Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইতালীয় খাবারের বিশ্বজয়ের গল্প

আপনি হয়তো মিশরের পিরামিড দেখতে যাবেন। কিংবা স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যেতে পারেন জার্মানিতে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি হয়তো ব্যবসায়িক কারণে আপনাকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পাঠাতে পারে। পরিবারের কারও চিকিৎসার খাতিরে আপনাকে সিঙ্গাপুরেও যেতে হতে পারে। বাঙালি হওয়ার কারণে যেসব খাবার খেয়ে আপনি অভ্যস্ত, এসব দেশের খাদ্যাভাসের সাথে তার সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আপনি হয়তো এই দেশগুলোতে গিয়ে নিজের পরিচিত খাবারগুলো খুঁজতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু আপনার শহরেই যে ফাস্টফুডগুলো পাওয়া যায় (পিৎজা, স্যান্ডউইচ কিংবা আইসক্রিম) তা অনায়াসেই পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় পেয়ে যাবেন। শুধু আপনার শহরেই নয়, সারা বিশ্বজুড়ে এই খাবারগুলোর কদর রয়েছে।

পিৎজা, পাস্তা কিংবা চিকেন স্টিকের মতো খাবারগুলো আমাদের দেশের নিজস্ব খাবার নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে আমাদের পূর্বসূরিদের খাবারের তালিকায় এসব খাবারের নাম কোথাও পাওয়া যায় না। রেস্তোরাঁয় পিৎজার টুকরা খেতে খেতে কখনও ভেবে দেখেছেন কোথা থেকে এসে এই খাবারগুলো আমাদের দেশে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করলো? কিংবা কীভাবে এই খাবারগুলো সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারলো? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে আজকের এই আর্টিকেলে।

পনকবজবজআহ
পিৎজা, পাস্তা কিংবা হরেক রকমের সুস্বাদু সালাদের মতো খাবারের আদিনিবাস হচ্ছে ইতালি; image source: takeaway.com

পিৎজা, স্যান্ডউইচ, পাস্তা, চিকেন স্টিক, ম্যাকারনি কিংবা বিখ্যাত স্প্যাগেত্তির মতো খাবারগুলোর জন্ম ভূমধ্যসাগরের তীরের দেশ ইতালিতে। ইতালির বেশিরভাগ অঞ্চল যেমন সিসিলি, ভেনিস কিংবা তুরিন একসময়ে স্বকীয়তা বজায় রেখে চলতো, পরবর্তীতে তারা একত্র হয়ে ঐক্যবদ্ধ ইতালি গঠন করে। এসব অঞ্চলে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তেমন স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ছিল না। স্বাভাবিক জীবনের জন্য যা দরকার, তার বালাই বলতে কিছুই ছিল না। এজন্য অনেক আগে থেকেই ইতালিয়ানরা দেশ ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়তে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে আমেরিকায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে অনেক ইতালীয় নাগরিক স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি জমান লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপে। তারা স্বদেশ ছেড়ে গেলেও শত শত বছর ধরে চলে আসা ইতালিয়ান খাদ্যাভাসের সংস্কৃতি পরিত্যাগ করেননি। নতুন দেশে গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করলেও ইতালীয় খাবার তৈরির উপাদানগুলোর সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের নিজস্ব খাদ্যাভাসকেই অব্যাহত রেখেছিলেন।

যেকোনো খাবারের আন্তর্জাতিকীকরণে জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সেই খাবার সম্পর্কে যথোপযুক্ত বিজ্ঞাপন দেয়া কিংবা সাধারণ মানুষকে সেই খাবার সম্পর্কে জানানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় ব্রিটিশরা বিনামূল্যে চা-পাতা বিতরণ করতো বাঙালিদের মাঝে। কারণ এর মাধ্যমে বাঙালিরা চা সম্পর্কে জানতে পারতো। নিয়মিত পান করার অভ্যাসের মাধ্যমে এটি একসময় বাঙালির নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হতো। পরবর্তীতে অভ্যাসের কারণে টাকা দিয়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে চা-পাতা কিনতে বাধ্য হয় বাঙালিরা।

ইতালীয় খাবারের ক্ষেত্রে সেই কাজটি করেছিলেন বিভিন্ন দেশে যাওয়া ইতালিয়ান নাগরিকেরা। ইতালিয়ানরা পৃথিবীর সবচেয়ে বন্ধুবৎসল জাতিগুলোর একটি, যারা খাবারের সময় অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষদের বিনয়ের সাথে আমন্ত্রণ জানায়। ইতালীয়রা যখন ইউরোপ কিংবা লাতিন আমেরিকায় গিয়ে নিজেদের খাবার খেত, তখন তারা সেই দেশগুলোর স্থানীয় মানুষদেরও আমন্ত্রণ জানাত। এছাড়াও অনেক ইতালিয়ান বিদেশে গিয়ে আস্ত ইতালীয় রেস্তোরাঁ এবং খাবারের দোকান খুলে বসে, যেখানে সুস্বাদু ইতালীয় খাবার পাওয়া যায়। সেসব খাবারের দোকান কিংবা রেস্তোরাঁয় গিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষ ইতালীয় খাবারের সাথে পরিচিত হয় এবং সাদরে বরণ করে নেয়। ইতালীয় খাবারের বিজ্ঞাপনের কাজটি সম্পাদিত হয়েছিল এভাবেই।

জবজবজ ম
ইতালীয়রা জীবিকার খোঁজে কিংবা অনান্য কারণে আমেরিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, যেটিও তাদের খাবারের বৈশ্বিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে; image source: iitaly.org

ইতালীয় খাবারের সর্বজনগ্রাহ্যতার আরেকটি বড় কারণ ছিল খাবার তৈরির উপাদানগুলোর সহজলভ্যতা। কৃষিবিপ্লবের পর থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক হারে টমেটো, পুদিনা পাতা, অ্যাসপারাগাস, ক্যাপসিকাম প্রভৃতি সবজির চাষ শুরু হয়। আর ইতালীয় খাবারগুলোতে মোটাদাগে সবগুলোতেই এগুলো ব্যবহার করা হয়। যেহেতু এগুলো সারা পৃথিবীতেই পাওয়া যায়, তাই যেকোনো অঞ্চলে ইতালিয়ান খাবার তৈরি করা উপাদান নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। এটাও ইতালীয় খাবারের বিশ্বজয়ের আরেকটি বড় কারণ।

শিল্পবিপ্লবের পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। প্রযুক্তির ব্যবহারে মানুষের কায়িক শ্রমের পরিমাণ কমে আসে, অপরদিকে উৎপাদন বাড়তে থাকে হু হু করে। রান্না করার সরঞ্জামগুলোর আধুনিকায়ন করা হয়, আগের চেয়ে রান্নার পেছনে ব্যয় করা সময়ের পরিমাণ কমে আসে। ইতালীয় খাবারের জনপ্রিয়তার পেছনে এটাও অন্যতম কারণ। শিল্পবিপ্লবের ফলে যে আধুনিক পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে, সেখানে শ্রমিকদের হাতে খাবারের পেছনে বেশি সময় ব্যয় করার সুযোগ ছিল না। তাই স্বল্প সময়ে প্রস্তুত করা ইতালিয়ান খাবারগুলো দ্রুত অনেকের পছন্দের তালিকায় স্থান করে নেয়।

Image source: DojoMojo

গত শতাব্দীর ‘৭০ ও ৮০’র দশকের দিকে নব্য উদারনীতিবাদের উদ্ভবের ফলে বিশ্বায়নের সূচনা হয়। বিশ্বায়নের ছোঁয়া লাগে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পুঁজি কিংবা শ্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের খাবার-দাবারেরও আন্তর্জাতিকীকরণ শুরু হয়। দেখা যেত, যেখানে ইউরোপে কিংবা লাতিন আমেরিকায় অল্প কিছু রেস্তোরাঁয় ইতালীয় খাবার পাওয়া যেত, সেখানে নব্য-উদারনীতিবাদের সূচনা হওয়ার পর অসংখ্য ইতালীয় খাবারের রেঁস্তোরা গড়ে ওঠে, এবং ইতালীয় খাবারের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা হয়ে ওঠে পুঁজিবাদ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের অভিভাবক, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকায় ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ইতালীয় খাবার পুরো বিশ্বের ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

ইতালীয় খাবারের স্বাদ এতটাই চমৎকার যে সব অঞ্চলের মানুষকেই এই খাবার আকৃষ্ট করে। বর্তমানে চীনা খাবার কিংবা থাই খাবারেরও আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে। বাংলাদেশের ভালো রেস্তোরাঁগুলোতে খোঁজ করলেই এসব পাওয়া যাবে। কিন্তু পিৎজা অথবা পাস্তার মতো ইতালীয় খাবার যে পরিমাণে বিক্রয় হয়, তার তুলনায় এসব খাবারের বিক্রয়ের পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। এক্ষেত্রে দামও একটি বিষয়। ইতালীয় খাবারগুলো এমন সব উপাদান দিয়ে তৈরি, যেগুলো অল্প খরচেই পেয়ে যাওয়া সম্ভব। এ কারণে পৃথিবীর সবখানেই তুলনামূলক অল্প খরচে ইতালীয় খাবার পাওয়া যায়, উৎপাদন খরচ কম হওয়ার কারণে।

ইতালীয় খাবার প্রথমে সীমানা পেরিয়ে জায়গা করে নেয় আমেরিকায়। আমেরিকান ও ইতালীয়– দুইয়ের সমন্বয়ে ইতালীয়-আমেরিকান ঘরানার খাবারের উদ্ভব ঘটে, যদিও এতে ইতালিয়ান খাবারের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। বলতে গেলে ইতালীয় খাবারের অভিযোজন ঘটেছে অনেক দেশে। জাপানের কথা বলা যায় এক্ষেত্রে। জাপানের নিজস্ব খাবারের মৌলিক সংস্কৃতি থাকলেও সেদেশে ইতালীয় খাবার তুমুল জনপ্রিয়। জাপানীরা ইতালীয় খাবারের বিবর্তন ঘটিয়ে নিজেদের মতো করে ইতালীয় খাবারের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। যেমন- ইতালীয় পাস্তার বিবর্তন ঘটিয়ে জাপানে ‘ওয়াফু’ পাস্তা ও তাদের নিজস্ব ফ্লেভারের ইয়ুজুকুশো সসেজ এখন খুবই জনপ্রিয়। এগুলোর একটিও ইতালিতে পাওয়া যায় না, অথচ ইতালির খাবারের আদলেই এগুলো তৈরি করা হয়।

ৃবজবজবজ
জাপানি ওয়াফু পাস্তা; image source: favy-jp.com

একটি খাবারের আন্তর্জাতিকীকরণ কিংবা বিশ্বজয়– যা-ই বলা হোক না কেন, তা করতে গেলে অনেকগুলো শর্ত পূরণ করতে হয়। ইতালীয় খাবারগুলো এক্ষেত্রে সবদিক থেকে সফল। ভারতীয় খাবার, চীনা খাবার কিংবা হালের থাই খাবারেরও জনপ্রিয়তা রয়েছে বিশ্বজুড়ে, তবে তা ইতালিয়ান খাবারের কাছে নস্যি। ইতালীয় রেস্তোরাঁগুলোতে তুলনামূলক কম দামে উচ্চমানের সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়, যেখানে ভারতীয় কিংবা চীনা খাবারের ক্ষেত্রে দামের সামঞ্জস্যতা থাকলেঅ স্বাদ প্রত্যাশানুযায়ী থাকে না, আবার স্বাদ নিশ্চিত করতে গেলে দাম অত্যধিক বেড়ে যায়। ইতালীয় খাবারের যে জয়জয়কার দেখেছে পুরো বিশ্ব, এটি হয়তো সামনেও অব্যাহত থাকবে।

Related Articles