কামালপুরের ১ম যুদ্ধে তীব্র বিপর্যয়ে পড়েও ইস্ট বেঙ্গলের সেনারা লড়াই করে যায়। এই যুদ্ধে আর্টিলারি সাপোর্ট ছাড়াই মাইনফিল্ড, বুবি ট্র্যাপ, ২/৩ স্তরে গোলা-প্রতিরোধী বাংকার, Communication trench ঘেরা পাকঘাঁটি আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। ফর্ম আপ বা শত্রু ঘাঁটির কাছে গিয়ে ফায়ার করার পজিশনে যাবার আগেই পাকবাহিনী তাদের উপর হামলা করে বসে। তার উপর পাকঘাঁটির চারপাশে কাদা থাকায় সেনারা একে অন্যের গায়ের উপর এসে পড়তে শুরু করে। সেনাদের দৌড়াদৌড়ির শব্দে পাকিদের টার্গেট ঠিক করা সহজ হয়ে যায়। এরই মধ্যে একের পর এক মাইন ফাটছে।
এ দিন সমস্যার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছিল ওয়্যারলেস জ্যাম হয়ে! ফলে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। হামলার কয়েকদিন আগে রেকি করতে গিয়ে পাকবাহিনীর সামনে পড়ে যায় কয়েকজন মুক্তিসেনা। হামলা আসন্ন বুঝে শক্তি বাড়িয়েছিল পাকসেনারাও।
মুক্তিবাহিনীর মধ্যে যখন পূর্ণ হারের ভয় জেঁকে ধরছে ঠিক তখনই হ্যান্ডমাইকে শোনা গেল এক সাহসী কণ্ঠ!
ডেল্টা কোম্পানি কম্যান্ডার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন (শহীদ, বীর উত্তম) যখন মাইনফিল্ডে দাঁড়িয়ে তীব্র ফায়ারিং এর মুখে পড়েছেন, তখন সাহস না হারিয়ে হ্যান্ডমাইকে পাকবাহিনীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকেন,
আভি তক ওয়াক্ত হ্যায়, শালালোক সারেন্ডার করো, নেহিত জিন্দা নেহি ছোড়েঙ্গা।
(সময় থাকতে সারেন্ডার করো, পরে জীবিত ছাড়ব না)ইয়াহিয়া খান এখনও এমন বুলেট তৈরি করতে পারে নাই, যা মমতাজকে ভেদ করবে।
যদি মরতেই হয়, পাকসেনা সাথে নিয়ে যাও। বাংলার মাটিতে শহিদ হও জোয়ানেরা!
বাংলা-উর্দু-ইংরেজি মিশিয়ে পাকসেনাদের হ্যান্ডমাইকে ব্যাপক গালাগালি শুরু করেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীর ভয় পরিণত হতে শুরু করে মনোবলে। সেনারা গগনবিদারী স্লোগানে “জয় বাংলা” ধ্বনি তুলে আক্রমণ শুরু করে।
জওয়ানরা দ্রুত ফর্ম আপ করার চেষ্টা করতে থাকে। অন্ধকার, কাদায় একজন আরেকজনের ওপর এসে পড়ছে। নিচু কর্দমাক্ত জমিতে নেমে আসা বাঙালি সৈনিকেরা সবচেয়ে বিপদে পড়ল। শত্রু এবং সহযোদ্ধাদের গুলির মাঝখানে তারা। মেজর মইনও তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন।
ডেল্টা এবং ব্রাভোর কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন আর হাফিজ ছুটে বেড়াচ্ছেন সবাইকে একত্র করে ঠিকমতো পজিশনে নেবার জন্যে। দুই কমান্ডার কৃতিত্বের সাথে প্রায় বেসামাল পুরো বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। ক্যাম্পের দিকে যখনই অগ্রসর হতে শুরু করলেন তারা, তখনই বজ্রপাতের মতো শুরু হলো পাকিস্তানি আর্টিলারির সেলভো ফায়ার (সব বন্দুক/ কামানের একসাথে ফায়ার)। সবাই শুয়ে পড়ল মাটিতে। এত কষ্টের পরও কি আক্রমণ করা সম্ভব হবে না?
ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন আবার মেগাফোন তুলে নিলেন। ‘Move Forward!’ একই সাথে মেগাফোনে পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে বাংলা-ইংরেজি-উর্দু মিশিয়ে ব্যাপক গালাগালি শুরু করলেন তিনি।
এই পর্যন্ত যুদ্ধ পাকিস্তানিদের সম্পূর্ণ অনুকূলে ছিল। তাদের জয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু এরপর এমন কিছু ঘটল যাতে তাদের আত্মা উড়ে যাবার দশা হলো!
জয় বাংলা
জয় বাংলা
পেছনে থাকা সেনা থেকে শুরু করে ফ্রন্টলাইনে বোমায় হাতের হাড় বের হয়ে যাওয়া সেনাও একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠল। প্রথম কে জয় বাংলা ধ্বনি তুলেছিল জানা যায়নি। কিন্তু একজন স্লোগান তোলার সাথে সাথেই সবাই একনাগাড়ে স্লোগান দিতে থাকল।
“জয় বাংলা” স্লোগান দিতে দিতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের ডেল্টা কোম্পানি প্রচণ্ড আক্রমণ করে পাকিস্তানিদের ডিফেন্স লাইনের সামনের বাংকারে ঢুকে পড়ে। পাকবাহিনী প্রথম সারির বাংকার থেকে পিছু হটে।
বাংকার পার হয়ে ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়ল পাকবাহিনীর আওতাধীন কমিউনিটি সেন্টারে। ভেতরে যেসব পাকিস্তানি সৈন্য ছিল তাদের সাথে হাতাহাতি লড়াই শুরু হলো। বেয়নেট চার্জ, ধস্তাধস্তি শুরু হয়। মাত্র দুজন বাঙালি সৈন্য আহত অবস্থায় ফিরে এলেন। বাকি সবাই শহিদ হলেন সেই হাতাহাতি যুদ্ধে। যুদ্ধের ময়দানে অন্য সব জায়গায়ও হাতাহাতি চলছে। আহত সৈন্য আর লাশের ছড়াছড়ি সব জায়গায়।
সুবেদার হাই তার এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে যে এলাকায় ঢুকে পড়েছেন সেটা একটা মাইন ফিল্ড। ফেঁসে গেলেন তিনি পুরো দল নিয়েই। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন বুঝতে পারলেন পাকসেনারা প্রথম সারির বাংকার ছেড়ে আরো পেছনে সেকেন্ড লাইনে চলে গেছে। সেখান থেকে আবার আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে মাইন ফিল্ডে আগে-পিছে চলতে গেলেই বিপদ। সালাউদ্দিন কমান্ড করলেন সুবেদার হাইকে তার সৈন্য নিয়ে ডানে সরে যেতে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হচ্ছে মাইন। সুবেদার হাই-এর সাথে ৪০ জন সৈন্য ছিল। লক্ষ্যে পৌঁছতে গিয়ে অক্ষত সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল ১৫-২০ জনে।
নায়েক শফির (বীর প্রতীক) একটা হাত উড়ে গেল মাইনের আঘাতে। তবুও থামলেন না তিনি। সালাহউদ্দিন মৃত্যুভয় ভুলে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। পেছন থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, “স্যার পজিশনে যান” অর্থাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ার কথা বলল। সালাহউদ্দিন তাকে ধমকে উঠলেন,
ব্যাটা স্যার স্যার করে চিৎকার করিস না। শত্রুরা আমার অবস্থান টের পেয়ে যাবে। চিন্তা করিস না, তুই ব্যাটা আমার কাছে এসে দাঁড়া। গুলি লাগবে না, ইয়াহিয়া খান আজও আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি।
আরেক দফা আক্রমণে শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। হ্যান্ডমাইকটা আবার হাতে সুবেদার হাইকে ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটে বোমা তার সামনে এসে পড়ল। সৈন্যরা দেখল স্লো-মোশনের মতো একবার বাঁয়ে, পরে আধা ডানে বেঁকে পড়ে গেল তার দেহ। একজন জোয়ান ছুটে এসে বলল, “স্যার কলেমা পড়েন।“
মৃতপ্রায় সালাউদ্দিন বজ্রকণ্ঠে বললেন,
আমার কলেমা পড়ার দরকার নেই। আমার কালেমা আগেই হয়ে গেছে। খোদার কসম, যে পেছনে হটবি তাকেই গুলি করব। মরতে যদি হয় দেশের মাটিতে মর। এদের মেরে তারপর মর।
শহীদ হলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। সাদা শার্ট লাল রঙ ধারণ করেছে তখন। শার্টটি ছিল ত্রাণের পণ্য হিসেবে আসা। বাংলাদেশের একজন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পর্যন্ত ত্রাণের শার্ট পরে যুদ্ধ করেছেন! কত প্রতিকূলতার মধ্যে তারা যুদ্ধ করেছেন, সেটা বোঝাতে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই মনে হয়। আটটি গুলি লাগে তার শরীরে। তার ঘড়ি, পকেটের কাগজ আর স্টেনগান নিয়ে আসে সহযোদ্ধারা। তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে শহীদ হন আরো তিনজন। তবে দুর্ভাগ্য, তার মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি।
ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন নিহত হবার খবর জানতে পেরে মেজর মইন ওয়্যারলেসে ক্যাপ্টেন মাহবুবকে কমান্ড করেন পেছন থেকে আক্রমণের জন্য। কিন্তু ওয়্যারলেসগুলো ঠিকমতো কাজ না করায় সেই নির্দেশ পৌঁছায় না ক্যাপ্টেন মাহবুবের কাছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাড়া না পেয়ে তিনি ঝোপঝাড় গাছের আড়াল থেকে খোলা জায়গায় চলে আসেন যাতে ওয়্যারলেস ভালোভাবে কাজ করতে পারে। এ সময় মেশিনগানের গুলি এসে তার ওয়্যারলেস অপারেটর শহীদ হন। মেজর মইন চিৎকার করে কমান্ড দিতে থাকেন।
প্রায় একই সময়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং লে. মান্নান আহত হন। ক্যাপ্টেন হাফিজের হাতে গোলা আঘাত করে, লে. মান্নানের ঊরুতে গুলি লাগে। লে. মান্নানকে ধরে ফ্লাইং অফিসার লিয়াকত আলী খান নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলেন।
আহত ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধার করতে অগ্রসর হতেই গুলি লাগল নায়েক রবিউলের। কিন্তু থামলেন না তিনি। কাছে গিয়ে দেখলেন, ক্যাপ্টেন হাফিজকে অন্য কেউ সরিয়ে নিয়ে গেছে। পাশে পড়ে আছে ওয়্যারলেস সেট আর রকেট লঞ্চার। সেই দুটো তোলার জন্যে উবু হতেই গুলি এসে বুকে লাগল রবিউলের। তার ডান হাতের হাড় বের হয়ে গিয়েছিল। পড়ে গেলেন তিনি। তারপর খেয়াল হলো এখনো বেঁচে আছেন। শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ালেন। গ্রেনেড হাতে নিয়ে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল পাকসেনারা তাকে জীবিত ধরতে এলে তাদের জাহান্নামে পাঠাবেন গ্রেনেড দিয়ে। বৃষ্টির মতো গুলি চারপাশ দিয়ে ছুটে গেল। আশ্চর্য! তার একটিও গুলি গায়ে লাগল না। গুরুতর আহত অবস্থায় রক্তাক্ত দেহে ছুটে এলেন তিনি। এ সময় কোথা থেকে এসে যেন উদয় হন গ্রামের দুই নারী। তাদের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি নিরাপদ স্থানে আসেন।
একসময় ভোরের আলো ফুটে ওঠে। চারদিকে হতাহতের ছড়াছড়ি। মেজর জিয়াও এ সময় উদ্ধারকাজে যোগ দেন।
ভোর সাতটা পর্যন্ত আক্রমণ চলল। ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকবাহিনীর হতাহত আরো বেশি। তিন ট্রাক ভরে পাকসেনারা তাদের লাশ নিয়েছিল।
অন্যদিকে দুটি ১২০ মিলিমিটার মর্টার আর বেশ কিছু সেনাসহ বকশীগঞ্জ থেকে কামালপুরের দিকে আসতে থাকা ৩টি ট্রাক উড়ে যায় কাট অব পার্টির পুঁতে রাখা মাইনে। তাদের অ্যামবুশে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং ১০-১১ জন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, ২-৩ জন আহত হন।
মাত্র ৩-৪ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ পাওয়া সেনারা সেদিন দুর্দান্ত বীরত্ব দেখিয়েছিল। পাক অফিসাররাও বলতে শুরু করে, “Bengal regiment fight like real tiger!”
জুলাই থেকে মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। কামালপুর ১১ নং সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত হয়। মেজর আবু তাহের (পরে কর্নেল এবং বীর উত্তম) সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পান। কামালপুর ঘাঁটিতে নিয়মিত হামলার পরিকল্পনা হয়। এ সময় ছোট ছোট হামলা করে কামালপুরের পাক ঘাঁটিকে কাবু করার সিদ্ধান্ত হয়।
ছোট ছোট হামলায় পাকবাহিনী নাকাল হতে শুরু করে। পতনের দিকে এগিয়ে যায় কামালপুর! কীভাবে শেষপর্যন্ত পতন হলো কামালপুরের? জানুন ৩য় পর্বে!