হুমায়ূন আহমেদ লেখক হিসেবে যেমন অত্যন্ত জনপ্রিয়, টিভি নাটক নির্মাণেও তাই। একসময় তার খেয়াল হলো, সিনেমা বানাবেন। অনেকই নিষেধ করলেন, এমনকি গুলতেকিন খানও। এরপরও তিনি চিত্রপরিচালক হলেন, নিজের লেখা উপন্যাস ‘আগুনের পরশমণি’কে সেলুলয়েডের ফিতায় বাঁধলেন। প্রথম ছবিতেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে বাজিমাৎ করলেন। এরপরের ছবিগুলোও তাকে নামকরা পরিচালকের খ্যাতি এনে দিল।
সিনেমা বানাবেন, এরকম কোনো স্বপ্ন তার ছিল না। তার মাথায় সিনেমা বানানোর পোকা ঢুকিয়ে দিলেন বন্ধুস্থানীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই আনিস সাবেত। যিনি নামকরা চিত্রপরিচালক হতে চাইলেও দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার তা হতে দেয়নি। কিন্তু অবচেতনভাবে স্বপ্নের বীজ তিনি ঢুকিয়ে দিয়ে যান হুমায়ূন আহমেদের মনে। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়,
“মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু তাদের স্বপ্ন মরে না।”
সিনেমা বানানোর চিন্তা-ভাবনা না থাকলেও সিনেমা দেখার নেশা তার পুরোদস্তুর ছিল। বাচ্চা বয়সে সিলেটের ‘রঙমহল’ ছবিঘরে উর্দু বা হিন্দি ছবি ‘বহত দিন হুয়ে’ দেখেন মামার সাথে। সেই থেকে শুরু। ঢাকা কলেজে পড়াকালীন ‘বলাকা’ আর ‘নাজে’ যেসব ছবি মুক্তি পেত, সবই দেখতেন কোনো বাছবিচার ছাড়া। একদিন শিক্ষিকার পরামর্শে ‘রোমান হলিডে’ দেখলেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথম দেখা ভালো সিনেমা আর সবচেয়ে বেশিবার দেখেছেন ‘ক্রেইনস অভ ফ্লাইং’।
হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিলেন, কেমন করে একদম আনাড়ি থেকে জাতীয় পুরস্কার জয়ী পরিচালক বনে গেলেন, তার ছবির কলাকুশলীদের কর্মকাণ্ড, তার অভিজ্ঞতা, অর্থের যোগাড় হওয়া- এসব নিয়ে তিনি ‘ছবি বানানোর গল্প’ নামে চমৎকার একটি বই লিখে গেছেন। বইতে তিনি তার প্রথম ছবি ‘আগুনের পরশমণি’ পরিচালনার কাহিনী বর্ণনা করেছেন সহজ-সরল ভাষায়, বোনাস হিসেবে ছবির চিত্রনাট্য ও মূল উপন্যাসটি দিয়ে দিয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদের মতে, চিত্রনাট্য তৈরি মানে ৫০ ভাগ কাজ শেষ। তিনিও ৫০ ভাগ কাজ শেষ করলেন। প্রথম ছবির জন্য বাছাই করলেন নিজের লেখা উপন্যাস। তার ভাষায়,
“সিনেমা বানানোর জন্য আগুনের পরশমণি বাছাই করার কারণ হলো, এটি আমার অতি প্রিয় গল্প। অপ্রধান কিছু কারণ আছে, যেমন এটি মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প। পুরো গল্পটি একসেটে বলা হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের একতলা একটি বাড়িতে কয়েকদিনের ঘটনা। অল্প কিছু পাত্র-পাত্রী নিয়ে কাজ। বিশাল আয়োজনের কিছু দরকার নেই।”
চিত্রনাট্য হলো, কিন্তু ছবি বানাতে টাকা তো লাগবে, সেটা নিশ্চয়ই গৌরীসেন দেবে না। তিনি বইয়ের প্রকাশক, বন্ধুবান্ধব, ধনবান কাউকে বাদ দিলেন না টাকা যোগাড়ের জন্য। কাজের কাজ কিছুই হলো না, শেষপর্যন্ত গৌরীসেনই টাকা দিল! সহজভাবে বললে, বাংলাদেশ সরকার অনুদান দিল। এই কাহিনী বেশ মজার। রাতে তিনি চিন্তা করলেন, টাকার যোগাড় যেহেতু নেই, তাই সকালবেলা চিত্রনাট্যটি পুড়িয়ে ফেলবেন, ছবি বানানোর ভূত মাথা থেকে বিদায় নেবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি কাজ করলেন উল্টো, চিত্রনাট্যটি বগলদাবা করে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদার কাছে গেলেন। মন্ত্রী সাহেবের সাথে তার কথোপকথন নিম্নরূপ-
-আপনি তো লেখক মানুষ, ছবি বানানোর আপনি কী জানেন?
-কিছুই জানি না, তবে আমি শিখব।
-শিখে ছবি বানাবেন?
-জি।
-নিজের উপর আপনার এত বিশ্বাসের কারণ কী?
-অন্যের উপর বিশ্বাস করার চেয়ে নিজের উপর বিশ্বাস করা কি ভালো নয়?
হুমায়ূন আহমেদকে অবাক করে দিয়ে মন্ত্রী মহোদয় তার ছবিতে অনুদানের ব্যবস্থা করে দিলেন।
টাকার যোগাড় হলো। এবার সেলুলয়েডের ফিতায় ছবিকে বন্দী করার পালা। ছবির অনানুষ্ঠানিক দৃশ্যধারণ হলো মিরপুর চিড়িয়াখানায় খুব ভোরে, হাজার হাজার অতিথি পাখি ওড়ার দৃশ্য। হুমায়ূন আহমেদের টার্গেট ছিল, সে বছর বিজয় দিবসে ছবি মুক্তি দেবেন। তাই দ্রুত কাজ শুরু করে দিলেন। বাদ সাধলেন স্ত্রী গুলতেকিন খান ও কন্যারা, অভিমান করে তারা কেউ মহরতে এলেন না। এরপর প্রথম শট নেয়ার পালা। সেটা লেখকের মুখেই শোনা যাক,
“আমি বিসমিল্লাহ বলে লেন্সের ভিতর দিয়ে তাকালাম। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই দেখতে পেলাম না। ব্যাপারটা মনে হয় প্রাথমিক উত্তেজনার কারণে হলো। হ্যাঁ, দেখা গেল, ঐতো মতিন সাহেব বসে আছেন।”
ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়, পরিচালক লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশান বললেন দৃশ্যধারণ হলো, ‘কাট’ না বলাতে ক্যামেরা চলতে লাগল। পরদিন পত্রিকায় লেখা হলো,
“নবীন পরিচালক কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ‘কাট’ বলতে ভুলে গেছেন।”
পৃথিবী বিখ্যাত জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার মতে, ভালো পরিচালক হতে হলে আগে ভালো একজন সহকারী পরিচালক লাগবে। হুমায়ূন আহমেদ সে পথে হাঁটলেন, তার সহকারী হলেন মুনির হোসেন চৌধুরী তারা। যাকে তিনি নির্মাণের মাঝপথে বহিষ্কার করেন, তবে আবার তাকে ফেরত এনে কাজ শুরু করলেন। সহ-পরিচালকের সমস্যা ছিল, তিনি নিজেকে সবজান্তা ভাবতেন, অন্য কারো মতকে গুরুত্ব দিতেন না। তবে তাকে নিয়ে যে কেউ নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পারে, এই পরামর্শ হুমায়ূন আহমেদ সবশেষে দিয়েছেন।
চিত্রগ্রাহক হিসেবে তিনি নিলেন আখতার হোসেনকে, যিনি জহির রায়হানের সাথেও কাজ করেছেন। আর সম্পাদক হিসেবে নিলেন আতিকুর রহমান মল্লিককে, যিনি নিজ থেকে হুমায়ূন আহমেদের কাছে এসেছেন। দেশের বিখ্যাত সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা, হুমায়ূন আহমেদকে এক রাতে টেলিফোন করে ছবিতে কাজ করার জন্য জেঁকে ধরলেন। সত্য সাহা ‘আগুনের পরশমণি’তে কাজ করে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে তার দীর্ঘদিনের আক্ষেপ গুছালেন। সত্য সাহার বক্তব্য, হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে লিখেছেন,
“আমরা যারা পুরনো দিনের সংগীত পরিচালক, তাদের সময়টা খুব খারাপ, খুব খারাপ। এখন বেশিরভাগ পরিচালক হিন্দি ছবির সিডি দিয়ে বলে, এই জিনিস চাই। আমার পক্ষে কি সেই জিনিস দেয়া সম্ভব? আপনি আমাকে কাজের স্বাধীনতা দিয়েছেন, আমি সেটা ব্যবহার করেছি।”
হুমায়ূন আহমেদ ছবির প্রধান নারী চরিত্রে অনেকের নিষেধ উপেক্ষা করে বিপাশা হায়াতকে নিলেন। বিপাশাও হুমায়ূন আহমেদের মান রাখলেন, চমৎকার অভিনয় করে প্রথম ছবিতে পেয়ে গেলেন জাতীয় চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। বিপাশাকে নেয়ার কারণ ছিল, ‘আগুনের পরশমণি’ বিপাশার প্রিয় উপন্যাস।
প্রধান অভিনেতা ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। বিপাশার ছোট বোন চরিত্র বাছাইয়ে হুমায়ূন আহমেদ তার ভাষ্য মতে ‘পক্ষপাতিত্ব’ করলেন, নিলেন নিজ কন্যা শীলা আহমেদকে। তিনিও শিশু শিল্পী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে গেলেন। পুরস্কার পাওয়ার পর গুলতেকিন খান শীলাকে বলেন, বাবাকে ধন্যবাদ দিতে কারণ তিনি সুযোগ দেয়াতে শীলা অভিনয় করতে পারল এবং পুরস্কার জিতল। হুমায়ুন আহমেদের লেখনীতে উঠে এল, শীলার ভাষ্য অন্যরকম,
“মা, তুমি একটা ভুল কথা বলছ। বাবা জানে, আমি ভালো অভিনয় করি। সে জেনেশুনে আমাকে নিয়েছে। আমি খারাপ অভিনয় করলে, বাবা কখনো আমাকে নিত না। তাকে আমি খুব ভাল করে চিনি এবং তুমিও চিনো।”
হুমায়ূন আহমেদের মতে, আগুনের পরশমণিতে সবচেয়ে ভালো অভিনয় করেছেন, পাকিস্তানি আর্মির চরিত্র করা ওয়ালিয়ুল ইসলাম। তিনি আরো মনে করেন, তাকে জাতীয় পুরস্কার না দেয়া ভুল হয়েছে।
এই নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও অন্যতম চলচ্চিত্র পরিচালক বরাবরই বাংলাদেশের কলাকুশলীদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে তার একটি বেশ ভাবনা উদ্রেককারী বক্তব্য এখানে তুলে দেয়া হলো-
“আমার কাছে সুবর্ণাকে শাবানা আজমীর চেয়েও বড় অভিনেত্রী মনে হয়। নূরকে (আসাদুজ্জামান নূর) আমার মনে হয় ডাসটিন হাফম্যানের চেয়েও বড় মানের অভিনেতা। আলেক গিনেস কি আবুল হায়াতের চেয়ে বড় অভিনেতা? আমার তা মনে হয় না। হুমায়ূন ফরিদী আরেক গ্র্যান্ড মাস্টার। অভিনয়কলা তার হাতের পোষা পাখি। তাকে যখন দেখি হাল আমলের বাংলা ছবিতে ভিলেন হিসেবে লাফালাফি করছেন, তখন খুব কষ্ট হয়। ক্ষমতাধর অভিনেতা-অভিনেত্রী আমাদের আছে, জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছি না।”
ছবি নির্মাণ শেষ হলো, এবার মুক্তি দেয়ার পালা। তখন হুমায়ূন আহমেদের মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার প্রথম ছবিতে বঙ্গবন্ধু থাকবেন না, তা হয় না। তিনি কৌশলে ৭ই মার্চের ভাষণের অংশবিশেষ এমনভাবে ছবির শুরুতে রাখলেন, যাতে আরোপিত মনে না হয়।
সেন্সর বোর্ড রাজনৈতিক কারণে এটা নিয়ে সমস্যা করল, লেখকের ভাষায় “সূর্যের চেয়ে বালি গরম”। পরে নিজের যুক্তি ও সেন্সর বোর্ডের একজন সদস্য মুস্তফা জামান আব্বাসীর সহযোগিতায় তিনি সেন্সর সার্টিফিকেট পেলেন। ছবির প্রিমিয়ার শো এফডিসিতে উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তিনি এক বসায় পুরো ছবি শেষ করলেন।
হুমায়ূন আহমেদ ছবি নির্মাণে সেনাবাহিনীর অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন। সেনা সদস্যরা পাকিস্তানি আর্মির চরিত্রে অভিনয় করেছেন, অস্ত্র, গোলাবারুদ, কনভয়, জিপ দিয়েছেন ছবির জন্য। সবকিছু করেছেন বিনামূল্যে। তৎকালীন সেনাপ্রধান আশ্বাস দিয়েছিলেন, হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী ছবি যদি মুক্তিযুদ্ধের ছবি হয়, যদি কোনো সাহায্য লাগে, তবে সেনাবাহিনী তার পাশে থাকবে।
ছবি বানানোর গল্প, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চলচ্চিত্র বানানোর বিস্তারিত কর্মযজ্ঞের বিশদ বিবরণ। তার সহজ-সাবলীল গল্প বলার ধরন যেকোনো পাঠককে আকৃষ্ট করে, এ বইয়েও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় সমালোচক। চিত্রপরিচালক হিসেবে নিজের আনাড়িপনা, কীভাবে সেটা কাটিয়ে উঠলেন, তার অনভিজ্ঞতার সুযোগ কীভাবে অন্যরা অপব্যবহার করল, অবলীলায় সেসব লিখে গেছেন। নবীন পরিচালকদের জন্য বইটি চমৎকার অভিজ্ঞতার সোপান হতে পারে, আর পাঠকদের এটি এনে দেবে একটি স্বপ্নযাত্রার আড়ালের কাহিনী জানার সুখানুভূতি।
হুমায়ূন আহমেদ এর “আগুনের পরশমণি” ও “ছবি বানানোর গল্প” বইগুলো অনলাইনে কিনতে চাইলে লিংকে ক্লিক করতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদের সকল বই দেখতে এখানে ক্লিক করুন।