মহাশূন্য যেন এক বিশাল সমুদ্র। অজানা এ জায়গা নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। আমরা তাই প্রতিনিয়ত প্রাণের খোঁজে কিংবা জ্বালানির উদ্দেশ্যে মহাকাশে অভিযান চালনা করেছি বিভিন্ন সময়ে। এ স্থানে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষভাবে তৈরি মহাকাশযান। মহাকাশযান পরিচালনা করতে হয় অনেকটা সমুদ্রের জাহাজের মতোই। সমুদ্রে যদি জাহাজডুবি বা নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে, তাহলে যাত্রীরা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে সাহায্যের আবেদন জানাতে পারেন। কিন্তু মহাকাশযান বা স্পেসক্রাফট যদি পৃথিবীর বাইরের আকাশে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়, তখন কি নভোচারীরা পারেন জাহাজের সেই যাত্রীদের মতো ঝাঁপ দিতে?
অবশ্যই না। পানি আর মহাশূন্য এক নয়। কিন্তু মহাকাশযানে যদি জ্বালানি কিংবা বিদ্যুতের অভাব দেখা যায়? এটি যদি বিস্ফারিত হয়? সোজা ভাষায় বললে, সমুদ্রের জাহাজডুবির মতো ঘটনা ঘটলে মহাকাশযানের যাত্রীদের কী অবস্থা হবে? একদিকে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলবেন, অন্যদিকে পৃথিবীতে ফিরে আসার মতো জ্বালানি কিংবা বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেনও অবশিষ্ট থাকবে না। তারা হারিয়ে যাবেন চিরতরে।
বর্তমানে প্রযুক্তি অবশ্য অনেক উন্নতি করেছে। কিন্তু ১৯৭০ সালে এ অবস্থা ছিল না। নাসার অ্যাপোলো অভিযানের প্রথম দুটি অভিযান সফল হওয়ায় সকলেই যেন অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলেন। এ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই কাল হয়ে দাঁড়ায় অ্যাপোলো-১৩ মিশনের সময়। মহাশূন্যে প্রথমবারের মতো দুর্ঘটনার মুখে পড়ে কোনো মহাকাশযান। তবে সেই অবস্থা থেকে পৃথিবীতে ফিরেও আসে তিনজন নভোচারীর সেই দল। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়েছিল কীভাবে? এর ব্যাখ্যা শুনলে মনে হবে যেন কোনো সায়েন্স ফিকশন থ্রিলার! এটা ছিল ব্যর্থতায় মোড়ানো এক সফল অভিযান। নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে ১৯৭২ সালের ৩ নভেম্বরে অ্যাপোলো-১৩ মিশন নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য সেই প্রতিবেদনটি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
১৩ এপ্রিল ১৯৭০; সোমবারের সেই রাতে কেন্দ্রীয় সময় ৯ টার কিছু সময় পর দূরের পশ্চিমাকাশে অতি ক্ষুদ্র আলোর শিখা দেখা যায়। দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের ছায়াপথের দূরবর্তী কোনো স্থানের তারা বিস্ফারিত হচ্ছে। টেক্সাসের হিউস্টোনের কাছে মানব পরিবহণকারী মহাকাশযান কেন্দ্রের প্রকৌশলীদের চোখেও পড়ে দূর আকাশের সেই আভা। তারা দুই দিন আগে উড্ডয়ন করা অ্যাপোলো-১৩ স্পেসক্রাফটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। স্পেসক্রাফটটি তখন চাঁদ থেকে এক দিনের দূরত্বে ছিল এবং দুই দিন পর চাঁদে অবতরণ করার কথা ছিল।
প্রকৌশলীদের গ্রুপের একজন অ্যান্ডি সাউলিয়েটিস একটি টেলিস্কোপকে টেলিভিশনের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত করলেন যেন টেলিস্কোপে দৃশ্যায়মান হওয়া ছবিগুলো স্ক্রিনে ভেসে উঠে। উপরে রাতের আকাশ ছিল গভীর জলের মতো পরিষ্কার ও কালো। মাঝে মাঝে কিছু মেঘ ঢেউয়ের মতো দেখাচ্ছিল। সাউলিয়েটিস এবং তার সঙ্গীরা কেউই অ্যাপোলো-১৩ মিশনের সাথে যুক্ত ছিলেন না। ঘটনাচক্রে এর সাথে সম্পর্কিত অন্য একটা প্রকল্পের জন্য এটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু তাদের থেকে ২ লক্ষ ৫ হাজার মাইল দূরে স্পেসক্রাফটটি হারিয়ে যায়।
যা-ই হোকম তারা সেই স্পেসক্রাফটকে সম্মুখ দিকে চালিত করা রকেটটির ওপর নজর রাখতে থাকেন, যা পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে গিয়ে স্পেসক্রাফটটি ছেড়ে দেয় এবং তার পেছন পেছন চাঁদের দিকে অনুসরণ করতে থাকে। সেই রকেটটি ক্ষুদ্র আলোক কণার মতো দেখাচ্ছিল যা পরিবর্তনশীল তারার মতো ধীরে ধীরে কাঁপছিল। জ্বালানি ফুরিয়ে আসায় এর প্রান্ত টলমল করছিল। সূর্যের আলোর বিভিন্ন তীব্রতা অনুযায়ী এর ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পাচ্ছিল। নয়টার কিছুক্ষণ আগে হিউস্টনের ছাদের সেই পর্যবেক্ষক দল রকেটটি হারিয়ে ফেলে। তাদের কাছে থাকা সরঞ্জাম দিয়ে সেই ক্ষুদ্র আলোককণা পর্যন্তই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব ছিল।
হঠাৎ করে টেলিভিশনের স্ক্রিনের মাঝ বরাবর একটি উজ্জ্বল বিন্দু দেখা গেল। দশ মিনিটের মধ্যে এটি ছোট চাকতির মতো আকার ধারণ করল। ছাদের পর্যবেক্ষক দলের ২০০ গজ দূরেই ছিল মিশন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এটি ছিল বিশাল একটি দালান, যা দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। একটি অংশে ছিল অপারেশন কক্ষসমূহ এবং অন্যটিতে ছিল অফিস। এদের মধ্যে সংযোগকারী অংশও ছিল। পর্যবেক্ষক দলের সাথে মিশন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কোনো যোগাযোগ ছিল না। আকাশের সেই আভা দেখে তার সাথে অ্যাপোলো মহাকাশযানের বিস্ফোরণ কিংবা এর ক্রুদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরির পরিস্থিতিও তাই তাদের মাঝে ছিল না। ক্রুদের মধ্যে কমান্ডার ছিলেন আমেরিকান নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন জেমস আর্থার লাভেল জুনিয়র। কমান্ড ও লুনার মডিউলের পাইলট হিসেবে ছিলেন জন এল সুইগার্ট জুনিয়র ও ফ্রেড ডব্লিউ হাইস জুনিয়র। তারা উভয়ই ছিলেন বেসামরিক সদস্য।
মিশন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র টেলিস্কোপে অ্যাপোলো-১৩-কে দেখতে পাচ্ছিল না। কেন্দ্র অথবা নভোচারীরা টের পাওয়ার আগেই মহাকাশযানের দুটি অক্সিজেন ট্যাংক ফেটে যায়। তখন ৩০০ পাউন্ডের মতো তরল অক্সিজেন ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যে। ফলে মহাকাশযানের বিদ্যুৎ ও পানি উৎপাদনের অর্ধেক উপাদানই হারিয়ে যায়। তরল অক্সিজেন বের হওয়ার পর একটা বড় দলার মতো দেখায়। অভিকর্ষ না থাকায় এই দলা খুব দ্রুত বড় ক্ষেত্র তৈরি করে। এর ওপর সূর্যের আলো পড়ায় চকচক করতে থাকে। দশ মিনিটের মধ্যে এর ব্যাস হয়ে যায় ৩০ মাইল! এরপর এই সাদা চাকতিটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। যদিও এর রয়ে যাওয়া কিছু অংশ এক ঘণ্টা পরও কানাডার আরেকটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ থেকে দেখা যায়।
সাউলিয়েটিস ও তার অন্য সঙ্গীরা মনে করেছিলেন স্ক্রিনে দেখানো সাদা চাকতিটি তাদের টেলিভিশন সেটের ত্রুটির কারণে হচ্ছে। স্ক্রিনে তীব্র ঝাঁকুনি ও বিশ্রী শব্দ হচ্ছিল। তাই তারা বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং পরের দিন সকাল পর্যন্ত এটা নিয়ে আর কিছু ভাবেননি।
এর আগে আরো দুটি অ্যাপোলো মিশনের চাঁদে সফল অবতরণ হওয়ায় মহাকাশ কেন্দ্রের কেউ দুর্ঘটনার কথা চিন্তাই করেননি। পরবর্তীতে প্রাথমিকভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় মহাকাশযানটি জুল ভার্নের সায়েন্স ফিকশনের মতো উলকাপিণ্ডের আঘাতের শিকার হয়ে থাকতে পারে। কেউই ভাবেনি মহাকাশযানেই ত্রুটি থাকতে পারে। মিশন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে কয়েক ডজন স্বয়ংক্রিয় কলম কাজ করছিল, যা অ্যাপোলো-১৩ থেকে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে আসা ডেটাগুলো লিপিবদ্ধ করছিল। বিস্ফোরণের সময় স্বয়ংক্রিয় কলমগুলো প্রায় দুই সেকেন্ড বন্ধ ছিল। ডেটা গ্রহণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া নির্দেশ করে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ত্রুটি অথবা মহাকাশযান থেকে ডেটা পরিবহণে কোনো ত্রুটি হয়েছে। কিন্তু কেউই এটা তখন লক্ষ্য করেনি।
মিশন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের অপারেশন ভবনটি ছিল গাট্টাগোট্টা স্তম্ভের মতো, যেন মহাকাশের দূরবর্তী স্থানের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী। ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা ছিলেন বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন, যেন সাগরের জাহাজে নিচের ডেকের নাবিকদের মতো। নিচের ডেকের মতোই সেখানে কোনো জানালা ছিল না। অর্থাৎ, পুরো অপারেশন ভবনই ছিল সামুদ্রিক জাহাজের নিচের ডেকের মতো। এর উপরের ডেক ছিল মহাকাশে দুই লাখ মাইল দূরে।
নভোচারীরা এখানে নির্জন এলাকার একাকী কোনো নায়ক নন। বরং তারা বিদেশে যাওয়া বড় জাহাজের অফিসার। ফলে তাদের ভূমিকা উপলব্ধি করা অনেকের জন্য কঠিন মনে হতে পারে। মহাকাশযানে থাকা নভোচারীরা এবং মিশন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে থাকা ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা সংখ্যায় মিলিতভাবে বড় জাহাজের অফিসারদের সংখ্যার সমানই ছিলেন। তারা নিচের ডেকে থাকা নাবিকদের সাথে ব্রিজে থাকা অফিসারদের মতোই একসাথে কাজ করতেন। এমনকি কন্ট্রোলারদের একজন যিনি ছিলেন ফ্লাইট ডিরেক্টর, তাকে কিছু ক্ষেত্রে মহাকাশযানের প্রকৃত অধিনায়ক হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
যদিও নভোচারীদের সাথে পৃথিবীতে থাকা ডিরেক্টরের সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরশীল ছিল, নভোচারীরা তার নির্দেশমতোই কাজ করত। বিশেষ করে জরুরি মুহূর্তে তাদের ওপরই নির্ভর করতে হতো নভোচারীদের। ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা পৃথিবীতে থাকলেও টেলিমেট্রির মাধ্যমে তাদের কাছে মহাকাশযান থেকে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে তথ্য আসতে থাকত। মহাকাশ সম্পর্কে ওই মুহূর্তে নভোচারীদের চেয়ে তাদের কাছেই তথ্য থাকত বেশি। অপারেশন ভবনের চতুর্থ তলায় মিশন নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেয়ালের রঙ ছিল কমান্ড মডিউলের ভেতরের অংশের মতো ধূসর রঙ।
অপারেশন কক্ষের সামনের দিকে থাকা পাঁচটি বড় স্ক্রিন ছিল যেন মহাকাশ পর্যবেক্ষণের জানালা। মাঝখানের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল বামে পৃথিবী ও ডানে চাঁদ। মাঝখানের গাঢ় হলুদ রঙের লাইন নির্দেশ করে মহাকাশযান উৎক্ষেপণের রাস্তা।
ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের বেশিরভাগের বয়সই ছিল বিশ-ত্রিশের কোঠায়। তারা চারটি সারিতে বসেছিলেন। ওই মুহূর্তে তারা ছিলেন নিরুদ্বেগ, এমনকি বিরক্তও। প্রথম ৫৫ ঘণ্টা এতই সাবলীলভাবে গিয়েছিল যে, একপর্যায়ে নভোচারীদের বার্তা পাঠান তারা নাকি পৃথিবীতে থাকা কন্ট্রোলারদের ‘ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন’। অ্যাপোলো-১৩ পৃথিবীর কক্ষপথ ত্যাগ করার পর ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের কাছে একটি ঘটনাই কেবল দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এটি ছিল দুর্ঘটনার আগের দিন একটি ছোট রকেটের পুড়ে যাওয়ার ঘটনা। রকেট পাঠানো ছিল ‘হাইব্রিড স্থানান্তর কৌশল’ এর অংশ। এর মাধ্যমে মহাকাশযানকে চাঁদের ফ্রা মাউরো অঞ্চল লক্ষ্য করে পাঠানো হয়। ঘটনাক্রমে এটি মহাকাশযানের জন্য নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার রাস্তা তৈরি করে দেয়, যা পূর্ববর্তী অ্যাপোলো মিশনগুলো ব্যবহার করেছিল। এতে মহাকাশযান কোনো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলে নেভিগেশন সামঞ্জস্য ঠিক করা ছাড়াই চাঁদকে ঘিরে পৃথিবীতে ফেরত চলে আসতে পারত।
ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের মধ্যে একজন থাকেন রেট্রোফায়ার অফিসার, যার কাজ থাকে মহাকাশে মিশনের সময় প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে সবসময় একটা পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখা, যেন নভোচারীদের পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা যায়। সেই রাতে নয়টা বাজার দুই মিনিট আগে তিনি ফ্লাইট ডিরেক্টরকে জানান আরেকটি ব্রিজ পুড়তে যাচ্ছে, যা একটি নিউমেটিক টিউব সিস্টেমের মাধ্যমে কনসোলের সাথে সংযুক্ত। তিনি একটি রুটিন চিঠি প্রেরণ করেন, যাতে বলা হয় মহাকাশযান হয়তো তার গতির দিক বিপরীতমুখে পরিবর্তন করতে পারবে না এবং পৃথিবীতে ফেরত আসতে পারবে না, যদি খারাপ কিছু ঘটে।
সেখানে অপারেশন কক্ষে দুই ডজন কন্ট্রোলার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক কন্ট্রোলার যেকোনো সময় সরাসরি মহাকাশযান চালনার সাথে যুক্ত ছিলেন। সম্মুখ সারিকে বলা হতো ‘ট্রেঞ্চ’। এখানে তিনজন ফ্লাইট ডিনামিক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তারা মহাকাশযানের গতিপথ সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন। ডান থেকে বামে ছিলেন যথাক্রমে গাইডেন্স অফিসার বা গাইডো (GUIDO), যিনি ছিলেন প্রধান নেভিগেশন অফিসার, মাঝে ছিলেন ফ্লাইট ডিনামিক অফিসার বা ফিডো (FIDO), যিনি গতিপথ নকশা করেন ও স্পেসক্রাফট সেটা ঠিকমতো অনুসরণ করছে কিনা সেটা লক্ষ্য রাখেন, এবং সবার বামে ছিলেন রেট্রো অফিসার বা রেট্রো (RETRO), যার দায়িত্ব ছিল মহাকাশযানকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
ট্রেঞ্চের পেছনে দ্বিতীয় সারির বেশিরভাগ কর্মী ছিলেন সিস্টেমস অপারেশন ইঞ্জিনিয়ার। তারা মহাকাশযানের অভ্যন্তরীণ অংশের সরঞ্জাম নিরীক্ষণ করতেন। এই সারির মাখখানে ছিলেন ইইকম (EECOM), যার কাজ ছিল কমান্ড মডিউলের বৈদ্যুতিক, পরিবেশগত ও অন্যান্য সিস্টেম দেখাশোনা করা যেখানে চড়ে নভোচারীরা উড্ডয়ন করেছিলেন। তার পাশে ছিলেন এলএম সিস্টেম অফিসার বা টেলমু (TELMU)। তিনি একই কাজ করতেন লুনার মডিউলের ক্ষেত্রে। এটি দিয়ে নভোচারীরা চাঁদে অবতরণ করার কথা ছিল। এরপর ছিলেন দুজন গাইডেন্স ও নেভিগেশন কন্ট্রোল অফিসার। তারা একজন ছিলেন যথাক্রমে জিএনসি (GNC) যিনি কমান্ড মডিউলের দায়িত্বে, অন্যজন ‘কন্ট্রোলার’, যিনি ছিলেন লুনার মডিউলের দায়িত্বে। তারা দুই মডিউলের যন্ত্রাংশ সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি সম্মুখদিকে পথ পরিচালনারও দায়িত্ব পালন করেন।
তাদের বামে ছিলেন স্পেসক্রাফটের সংবাদদাতা ক্যাপকম (CAPCOM)। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি নভোচারীদের সাথে সরাসরি কথা বলতে পারতেন। তার বামে ছিলেন ফ্লাইট সার্জন। ফ্লাইট সার্জনের পেছনে তৃতীয় সারিতে ছিলেন ইন্সট্রুম্যান্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার। তিনি মহাকাশযান থেকে আসা বেতার তরঙ্গ ও টেলিমেট্রির ট্রান্সমিটারের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সর্বশেষ এই সারির মাঝখানে সবার ওপর চোখ রাখার মতো সুবিধাজনক স্থানে থাকতেন ফ্লাইট পরিচালক। তিনি ছিলেন মহাকাশযানের পার্থিব অংশের সহ-অধিনায়ক। চতুর্থ সারিতে বসতেন প্রশাসক, জনসম্পর্ক বিষয়ক অফিসাররা।
মহাকাশযান নিয়ন্ত্রণকারীরা চারটি দলে বিভক্ত ছিলেন। তাদের দলগুলোর নাম ছিল হোয়াইট, ব্ল্যাক, ম্যারুন ও গোল্ড। দুর্ঘটনার সময়টাতে দায়িত্বে ছিল হোয়াইট দল। তারা ইন্টারকমের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। নিয়ন্ত্রণকারীদের গাইডো, ফিডো, রেট্রো ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত নামে ডাকা হতো। অ্যাপোলো-১৩ কে ডাকা হতো শুধুমাত্র ‘থার্টিন’ নামে।
এরপর দেখুন- অ্যাপোলো-১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প (পর্ব ২)