গতবছর অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস ‘ডিজনি প্লাস’-এ ‘মুন নাইট’ মুক্তি পেলে, চারিদিকে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় সিরিজটি। অল্পসময়েই হয়ে ওঠে সিনেপাড়ার হট টপিক, ঝড় উঠায় সিরিজপ্রেমীদের মনে। শুরু থেকেই দর্শকমহলে এই সিরিজ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা বজায় ছিল। একে একে যত এপিসোড এগিয়েছে, দর্শকরা ততোই অভিভূত হয়েছেন।
একটা কমিকবুক চরিত্র মনস্তাত্ত্বিকভাবে কতটা প্রভাব খাটাতে পারে, তার চমৎকার এক উদাহরণ হয়ে থাকবে এই সিরিজ। কালক্রমে স্টিভেন গ্র্যান্ট, মার্ক স্পেক্টর, কিংবা চন্দ্রদেবতা খোনশু, প্রতিটা চরিত্রই গেঁথে গিয়েছে মানুষের মনে। তবে ছয় পর্বের সিরিজে মুন নাইটের পুরো গল্প কভার না পারায় ব্যাকস্টোরি হিসেবে অনেক কাহিনিই রয়ে গেছে পর্দার আড়ালে। যারা মুন নাইট কমিক পড়েনি, তাদের উদ্দেশ্যে মুন নাইট চরিত্রের অজানা কিছু দিক নিয়ে আজকের এই আলোচনা।
সাদা রংয়ের পোশাক
অনেক কমিকবুক ভক্তের ধারণা, মারভেল মার্ক স্পেকটরকে সৃষ্টি করেছে ডিসি কমিকসের কালজয়ী চরিত্র ব্রুস ওয়েনের আদলে। তারা উভয়েই শহরের নৈশপ্রহরী, অন্ধকারে শত্রুদের কাছে ত্রাসের নামান্তর। তবে কস্টিউম বা পোশাকের দিক দিয়ে তাদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। ব্যাটম্যান সর্বদা কালো রঙয়ের কস্টিউম পরিধান করলেও, মুন নাইটের কস্টিউমের রং ধবধবে সাদা। মুন নাইট সাদা পোশাক পরার কারণ হলো, সে চায়, সে যে শত্রুদের ধবল-ধোলাই করতে এগিয়ে আসছে, তা শত্রুরা দূর থেকেই আঁচ করতে পারুক।
চন্দ্রক্ষমতা অর্জন
বর্তমান টিভি সিরিজে মুন নাইটকে একজন সাধারণ এবং মরণশীল মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার লড়াই কৌশল ছাড়া অন্য কোনো অলৌকিক শক্তি বা ক্ষমতা নেই। কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় এমন ছিল না। ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছয় পর্বের এক মিনি সিরিজে মুন নাইটকে মিশরীয় চন্দ্রদেব খোনশুর সাথে দেখা গিয়েছিল। এসময় খোনশু মার্ককে কিছু বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেছিল। এই ক্ষমতাগুলোর মধ্যে অতিমানবীয় শক্তিমত্তা, স্থায়িত্ব, ছায়াতে অদৃশ্য হওয়া, দ্রুত নিরাময় লাভ করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ছিল। মুন নাইটের এই শক্তি লাভ প্রক্রিয়া সম্পৃক্ত ছিল চন্দ্র উদয়ের সাথে। আকাশে চাঁদ যত পরিষ্কার থাকত, তার শক্তিগুলো হয়ে উঠত তত তীব্রতর।
রূপালী পর্দায় মুন নাইট
টিভি সিরিজ হিসেবে অভিষিক্ত হবার পূর্বে কমিক জগতের রঙিন পাতা থেকে মুন নাইটকে সেলুলয়েডের পর্দায় জীবন্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে মোট দুবার। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো ‘Spike TV’ তে প্রিমিয়ার হওয়া ‘Blade: The Series’ নামক সিরিজের দ্বিতীয় সিজনে মুন নাইটের একটা ক্যামিও থাকার কথা ছিল, যা থেকে পরবর্তীতে পরিকল্পনামাফিক স্পিন-অফ টিভি সিরিজ সেট আপ হতো।
কিন্তু প্রথম সিজন পরেই এই সিরিজ আর আলোর মুখ দেখতে পায় না। ফলে মুখ থুবড়ে পরে যায় মুন নাইট প্রজেক্টও।
ওই বছর অক্টোবরে মার্ভেল স্টুডিওজ ‘নো ইক্যুয়াল এন্টারটেইনমেন্ট’-এর সাথে পার্টনার হয়ে মুন নাইটকে নিয়ে আলাদা টেলিভিশন সিরিজ আনতে চেয়েছিলেন। এজন্য ২০০৮ সালে লেখক জন কুকসেকে সিরিজের ডেভেলপার হিসেবে নিযুক্ত করলেও, এই সিরিজ এগোতে পারেনি।
২০১৭ সালে হলিউড পরিচালক জেমস গান মুন নাইটকে মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সে ইন্ট্রোডিউজ করার একটা প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ব্যাটে-বলে হয়ে উঠেনি। পরবর্তীতে কেভিন ফেইগি ২০১৯ সালে ‘ডি২৩-এ’ মুন নাইট প্রজেক্টের কথা ঘোষণা করেন।
অ্যাভেঞ্জারস দলে মুন নাইট
১৯৮৭ সালে, মার্ক স্পেক্টর ওয়েস্ট কোস্ট অ্যাভেঞ্জারস দলে যোগ দেওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়েছিল। খোনশুর নির্দেশে ওই দলে যোগ দিয়ে সে হকআই, মকিংবার্ড, ওয়ান্ডার ম্যানদের সাথে বিভিন্ন মিশনে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ওয়েস্ট কোস্ট অ্যাভেঞ্জারস একবার সময় পরিভ্রমণের জটিলতায় ৫ হাজার বছর পূর্বের প্রাচীন মিশরীয় আমলে আটকে যায়। ওখান থেকে বের হবার পথ খুঁজতে অ্যাভেঞ্জারদের প্রায় দুই বছর সময় লেগেছিল। এরপর থেকে মুন নাইট অ্যাভেঞ্জার দলের অফিসিয়াল সদস্যপদ পায়। তাকে দেওয়া হয় ‘অ্যাভেঞ্জার্স আইডেন্টিকার্ড’। ২০০৪ সালে অ্যাভেঞ্জারস ডিস অ্যাসেম্বল্ডে স্কারলেট উইচের অ্যাপোক্যালিপ্টিক অ্যাটাকের সময় ক্যাপ্টেন আমেরিকার ডাকে যে কয়জন অ্যাভেঞ্জার সাড়া দিয়েছিল, তার মধ্যে মুন নাইট অন্যতম। ২০১০ সালে স্টিভ রজার্স মুন নাইটকে সিক্রেট অ্যাভেঞ্জারস দলের সদস্য হিসেবে নিয়ে নেয়।
মুন নাইটের প্রথম অস্ত্র
১৯৮৭ সালে ওয়েস্ট কোস্ট অ্যাভেঞ্জারস ইতিহাসের বিভিন্ন টাইমলাইনে ঘুরতে গিয়ে আটকা পড়ে ৫০০০ বছরের প্রাচীন মিশরে। ওই সময় অ্যাভেঞ্জারস দলে ছিল হকআই, আইরন ম্যান, টিগরা, এবং ওয়ান্ডার ম্যান। এই প্রাচীন আমল থেকে বের হবার পথ হন্যে হয়ে খুঁজছিল তারা। তখন একদল খোনশু পূজারীর সাথে দেখা হয় তাদের।
পূজারীরা তাদেরকে নিয়ে যায় দেবতা খোনশুর মন্দিরে। মন্দিরে প্রবেশের পর বিশেষ কিছু পদার্থ চোখে পড়ে হক আইয়ের। সেগুলো দিয়ে সে ডার্ট, বুমেরাং, থ্রোয়িং আইরনসহ বিভিন্ন অস্ত্র বানিয়ে দেয় খোনশুর অনুসারীদের, যাতে তারা যেকোনো ঝামেলা মোকাবেলার পাশাপাশি আত্মরক্ষা করতে পারে। এরপর মার্ক স্পেক্টর একসময় খোনশুর মন্দিরে গেলে প্রতিরক্ষার জন্য তাকে ওই অস্ত্রগুলো একটা হাতে ধরিয়ে দেয় খোনশুর অনুসারীরা। এভাবেই প্রথম নিজের অস্ত্র হাতে পায় মুন নাইট।
মুন নাইটের বাবা
মুন নাইট কমিকের ৩৭ নম্বর ইস্যুতে বর্ণিত আছে, মার্কের পিতা ইলিয়াস স্পেক্টর ছিলেন একজন ইহুদি, যিনি অল্পবয়সেই র্যাবাই হয়েছিলেন। হিটলার যখন ইউরোপে আক্রমণ চালান, তখন ইলিয়াস যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়ে শিকাগোতে স্থায়ী নিবাস গড়ে নেন। ইলিয়াস ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল ও ধর্মভীরু মানুষ। এক রাতে তিনি প্রতিবেশী একদল দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হলেও পাল্টা আক্রমণ করেননি ইলিয়াস। তারা ইলিয়াসের কপালে নাজি বাহিনীর স্বস্তিকা চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল।
ইলিয়াস তার শান্তিবাদী বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে রাখলেও, মার্ক স্পেক্টর আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে স্থানীয় ব্যায়ামাগারে গিয়ে বক্সিং প্রশিক্ষণ নিত। ১৮ বছর বয়সে সে রিং এর একজন সুকৌশলী প্রাইজফাইটার হয়ে ওঠে। ইলিয়াস তখন তার ছেলেকে অনেক অনুরোধ করে, এসব ছেড়েছুড়ে বাড়ি চলে আসতে। সেসময় রেগে গিয়ে মার্ক তার বাবার উপর এক ঘুষি বসিয়ে দিয়েছিল। এরপর আর কখনো দেখা হয়নি তাদের। ইলিয়াস শিকাগোর এক হাসপাতালে ক্যান্সারের সাথে প্রাণপণ লড়াই করে জীবনযুদ্ধে হেরে যান। শেষ বিদায়ে তিনি তার ছেলেকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন।
মৃত্যু এবং পুনরুত্থান
মৃত্যুর পরেও বহুবার জীবন ফিরে পেয়েছে মুন নাইট। মিশরীয় মরুভূমিতে মার্ক স্পেক্টর খুন হবার পর তাকে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিল চন্দ্রদেবতা খোনশু। তখনই ‘ফিস্ট অভ খোনশু’ দলের অন্তর্ভুক্ত হয় মার্ক। ‘মার্ক স্পেক্টর: মুন নাইট’ কমিকসের ২৮ নং ইস্যুতে পিঠে ছুরি মেরে খুন করা হয় স্পেক্টরকে। তখনও তার রক্ষাকর্তা হিসেবে এগিয়ে এসেছিলেন খোনশু।
এই সিরিজে মার্ক বিস্ফোরণে প্রাণ হারালে খোনশু আবারও তাকে জীবন দান করে। বার বার শত্রুদের কাছ থেকে আঘাত পাওয়ার পর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল মার্ক। একসময় তা এত প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে, সুপারহিরো হিসেবে সে আর তার কাজ চালিয়ে যেতে পারছিল না। তখন খোনশু তার সকল শক্তি আবার পুনরুদ্ধার করে দেয়।
কঠোর প্রশিক্ষণ
শুরুতে মার্ক একজন ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে নিজ পেশা শুরু করেছিল। এরপর সিআইএর নৌবাহিনীতে থেকে কঠিন ইস্পাতের ন্যায় নিজেকে দৃঢ় করে গড়ে তুলেছিল সে। সিআইএর এই নিয়মানুবর্তী কঠোর প্রশিক্ষণ লাভের ফলে অন্য যেকোনো সুপারহিরো থেকে যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল মার্ক।
বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হবার পাশাপাশি জুডো, কুং ফু, সাভাতেতে ছিল তার জুড়ি মেলা ভার। মুহূর্তের মধ্যে কীভাবে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে হয়, কোন দুর্বল জায়গায় মারলে সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে প্রতিপক্ষ, তা ভালোভাবেই জানা ছিল মার্কের। পিস্তল থেকে মেশিন গান, স্নাইপার রাইফেল, তলোয়ার, ছুরি, তীর-ধনুকসহ সুদক্ষভাবে যেকোনো অস্ত্র চালনাই ছিল তার বাঁ-হাতের খেল।
ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সমাহার
মুন নাইটের অন্যতম লক্ষণীয় এক বৈশিষ্ট্য হলো, সে ছিল ডিসোসিয়াটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত। প্রথমদিকে সে ধনী ব্যবসায়ী স্টিভেন গ্র্যান্ট, এর বাইরে মার্ক স্পেক্টর এবং মুন নাইটের আলাদা আলাদা চরিত্র ধারণ করত। এছাড়াও সে নিজের মধ্যে জ্যাক লকলি নামক ক্যাব চালকের চরিত্রও তৈরি করে ফেলেছিল।
তবে লেখকরা মালমশলা যোগ করার জন্য আরও অনেক পরিবর্তন এনেছিল তার চরিত্রে। ২০১১ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে চলে যাওয়ার পর মোট পাঁচজন সুপারহিরোর ক্যারেক্টার নিজের মধ্যে তৈরি করে সে। তারা ছিল ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ওলভারিন, স্পাইডার-ম্যান, আইরন ম্যান এবং ইকো।
যখন যে চরিত্র ব্যবহারের দরকার পড়ত, তখন সে চরিত্রই ব্যবহার করত সে। এমনকি প্রত্যেক সুপারহিরোর আলাদা আলাদা ব্যাটেল সিগনেচার পোর্ট্রে করতে দেখা যেত তাকে। ২০১৪ সালে নিউ-ইয়র্কে গিয়ে সে নিজের মধ্যে ‘মিস্টার নাইট’ নামে আরও একটি চরিত্র যোগ করে নেয়। তখন সে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি মুন নাইটের চরিত্রকেও চালিয়ে নেয় রাতের আঁধারে।