গোলের খেলা ফুটবল। ইংরেজি ‘গোল’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল লক্ষ্য। অর্থাৎ, জয়ের জন্য লক্ষ্যভেদ করতে হবে। কিন্তু গোলটা যে হবে, সেটি করবেন কোথায়? বোকার মতো প্রশ্ন, অবশ্যই গোলপোস্ট। গোলপোস্ট ছাড়া আবার খেলা হয় নাকি! শুধু বল থাকলে তো শুধু পাস-পাস কিংবা ‘বলচোর’ টাইপের খেলা খেলতে হবে, কিন্তু এতে কি আর ফুটবলের আসল মজাটা পাওয়া যায়? এইজন্য দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল পেতে আমাদের গোলপোস্টটাই দরকার।
গোলপোস্ট শুনে আমরা সেটাকে নেহায়েত খেলো প্রতিপন্ন করছি বোধহয়। তবে ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে সেই ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ ব্যাপারটাকেই বেশ মজার মনে হতে পারে। চলুন, আজ সেই পথেই যাত্রা করা যাক। আর শুরুটা হোক আমাদের উঠোন থেকেই।
আমরা নিজেদের আশেপাশে এমনিতে খেলার জন্য কী ব্যাবহার করি? সচরাচর জুতো, নাহলে ইট। একটু গুরুত্বপূর্ণ খেলা হলে বাঁশ, খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলেই বড়জোর ইস্পাতের, যাকে গালভরা নামে ডাকা হয় ‘স্টেইনলেস স্টিল’।
ফুটবলের আদিভূমি হিসেবে আমরা চিনি ইউরোপকে। সেই ইউরোপে ফুটবলের গোলপোস্ট কীরকম হবে তা নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি। চীনাদের ফুটবল ছিল ইউরোপীয়দের থেকে অনেক আলাদা। সেখানেও খেলার ফল বের করতে প্রচুর সমস্যার মুখোমুখি হয়।
গোলপোস্ট হিসেবে সর্বপ্রথম বাঁশের ব্যবহার শুরু করে এই চীনারাই। তারা দুই পাশে দুইটি বাঁশ পুঁতে দিয়ে তাদের মাঝে সিল্কের জাল দিয়ে দিত। এই জালে বল স্পর্শ করলেই কেবল গোল হতো।
ইউরোপ আবার কিছু ক্ষেত্রে এই পোস্ট ব্যাপারটাকে আর একটু অদ্ভুতুড়ে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। সপ্তদশ শতকের দিকে একটি ম্যাচ হয়েছিল রাজার দাস এবং ডিউক অফ অ্যালবামার্লের মধ্যে। তারা গোলপোস্ট হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন সামনাসামনি অবস্থিত দুইটি দুর্গের বিশাল দুইটি প্রধান ফটককে। ঐ সময়ে গাছ, ঘরবাড়ি, দেয়াল কিছুই বাদ দেয়া হতো না। মোটামুটি একটা দুরত্ব থাকলেই চলত। এটি অনেকটা আমাদের উপমহাদেশ কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার স্ট্রিট ফুটবলের মতো অবস্থা ছিল।
দুই পোস্টের মাঝে দূরত্ব কত হবে, তা নিয়ে সর্বপ্রথম ১৮৬৩ সালে নিয়ম জারি করে দেয় ব্রিটেনের সমন্বিত ফুটবল এসোসিয়েশন। তাদের ঠিক করে দেওয়া ৮ গজের নিয়ম এখনো ফিফা মেনে চলছে। পুরো বিশ্বেই আদর্শ দূরত্ব হিসেবে ৮ গজকেই ধরা হয়।
পোস্টের ব্যাপারে কিছু সমাধান আসলেও ঐ সময় ক্রসবার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। কোনোমতে দুই পোস্টের মাঝ দিয়ে বল গেলেই গোল হতো। কিন্তু এতে ঝামেলা শুরু হয় আমাদের এলাকায় খেলা ফুটবল ম্যাচের মতো। আমরা গোলরক্ষকের উচ্চতা অনুযায়ী আন্দাজের উপর একটি ক্রসবারের উচ্চতা ধরে নিই। আর এই নিয়ে আমাদের মাঝে প্রায়ই খেলায় ঝগড়াঝাটি শুরু হয়। গোলরক্ষক একটু খাটো হলে তো আরো ঝামেলা। তখন অনেক নিশ্চিত গোলও তার উচ্চতার জন্য বাতিল করতে হয়, না হয় গোলরক্ষক পরিবর্তন করতে হয়।
ইউরোপেও এইরকম কিছু ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। ১৮৬৬ সালের দিকে দুই পোস্টের মাথা ফিতা দিয়ে বেঁধে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা করা হয়। এই পরীক্ষা প্রথম কোনো প্রতিযোগিতায় আসতে আসতে ১৮৭২ সাল চলে আসে। ১৮৭২ সালের এফএ কাপ ফাইনাল হয় ওয়ান্ডারার্স ও রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার্সের মধ্যে লন্ডনের কেনিংটন ওভালে। এই ম্যাচেই প্রথম পোস্টে ফিতা লাগানো হয় ক্রসবার বোঝানোর জন্য। ফিতাটি লাগানো হয় মাটি থেকে ৮ ফুট উপরে।
ফিতা দিয়ে ঐ সময়ে কাজ চালানো গেলেও এফএর চিন্তা ছিল পার্মানেন্ট ক্রসবার বসানো। এর প্রেক্ষিতে তারা কাঠের তৈরি ক্রসবার লাগাতে বলে সবাইকে। ১৯৭৫ সালের দিকে তারা প্রথম এই কাঠের ক্রসবার বসায়। ফিতার মতো এটিও মাটি থেকে ৮ ফুট উপরে ছিল। প্রথমে এটি পরীক্ষামূলক থাকলেও আস্তে আস্তে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৮৮২ সালের দিকে এই বিষয়ে সরাসরি কিছু নিয়ম ঘোষণা করা হয়। শেফিল্ড এফসি আর কুইন্স পার্ক হলো প্রথম দুটি ক্লাব যারা তাদের মাঠে স্থায়ীভাবে এই ক্রসবার বসায়।
তবে কিছু ক্লাব তো থাকেই, যাদের মাথায় সারাক্ষণ দুষ্টু বুদ্ধি ঘুরাফেরা করে। তাদের মাঝে একটি ক্লাব ছিল কেনসিংটন সুইফটস। ১৮৮৮ সালের দিকে এই ক্লাব দুই প্রান্তে দুইরকম উচ্চতায় ক্রসবার বসিয়ে ম্যাচের ফল নিজেদের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই অপচেষ্টা ধরা পরার পর তাদের এফএ কাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
কিন্তু ঝামেলার তো আর শেষ নেই। এরপর শুরু হয় নতুন ঝামেলা, বল আসলেই দুই পোস্টের মাঝে দিয়ে গিয়েছে না বাইরে দিয়ে। এ নিয়ে প্রায় প্রতি খেলাতেই শুরু হয় মারামারি। এছাড়া ১৮৮০ সালের দিকে ইংল্যান্ড বনাম আয়ারল্যান্ড ম্যাচেও এইরকম কিছু বিতর্কিত ঘটনা ঘটে। ৯-১ গোলে হারা ম্যাচে আয়ারল্যান্ড অভিযোগ করে, ইংল্যান্ডের শেষ গোলটি পোস্টের বাইরে দিয়ে গিয়েছে। ঐ সময়ে কেউ পাত্তা দেয়নি, কারণ তারা হেরেছিলই ৮ গোলের ব্যবধানে, ঐ এক গোল হলেই কী, আর না হলেই কী! কিন্তু ৪ বছর পর যখন এই আয়ারল্যান্ডের সাথেই ২-২ গোলে ড্র করে ইংল্যান্ড, তখন ইংল্যান্ড টিম এই ব্যাপারে অভিযোগ করে যে ম্যাচে সমতা আনা আয়ারল্যান্ডের শেষ সময়ের গোলটি ক্রসবারের উপর দিয়ে গিয়েছে। দুই পক্ষই নিজেদের ক্ষতিগ্রস্থ দাবি করে।
এর সমাধান দেওয়া হয় পোস্টে জাল লাগিয়ে। তারা প্যান্টের পকেটের আইডিয়া থেকে এই আইডিয়াটি পায়। বল জালের ভেতরে থাকলে গোল হবেই।। ঐ সময়গুলোতে জাল ছিল অনেক ঢোলা, কোনোমতে পোস্টের সাথে লেগে মাটিতে পড়ে থাকত। দৃষ্টিনন্দন না হলেও যথেষ্ট কাজ চালানোর মতো ছিল। ১৮৯২ সালের এফএ কাপ ফাইনাল হয়েছিল ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবিওন আর অ্যাস্টন ভিলার মধ্যে। এই খেলায় ক্রসবার এবং জাল দুটোই ব্যবহার করা হয়।
তবে নেট লাগানো হলেও কিছু বিতর্কিত ঘটনা এড়ানো যায়নি। যেমন ১৯৬৬ বিশ্বকাপে জিওফ হার্স্টের গোলটি। হার্স্টের শট ক্রসবারে লেগে নিচে ড্রপ খায়। লাইন্সম্যান সেটিকে গোল ঘোষণা করে দেন। এই গোলটি নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়ে গেছে যে বলটি আদৌ গোললাইন অতিক্রম করেছিল কি না।
গোলপোস্টের ব্যাপারে নিয়ম চালু করার পর থেকে গোলপোস্ট তৈরি করা হতো কাঠ দিয়ে। কাঠের টুকরো এনে গোলাকার বা বর্গাকারভাবে কেটে বসানো হতো। মোটামুটি ১০০ বছরের মতো এই কাঠের ব্যবহার চলে। এরপর গত শতাব্দীতে আশির দশকে ক্লাবগুলো কাঠের পরিবর্তে ইস্পাতের পোস্ট বসানো শুরু করে। অ্যালুমিনিয়ামের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় এরপর এটিও ব্যবহার শুরু হয়। যারা ফিফা খেলেন, তারা হয়তো খেয়াল করবেন, যখন কোনো শট পোস্টের ভিতরের সাইডে লেগে গোল হয়, দুই ধারাভাষ্যকার বর্গাকার আকৃতির গোলপোস্টের কথা তোলেন। সেখানে থাকা অ্যালান স্মিথ বয়সে মার্টিন টেইলরের থেকে ছোট, তাই টেইলর স্মিথকে উদ্দেশ্য করেই বলেন,
“যখন বর্গাকার আকৃতির পোস্ট চালু ছিল, তখন তোমার বয়স অনেক কম ছিল অ্যালান, তাই হয়ত তোমার কিছু মনে নেই।”
কিন্তু… হয়েছিলটা কী?
১৯২০ সালের দিকে নটিংহ্যাম ফরেস্ট বর্গাকার আকৃতির পোস্টের বদলে উপবৃত্তাকার আকৃতি ব্যবহার শুরু করে। এই পোস্টগুলি ছিল অনেক টেকসই। আর এগুলো কাঠের পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হওয়ার পর হয়ে ওঠে আরো টেকসই, হালকা ও খেলোয়াড়দের জন্য নিরাপদ। কারণ কাঠ যেকোনো সময়ে ভেঙে যেতে পারে।
এই উপবৃত্তাকার আকৃতির পোস্ট ১৯২০ সালেই চালু হলেও অন্য ক্লাবগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে অনেক সময় লাগে। বিশেষ করে স্কটিশ ক্লাবগুলো আশির দশকেও তাদের পোস্টগুলোতে পরিবর্তন আনেনি। তারা তাদের আগের পুরোনো বর্গাকার আকৃতির পোস্টগুলোই রেখে দেয়। তখন এইরকম বাঁধাধরা নিয়ম না থাকায় কেউ অভিযোগও করেনি। বিপত্তিটা আসে ১৯৭৬ সালের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে, যেটি অনুষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের হ্যাম্পডেন পার্ক স্টেডিয়ামে।
ঐ খেলায় জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখ ১-০ গোলে পরাজিত করে ফরাসি ক্লাব সেন্ট এতিয়েনকে। ঐ খেলায় সেন্ট এতিয়েনের দুইটি শট বর্গাকার পোস্টের কোণায় লেগে ফিরে আসে। ম্যাচ যখন ০-০ সমতায় ছিল, তখন সেন্ট এতিয়েনের মিডফিল্ডার ডমিনিক বেথেনির শট দারুণভাবে পরাস্ত করে বায়ার্নের গোলরক্ষক সেপ মেয়ারকে, কিন্তু তা পোস্টে লেগে ফিরে আসে। এর অল্প কিছুক্ষণ পরেই জ্যাক সান্তিনির হেড একইভাবে পোস্টে লেগে ফিরে আসে। এই দুটি উডওয়ার্ক যদি উপবৃত্তাকার আকৃতির পোস্টে হতো, তবে দুটিই গোল হওয়ার খুবই সম্ভাবনা ছিল। এরকম কিছু বিতর্কিত ঘটনার জন্য ১৯৮৭ সালে নিয়ম করে দেওয়া হয় যে গোলপোস্ট উপবৃত্তাকারই হতে হবে। বর্গাকার গোলপোস্ট ফিফা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয়।
পোস্টের আকৃতির এই পরিবর্তনটা বাদ দিলে মোটামুটি ১৩০ বছর ধরে গোলপোস্টের নিয়ম অপরিবর্তিত আছে। ফিফা টুকটাক কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ে পরিবর্তন আনলেও আদর্শ মডেল হিসেবে এখনো রয়ে গেছে সেই উনিশ শতকের ফুটবলীয় আইনের গোলপোস্ট। ফিফার মতে এখন গোলপোস্টের নিম্নবর্ণীত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হবে:
-
মাঠের দুই মাথায় যে দুইটি গোললাইন থাকে, ঐ গোললাইনের মাঝ বরাবর বসবে একটি গোল, অর্থাৎ দুই মাথায় দুই গোল। একটি গোলের দুইটি পোস্ট মাঝ বরাবর থেকে সমান দূরত্বে দুইপাশে বসবে।
-
পোস্ট দুইটি কর্নার ফ্ল্যাগ হতে সমান দূরত্বে বসাতে হবে। আর পোস্ট দুইটির মাথা একটি ক্রসবারের সাথে যুক্ত করে দিতে হবে। এগুলো বানাতে কাঠ, নাহলে অন্য কোনো ধাতু ব্যবহার করতে হবে। আর এইগুলো অবশ্যই সাদা রংয়ের হতে হবে।
-
ফিফার স্বীকৃত নিয়মে পোস্টের আকৃতি হিসেবে বর্গাকার, আয়তাকার, গোলাকার ও উপবৃত্তাকার – এই ৪ রকমই বলা আছে। কিন্তু বিতর্ক এড়াতে এখন শুধু উপবৃত্তাকার ব্যবহার করা হয়।
-
পোস্ট কোনোভাবেই যেন খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে, তা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। যেমন অনেকসময় বর্গাকার পোস্টের কোণ ধারালো হলে যে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে।
-
গোলপোস্ট আর ক্রসবারের প্রস্থ অবশ্যই সমান হতে হবে। এর আদর্শ পরিমাপ ১২ সেন্টিমিটার বা ৫ ইঞ্চি। গোললাইনের প্রস্থও এর সমান হতে হবে।
১৯৮৭ সালে উপবৃতাকার গোলপোস্ট বাদে অন্যগুলো বাতিল হওয়ার আগে নিয়মগুলো এমন ছিল:
-
পোস্টের আকার যদি বর্গাকার হয়, তবে তা গোললাইনের সাথে সমান্তরালে বসবে।
-
পোস্টের আকার যদি আয়তাকার হয়, তবে ছোট পাশ গোললাইনের বর্ডারের সাথে সমান্তরালে বসবে এবং তা গোললাইনে সাথে মিলে যাবে।
-
গোলপোস্টের আকার যদি বৃত্তাকার হয়, তবে তা এমনভাবে বসবে যেন গোললাইনের প্রস্থের মাঝ বরাবর হয়।
-
গোলপোস্টের আকার যদি উপবৃত্তাকার হয়, তবে এর ছোট অক্ষ, গোললাইনের সমান্তরালে মাঝামাঝি বসবে।
-
একটি গোলের দুইটি পোস্টের দূরত্ব হবে ৮ গজ (২৪ ফুট) বা ৭.৩২ মিটার। আর মাটি থেকে ক্রসবারের উচ্চতা হবে ৮ ফুট বা ২.৪৪ মিটার।
বর্তমানে গোলপোস্টে দেওয়া হয়েছে দৃষ্টিসুখকর আকৃতি। ক্রসবার এমনভাবে বানানো, যেন ক্রসবারের উপরের দিকে লাগলে বল বাইরে চলে যায়, আর নিচের দিকে লাগলে গোললাইনে পড়ে ভিতরে চলে যায় কিংবা খেলায় ফিরে আসে। ২০১০ বিশ্বকাপে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের গোল বাতিল হওয়ার পর আসে গোললাইন প্রযুক্তি। এর আগেও এইরকম কিছু ঘটনার জন্য গোল নিশ্চিত হওয়ার জন্য নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টায় ছিল সবাই। কিন্তু এই গোলটিই আসলে সবকিছুর পরিবর্তন করে দেয়।
এটা ছিল ২০১০ বিশ্বকাপের ঘটনা। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায় মুখোমুখি হয়েছিল জার্মানি ও ইংল্যান্ড। ম্যাচের বয়স তখন ৩৮ মিনিট, ইংল্যান্ড ১-২ গোলে পিছিয়ে। এই অবস্থায় বক্সের কোণায় বল পান ল্যাম্পার্ড। জার্মান গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যার তার লাইন ছেড়ে অনেকটুকু সামনে ছিলেন, সেই সুযোগে সেখান থেকে ল্যাম্পার্ড তার মাথার উপর দিয়ে বলটি শট করেন। বলটি ক্রসবারে লেগে নিচে নামে। বলটি তখনো গোললাইন পার হয়ে ভিতরে ছিল, এমনকি তা মাটিতেও পড়ে গোললাইনের কমপক্ষে ১ ফুট ভেতরে। বলটি ভেতরে ড্রপ করে আবার ক্রসবারের নিচের দিকে লাগে। ওই মুহূর্তে যারা দেখেছিল, সবাই খালি চোখেই নিশ্চিত ছিল যে এটা গোল; নিশ্চিত ছিলেন না কেবল রেফারিই। ম্যানুয়েল নয়্যার তড়িৎ গতিতে বলটি ধরে লং থ্রু করেন পোডলস্কির কাছে কাউন্টার অ্যাটাকের জন্য। রিপ্লেতে দেখা যায়, আগের যেকোনো বিতর্কিত গোলের তুলনায় এটা বেশ পরিষ্কার গোল।
প্রযুক্তির এই যুগে এমনভাবে গুরুতর ভুল? তাও আবার বিশ্বকাপ নকআউট পর্বের ম্যাচে? আইএফএবি সেই ১৯৯৯ সাল থেকেই মাঠে গোল নিশ্চিত হওয়া নিয়ে কাজ করছিল। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে কিছু প্রযুক্তির উপর পরীক্ষা চালানো হয়। সেসব আইএফেবির ২০১০ সালের মার্চের মিটিংয়ে তোলা হয়। কিন্তু সামান্য কিছু সমস্যা ছিল গোল ঘোষণার ক্ষেত্রে। এটিকে ইস্যু ধরে সেপ ব্লাটার ও মিশেল প্লাতিনি এর কোনো সমাধানের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি বাতিল করে দেন। ল্যাম্পার্ডের বাতিল হওয়া গোল এটাকে আবার পুনর্জীবিত করে। সে বছরের সেপ্টেম্বরে ফিফা ১৩টি কোম্পানিকে তাদের গোললাইন টেকনোলজি প্রদর্শনের সুযোগ দেয়। সেখানে কিছু সমস্যা উঠে আসে, যেমন ক্যামেরার নড়াচড়া বা মাত্রাতিরিক্ত গরমের ব্যাপার – যে পরিস্থিতিগুলোয় সিস্টেমটি ঠিকমতো কাজ করতো না। ২০১২ সালে ফিফা ‘হকআই’ এবং ‘গোলরেফ’ নামে দু’টি টেকনোলজিকে অনুমোদন দেয় যা ২০১২ সালের ক্লাব বিশ্বকাপে প্রথমবার ব্যবহার করা হয়।
গোললাইন টেকনলজির প্রথম সুবিধাটা পান এডিন জেকো। ২০১৩-১৪ মৌসুমের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এটি প্রথম চালু করা হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপে এর সাহায্যে ফ্রান্স একমাত্র গোলে হারায় হন্ডুরাসকে। এই টেকনোলজি আসার আগে উয়েফা গোলপোস্টের পাশে একজন করে বাড়তি সহকারি রেফারিকে বসায় যাদের কাজ ছিল গোল হওয়া-না হওয়া খেয়াল করা।
এখন এই টেকনোলজির জন্য ম্যাচের আগে রেফারি বসানো সেন্সরগুলো চেক করে নেন। বল গোললাইন অতিক্রম করলে রেফারির হাতে থাকা ঘড়িতে নোটিফিকেশন চলে আসে।
পোস্টের জালকে এখন অনেক পোক্ত করা হয়েছে। জালসহ পোস্টটিকে একটা বাক্সের মতো মনে হয়। সরাসরি পরিবর্তন না আসলেও এরকম অনেক নতুন জিনিস দিয়ে হালনাগাদ করা হয়েছে গোলপোস্টকে। প্রয়োজনের তাগিদে হয়তো আমরা সামনের দিনগুলোতেও এইরকম পরিবর্তন আরো পাব। তবে গোলপোস্ট যে দায়িত্বে আছে, তার কোনো পরিবর্তন হবে না।
এবার বলুন, এখনও গোলপোস্ট ব্যাপারটাকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ মনে হচ্ছে কি?