“মরিবার তরে বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে,
জনম গিয়েছে ভোগে আর ভাগে, কিছুই পড়ে না রহে।
মোহ মায়াজালে জীবন কাটিছে, ভ্রম রয় আঁখিপাতে,
কাল অমানিশা দিবস কাড়িছে, আলো নেই নব প্রাতে।
বেঁচে থাকা এই জীবন মৃত্যু, অহর্নিশিতে দহে,
মরিবার তরে বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে।”
মানবজীবন এক অদ্ভুত উপাখ্যান। এই জীবন নদীর মতো বহমান। এখানে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না যেন সেই মানব নদীর এপার ওপার। নদীর যেমন এ কূল ভাঙে-ও কূল গড়ে, তেমনি মানব জীবনের সুখ-দুঃখও। ভাঙা-গড়াই যেন জীবনের অংশ। সাদাত হোসাইনের লেখা ‘অন্দরমহল’ উপন্যাসে এই চিরন্তন সত্য খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জীবনের খুব সূক্ষ্ম বিষয়গুলো লেখক খুব সুন্দরভাবে তার লেখায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। মানবমনের বাহিরমহল আর অন্দরমহলে প্রতিনিয়ত যে নীরব যুদ্ধ চলে, তার সুন্দর উপস্থাপন এই বই।
অন্দরমহল মূলত এক হিন্দু জমিদার পরিবারের আখ্যান। বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির সবচেয়ে শক্তিশালী, তেজী এবং দাপুটে জমিদার হলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। তার ভোগ-বিলাস, বেপরোয়া চলাফেরা সম্পর্কে বিষ্ণুপুরের সবাই অবগত। দেবেন্দ্রনারায়ণ মাসের কোনো এক রবিবার দিবাগত রাতে তার বাগানবাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। মাঝরাত অবধি নাচগান হয়। সেখানে দূর-দূরান্ত থেকে আসে রূপবতী বাঈজির দল। ঘটনার সূত্রপাত যে রাতে, সে রাতে তিনি তার বাগানবাড়িতে ভোগ-বিলাসে মত্ত ছিলেন। রাত্রির তৃতীয় প্রহরে তার পেয়াদা রঘু এসে জানান এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ। তাকে গঙ্গাবতী নদীর তীরে যেতে হবে। যে দুসংবাদ থেকেই অন্দরমহলের মূল ঘটনার সূত্রপাত।
দেবেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গাবতী নদীর তীরে ছুটে এলেন। সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা হলো নিতাইয়ের। নিতাই সেই নদীতে নৌকা চালায় এবং মাছ ধরে। দেবেন্দ্রনারায়ণ আসার পর দেখলেন, নিতাই ভয়ে কাঁপছে। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। দেবেন্দ্রনারায়ণের তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। যা দেখার জন্য তিনি এখানে ছুটে এসেছেন, তা তিনি দেখতে পেয়েছেন। নিতাইয়ের পাশে দুই হাত দূরে নিতাইয়ের নৌকাটি বাঁধা। তার পাশেই আরেকটি নৌকা বাঁধা। সেই নৌকায় লণ্ঠনের আবছা আলোয় একটি ছেলেকে শুয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বয়স দশ-এগারো অথবা বারো-তেরো হতে পারে। ছেলেটির পুরো শরীরে গুটি বসন্ত। তখনকার সময়ে মারাত্মকভাবে গুটি বসন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। সেই ছেলেকে ভুলে ছুঁয়ে ফেলেছে নিতাই।
নিতাই এসে দেবেন্দ্রনারায়ণের পায়ে লুটিয়ে পড়ল, তাকে ক্ষমা করার জন্য। নিতাই তখন দেবেন্দ্রনারায়ণকে জানাল, নৌকায় রাখা একটা ঘটিতে ছোট এক চিরকুট আছে। সে তা এনে দেবেন্দ্রনারায়ণকে দিল। চিরকুটটি দেখার আগপর্যন্ত তিনি বালককে ছুঁয়ে ফেলা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, তবে দেখার পর বালককে রক্ষার চিন্তায় মশগুল হয়ে পড়লেন। কী লেখা ছিল সেই চিরকুটে? দেবেন্দ্রনারায়ণ কেনই বা সেই বালককে বাঁচাতে চেয়েছিলেন? তার সাথে কি সম্পর্ক তা জানার জন্য অবশ্যই পাঠককে পুরো উপন্যাসে ডুব দিতে হবে।
উপন্যাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো দেবেন্দ্রনারায়ণের ভাই অবনীন্দ্রনারায়ণ। তিনি কখনোই জমিদারি, সম্পদ, ক্ষমতা এসব নিয়ে ভাবেন না। তার চিন্তাভাবনা স্বাধীন। তার কাছে মনে হয়, মানবজীবনের সবকিছুই বৃথা। জমিদারি কখনও তাকে টানে না। এক রাতে অবনীন্দ্রনারায়ণ ঘর-সংসার ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েন জীবনের উদ্দেশ্য বের করতে। তিনি পরবর্তী সময়ে সন্ন্যাসী জীবন যাপন করতে শুরু করেন। অপরদিকে তার স্ত্রী বীণাবালা ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে ছিলেন। এমনকি দেবেন্দ্রনারায়ণকেও তিনি হত্যা করতে চেয়েছেন। তার লক্ষ্য ছিল বিষ্ণুপুর জমিদারীর সমস্ত ক্ষমতা এবং ধন সম্পদের মালিক হওয়া। এ যেন বিপরীত চরিত্রের দুই মানুষের মিলন।
হেমাঙ্গিনী দেবী নামক এক বাঈজির যুদ্ধের গল্প ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে। কখনো একজন মমতাময়ী মায়ের চরিত্র, যিনি তার সন্তানকে বাঁচাতে লড়ে গিয়েছেন শেষ পর্যন্ত। আবার কখনো নিজের আত্মরক্ষার জন্য লড়ে গিয়েছেন। বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির ভেতরের এক বিরাট রহস্য নিজের ভেতর বহন করে বেরিয়েছেন ছোটবেলা থেকে। আরেক চরিত্র- অন্ধ বিভুঁই; যে কিনা চোখে দেখে না, তা-ও নিজের রক্তে বহন করছে বিষ্ণুপুরের জমিদারি রক্ত। নিজের পিতা-মাতার নিকটে থেকেও পরিচয়হীন বেঁচে থাকার এক উপাখ্যান বিভুঁইয়ের।
লেখক মানব জীবনের খুব বিচিত্র কিছু দিক তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে। দেবেন্দ্রনারায়ণের মেয়ে সর্বজয়া এক সাহসী এবং আদর্শ নারীর চরিত্র। যে কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। রতনকান্তি চরিত্রটি খারাপ সময়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। হরিহরণ বণিক একজন একজন আদর্শ ভৃত্যের ন্যায় সবসময় দেবেন্দ্রনারায়ণের পাশে ছিল। এছাড়াও আরো কিছু পার্শ্ববর্তী চরিত্র আছে, যারা এই উপন্যাসকে আরো অলংকৃত করেছে।
লেখক ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিককার কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন তার লেখায়। তিনি গঙ্গাবতী নদীর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন, যা ছবির মতো সুন্দর এবং এই নদীর সাথে উপন্যাসটির বিশেষ এক যোগসূত্র তৈরি করেছে। সে যোগসূত্র বিষ্ণুপুর জমিদারদের সাথে হরিহরণ এবং হেমাঙ্গিনী দেবীর আদি সম্পর্কের, বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির রাজকোষ চুরি হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে দেবেন্দ্রনারায়ণের হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ার; বীণাবালার ক্ষমতার লোভ এবং অত্যাচারেরও।
দেবেন্দ্রনারায়ণের দাপুটে জমিদারি থেকে হঠাৎ চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে যাওয়াও এ যোগসূত্রেরই অন্তর্ভুক্ত। বিভুঁইয়ের আসল পরিচয় নিয়ে রহস্য ছেয়ে থাকে পুরো উপন্যাসে। গঙ্গাবতী নদীর সাথে জমিদারদের সম্পর্ক এবং মানবজীবনের অন্দরমহলের অমীমাংসিত রহস্য এই উপন্যাসের এক বিস্তৃত পটভূমি, যা পাঠককে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন করতে বাধ্য।
উপন্যাস পড়তে গিয়ে পাঠকের কখনো মনে হবে, এমন না হয়ে অমনটা হলেও পারত। আবার কখনো মনে হবে, একটু অপূর্ণতা আর আফসোস থেকে যাওয়াই ভালো। জীবন কীভাবে চলমান ভাঙা-গড়ার খেলায় বিভিন্ন চরিত্রকে এক করে ফেলতে পারে, তা মানুষ কখনোই টের পায় না। লেখক ব্যাপারটি যথেষ্ট সুন্দরভাবে পাঠকদের মাঝে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। জমিদারদের অন্দরমহলে ডুব দিতে চাইলে পড়ে ফেলতে পারেন সাদাত হোসাইনের ৪৩৮ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি।