধাদের হারানোর বেদনা, বাংলার আপামর জনগোষ্ঠীকে নির্যাতিত হতে দেখে শোকের আগুনকে শক্তিতে পরিণত করা, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির করুণ বর্ণনা, পাকসেনা ও রাজাকারদের খতমের বীরত্বপূর্ণ বর্ণনা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা উড়িয়ে দেয়ার টান টান উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত, এবং সবার শেষে ১৬ ডিসেম্বর বহু আকাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনের পর সীমাহীন আনন্দ- সবই যেন পাঠককে এক অন্য মায়াজালে আটকে রাখবে। সেই জাল তাকে যেমন বিজয়ের আনন্দে ভাসাবে, তেমনই সামান্য অসতর্কতার জন্য সম্ভাবনাময় জীবনের পরিসমাপ্তিও তাকে নির্ঘাত আফসোসের সাগরে ভাসাবে।
সাতটি বই মিলিয়ে ৮০টির অধিক কাহিনী উঠে এসেছে। আশিজনের অধিক যোদ্ধার কাহিনী বলবার উপায় নেই, কারণ বিভিন্ন খণ্ডেই একই মুক্তিযোদ্ধার বিভিন্ন যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা ঠাই পেয়েছে। তবে তাদের একেকজনের একেক কাহিনী পাঠককে যেন একেক সময় অভিজ্ঞতার একেক দুনিয়ার ঘুরিয়ে আনবে, যাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটাই- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটানো, এই দেশের মানুষগুলোকে একটি সোনার বাংলা উপহার দেওয়া।
সিরিজের প্রতিটি খণ্ড একই গতিতে এগিয়ে গিয়েছে, যেখানে পৃষ্ঠা সংখ্যা সর্বাধিক ১৩০ এর কাছাকাছি গিয়েছে। ফলে খুব বেশি পরিশ্রম বা সময় ব্যয় করতে হবে না একেকটি বই পড়তে, চাই কেবল আন্তরিক ইচ্ছাশক্তি।
স্বাভাবিক এই ধারার ব্যত্যয় ঘটেছে ৫ম খণ্ডে গিয়ে। ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র মো. আলী নকী এবং মো. ইমামউদ্দিন উদ্যোগ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় ও কীর্তি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করে যাবার। তাদের এই ভাল উদ্যোগে পরবর্তীতে আরও কয়েকজন তরুণই যুক্ত হন। ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ শিরোনামের সেই বইটিকে আলোর মুখ দেখতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এমনকি সম্পাদকদ্বয়ের ভাষ্যমতে, সেই সময় বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এক বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারীর এই বই না ছাপাবার পেছনে জবাব ছিল, “এইসব ইতিহাস টিতিহাসের বই তো কেউ পড়ে না…।” বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেই বইটিতে উঠে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনীই তুলে ধরা হয়েছে ৫ম খণ্ডে, তবে আরও সহজবোধ্য ঢঙে।
বইটিতে আশির অধিক সত্যিকারের কাহিনী উঠে এলেও সব যে উচ্চ সাহিত্য মানসম্পন্ন, সেটা দাবি করার উপায় নেই। সত্যি বলতে, সেই প্রত্যাশা করা উচিতও না। কারণ, এখানে যাদের কথা উঠে এসেছে, তারা কেউই প্রথাগত সাহিত্যিক না, তারপরও তারা চেয়েছেন আমরা যেন আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামের ঘটনাগুলো জানতে পারি তাদের কলমের মধ্য দিয়ে। সম্পাদক মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়াও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন বিষয়টি। তাই তো দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় তিনি সরাসরিই বলে দিয়েছেন,
যে যোদ্ধাদের লেখার চল নেই, তাদেরকে দিয়ে লেখানো কষ্টকর। লেখাগুলি সাহিত্যের বিচারকের দৃষ্টি দিয়ে না দেখতে অনুরোধ রইল। তবুও অব্যাহত থাক স্বাধীনতার প্রকাশ।
সম্পাদকের এই বক্তব্য দেখে অবশ্য ভাবতে যাবেন না যে মোটামুটি মানের কিছু লেখা তিনি কোনোভাবে আমাদের হাতে গছিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। বরং বইয়ে উঠে আসা কাহিনীগুলোর মাঝে অধিকাংশই উপভোগ্য, শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণামূলক। আর সেটা যে সম্পাদকের নিরলস পরিশ্রমের ফলেই হয়েছে, তা তো না বললেও চলে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, চার-পাঁচটি এমন কাহিনীর সন্ধানও পেয়েছি, যেগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী কোনো এক খণ্ডে সেগুলো যেমন এসেছে, তেমনই ঠাই পেয়েছে পরবর্তীতে প্রকাশিত কোনো খণ্ডেও। আশা করি বইটি বর্তমানে দেখভালের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এদিকে সতর্ক নজর দিয়ে এত চমৎকার এই সিরিজের সামান্য এই ক্ষতটুকু সারিয়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা নেবেন।
আগ্রহী পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলে রাখা ভাল, বইটি আপনি যেকোনো খণ্ড দিয়েই শুরু করতে পারবেন। এক খণ্ডের সাথে আরেক খণ্ডের কাহিনিগত কোনো সম্পর্ক নেই।
শেষ করছি স্বাধীন বাংলাদেশ আনয়নে ৫ম খণ্ডে উল্লেখিত এক তরুণীর আত্মত্যাগের সংকল্প উল্লেখ করেই,
“একাত্তরের এক রাতের কথা।
সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন এম. এ. মতিনসহ আরও কয়েকজন চিন্তা করছিলেন যুদ্ধে নারীদের কীভাবে আরও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা যায়।
নারীদের অনেকেরই প্রবল ইচ্ছা ছিল ছেলেদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের। কিন্তু তাদের বাসস্থান, নিরাপত্তা, টয়লেট, শারীরিক জটিলতা ইত্যাদি কারণে বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছিল।
যুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী নারীরাও সম্ভবত বিষয়গুলো বুঝতে পারছিলেন। তাদেরই মাঝে একজন, এক অবিবাহিতা তরুণী, বয়স ১৮/২০ বছর, এগিয়ে এলেন। মেজর খালেদ মােশাররফকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “স্যার, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজেদের প্রাণসহ সব দিচ্ছেন। স্বাধীনতার জন্য আমরাও সব দিতে প্রস্তুত আছি।”
এবার চোখের দৃষ্টি নিচু করে ক’সেকেন্ড চুপ করে রইলেন তিনি। টপ টপ করে চোখ থেকে পানির ফোটা মাটিতে পড়ছিল। তারপর আবারও বলে উঠলেন, “আমাদের সম্ভ্রমও।”
বই: স্বাধীনতা – সম্মুখ সমরের যোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা (৭ খণ্ড)
প্রকাশক: সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ
মুদ্রিত মূল্য: ১১২৫ টাকা (৭ খণ্ডের সর্বমোট মূল্য)
স্বাধীনতা-প্রথম খণ্ড বইটি পেতে লিংকে ক্লিক করুন।