নর্ডিক নয়্যার বা ক্ষেত্রবিশেষে যাকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান নয়্যারও বলা হয়ে থাকে– এটা মূলত ক্রাইম ফিকশনের একটা ধারা। এই ধারায় গল্পটা গড়ে ওঠে পুলিশের দৃষ্টিকোণ থেকে। আর গল্পের পটভূমি হয় নর্ডিক বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কোনো দেশ বা অঞ্চল। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বলতে নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং সুইডেনকে একত্রে বোঝানো হয়। আবার নর্ডিক বলতে নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ড এবং ফেরো আইল্যান্ডকে একত্রে বোঝায়। এই দেশগুলোর সংস্কৃতি, ধর্ম, সামাজিকতা, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, এমনকি জাতীয় পতাকা আর জাতীয়তাবাদের মধ্যেও ব্যাপক মিল রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবগুলোই স্বাধীন আর সার্বভৌম রাষ্ট্র।
নর্ডিক হোক আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান– এই দেশগুলোতে মানবাধিকার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এসমস্ত দেশে অপরাধ প্রবণতা অনেক কম। নর্ডিক আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অনেক দেশেই ফাঁসির নিয়ম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রশাসনের লোকদেরও অস্ত্রের ব্যবহারও খুবই সীমিত পরিসরের জন্য। এমনকি অপরাধী যদি কোনো কারণে আপনার অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়– সেজন্য আপনার পুলিশের চাকরিটাও চলে যেতে পারে! মূলত আইসল্যান্ডের এক ক্রাইম-ফিকশন সিরিজ নিয়ে আলোচনার জন্যেই এসব বলা। ‘দ্য ভ্যালহালা মার্ডারস’ নামের আইসল্যান্ডিক এই সিরিজ ইতিমধ্যেই সমালোচক এবং সিরিজপ্রেমীদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
গল্পটি আইসল্যান্ডের রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় অথচ শান্তশিষ্ট শহর রেইজাভিক (আইসল্যান্ডের উচ্চারণে রেইজাভিক আসে, তবে রিকজাভিকও বলা হয়ে থাকে) এর। একদিন সকালে শহরের এক বন্দর থেকে একটি লাশ পাওয়া যায়। শহরেরই এক বাসিন্দার লাশ। খুবই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। খুনীর যে অনেক ক্রোধ ছিল মৃত ব্যক্তির উপর, তারই যেন একটা প্রমাণ রেখেছে নৃশংসতায়। বয়স্ক মানুষটির সারা শরীর জুড়ে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। তার চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ড তদন্তের দায়িত্ব পায় রেইজাভিক পুলিশের অপরাধ তদন্তকারী অফিসার ক্যাথরিন/কাতা। প্রাথমিক তদন্তে মৃত লোকটির পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া খুনের কোনো ক্লু-ই পাওয়া যায় না। খড়ের গাঁদায় সুঁই খোঁজার মতো অবস্থা।
এমতাবস্থায় ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতেই আবারও একটি লাশ খুঁজে পায় রেইজাভিক পুলিশ। আগের খুন আর এই খুনের মধ্যে অনেক মিল দেখা যায়। তাই কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটা ভয়ংকর এক সিরিয়াল কিলারের কাজ। আইসল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজের নৃশংসতা দেখাতে শুরু করেছে এই কিলার। উর্ধ্বতন মহল থেকে চাপ বাড়ে তদন্তের কাজ দ্রুত সমাধা করা এবং খুনিকে গ্রেফতার করার জন্য। মিডিয়া অসংখ্য প্রশ্ন তুলতে থাকে। জনগণের মনে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করে। এরই মধ্যে রেইজাভিক পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুপারিশে নরওয়ের অসলো থেকে নিয়ে আসা হয় গোয়েন্দা আর্নারকে। সিরিয়াল কিলিংয়ের এই কেস তুলে দেয়া হয় রেইজাভিকের কাতা এবং অসলোর আর্নারের হাতে।
দুই তদন্তকারী অফিসার বেপরোয়া হয়ে ওঠে এই খুনের রহস্য সমাধানের জন্য। এরই মধ্যে আরেকটি লাশ খুঁজে পেলে তারা তিনটি খুনের মধ্যে বেশ মিল আর একটা যোগসূত্র খুঁজে পান। এই তিনজনই তরুণ বয়সে রাষ্ট্র পরিচালিত সংগঠন ভ্যালহালার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভ্যালহালাতে সেই সময়ে যারা ছিল তাদের একটি ছবি পাওয়া যায়। যে তিনজন মারা গিয়েছেন তারা বাদে বাকিদের খোঁজ নিতে গেলে ভ্যালহালাতে শিশু নির্যাতনের এক করুণ আর যন্ত্রণাদায়ক কাহিনী বেরিয়ে আসে। এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে ভ্যালহালাতে ৩০ বছর আগে এক তরুণের খুনের ঘটনা উঠে আসে, যে রহস্যের কোনো সমাধানই হয়নি। এখান থেকেই গল্পের মোড় প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে।
মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের কল্যাণে নর্স পুরাণের গল্প কম-বেশি অনেকেরই জানা আছে। এই সিরিজের সাথে নর্স পুরাণের এক মনস্তাত্ত্বিক যোগসূত্র দেখানো হয়েছে। তাই শুরুতেই আসে সিরিজের শিরোনাম। ভ্যালহালা শব্দটি নর্স পুরাণের অন্যতম আলোচিত বিষয়। প্রাচীন নর্স পুরাণমতে, ভ্যালহালা হচ্ছে ‘হল অফ দ্য ফলেন‘। যেখান নর্স দেবতা ওডিন যুদ্ধে যাদের হত্যা করা হয়েছে, এমন বীরযোদ্ধাদের আত্মাগুলোকে জায়গা দেন। এটি একটি গৌরবময় হল, যেখানে এই ধরনের মৃত্যু-পরবর্তী অভিজাত যোদ্ধাদের জায়গা হয়। সিরিজে রাষ্ট্র পরিচালিত যে ভ্যালহালার কথা বলা হয়েছে, সেটাকেও আদতে একটি সেইফ হাউজ হিসেবেই শুরুতে দেখানো হয়েছে। আবার এটাও লক্ষ্যণীয় যে, ওডিন দেবতাদের মধ্যে মুখ্য হলেও ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার জন্য নর্স পুরাণে তাকে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, এবং এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মন্দ বলেও বিবেচনা করা হয়।
ব্যাপারটা যেন এমন যে, রক্ষকের দায়িত্ব পেয়ে নিজের মনোবাসনা পূরণ করার এক ধরনের স্বার্থপরতা। সিরিজেও একই ব্যাপার দেখানো হয়েছে। ওডিন যেমন নিজের স্বার্থে নর্স পুরাণে সবকিছু করতে পারে এবং চাইলেই তা নির্মূল করতে পারে– সিরিজেও এই ব্যাপারটি বাস্তবতার আড়ালে থাকা সত্যের মতো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পুরাণের মতোই সিরিজের ভ্যালহালারও সর্বময় ক্ষমতা থাকে একজনের কাছে, যিনি নিজেই সরকারি এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অথচ এসবের আড়ালে লুকিয়ে আছে তার এক জঘন্য মনোবাসনা। প্রশাসনিক ব্যবস্থা যত ভালোই হোক না কেন, কেবলমাত্র একজনের কারণে যে তা কতটা অসংলগ্ন হয়ে ওঠে তারই প্রমাণ দিয়েছে ‘দ্য ভ্যালহালা মার্ডারস’ সিরিজটি।
নর্স পুরাণে থরের বাবা ওডিন। সিরিজে থর চরিত্রটি যেন এই ব্যাপারটি মনে করিয়ে দেয়ার জন্যই রাখা হয়েছে। আবার একইসঙ্গে নর্স পুরাণের কুখ্যাত ‘ওয়াইল্ড হান্ট’ এর পেছনে ওডিনকেই দায়ী করা হয়। সিরিজে এই ব্যাপারটি সিরিয়াল কিলিংয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শুধু কি তা-ই? ‘ভ্যালহালা’ শব্দটি এসেছে ‘ভ্যালর’ থেকে। টিউটনিক বা জার্মানিক ভাষায় এই শব্দের পরস্পর-সম্পর্কিত শব্দগুলো হচ্ছে জবাই, রক্তস্নান, এমনকি খুনও। সিরিজের মধ্যভাগে একটি দৃশ্য আছে যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত ভ্যালহালা পরিদর্শনে গিয়ে কাতা ভ্যালহালাকে স্লটারহাউজ বা জবাইঘর বলে অ্যাখ্যা দেয়। ‘ভ্যালর’ শব্দের সঙ্গে আরেকটি শব্দ জড়িত- ‘ভ্যালকারি’। সিরিজে এক ভিকটিমের ছেলে এই নামে একটি ভিডিও গেমস খেলে, যে ছেলেটার নিজেরও আছে এক অতীত ইতিহাস।
মজার বিষয় হচ্ছে, নর্স পুরাণে ভ্যালকারিদেরকে নিহতদের নির্বাচক বলা হয়। এসব ভ্যালকারি হচ্ছে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে প্রফুল্ল নারীদের আত্মা, যেটা সিরিজের গল্পে সিরিয়াল কিলিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা লাভ করেছে। ভ্যালকারিরাই মূলত সিদ্ধান্ত নিত কারা ভ্যালহালাতে প্রবেশ করতে পারবে। তাই গল্পে থাকা একটি চরিত্র ফ্যানারের সঙ্গে ভ্যালকারি আর ভ্যালহালার দারুণ একটা যোগসূত্র আছে। এমনকি ফ্যানারের এক সংলাপে তা যেন আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তবে তা বলে দিলে স্পয়লারের ভয় থাকে বিধায় বলা গেল না। কিন্তু যেকোনো দর্শকই, অন্তত যারা নর্স মিথোলজি সম্পর্কে অবগত, ব্যাপারগুলো ঠিকই ধরতে পারবে।
ক্যাথরিন বা কাতা চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিনা ডৌগ ফেলেপ্পিসডটির। এটি শুধুমাত্র একজন গোয়েন্দার চরিত্র নয়। সিরিজের গল্পে কাতা একজন তালাকপ্রাপ্তা নারী। ১৬ বছরের এক সন্তান আর নিজের মাকে নিয়ে তার বসবাস। প্রাক্তন স্বামী প্রতিনিয়ত ছেলেকে তার কাছে নিয়ে যেতে চায়, যেটা তার কাছে স্থায়ী এক মানসিক যন্ত্রণার কারণ। এরই মধ্যে অফিসে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারে ত্যক্তবিরক্ত কাতা।
সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে নিজের মানসিক চাপ থেকে শুরু করে মিডিয়াসহ পুরো দেশের জনগণের চাপ কাঁধে। এতকিছুর মধ্যে তার ছেলেটা খুবই জঘন্য এক অপরাধের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে যায়। নিজের ছেলেকে বাঁচাতে যেমন মরিয়া হয়ে ওঠে কাতা, তেমনই মরিয়া হয় সিরিয়াল কিলারকে খুঁজে বের করার জন্যেও। এমন চতুর্মুখী একটা চরিত্রে অভিনয় করতে অনেক শ্রম দিতে হয়, যেটা নিনা দিয়েছেন এবং ফলাফল এসেছে দুর্দান্ত। এত সহজে চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন যে চরিত্র থেকে তাকে আলাদা করাটাই বরং মুশকিল হয়ে গেছে।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে এরপরেই আসে অসলো থেকে আসা গোয়েন্দা আর্নারের নাম। আর্নার চরিত্রে ছিলেন বিয়োর্ন থর্স। আদতে আর্নার একজন প্রোফাইলার, কিংবা বলা যায় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষক। তার নিজেরও কিছু ব্যক্তিগত টানাপোড়েন আছে। অসুস্থ বাবা, যাকে ক্ষমা করতে চায় না আর্নার। যে কারণে রেইজাভিক থেকে দূরে থাকা সেই একমাত্র বোনের সঙ্গেই আবার দেখা-সাক্ষাত শুরু হয় এই তদন্তের কাজে এসে। নিজের স্বামীর হাতের পুতুল বোনের সঙ্গেও তেমন কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না আর্নার। কিন্তু তার বোন চায়। এই মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে আছে তার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু পেশাদারিত্বের দায়ভার বাধা দেয়। সবকিছুকে বাদ দিয়ে আর্নার এমন এক চরিত্র, যে ঠাণ্ডা মাথায় সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ খোঁজে। বিয়োর্ন থর্স কোনো ধরনের ছাড় দেননি এ চরিত্রে অভিনয় করতে।
থর্ডুর প্যালসনের লেখা আইসল্যান্ডিক ভাষায় ব্রট নামক এই সিরিজটির ইংরেজি নামকরণ করা হয়েছে ‘দ্য ভ্যালহালা মার্ডারস’। এটি আইসল্যান্ডের প্রথম কোনো সিরিজ যেটা নেটফ্লিক্সে দেখানো হচ্ছে। প্যালসন ছাড়াও এই সিরিজ লেখায় ভূমিকা রেখেছেন ওটার নর্ডফিয়োর্ড, ক্রিস্টিন থর্ডারসন, ডেভিড অস্কার ওলাফসন এবং মার্গারেট অরনফডিটিয়ার। সিরিজের নির্মাণশৈলী দুর্দান্ত। অনেক পরিমিত কাজ দেখিয়েছেন নির্মাতারা।
তবে নির্মাণশৈলীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে সিনেমাটোগ্রাফি বা চিত্রগ্রহণ। আর এর চেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে লোকেশন বা আইসল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বরফের বিস্তীর্ণ শুভ্রতা সিনেমাটোগ্রাফিকে করে তুলেছে আরো দুর্দান্ত ও আকর্ষণীয়। সিনেমাটোগ্রাফি দেখে বারবার নরওয়েজিয়ান সিরিজ উইস্টিং এবং জার্মান-অস্ট্রিয়ান সিরিজ প্যাগান পিক এর কথা মনে পড়ে যাবে দর্শকদের।
গল্পের মতোই চিত্রনাট্যও বেশ যত্ন নিয়ে করা। বেশ পরিপাটি আর সাজানো-গোছানো। অন্যান্য সিরিয়াল কিলিং গল্পে কেবলই যে সিরিয়াল কিলারকে প্রাধান্য দিয়ে গল্প বলার একটা প্রবণতা আছে, এই গল্পে তেমনটা চোখেই পড়েনি। গল্পের শুরু থেকেই হত্যাকারী কে, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বদলে কেন এই নৃশংসতা সেটা জানার প্রতিই আগ্রহী হবে দর্শক।
খুনি কে? এই ব্যাপারটিকে যথাসম্ভব হালকা করে খুনের কারণকে খুব গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন লেখক ও নির্মাতা। তবে চরিত্র উপস্থাপন এবং গল্পের ব্যাপ্তির কারণে বেশিরভাগ দর্শকের কাছেই এই সিরিজ খুব ধীরগতির বলে মনে হবে। তবুও গল্পের এমন গভীরতা আর নির্মাণশৈলী খুব দ্রুতই একজন দর্শককে নিয়ে যাবে গল্পের গহীনে।