হুগো শাভেজ। ল্যাটিন অ্যামেরিকার তুমুল জনপ্রিয়, সদা হাস্যোজ্জ্বল, বিতর্কিত এক রাজনীতিবিদ। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন নানাবিধ বিতর্কের। বহুমুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এই ব্যক্তির জীবন নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
শাভেজের পুরো নাম হুগো রাফায়েল শাভেজ ফ্রিয়াস। ভেনেজুয়েলার বারিন্যাস রাজ্যের সাবানেটা শহরে ১৯৫৪ সালের ২৮ জুলাই তার জন্ম। ২০১৩ সালের ৫ মার্চ, ৫৯ বছর বয়সে কারকাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হুগো শাভেজের মাঝে রাজনীতির বীজ বপনের কাজটি করেছিলেন তার দাদী রোজা আইনেস শাভেজ। দাদীর কল্যাণেই শাভেজের মাঝে ইতিহাস ও রাজনীতির প্রাথমিক সঞ্চারণ ঘটে। এ তো গেল শৈশবের কথা। কৈশোরে তার এক স্থানীয় শিক্ষক হোসে এস্তেবান রুইজ গুয়েভারা তাকে উত্তর অ্যামেরিকার স্বাধীনতাকামী নেতা সিমন বলিভার এবং সাম্যবাদের গুরু জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস বিষয়ে দীক্ষা দেন। বলা বাহুল্য, পরবর্তী জীবনে শাভেজের নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন গড়ে ওঠার পেছনে বলিভার ও মার্কসের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এছাড়াও ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মড ফোর্সেস (Fuerzas Armadas de Liberación Nacional; FALN) বিদ্রোহী কার্যক্রম দ্বারাও তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। এটি ছিল মূলত সাম্যবাদী গেরিলাদের একটি দল যারা ১৯৬০ সাল থেকে ভেনেজুয়েলা সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক আক্রমণ পরিচালনা করে আসছিল। সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী গেরিলাদের এই দলটি পেয়েছিল আরেক প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিবিদ ফিদেল ক্যাস্ট্রোর অকুণ্ঠ সমর্থন। এবং পরবর্তীতে ক্যাস্ট্রো হয়ে ওঠেন শাভেজের চিন্তাচেতনা আর অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎসস্থল।
শাভেজ নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘বলিভারিয়ান বিপ্লবের’ নায়ক হিসেবে। ‘বলিভারিয়ান বিপ্লব’ এর নামকরণ করা হয় মূলত উত্তর অ্যামেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃৎ সিমন বলিভিয়ার নামানুসারে। ‘বলিভারিয়ান বিপ্লব’ প্রকৃতপক্ষে একটি সমাজতন্ত্রবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন হলেও শাভেজের উদ্যোগে সেটি কিছুটা ভিন্ন খাতে পরিচালিত হয় ভেনেজুয়েলায়। অর্থাৎ তিনি নিজেকে ‘বলিভারিয়ান বিপ্লব’ এর অনুসারী বলে দাবী করলেও বস্তুত এর পথ তিনি পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করেননি। নিজস্ব ধ্যান-ধারণা বাস্তবায়নের নিমিত্তে ‘বলিভারিয়ান বিপ্লব’ শাভেজের নেতৃত্বে কিছুটা বাঁক বদল করেছিল বটে। পরবর্তীতে তার নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনা অনেকের কাছেই পরিচিত হয় ‘শ্যাভিজমো’ নামে।
রাজনীতিবিদ হিসেবে শাভেজ দ্ব্যর্থহীনভাবে ক্যারিশম্যাটিক ছিলেন। রাজনীতি বিশ্লেষকদের অধিকাংশের মতে, ফিদেল ক্যাস্ট্রো-পরবর্তী সময়ে শাভেজের ন্যায় এতটা বিতর্কিত রাজনৈতিক নেতা ল্যাটিন অ্যামেরিকা দ্বিতীয় আর দেখেনি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ একটি ল্যাটিন অ্যামেরিকান দেশ ভেনেজুয়েলাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পুনঃসংস্কারের মধ্য দিয়ে। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে নিজের দেশকে তিনি যে ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিচালনা করেছিলেন, তার ভাষায় সেটি ছিল বিদ্যমান সমাজতন্ত্র আর মুক্ত বাজার অর্থনীতির মধ্যপন্থা।
কিশোর শাভেজ ছিলেন একজন দুর্দান্ত বেসবল খেলোয়াড়। বেসবল প্রতিভার কারণে দেশের প্রসিদ্ধ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগদানের অপূর্ব সুযোগ তার কাছে চলে আসে। নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেন সেনাবাহিনীতেও। একের পর এক পদোন্নতি পেয়ে তিনি অবশেষে প্যারাট্রুপারদের একটি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পান।
সেই সময় ভেনেজুয়েলা সরকারে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের অবাধে ঘুষ গ্রহণ, জুয়ার নেশা, বাজি ধরা ইত্যাদি বিষয়গুলো হয়ে গিয়েছিল জলবৎ তরলং। এতটা অবাধে এসবের চর্চা দেখে শাভেজ ক্ষুব্ধ হয়ে সমমনা আরও কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে দুর্নীতি বিরোধী কমিশন গঠন করেন যেটি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে কার্যক্রম চালাতে থাকে। শাভেজ দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রম শুরু করেন ১৯৮০ সালে। অবশেষে আচমকা কামান দাগার মতোই ১৯৯২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১২,০০০ সৈন্য সহযোগে ভেনেজুয়েলার তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘোষণা করেন।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কারলোস আন্দ্রেজ পেরেজ এই বিদ্রোহকে দমন করেন। শাস্তি হিসেবে শাভেজ কারাবন্দিত্ব গ্রহণ করেন। এই অভ্যুত্থান কার্যত সফল না হলেও এর দুটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল যার মাঝে প্রথমটি শাভেজের জন্য ব্যক্তিগত সাফল্য এবং দ্বিতীয়টি সামষ্টিকভাবে দেশের জন্য কল্যাণকর। এর ফলেই তিনি একজন জাতীয় বীরে পরিণত হন। এছাড়া ভেনেজুয়েলার সরকারের মুখোশ উন্মোচনের মাধ্যমে দেশের মানুষের কাছে এটুকু পরিষ্কার হয়েছিল যে দেশ সত্যিই কোন পথে যাচ্ছে।
দুর্নীতির আখড়া হয়ে ওঠা পেরেজ সরকার কিছুদিনের মাঝে এমনিতেই গদি হারায়। অভিশংসনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯৪ সালে জেল থেকে মুক্তি পান হুগো শাভেজ। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি মিলিটারিতে থাকা তার ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন ব্যক্তিদের সাথে নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করেন এবং এরই মাধ্যমে ‘বলিভারিয়ান বিপ্লবী আন্দোলন’ এর সূচনা হয়।
শাভেজ একদিকে ছিলেন ক্যাস্ট্রোর প্রবল অনুরাগী, অন্যদিকে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত বিরোধী। রাজনৈতিকভাবে শাভেজ যা পেয়েছেন বা যা হারিয়েছেন- রাজনৈতিক জীবন জুড়ে তার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে তার অবস্থান যা ছিল তার উপর শাভেজের ক্যাস্ট্রোপ্রিয়তা আর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ দুটোরই উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।
জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে তুলনামূলক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে বৈষম্য ও শোষণমূলক আচরণ ছিল, শাভেজ ছিলেন তার স্পষ্ট বিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেতৃত্বে (অন্তত শাভেজের বিশ্বাস অনুযায়ী) ভেনেজুয়েলায় শাভেজের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় তার কিছুকাল পরেই তিনি পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হন। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তার মনোভাব অধিকতর আগ্রাসী রূপ ধারণ করে। এবং একই সাথে তিনি ইরান, কিউবা, নিকারাগুয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে মনোযোগী হন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের সরাসরি ও প্রকাশ্য সমালোচনা করতে গিয়ে শাভেজ একপর্যায়ে জর্জ ডব্লিউ বুশকে ‘গাধা’ বলে আখ্যা দেন।
ভেনেজুয়েলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে শাভেজ একজন জনমানুষের রাজনীতিবিদ হিসেবে আবেগের স্থান পেয়েছিলেন এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে দেশটির উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির নাগরিকদের কাছে তিনি অত্যন্ত বিরক্তির পাত্র হয়ে এসেছিলেন। কারণ তিনি দেশের মুষ্টিমেয় লোকের কাছে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে থাকার বিরুদ্ধে ছিলেন। এই শ্রেণির নাগরিক কর্তৃক অধিকৃত সম্পত্তির (ভূমি, শিল্প কারখানা) একটি নির্দিষ্ট অংশ তিনি জাতীয়করণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই বুর্জোয়া শ্রেণি তার উপর ক্ষুব্ধ হয়।
হুগো শাভেজ তর্কাতীতভাবেই একজন কিংবদন্তি। তার মতো এমন অনন্যসাধারণ নেতা এক প্রজন্মে দ্বিতীয়টি মেলা ভার। তার সহজাত রাজনৈতিক বোধবুদ্ধির সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থান করবেন আর্জেন্টাইন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হুয়ান ডমিঙ্গো পেরন। শাভেজের সাথে তার সাদৃশ্য এখানেই যে পেরন নিজেও একজন প্রাক্তন মিলিটারি সদস্য এবং সেনাবাহিনীর ক্যারিয়ার শেষে রাজনীতিতে প্রবেশ করে তিনিও গণমানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন।
শাভেজের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব কী? তিনি সেসব জনগণের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছিলেন যারা যুক্তরাষ্ট্রকেই বিশ্বের তথা নিজেদের মোড়ল হিসেবে মেনে নেওয়ার বদলে স্বীয় শক্তির উপর ভিত্তি করে লড়াই চালিয়ে যেতে ছিল বদ্ধপরিকর। ল্যাটিন অ্যামেরিকায় ভেনেজুয়েলার অবস্থানও তাই অনন্য উচ্চতায়। ল্যাটিন অ্যামেরিকা মনে রাখবে ভেনেজুয়েলাকে, আর ভেনেজুয়েলা মনে রাখবে তাদের অবিসংবাদিত মায়েস্ত্রো হুগো শাভেজকে।