Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে আফগান নারীরা পশ্চিমা নারী-অধিকার চায়নি! (৪র্থ পর্ব)

গতানুগতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে সাধারণত শহুরে আফগান নারীদের অধিকার নিয়েই বেশি আলোচনা করা হয়। আড়ালে রয়ে যায় গ্রামীণ আফগান নারীদের চাওয়া-পাওয়ার কথা। অথচ এরাই মূলত আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল নারী। কারণ আফগানিস্তানের ৭০% মানুষই গ্রামে বসবাস করে। সেই নারীদের কথাই নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের একটি দীর্ঘপাঠ প্রবন্ধে তুলে এনছেন সাংবাদিক আনন্দ গোপাল। 

সেই সাথে প্রবন্ধটিতে উঠে এসেছে আমেরিকান বাহিনীর এবং তাদের সহযোগী আফগান ন্যাশনাল আর্মির সীমাহীন অমানবিকতার কথা, আফগান জনগণের উপর চালানো তাদের গণহত্যার কথা এবং তালেবানদের বিজয়ের পেছনের কারণগুলোর কথা।

আমাদের এই সিরিজটি দীর্ঘ এই চমৎকার প্রবন্ধটিরই অনুবাদ। মোট সাতটি পর্বে করা অনুবাদ সিরিজটির এটি চতুর্থ পর্ব। সবগুলো পর্বের লিঙ্ক এখানে: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব


মার্কিন আগ্রাসনের চার বছর পর, ২০০৫ সালে শাকিরা তৃতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা ছিল। তার গৃহস্থালি দায়িত্ব তাকে গ্রাস করে রেখেছিল। “সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমি কাজ করতাম আর ঘামতাম,” সে স্মরণ করেছিল। কিন্তু যখন সে তন্দুর রুটি সেঁকতে গিয়ে বা জাম গাছের ডালপালা ছাঁটাই করতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিত, তখন সে বুঝতে পারত একসময় যেরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞা সে অনুভব করত, সেই অনুভূতি সে হারিয়ে ফেলেছে। 

প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সে শুনতে পেত, আরও একজন যুবককে আমেরিকানরা বা মিলিশিয়ারা তুলে নিয়ে গেছে। তার স্বামীর কোনো কাজকর্ম ছিল না, এবং সম্প্রতি সে নিজেই আফিম খাওয়া শুরু করেছিল। তাদের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। গ্রামের অবিশ্বাসের মেজাজের সাথে মিল রেখে তাদের ঘরেও একটা অবিশ্বাসের হাওয়া এসে ভর করেছিল।

কাজেই সে বছর তালেবানদের একটি গাড়িবহর যখন পান কিল্লায়ে ঢুকে পড়ে, কালো পাগড়িওয়ালা পুরুষরা যখন লম্বা সাদা পতাকা উত্তোলন করতে শুরু করে, শাকিরা তখন আগন্তুকদেরকে আগ্রহ, এমনকি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে অবলোকন করে। সে আশা করে, হয়তো এবার অন্তত পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।

২০০৬ সালে সাংগিনে বিদ্রোহ দমন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল অপারেশন বাহিনীর ক্রমবর্ধমান সৈন্যদলের সাথে যুক্তরাজ্যও যোগদান করে। শাকিরা স্মরণ করে, “শীঘ্রই এলাকাটা নরকে পরিণত হয়।” তালেবানরা যৌথ বাহিনীর টহলদলের উপর আক্রমণ করে, যুদ্ধের ফাঁড়িতে অতর্কিত অভিযান চালায় এবং রোডব্লক স্থাপন করে। অন্যদিকে পান কিল্লায়ের একটি পাহাড়ের চূড়ায় আমেরিকানরা এক মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি দখল করে নেয়। তারা একে বালির বস্তা, ওয়াচটাওয়ার এবং পেঁচানো কাঁটাতারের বেড়ার একটি কম্পাউন্ডে রূপান্তরিত করে। বেশিরভাগ যুদ্ধের আগে তরুণ তালেবরা এলাকাবাসীর বাসায় বাসায় গিয়ে তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে এলাকা ছাড়ার জন্য সতর্ক করে দিত। এরপর তালেবানরা তাদের আক্রমণ শুরু করত, কোয়ালিশন বাহিনী পাল্টা জবাব দিত এবং দুনিয়া কেঁপে উঠত।

হেলমন্দে তালেবানদের সাথে আফগান বাহিনীর একটি যুদ্ধ; Image Source: Noorullah Shirzada/ AFP/ Getty Images

মাঝে মাঝে পালিয়ে গিয়েও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত না। এক যুদ্ধের সময় আব্দুস সালাম নামে শাকিরার এক চাচাশ্বশুর তার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি নামাজ পড়ার জন্য একটি মসজিদে প্রবেশ করেন। সেখানে কয়েকজন তালেবানও ছিল। কোয়ালিশন বাহিনী সেখানে বিমান হামলা চালালে ভেতরে থাকা প্রায় সবাই নিহত হয়। পরের দিন শোকসন্তপ্ত আত্মীয়-স্বজনরা জানাজার নামাজের জন্য জড়ো হলে সেখানে দ্বিতীয়বার বিমান হামলা চালানো হয়। নিহত হয় আরও এক ডজন বেসামরিক মানুষ। পান কিল্লায়ে যাদের লাশ ফিরে এসেছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস সালাম, তার চাচা এবং তার তিন ভাস্তে, যাদের বয়স ছিল ছয় থেকে পনেরো বছরের মধ্যে।

ছোটবেলা থেকে শাকিরা পরিচিত কাউকে বিমান হামলায় মারা যেতে দেখেনি। কিন্তু এখন সাতাশ বছর বয়সের সময় সে নিজে এমনভাবে প্রস্তুত হয়ে ঘুমাতে যায়, যেন যেকোনো মুহূর্তে তাকে ঘুম থেকে উঠে আত্মরক্ষার জন্য দৌড় দিতে হতে পারে। এক রাতে সে এত জোরে একটি চিৎকারের আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল যে তার আশঙ্কা হচ্ছিল তার ঘরটি হয়তো ভেঙে পড়ছে। তার স্বামী তখনও নাক ডাকছিল। শাকিরা বিড়বিড় করে তাকে অভিশাপ দিলো। এরপর সে পা টিপে টিপে বাড়ির সামনের উঠোনে এগিয়ে গেল। 

তাদের বাড়ির পাশ দিয়েই কোয়ালিশন বাহিনীর সামরিক যানবাহন এগিয়ে যাচ্ছিল, পুরাতন ধাতুর উপর দিয়ে সেগুলোর চাকা গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল। শাকিরা তার পরিবারকে জাগিয়ে তুলল। তখন আর বাড়ি ছাড়ার মতো সময় ছিল না, শাকিরা শুধু প্রার্থনা করছিল তালেবানরা যেন আক্রমণ না করে। বোমার আঘাতে ছাদ ভেঙে পড়লেও যেন বাচ্চাদেরকে রক্ষা করা যায়, সেজন্য মরিয়া চেষ্টার অংশ হিসেবে সে তাদেরকে খুপরিকাটা জানালার ভেতরে ঠেলে দিয়ে ভারী কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল।

উঠোনে ফিরে এসে শাকিরা দেখল, তাদের বাড়ির সামনে বিদেশিদের একটি গাড়ি স্থির বসে আছে। গাড়ির ছাদ থেকে একজোড়া অ্যান্টেনা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা আমাদেরকে হত্যা করতে এসেছে, সে ভাবল। সে বাড়ির ছাদে উঠে গাড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে গাড়িটি খালি। সৈন্যরা এটি পার্ক করে পায়ে হেঁটে চলে গেছে। সে তাদেরকে হেঁটে হেঁটে সেতু পার হয়ে নলখাগড়ার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল।

কয়েকটা ক্ষেত পরে তালেবানদের সাথে বিদেশীদের গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত শাকিরার পরিবার ঘরের মধ্যে জড়াজড়ি করে বসে রইল। গোলাগুলির শব্দে দেয়াল কেঁপে উঠছিল, আর বাচ্চারা কাঁদছিল। শাকিরা তার কাপড়ের পুতুল বের করে এনেছিল। সে আহমদকে কোলে নিয়ে দোল খাওয়াচ্ছিল আর ফিসফিস করে গল্প শোনাচ্ছিল। 

সাংগিন উপত্যকায় কোয়ালিশন বাহিনীর হেলিকপ্টার; Image Source: Jason P. Howe

ভোরের দিকে যখন গোলাগুলির আওয়াজ বন্ধ হয়ে আসে, তখন শাকিরা পরিস্থিতি দেখার জন্য আরেকবার বাইরে যায়। গাড়িটি তখনও সেখানেই একাকী পড়ে ছিল। শাকিরা রাগে কাঁপছিল। সারা বছরজুড়ে প্রতি মাসে প্রায় একবার করে তাদেরকে এই ধরনের আতঙ্কের শিকার হতে হয়েছে। হামলাগুলো তালেবানরাই করেছিল, কিন্তু শাকিরার বেশিরভাগ ক্ষোভই ছিল বহিরাগতদের প্রতি। কেন তাকে এবং তার সন্তানদেরকে এভাবে ভুগতে হবে?

তার মাথায় একটি উন্মত্ত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে বাড়ির ভেতরে ছুটে গিয়ে তার শাশুড়ির সাথে কথা বলল। সৈন্যরা তখনও খালের অপরপ্রান্তে অবস্থান করছিল। শাকিরা কিছু ম্যাচ খুঁজে বের করল। তার শাশুড়ি ডিজেল ভর্তি একটি জেরিক্যান নিয়ে এলেন। রাস্তায় প্রতিবেশীদের একজন জেরিক্যানের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে দ্বিতীয় একটি জগ নিয়ে ফিরে এলো। শাকিরার শাশুড়ি গাড়িটির একটি টায়ারের উপর ডিজেল ঢেলে দিলেন। এরপর গাড়ির ঢাকনা তুলে ইঞ্জিন ভিজিয়ে দিলেন। শাকিরা একটি ম্যাচ ধরালো, এরপর টায়ারের দিকে সেটি ছুঁড়ে মারল।

বাড়ির ভেতর থেকে তারা তাকিয়ে দেখল, আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ ধূসর হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা দক্ষিণ দিক থেকে একটি হেলিকপ্টার উড়ে আসার আওয়াজ শুনতে পেল। “এটা আমাদেরকে মারার জন্য আসছে!” তার শাশুড়ি চিৎকার করে উঠলেন। শাকিরার দেবর পাগলের মতো ছুটে গিয়ে বাচ্চাদেরকে একত্রিত করল। কিন্তু শাকিরা বুঝতে পারছিল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদেরকে যদি মরতেই হয়, তাহলে বাড়ির ভেতরে থেকে মরাই ভালো, সে ভাবল।

তারা বাড়ির পেছনের উঠোনে খনন করা একটি অগভীর পরিখার মধ্যে গিয়ে লুকালো- বাচ্চারা নিচে, বয়স্করা তাদের উপরে। প্রচণ্ড শব্দে পৃথিবী ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠল, এরপর হেলিকপ্টারটা ফিরে গেল। বেরিয়ে আসার পর শাকিরা দেখতে পেল বিদেশীরা জ্বলন্ত গাড়িটা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল, যেন এর কোনো অংশ শত্রুপক্ষের কারও হাতে না পড়ে।

পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাওয়ার পর পান কিল্লায়ের মহিলারা শাকিরাকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে এসেছিল। এক মহিলা পরে আমাকে বলেছিল, শাকিরা ছিল একজন “হিরো”। কিন্তু শাকিরার গর্বিত হতে কষ্ট হচ্ছিল, সে কেবল স্বস্তি অনুভব করছিল। “আমি শুধু আশা করছিলাম যে তারা আর এখানে ফিরে আসবে না,” সে বলেছিল। “এবং আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারব।”

পরবর্তী পর্বে থাকছে কীভাবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী সাংগিনে বেসামরিক জনগণের উপর গণহত্যা চালিয়েছে, সেই কাহিনী। পড়তে ক্লিক করুন এখানে

This article is in Bangla. It's a translation of the article titled "The other Afghan Women" by Anand Gopal, published on the New Yorker Magazine.

Featured Image by Momsrising

Related Articles