মহাভারতের পাতায় পাতায় জীবনের বহু চরিত্র এবং অনুভূতি এসে ভিড় করে। সংসারের সবচেয়ে সজ্জন ব্যক্তি থেকে শুরু করে কুটিলতম চরিত্রের মনস্তত্ত্ব রচিত হয় এই মহাকাব্যে। সেই কতকাল আগে সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিশালাকায় একটি কবিতা আজো তাই কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। স্বল্পশিক্ষিত গ্রাম্য গৃহবধূ কিংবা বাঘা পণ্ডিত ব্যক্তি, কেউই মহাভারত থেকে খালি হাতে ফেরেন না। অনাদিকাল ধরে মহাভারতের এই সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অবাক করবার মতো।
মহাভারতের মূল আখ্যান কুরু-পাণ্ডবের গৃহবিবাদ ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হলেও এর মাঝে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে অসংখ্য উপাখ্যান। ধর্মীয়ভাবে আটকে ফেলার কারণে আমরা অনেকসময় ভুলে যাই, মহাভারত প্রাচীন ভারতীয় সমাজধারার সবচেয়ে সহজাতভাবে গড়ে ওঠা একটি দলিল। বহুবার এখানে প্রেমের অবতারণা ঘটেছে বিচিত্রভাবে। প্রেম, বিচ্ছেদ, যুদ্ধ, নিষ্ঠুরতা, চক্রান্ত, কূটনীতি আর প্রগাঢ় ভালোবাসায় আর্বতিত হয়েছে মানব-মানবীদের জীবন। সেসব প্রেমের মধ্য থেকে একটি বিশেষ গাথা, মহাভারতের আদিপর্ব থেকে কচ আর দেবযানীর চমৎকার গল্পটি নিয়ে আজ আলোচনা হবে।
মহাভারতে দেবতা আর অসুরের অহরহ দেখা-সাক্ষাৎ হয়। ত্রিলোকের ক্ষমতা নিয়ে একবার তাদের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ দেখা দিল। যুদ্ধে দেবতারা বৃহস্পতি এবং অসুররা শুক্রাচার্যের পৌরোহিত্য গ্রহণ করলেন। শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা জানতেন। এই বিদ্যা দিয়ে মন্ত্রবলে মৃত ব্যক্তিকে আবার জীবিত করে তোলা সম্ভব। দানবদের তখন ভীষণ সুসময়। দেবতারা যেসকল দানবকে যুদ্ধে পরাজিত করে মারতেন, শুক্রাচার্য নিমেষেই তাদের দেহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। দেবতারা এ সমস্যার কোনো কূলকিনারা দেখছেন না। একে একে সব মৃত দানবের দেহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলে, যুদ্ধ টিকে থাকা দুরূহ ব্যাপার।
দেবতারা সকলে মিলে বৃহস্পতিপুত্র কচের শরণাপন্ন হলেন তখন। কচ তরুণ, সুদর্শন যুবক। শিল্পকলায় বিশেষ পারদর্শী। দেবতারা কচকে পরামর্শ দিলেন, শুক্রাচার্যের কাছ থেকে সঞ্জীবনী বিদ্যা রপ্ত করে আসতে। আর শুক্রের কন্যা দেবযানীকে মুগ্ধ করতে পারলে বিদ্যার্জন আরো সহজ হয়ে উঠবে, এই ছিল দেবতাদের পরিকল্পনা। স্বজাতির স্বার্থ রক্ষায় হাজার বছরের জন্য কচ পাড়ি জমালেন শুক্রাচার্যের কাছে বিদ্যালাভের আশায়। মহাভারতে সময়ের হিসেব বড় গোলমেলে। এখানে সহস্র বছর সময়ের হিসাব তাই দুগ্ধপোষ্য শিশু।
ব্রাহ্মণের পুত্র শিষ্যত্ব কামনা করলে, অপর ব্রাহ্মণ তা কখনোই প্রত্যাখ্যান করতেন না। ফলে, শুক্রাচার্য কচকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করলেন। গুরু ও গুরুকন্যার সেবা করে কচের ব্রহ্মচর্য জীবন শুরু হলো। কিন্তু এদিকে দেবযানী এবং কচের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। নির্জন বনপ্রান্তর এই দুই নর-নারীর যৌথ সঙ্গীতে প্লাবিত হতো। কচ বনের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি দেবযানীর জন্য তুলে নিয়ে আসতেন।
পাঁচশো বছর কেটে গেল। কচ ক্রমশ বাকি দানবদের ক্রোষানলে পড়তে শুরু করলেন। তারা হয়তো কচের এখানে আসবার আসল কারণ অনুমান করতে পেরেছিল। কচ একবার সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে গেলে দানবদের একচেটিয়া আধিপত্য টিকবে না। সুতরাং কচকে মেরে ফেলাই ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। কচের উপর শুক্রের গাভীদের দেখাশোনা করবার ভার ছিল। একদিন বিকালে, কচ বনে গরু চরানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ সুযোগে দানবেরা কচকে মেরে ফেলে, তার মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে কুকুরকে খাইয়ে দিল।
সূর্য অস্ত গেল। গরুর দল ঘরে ফিরে এল। কচকে না দেখে দেবযানী দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। শুক্রের কাছে গিয়ে নিজের আশঙ্কার জানালেন দেবযানী। দেবযানী ধারণা করতে পারছিলেন, হয়তো কচকে কোনোভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করলেন। তিনবার “এসো, কচ” বলে আহ্বান করতেই কুকুরের শরীর ভেদ করে অক্ষত শরীরে কচ উপস্থিত হলেন। প্রাণ ফিরে পেয়ে কচ আবার গুরুসেবায় মন দিলেন।
কিন্তু দানবেরা এত সহজে ক্ষান্ত হলো না। একদিন দেবযানীর খোঁপার জন্য এক বিশেষ ধরনের ফুল প্রয়োজন। কচ ফুলের সংগ্রহে ক্রমশ গভীর বনে এগিয়ে যেতে থাকলেন। সেখানে অসুরেরা আবার কচকে হত্যা করল এবং তার হাড়-মাংস ছুঁড়ে ফেলল সমুদ্রে। এবারও কন্যার করুণ আকুতিতে শুক্রাচার্য কচকে প্রাণদান করলেন।
পরপর দু’বার এরকম নিদারুণ ব্যর্থতা দানবদের ভাবিয়ে তুলল। সহজ উপায়ে কচকে আবার হত্যা করে যে লাভ নেই, বুঝেছিলেন তারা। তাই এবার নতুন ফন্দি আঁটতে হবে। এবার কচকে মেরে তার মৃতদেহের ছাই সোমরসের সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে খাইয়ে দিলেন দানবেরা।
সোমরস হলো মদ, মাংস ও ঘি দিয়ে বানানো একপ্রকার পানীয়। সমাজের উঁচুতলার মানুষদের জন্য এ পানীয় নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল না সেকালে। দেবযানী পিতার কাছে কচের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন আবারও। শুক্রাচার্য কন্যাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, মৃত ব্যক্তির জন্য বারবার বিলাপ অনর্থক। তবু দেবযানীকে কোনোক্রমেই থামানো যাচ্ছিল না। দেবযানী বললেন, কচকে ফিরে না পেলে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন।
শুক্র ধ্যানে বসে দেখলেন, কচ তারই উদরে। কচের কাছে থেকে সব ঘটনা শুনলেন। কচের উপর এবার সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করলে কচ তার উদর ভেদ করে বেরিয়ে আসবেন। তাতে শুক্রাচার্য নিজেই মারা যাবেন। আবার কচকে না বাঁচালে তার দ্বারা ব্রাহ্মণহত্যা হবে। এদিকে তার আদরের কন্যাটিও কচের শোকে মুহ্যমান। দেবযানীর সামনে প্রবল ধর্মসংকট। পিতার জীবনের বিনিময়ে তিনি প্রেমিকের জীবন চাইতে পারেন না। যেকোনো একজনের মৃত্যুই তার কাছে নিজের মৃত্যুতুল্য। দেবযানী শোকে স্তম্ভিত হয়ে রইলেন।
অবশেষে শুক্রাচার্য নিজের গর্ভে থাকা কচকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শেখালেন, যাতে মৃত্যুর পর কচ আবার তাকে জীবিত করে তুলতে পারে। গুরুর পাকস্থলী থেকে বের হয়ে কচ এ বিদ্যা প্রয়োগ করে শুক্রাচার্যকে নবজীবন দিলেন। এরপর আরো বহু বছর কচ গুরুগৃহে বিদ্যাচর্চায় কাটালেন।
হাজার বছর কেটে গেল। কচের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এল। দেবযানী কচকে এ পর্যায়ে প্রেম নিবেদন করলেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু কচ প্রবল অসম্মতি জানালেন। তার যুক্তি ছিল, যেহেতু তিনি শুক্রাচার্যের শরীর থেকে নবজীবন লাভ করেছেন, সেহেতু দেবযানী তার বোনের মতো। এ বিয়ে ধর্মসঙ্গত হতে পারে না। তাছাড়া তিনি ইন্দ্রপুরী থেকে বিশেষ কাজ নিয়ে এসেছেন। এখানে এসে কোনো নারীর সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক স্থাপন তার পক্ষে সম্ভব নয়।
এখানে উল্লেখ্য, নারীর প্রেমপ্রস্তাব হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন জায়গায় প্রত্যাখ্যাত হতে দেখা গেছে। শূর্পনখার প্রেম প্রত্যাখান করেছেন লক্ষণ এবং তার নাক কেটে নিয়েছেন, উর্বশীর আহ্বান অবলীলায় অস্বীকার করেছেন অর্জুন, পার্বতীর আকুতিতে শুরুতে শিব খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না। এসব ঘটনা আদতে সমাজে পুরুষের ‘মহত্ত্ব’ প্রচার করে। ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা ও প্রেমের চাইতে পুরুষ কর্তব্যকেই এগিয়ে রাখে, এ বাণীই মূলত এসব আখ্যানের মধ্যে দিয়ে প্রচার করা হয়।
তবে দেবযানী এখানে আর্দশ ভারতীয় নারীর সেই তথাকথিত রূপটি পালন করেন না, যে নারী যাবতীয় অবমাননা নীরবে সহ্য করে। কচের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে দেবযানী কচকে অভিশাপ দেন। মহাভারত বা রামায়ণে নারীদের অভিশাপ দেওয়ার ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষেরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অধস্তন নারীদের শাপ দিতেন। দেবযানী এখানে ব্যতিক্রম।
তিনি কচকে অভিশাপ দেন, তিনি কখনো সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারবেন না। শুধুমাত্র অপরকে শেখাতে পারবেন। হাজার বছর ধরে অর্জিত বিদ্যার ভারবাহক হয়ে থাকতে হবে তাকে। প্রমনাথ বিশী একবার বলেছেন, “দেবযানী প্রাচীনতম মর্ডান উইমেন”। এ অভিশাপে ক্রোধান্বিত হয়ে কচও পাল্টা অভিশাপ দেন, দেবযানীর কখনোই ব্রাহ্মণ পু্ত্রের সঙ্গে বিয়ে হবে না। কুলীন ব্রাহ্মণের কন্যা হয়েও তার বিয়ে হবে ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে। এ অভিশাপ দেবযানীর পরবর্তী জীবনে সত্যি হয়েছিল।
পৌরাণিক এ প্রেমের অবসান ঘটে পারস্পরিক অভিশাপের ছোবলে। অভিশাপ পর্ব সমাপ্ত হলে কচ ফিরে যান স্বর্গরাজ্যে। আদতে কচের জীবনে বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিল। প্রেমকে কখনোই জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি রাখেননি। বরং বৃহত্তর উদ্দেশ্যের পথে চমৎকার অবলম্বন হয়েছে তার প্রেম। উদ্দেশ্য সম্পন্ন হবার পর আলাদা করে মূল্য পায়নি তার প্রেম। ভাবভঙ্গিতে মনে হয়, দেবযানী হাজার বছর পর হঠাৎ একদিন প্রেমপ্রস্তাব নিয়ে এসেছে, আগে তার পক্ষ থেকে কোনো আগ্রহই ছিল না- যা সত্য নয়।
এ কাহিনী নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০০ বঙ্গাব্দে রচনা করেন ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতা। মহাভারতের একাধিক আখ্যান ও চরিত্র রবীন্দ্রসাহিত্যে দেখতে পাওয়া যায়। এ গল্পের শেষের অংশ অবশ্য তিনি বদলে দেন। দেবযানীর অভিশাপ দেওয়া পর্যন্ত গল্প প্রায় ব্যাসদেবের মহাভারতের সঙ্গে মিলে যায়। তবে অভিশাপের বদলে কচকে দিয়ে তিনি প্রচার করেন প্রেমের চিরন্তন বাণী। কচ স্বর্গে ফিরে যাওয়ার আগে দেবযানীর নিখাদ মঙ্গলকামনা করেন। নিজে অভিশাপে জর্জরিত হয়েও কচ বলে ওঠেন,
“আমি বর দিনু, দেবী তুমি সুখী হবে-
ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে”
বিদায় অভিশাপ নিয়ে পরবর্তী আলোচনায় ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ বলেন,
“মেয়েদের ব্রত পুরুষকে বাঁধা আর পুরুষের ব্রত মেয়ের বাঁধন কাটিয়ে স্বর্গলোকের রাস্তা বানানো।….যে দুর্গম পথে মেয়ে-পুরুষের চিরকালের দ্বন্দ্ব, সেখানে পুরুষেরা হোক জয়ী….।”
এ কাহিনীকে উপজীব্য করে ১৮৫৯ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্য শৈলীতে ‘শর্মিষ্ঠা’ নামক একটি নাটক উপস্থাপন করেন। পাশ্চাত্য রোমাঞ্চ এবং প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থা ও মূল্যবোধের অদ্ভুত মেলবন্ধন দেখানো হয়েছে নাটকটিতে। দেবযানী, দেবযানীর স্বামী যযাতি ও কচের ত্রিভুজ প্রেম চিত্রিত হয়েছে এখানে। এটিই বাংলা সাহিত্যে রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। সে যুগে ইংরেজি শিক্ষিত পাঠক সমাজে নাটকটি সমাদৃত হয়। বেলগাছিয়ার রঙ্গমঞ্চে নাটকটি অভিনীত হয়।
প্রেম আর প্রতিশোধের এই পৌরাণিক প্রেম পাঠকের মনে চিরকালীন আবেদন তৈরি করেছে। মহাকাব্যের পাতা থেকে এ গল্প সেলুলয়েডও উঠে এসেছে আধুনিক যুগে। ১৯৪১ সালে ভারতে তামিল চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে কচ আর দেবযানীকে নিয়ে। কালে কালে অনুভূতির তীব্রতায় পাঠক মগ্ন হয়েছে এই গল্পে।