আমেরিকান উদ্ভাবক এবং বিশিষ্ট শিল্পপতি স্যামুয়েল কোল্ট, রিভলবারের আবিষ্কারক হিসেবে সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন পৃথিবীর প্রথম এমন আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাতা, যা একবার রিলোড করলে একাধিকবার গুলি করতে পারতো। তিনি বাণিজ্যিকভাবে রিভলবার সরবরাহের জন্য কোল্ট’স ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যা কিনা এখনো আমেরিকার অন্যতম সেরা উৎপাদনশীল আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। দেড়শ বছরের অধিক সময় ধরে এই কোম্পানি চলে আসছে কোল্টের জন্যই। কারণ কোল্টই আগ্নেয়াস্ত্রকে তার সৃজনশীল চিন্তাভাবনা দিয়ে সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে যান। যখন তিনি মারা যান, ততদিনে অস্ত্রশিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন এই মেধাবী উদ্ভাবক।
যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের হার্টফোর্ডে বসবাস করতেন বিশিষ্ট টেক্সটাইল শিল্পপতি ক্রিস্টোফার কোল্ট ও তার স্ত্রী সারাহ কোল্ট। ১৮১৪ সালের ১৯ জুলাই তাদের ঘর আলো করে আসে একটি সুদর্শন পুত্রসন্তান, স্যামুয়েল কোল্ট। সুদর্শন যতটুকু তার চেয়ে বেশি মেধাবী, সেটি প্রমাণিত হতেও বেশি সময় নেয়নি। তবে সৃষ্টিকর্তাও যে কাকতালীয়তা পছন্দ করেন, তা স্যামুয়েল কোল্টের ভবিষ্যৎ জীবন প্রমাণ করে দেয়। হ্যাঁ, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আমেরিকা যখন মরণখেলায় মেতে ওঠে, (১৮১২ সালে শুরু হওয়া যে যুদ্ধটি ‘ওয়্যার অব ১৮১২’ নামে পরিচিত) সেসময়ই জন্ম কোল্টের। আর তাইতো আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন করেই জীবন কাটিয়েছেন তিনি!
চলুন, কোল্টের ছেলেবেলা থেকে একটু ঘুরে আসা যাক! ব্যাটারিচালিত ছোট খেলনা গাড়ি, কথা বলতে পারা পুতুল, টিভির রিমোট, মেলা থেকে কিনে দেয়া খেলনা পিস্তল আর ভিডিও গেমস, বড় ভাইবোনের ব্যবহার করা ক্যালকুলেটর, হলফ করে বলতে পারি আপনিও শৈশবে এসব জিনিস খুলে ফেলেছেন, নষ্ট করেছেন, ভেঙেছেন কৌতুহল থেকে। এমন কৌতূহল কোল্টেরও ছিল। যা-ই হোক, বাবার টেক্সটাইল কারখানায় নিয়মিত যাতায়াত করে যেকোনো যন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন শিশু কোল্ট। যন্ত্র দেখলেই তার মনে প্রশ্ন জাগতো তা কীভাবে কাজ করে সে প্রক্রিয়া জানার। আর এই জিজ্ঞাসা থেকেই খেলনা আর অন্যান্য গৃহস্থালী জিনিস খুলতে খুলতে কোল্ট পৌঁছে গেলেন তার বাবার লাইসেন্স করানো বন্দুক পর্যন্ত! নিজের বন্দুকের যাচ্ছেতাই অবস্থা দেখে ক্রিস্টোফার যতটা ক্ষেপেছিলেন, তার চেয়ে বেশি খেপেছিলেন এই ভেবে যে যদি ভুলক্রমে বন্দুক চালিয়ে ফেলতো শিশু কোল্ট! কিন্তু পরদিনই ক্রিস্টোফারকে বিস্ময়ের সাগরে নিমজ্জিত করে বন্দুকটি যথাযথরূপে তার সামনে হাজির করলেন কোল্ট! যদিও বন্দুকটি আর কাজ করেনি।
১৬ বছর বয়সে ম্যাসাচুসেটসের অ্যামহার্স্ট একাডেমিতে নৌপরিচালনাবিদ্যা পড়ার জন্য ভর্তি হন স্যামুয়েল কোল্ট। কিন্তু অতিমাত্রায় দুষ্টু স্বভাবের জন্য তিনি সেখান থেকে বহিষ্কৃত হন! ক্রিস্টোফার তাই সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে হাতে-কলমেই শেখাবেন ন্যাভিগেশন। ফলে এক বছরের লম্বা এক সমুদ্রযাত্রায় কর্ভো নামক এক জাহাজে করে সমুদ্রের বুকে পাড়ি জমালেন কোল্ট। এই সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে এসে আরো দু’বছর উত্তর আমেরিকা চষে বেড়িয়েছেন তিনি। তবে তার জীবন পরিবর্তন করে দেয়া ঘটনাটি ঘটেছিল কর্ভোতেই। জাহাজের দিক পরিবর্তনের চাকা এবং ক্লাচ তাকে কৌতূহলী করে তুললো। চাকার এই নিয়ন্ত্রিত ঘূর্ণনকে তিনি একটি ‘সিঙ্গেল-শুট’ বন্দুকের মধ্যে স্থাপনের কথা কল্পনা করতে লাগলেন। আর তার মাথায় খেলে গেল এমন এক পিস্তল নির্মাণের ধারণা, যা আগ্নেয়াস্ত্রের গতিপথটাই বদলে দেয়।
অনেকেই স্যামুয়েল কোল্টের রিভলবারকে উদ্ভাবন না বলে প্রবর্তন বলতে চান। কারণ তার পিস্তল গড়ে উঠেছিল মূলতা ঘূর্ণায়মান ফ্লিন্টলকের উপর ভিত্তি করে। এ ধরনের ফ্লিন্টলক ততদিনে বোস্টনের উদ্ভাবক এলিশা কলিয়ের প্যাটেন্ট করিয়ে বসে আছেন। কোল্ট তার রিভলভিং সিলিন্ডার মেকানিজমের জন্য ১৮৩৫ ও ১৮৩৬ সালে যথাক্রমে যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকার প্যাটেন্ট লাভ করেন। তার প্যাটেন্টে নতুন সংযোজন ছিল লোডিং সুবিধা, কম ওজন, সিলিন্ডারের অবস্থানের জন্য পিস্তলের সুস্থিরতা এবং অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে পরপর দু’বার গুলি করার সক্ষমতা। ১৮৩৬ সালেই নিউ জার্সিতে তিনি তার ‘কোল্ট’স আর্মস ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং উৎপাদন শুরু করেন।
প্রাথমিকভাবে কোল্ট কিছু শটগান বেল্ট, বন্দুক রাখার খাপ এবং পকেট পিস্তল উৎপাদন করেন যেগুলোর প্রতিটিই রিভলভিং বা ঘূর্ণায়মান সিলিন্ডার নীতির উপর তৈরি ছিল। এই সিলিন্ডারের ভেতরেই গানপাউডার এবং বুলেট লোড করা হতো। সিলিন্ডারের বাইরে স্থাপন করা হয় একটি প্লেট যার মধ্যে রয়েছে কার্তুজ। ট্রিগার চাপার সাথে সাথেই একটি হ্যামার সেই প্লেটে সজোরে আঘাত করবে আর দহন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। যেখানে একটি সাধারণ সিঙ্গেল-শুট বন্দুকের ছ’বার রিলোড করে ছ’টি গুলি চালাতে ২০ থেকে ২৫ সেকেন্ড সময় লাগে, সেখানে কোল্টের পিস্তল মাত্র একবার রিলোডেই ছ’বার গুলি চালাতে পারে ছয় থেকে আট সেকেন্ডে! তার এই প্রাথমিক নজরকাড়া ডিজাইন শুধু দিনদিন উন্নতই করেছেন কোল্ট। ফলে তা নজরে আসতে শুরু করে আমেরিকান সৈন্যদের। তবে তা একদিনে সম্পন্ন হয়নি, নিয়েছে অনেক সময়।
১৮৩৫ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় টেক্সাস এবং ফ্লোরিডায় চলে দ্বিতীয় সেমিনোল যুদ্ধ। কোল্ট ভেবেছিলেন এটাই উত্তম সময় হবে তার এই চমকপ্রদ অস্ত্রের পসরা বাড়ানোর। তিনি চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিষয়ক সচিবের কার্যালয়ে নিজের উদ্ভাবন দেখাতে। কিন্তু সেক্রেটারি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন এই বলে যে, কোল্টের পিস্তল যথেষ্ট নিরাপদ নয়! এ ঘটনা জানাজানি হলে কোল্টের কোম্পানির ব্যবসা নাটকীয়ভাবে কমতে শুরু করে। কোম্পানির সভায় তাকে প্যাটেন্ট অস্ত্র উৎপাদনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সেলস এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তাতেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। ১৮৪২ সালে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায় এবং এর বন্দুক উৎপাদনের সকল যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়।
সময় যখন খারাপ যায় তখন সবদিকই অন্ধকার হয়ে আসে। অস্ত্র ব্যবসা ব্যর্থ হবার পর কোল্ট ভেবেছিলেন পানির নিচে কাজ করতে পারে এমন মাইন তৈরি করবেন। এর জন্য পরিকল্পনা করে কাজও শুরু করেন কোল্ট। তার ডিজাইনে সাবমেরিন ব্যাটারির জন্য পানির নিচে বিদ্যুৎ পরিবহণ করার মতো জলনিরোধী তার প্রয়োজন ছিল। এই তারের সমস্যা সমাধান হয় তখনকার আরেক বিখ্যাত উদ্ভাবক স্যামুয়েল মোর্সের মাধ্যমে। এতে করে দুই উদ্ভাবকের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বন্ধুত্ব এতোটাই গভীর হয় যে দুজনে মিলে নিউ জার্সি থেকে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা করে ফেলেন! কিন্তু তখনই আবার বাধা আসে। আর এবার সমস্যার সৃষ্টি করেন তারই ভাই জন কোল্ট। জন একজন বিখ্যাত প্রিন্টিংয়ের মালিককে হত্যা করেন যার সাথে আবার কোল্ট একসময় কাজ করতেন। এই ঘটনা একটি জাতীয় কলঙ্কজনক ঘটনায় পরিণত হয়।
১৮৪৪ সালে আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেমস কে পক টেক্সাস ও আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন। এ সময় সরকারের প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। কোল্ট এটাকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলেন। তিনি তার পিস্তলের আরো উন্নত ডিজাইনের একটি নমুনা আমেরিকার ওয়ার ডিপার্টমেন্টে জমা দিলেন। ১৮৪৬ সালে আমেরিকা-মেক্সিকো যুদ্ধ শুরু হয় এবং তৎকালীন আমেরিকান প্রধান সেনাপতি জেসারি টেইলর কোল্টকে এক হাজার পিস্তলের অর্ডার দেন। আর এখান থেকেই কোল্টের ভাগ্যের চাকা পুনরায় ঘুরতে শুরু করে। এক বছর পরই সেই এক হাজার পিস্তল আমেরিকান সেনাবাহিনীর নিকট সরবরাহ করেন কোল্ট।
এবার কোল্টের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নতুন নাম ‘কোল্ট প্যাটেন্ট ফায়ার আর্মস ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’ নিয়ে হার্টফোর্ডে পুরোদমে অস্ত্র উৎপাদন শুরু করে তার কোম্পানি। এলিশা কে রুটের মতো অভিজ্ঞ সুপারভাইজার এবং অনেক দক্ষ প্রকৌশলী নিয়োগ দেন কোল্ট। ১৮৫০ সালের মধ্যে তার কোম্পানির একটি নতুন শাখা স্থাপিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এর পাঁচ বছরের মাথায় ‘কানেক্টিকাট রিভার’কে হারিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কোল্টের হার্টফোর্ডের কারখানাটি। তখন কারখানাটির উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১৫০-এ উন্নীত হয়। দুর্দান্ত সব বন্দুকের চমৎকার ও চটকদার বিজ্ঞাপন তৈরি করে ১৮৫৬ সালের মধ্যে কোল্টের কোম্পানি বিশ্বজুড়ে ব্র্যান্ডে পরিণত হয়।
১৮৫০ থেকেই আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করে। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল এই যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবার আগেই কোল্ট অনুধাবন করেছিলেন যে তার ব্যবসা আরো একধাপ এগিয়ে নেবার সময় চলে এসেছে। তিনি নতুন করে এক হাজার কর্মী নিয়োগ দেন এবং তার কোম্পানি চলতে থাকে পুরোদমে। অস্ত্র সরবরাহের জন্য তিনি ইউনিয়ন আর্মিকেই বেছে নিয়েছিলেন। গৃহযুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই কোল্ট এতো বিপুল পরিমাণ ব্যবসা করেছিলেন যে তিনি আমেরিকার সেরা দশ ধনী ব্যক্তির তালিকায় নাম লেখান। ততদিনে তার কোম্পানি থেকে উৎপাদিত হয়ে গেছে চার লক্ষাধিক পিস্তল। কোল্ট দিনরাত লেগে রইলেন তার কারখানার উন্নয়নের পেছনে। কিন্তু এই লেগে থাকাটাই কি তার জন্য কাল হলো?
গৃহযুদ্ধ চলাকালীনই ১৮৬২ সালের ১০ জানুয়ারি মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন স্যামুয়েল কোল্ট। তার পরিবারের দাবি, গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে কারখানার পেছনে অমানুষিক পরিশ্রমই তার অকাল মৃত্যু ডেকে এনেছিল। মৃত্যুর পর তার বিশাল সম্পত্তির মালিক হন তার স্ত্রী এলিজাবেথ। তার মৃত্যুর কয়েকবছর পরই তার কোম্পানি একপ্রকার নতুন আর্মি হ্যান্ডগান তৈরি শুরু করে যার নামকরণ তার সম্মানে কোল্ট .৪৫ রাখা হয়েছিল। ততদিনে অবশ্য কোম্পানিটি একদল বিনিয়োগকারীর নিকট বেচে দিয়েছে কোল্টের পরিবার। সেই কোম্পানি আজ অবধি চলছে সগৌরবে, উৎপাদন করেছে তিন কোটির অধিক পিস্তল আর রাইফেল।